আজ ০৪ মার্চ কবি, সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক বীরেন মুখার্জীর শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।
অহিংসচুম্বন
এসো, দ্রাক্ষাবনে রোপন করি হন্তারক আলো-
মোমের পোশাক পরে সবাই আসুক, দাঁড়াক ভূ-সত্যে
অহোরাত্র গলে দৈনন্দিন কান্নায় বাজুক মিশ্র সুর!
উন্নয়নসঙ্গী, এসো, বিচ্ছুরিত আলোকের রথে-
সান্ত্বনাপাড়ার ছিন্নভিন্ন কুটুরিতে সমৃদ্ধির মধু ঢেলে
হাত ধরাধরি করে শুয়ে পড়ি নির্জন, নিভৃত কক্ষে!
শ্রমিকের ক্লান্ত দেহ, জন্ম হোক শ্রুতিপুষ্প, কিংবা,
দেহময় ঝরে পড়ুক একুশ শতকের নিদ্রা- বরং
শ্রবণবিদ্যায় গড়ে তোলা যাক গোপন গিলগামেশ!
আমাদের রাফখাতার মার্জিনে ঝুলে থাক ব্রহ্মচিৎকার
আর সাম্রাজ্যবাদী মঞ্চ আলোকিত হোক সপ্রতিভ চুম্বনে!
বিশেষ দ্রষ্টব্য
বেঁচে থাকা যেন এক বিজ্ঞাপিত কৌশল!
অথবা, অনেক উঁচুতে উঠে পাখির চোখে
আদিগন্ত জীবন-দর্শন!
কখনো মনে হয়, মানুষ এক কেতাদূরস্ত টগবগ
মৃত্যুঅব্দি নিবিষ্ট থাকে রঙ-বেরঙের প্রকোষ্টে
আবার সরল ভ্রমণ শেষে ফিরে আসে
জীবনের কাঠগড়ায় ফের-
শূন্য অন্বেষণে পার করে দীর্ঘজীবন!
সর্বোপরি, মানুষ হতে পারে-
ফুল ও কীটের মহিমান্বিত দিনলিপির সাক্ষ্যবাহী!
পালকের ঐশ্বর্য
পৌরাণিক অন্ধকার ছুঁয়ে, নিয়তিশাসিত মানুষ বৃথা খোঁজে, কোলাহলমুখর সন্ধ্যা। আঁচলের আড়ালে আকাশ ঢেকে দেহ থেকে খুলে রাখে দ্রোহের মৌনাস্ত্র; পরিবর্তিত আঙুল অচল আধূলিতে সাজিয়ে রাখে-চুম্বনের অধরা বায়োস্কোপ! চোখের খামারে শাদা ভোর দেখে যে মানুষ ছোটে পার্থিব ভুলের বাগানে, সেখানে জলের নূপুরে বাজে সম্ভ্রান্ত রোদ! সূর্যাস্তের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মুখোশ পরা চাঁদ মফস্বলী উঠোনে তাড়ায়-চেতনার বালিহাঁস।
এই দীর্ঘ প্রস্তাবনা, খণ্ড-বিখণ্ড আত্মরতি মিশে যায়-ঘুমের আলিঙ্গনে। আবারও পৌরাণিক মৌতাত উঁকি দেয় যাপনের অলিগলি আর যুগপৎ সংক্রামিত হতে থাকে, নিয়তির জ্যোৎস্নায় পুড়ে যায়-অমরত্বের মানবিক গুহা!
২.
চন্দ্রচ্যুত আলো আর কতটুকু উজ্জ্বলতা ধরে! যাযাবর দৃষ্টি তবু আঁখি তোলে চাঁদের আকাশে। আকাশের শাখা থেকে ছিঁড়ে নিলে সৌন্দর্যের সবটুকু আহ্লাদ, আত্ম অন্ধকারে তুলে নিবো শূন্যের কলহাস্য। যে ডানায় জমা আছে স্বাধীনতার বিশ্বস্ত পাঠ, দেখাব না তাকে আর শস্যহীন মাঠ! সময় ছাড়ে না আত্মক্ষয়ের বিবর্ণ উঠোন, ফিরে যায় দাঁড় বেয়ে উজান মাঝি-স্রোত খেলা অবিরাম; দলছুট বাতাস, কেঁদে ওঠে পোড়া ক্ষত-পল্লবের বাসনা তবু ধরে রাখে সূর্যবয়সী বৃক্ষ?
দূরত্বে মজেছে দেহ নৈকট্যের ঘানি টানা মিছে, গোধূলির এত রঙ কোথা থেকে আসে, মৃত্যুর পয়স্তি নেই জেনেও গাঙুরের জলে যদি কেঁপে ওঠে বেহুলার ছায়া, মনসার মন কাঁদে থরোথরো মোহে। সওদাগর পাপ-তাপ ধুয়ে নিতে-সবুজ উৎসবে!
৩.
বোধের পরাগ উড়িয়েছি বহুকাল প্রমিত আলোর সন্ধানে, এখন নির্বাণকাল-উড়ে যাবো, রেখে যাবো মুঠো মুঠো ধানের চাতাল; ঘ্রাণসন্ধ্যায় মেখে নেব কৃষ্ণচূড়া ভোর। এই রাতে জ্যোৎস্না পোড়ালে-পোড়ে নক্ষত্রের মন, তুমি আমি ব্যাকুল বিরহী; মুখে কার জেগে থাকে রতিক্লান্ত ভোর!
আলোর সমান বয়সে কাঁপে সবুজ স্নিগ্ধ ঠোঁট, হরপ্পার লিপি কে মাখে কপোলে? এই আমি, মহাপৃথিবী ব্যেপে আছি-বৃক্ষগন্ধা নদী, পালকের ঐশ্বর্যে আছি, তোমার ছায়াতলে মজে আছি ধ্যানে; আমাকে ফেরানো সহজ হবে না!
ভোজবাজি
ভোজবাজির দুপুরগুলো ধূলিময় পথের দালাল, কিছু সংশয় দেহের ভাঁজে গচ্ছিত রাখে সারাক্ষণ; অবশিষ্ট কিছু মনস্তাপ উড়িয়ে দেয় দেহের গৌরবে! বিবর্তিত মানুষ মসৃণ কিছু ভুল তুলে রাখে, মৌন বাতাস-উড়ন্ত বাসনায়, স্মৃতিগুলো তাদের বিষণ্ন, মাতাল হয়-সাংস্কৃতিক নিয়ম! মানুষের জন্মপাপ শিকড় প্রসারী, মূল ধরে টানে; বহুজাতিক বাদ্য শুনে ভুলে যায় আত্মার প্রকার!
ভোজবাজির বেসামাল খেলায় মিশ্র-অস্ট্রিক-জন্মদৌড়ে মগ্ন সারাক্ষণ!
অনুরণন
রক্তের স্পন্দন বুঝি সবুজ স্নিগ্ধ ভূমে, রক্তের মোহন সুখ-বিজয়ের ঐক্যতানে। নক্ষত্রসভায় মিটি মিটি চাঁদ আকাশের সতিন হয়ে দেহের সুবাসে জাগে। ভূগোল আর ভূ-বিদ্যার আহ্বানে জীবনানন্দের হাত ধরে অসীম উচ্চতায় ছুঁয়ে যায় লক্ষ্মণরেখা-নদী, জলপথ আর মাতালসন্ধ্যার পরাবাস্তব পথে;
ভোগের নদীতে উড়িয়ে দেওয়া উজ্জ্বল ভোর বহুদিন মিছিলে নামে, যুগলসন্ধ্যার মিহিন পথে সোঁদাগন্ধ ফেরি করা আত্মার চাষীরা সবুজ ক্যানভাসে দ্যাখে ফলিত কৃষাণীর মুখ-পালকের ঐশ্বর্য তবু হৃৎপিন্ডের গ্রীবায় নিয়ত আঁকে স্বদেশের চিত্রকল্প।
২.
গলনাঙ্কের তাপ নিয়ে মোমের শয্যা, বুকে হেঁটে পেয়ে যায় সম্ভ্রান্ত নক্ষত্রের আকাশ। শস্যহীন ঘুমের মোড়কে দেখি পলির প্লাবনে বাড়ে নদীমাতৃক ভোর, মনে হয় বেওয়ারিশ হয়ে যাই, সার্বভৌম ভাবনায় তুলে দিই সন্নিহিত শিখা; জ্বলে যাক, পুড়ে যাক সূর্যবয়সী দেহ! কত আর তাপ ধরে বোধের টিউলিপ!
লোভের ছুরিতে মেখে ব্যবচ্ছেদ রঙ-পাতার ইশারায় বাড়ে স্রোতের প্রদাহ, গলে যায় সুখ, গচ্ছিত প্রত্নমুদ্রা-আমাদের শহর সংসার!
রৌদ্রের গান
যে পাতায় জমে ওঠে হাটের উৎসব-আত্মানুসন্ধানে, উৎফুল্ল জয়ধ্বনি আর শান্তি আহ্বানে পুড়ে যায় বিমূর্ত সঙ্গীত, পল্লবিত নাবালক হাসিতে প্রাণতা পায় বৃক্ষসভা! আমি সে হাটের পথিক-পদব্রজে সেলাই করি স্বপ্নের নামতা! টেরাকোটা খুঁজতে গিয়ে দেখি মিছিলের সমান বুভুক্ষু মানুষ, রৌদ্রের আঁচড়ে একজীবন ক্ষুধার ভাস্কর্য! আহা, রৌদ্রময় উৎসব! আহার্য সন্ধানে আমিও এক রক্ত গিনিপিগ, উৎসবের আড়ালে-অপাঠ্য অন্ধকার ছুঁয়ে ফেরি করি নিরলস শ্রম!
দেহের পাতায় ঢেকে জঠরের সম্ভ্রম, সাংস্কৃতিক কোলাজের বিপরীতে বিলাসি পাড়ায় তবু ওড়ে লবণাক্ত ঘুম; রকমারি মোহে তাদেরও ভাবনাহীন জীবন- একতারায়, একবেলা। গুরু গুরু মেঘের সাম্পানে বেহুলাজীবন, আবছায়া সন্ধ্যায় জপে মৃত্যুর নাম। অনিবার্য মৃত্যু কী তবে জীবনের ভগ্নাংশ?
আরো পড়ুন: শরৎ, তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি
বৃষ্টির এপিক
আটপৌরে বৃষ্টির গন্ধ হেঁটে এলে বুকের বারান্দায় কিছু মনস্তাপ গোপন ঐশ্বর্য দিয়ে ঢেকে রাখে অশ্রুর বেদনা, মেঘের চিরকুটে সঞ্চিত ক্ষোভ ও চঞ্চলতা লাজুক সম্ভাষণে ঝরে যায়। ঝমঝম, ঝমঝম। টানাস্রোত ভেঙে কত আর ঘুরে দাঁড়াবো জলের সীমানায়! ঘুমের মন্ত্রণা জাগিয়ে উড়ে গেছে যে পাখি চন্দ্রচ্যুত আলোর আকাশে, পলাতক গন্ধ তার ঢেকে রাখি বুকের বাস্তবতায়, মসৃণ আদরে।
বৃষ্টির গন্ধ হেঁটে এলে বুকের বারান্দায়, জৈষ্ঠ্যের মধুযন্ত্রণা ভুলে, নিদ্রাহীন রাতে লিখে রাখি বৃষ্টির এপিক!
মৃত্যুর কাছাকাছি একদিন
চোখের পাতায় আছড়ে পড়ছে নীলজল- নীল বদ্বুদ, ঝিম ঝিম ভেঙে যাচ্ছে মস্তিষ্কের নিউরণ, কুয়াশা পরীরা হেঁটে যাচ্ছে ক্রমশ সেলুলয়েডে; উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ, কাঁটাতার ডিঙিয়ে অন্ধ জ্যোৎস্নায়। মাইগ্রেন তীব্রতা, টিক টিক টিক টিক… পাকস্থলি উগরে ধেয়ে আসছে জমাট ঢেউ, অ্যানেসথেসিয়ার ঝাঁঝালো গন্ধে মিশে যাচ্ছে বিন্দুবাদী দেহ…
লাবণ্যময় সাদা নার্সের স্পর্শ, দ্যুতিময় কোলাহল; আমার অস্তিত্বে ভুলের জয়োল্লাস, সময় ভেসে যাচ্ছে অভিজাত ক্লিনিকের শ্বেত-শুভ্র কৌতুহলে!
ও বৃষ্টিদিন, ও সন্ধ্যা
মেঘের গ্রীবা ছুঁয়ে নেমে যাচ্ছে মেঘ-আত্মজসন্ধ্যায়; মনের দিগন্তে যে এসে দাঁড়ায় রোজ, বৃষ্টির পদাবলি শুনে সে-ও ঘুমিয়ে পড়ে বুকের সরোবরে! মাছরাঙার পালকে রৌদ্রের গন্ধ ঢেলে শতবর্ষী বৃক্ষ মাতাল করে অলৌকিক জলের শরীর। তাপদগ্ধ ব্যাকুল বিরহী- মনোস্নানে তুলে নেয় বর্ষণসিক্ত সজীবতা আর ঋতুর পরিহাস ভেঙে সঞ্চয় করে ঈশ্বরের ছায়া!
প্লাবন সন্ধ্যায়-মৌন আঁধারে ঝুলে আছে চাঁদের শরীর; এসো আজ পাটাতনে সুবাসিত সৌরভ মাখি, মনস্তাপ মুছে ফেলে ক্লান্ত ভেলা ভাসিয়ে দেই মেঘের সরোবরে।
বিলাপ
অভাবিত স্বপ্ন নিয়ে উড়ে যায় মেঘ
নীলের কাছাকাছি
চোখের ইজেলে এই সব দৃশ্যপট সাজিয়ে
কে যেন আঁকে অহর্নিশ মানুষের মুখ
গর্ভবতী ধানের পদ্য লিখে
উঠোনময় নির্মাণ করে স্মৃতিভ্রংশ বালুর রূপরেখা
কালাকাল বুঝি না তাই নেচে যাই দিন-রাত
করতল বন্দি সময় নিয়ে বৃথা মাপতে চাই
জীবন থেকে জীবনের দূরত্ব কিংবা
বহমান নদীতে স্রোতের দৈর্ঘ্য
গভীর ফাঁকি লুকিয়ে থাকে প্রেমের ছলাকলায়
সৌন্দর্যের সতীন যখন পাখি হয় বিনীত অন্ধকারে
ডুবন্ত সাম্রাজ্যের খোঁজে হ্রদ অভিযান থামিয়ে দেয়
কর্পোরেট পৃথিবী, তখন নিজেকেই প্রশ্ন করি
ভোগসভার পৃথিবীতে কে আমি?
পরিচয় অন্বেষণ সূত্রে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাঁচি
প্রশ্বাসে ঘুমের ঘোর বৃথাই জীবননাট্য লিখি
ইচ্ছেপত্র
সেই ভালো মর্মপীড়া ভেদ করে বেরিয়ে যাওয়া
একা-অন্ধকারে;
বাতাস হয়ে ছুঁয়ে যাওয়া রোদ্দুরের রঙ
কিংবা বৃষ্টির শব্দে খুঁজে নেওয়া নির্জনতা
ঘুম ঘুম সান্ধ্যদীঘি;
শৈশবের গন্ধ ভেজা খড়ের বুনো গন্ধে মজে
চন্দ্রবিন্দু হয়ে ঝুলে থাকা গ্রাম্য পথে
শৈশবের উজ্জ্বল আকাশ!
তালুতে শুয়ে থাকা আয়ুরেখা যেন এক অন্ধ অজগর
ছুঁয়ে যায় সম্ভ্রান্ত পৃথিবীর সন্ধ্যা
জননীর অভিজ্ঞ অঞ্চল গোপনে শাসায়
অনিবার্য ক্ষরণ ভুলে ইচ্ছেপত্রে লিখে রাখি
মনস্তাপ আর মনোছলের সাংকেতিক ইতিবৃত্ত
যাপনের খন্ডিত উপভাষা!
মোহ
আয়ুর মমতা বুঝে কেঁদে গেলে শুষ্ক নদী
বিশুদ্ধতা উড়ে যায় জলবায়ু বুঝে
মানুষ তবু রক্তকরবীর মোহে অকালে ঘুমায়-কালঘুমে
পড়শির জ্ঞান নিয়ে মেতে ওঠে কলহাস্যে
মায়ের আঁচল থেকে খুলে নিয়ে শৈশবের চিঠি
আমৃত্যু দৌড়ায় খ্যাতির অন্ধ কানাগলি
নির্জনতার শব কুড়াতে গিয়ে একদিন আমিও
হয়ে গেছি ট্রেনের শেষ যাত্রীটির মতো নিঃসঙ্গ
আমাকে রেখে ছেড়ে যায় দূরগামী ট্রেনের বহর
আর সিগন্যাল বাতির আড়ালে
সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে যে দেবদূত-লণ্ঠন উঁচিয়ে
কখনও তার নাম জিজ্ঞাসা করিনি
জেনেছি, মানুষও এক অনন্ত ট্রেনের যাত্রী
বয়ে চলে সারাক্ষণ নদীর স্রোতের মতো
উত্থান-পতন বুঝে মেপে নেয় দীর্ঘ যাত্রাপথ
আর ব্যক্তিগত খামারে চাষ করে
মোহ ও প্রণয়ের যুগল ভাষ্য!
অপরিচিত মুদ্রার রহস্য
খুব ভোরে পরিচিত স্বপ্নগুলো অচেনা হয়ে যায়
বিচিত্র পথের সাক্ষী, ফেলে গেলে ঝড়ের রাতে
আমি এক অন্ধ মাঝি, পাল্টে যাওয়া দৃশ্যপটে
চোখের গোলকে বন্দি রাখি সোনারঙ ইলিশ!
অপরিচিত মুদ্রার রহস্য নিয়ে জন্মান্ধ অভিযাত্রী এক
অতিক্রম করে স্বচ্ছ জলাধার থেকে হেমন্তের নগ্ন মাঠ
বিশ্রামহীন এই চলা ঘড়ির কাঁটায় টিক টিক
মাটির ঘ্রাণে সুবাসিত তবু আটপৌরে স্ব-কাল!
অধিবাস্তবতা
ভোগের আগে চাই এক প্রস্থ সুখদ যন্ত্রণা
নদী প্রবাহ থেকে এক মুঠো কাক্সক্ষা উড়িয়ে
ভেসে যেতে চাই সমবয়সী দূরত্বের পাশে;
রাত্রিগুলো নীলকণ্ঠ হলে ল্যাম্পপোস্টের কৌম আলোয়
পকেটে পুরে গলিপথের যুথবদ্ধ জটিলতা কিংবা
পানশালার গোপন আড্ডা থেকে এক মুঠো মুখরা শব্দ
নিয়ে হেঁটে যেতে চাই কবিতার অলিগলি
জলাঙ্গীর ঢেউ গুনে দেবদারু সাহসে
সুউচ্চ মিনারে দাঁড়াতে চাই-ঝড়ের বিপুলা রাজ্যে;
মেয়াদ উত্তীর্ণ পর্যবেক্ষণের ধাক্কায় আজ খসে গেল
নক্ষত্রসমান যে দীর্ঘ রাত্রি, মোমের স্বল্প আলোয়
করতল গলে ঝরে পড়া ওই প্রশ্বাসের প্রগাঢ় শূন্যতা
আর হাওয়া বদল নীতির প্রতিবেশিসুলভ অন্ধকারে
ঠোঁটের আকুতি নিয়ে বসে থাকি-জলন্ত অগ্নিকু-!
কাঙ্খার স্বর্গ
একবার যদি পরিত্যাগ করা যেত-ক্রোধের অস্তিত্ব
মৃত্যুর অসংখ্য টুকরো থেকে-জীবনের ছবি
কিংবা অনুশোচনার অগ্নি থেকে ফেরানো গেলে নীলদৃষ্টি
নক্ষত্রের বিচরণ ক্ষেত্র নিশ্চিত শস্যভূমি হতো;
একদিন, অন্ধকারের বৃত্ত ছুঁয়ে গীত হলে
জীবনের গান
কবির কাক্সক্ষার মতো চেতনা উদ্ভাসী শব্দগুলো
সৌরভ ছড়াবে বেশ-দেবদূত মুগ্ধতায়
তখন জীবন ছেড়ে উঠে আসবে মহাজীবন
প্রাণের সজীব উচ্ছলতায়;
মীন চোখে জলের শুদ্ধতা দেখে দেখে
ভুলে আছি কলঙ্কিত প্রাণের উপদ্রুত ইতিহাস
জেনেছি, জীবন একটি সম্পূর্ণ উপমা
প্রতিবিম্বহীন বৃক্ষের ছায়ায় দীর্ঘায়িত হয়ে ওঠে।
প্রেম এক অভিনব ঘুমের চাতুর্য
চলো, উড়ে যাই-
আঙুলগুলো প্রজাপতি হোক ভুলের বাগানে
শিশিরের নামতায় জড়ো করি জীবনের সবিশেষ
ফেলে আসা পান্ডুলিপি অমলিন জেগে থাক
শুভ্র মেঘের কলহাস্যে।
চলো, ঘাসফুল মাখি-
নদীর স্রোতে কান পেতে শুনি কাশফুলের আহ্বান
সপ্তডিঙায় উড়িয়ে দিয়ে সবটুকু দিনের ঔজ্জ্বল্য
চাঁদের অক্ষরে লিখি শ্বাসরোধী দহন।
আমাদের ভ্রমণকথা নক্ষত্র রাতের আতিশয্যে
মিশে থাক; চন্দ্রচ্যুত জোৎস্নায় মিটিমিটি জোনাকিরা
জেনে যাক-প্রেম এক অভিনব ঘুমের চাতুর্য
অবিশ্বাসে ভেঙে পড়া মাতাল বালিয়াড়ি!
প্রস্থানের চিত্রকল্প
তোর পাখিটি বোঝে, বিষাদের ঘোর লাগা দিন
পাতা ওড়ার করণকৌশল, স্তন ছুঁয়ে বসে থাকা মৃত্তিকার পাপ
আর অভিমানী গোপন আখ্যান!
তোর পাখিটি বোঝে, মেঘের এস্রাজে বাজে ঝড়ের আরতি
পুড়ে যাবে, উড়ে যাবে রিরংসার পাপ
এক চন্দ্রকাল গত হলে নিভে যাবে সমূহ উত্তাপ
তবু তুই বাম চোখে, এঁকে যাস ভ্রুণের উচ্ছ্বাস!
তোর পাখিটি বোঝে, নীরবতা মানে সৌমত্ত কবিতা
তৃষ্ণার আড়ালে এক পৌরাণিক দ্বীপ
কিংবা বাস্তচ্যুত দৃশ্যে দৃশ্যে লাল কাঁকড়ার ঘর!
তোর পাখিটি জানে, কুয়াশার স্রোত ভেঙে স্বপ্নমুগ্ধ জ্ঞানে
প্রাকৃতিক বীণায় বাজে প্রস্থানের সুর
বৈভবের কিছু দৃশ্য বাঁধা থাকে চিত্রকল্পে- স্বপ্নে ও শ্লোকে!
জীবনমুদ্রা
যে ভাবেই দেখো- জীবন এক প্ররোচনাময় টগবগ, কতিপয় ঘোরেই সুস্থির! বরং অননুমোদিত সেইসব দিনের কথা ভেবে হেঁটে যাও প্রাগ্রসর পথে, হয়তো শুনতে পাবে- পর্যটনপ্রিয় ঘোড়াদের হ্রেষাধ্বনি মিলিয়ে যাচ্ছে শ্রাবণভূমির অচেনা সন্ধ্যায়, বুঝে নিও- অশ্রু ও বর্ষার শাশ্বতরূপে প্রোথিত রয়েছে রূপান্তরের বিপুল সম্ভার। কিংবা, ঊরুস্তম্ভে উল্কি এঁকে বিকল্প উৎসেও খুঁজে পেতে পারো জীবনের প্রকৃত নৈর্ঋত!
এভাবেই- হাঁটতে হাঁটতে ভেঙে ফেলো অক্ষরের শব আর কাচের মহিমা; প্ররোচনা এড়িয়ে- ভাবে ও আচারে পুনরাধুনিক হয়ে ওঠাই বরং শ্রেয়তর!
নব্বইয়ের সময়পর্বের কবি ও নির্মাতা। তিনি গল্পকার, সাহিত্য সমালোচক, ও কলাম লেখক হিসেবেও পরিচিত। গবেষণা করেন লোকসাহিত্য ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। জন্ম ১৯৬৯ সালের ৪ মার্চ মাগুরার শালিখা উপজেলার দরিশলই গ্রামে। সম্পাদনা করেন শিল্প-সাহিত্যের ছোটকাগজ ‘দৃষ্টি’। দৈনিক যায়যায়দিন পত্রিকার, সম্পাদকীয় বিভাগে কর্মরত।
সুন্দর কবিতা সব।
শুভ জন্মদিন