Birju Maharaj on_living breathing and_dreaming Kathak

শিল্পই আমার জীবনের প্রথম ও শেষ আরাধনা: পণ্ডিত বিরজু মহারাজ

Reading Time: 7 minutes

পদ্মবিভূষণ পণ্ডিত বিরজু মহারাজের জন্ম ৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৮; ভারতের উত্তরপ্রদেশ লক্ষ্নৌতে। শিল্পকলায় তার অবদান বহুমুখী। একাধারে নৃত্যবিদ, সংগীতকার, কোরিওগ্রাফার, যন্ত্রশিল্পী, নির্দেশক, শিল্পস্রষ্টা, কবি ও চিত্রশিল্পী। মাত্র ৪৬ বছর বয়সে ভারত সরকারের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান পদ্মবিভূষণ, সংগীত ও নাটক একাডেমি অ্যাওয়ার্ড, কালিদাশ সম্মান; ভারতের বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়, খাইরাগারাহ বিশ্ববিদ্যালয় ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেছেন। চলচ্চিত্রে নৃত্য পরিচালনার জন্য ২০১২ সালে ‘বিষ্ণুপুরম’ এবং ২০১৬ সালে ‘বাজিরাও মাস্তানি’ চলচ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ কোরিওগ্রাফারের অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। মহান এই নৃত্যগুরুর প্রয়াণ দিবসে বাংলাদেশ প্রতিদিন-এ প্রকাশিত একটি সাক্ষাৎকার ইরাবতীতে পুনঃপ্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন—শেখ মেহেদী হাসান।


মহারাজজি, আপনার পরিবার চারশ বছর ভারতীয় ধ্রুপদী কত্থক নাচের চর্চা করে। আপনি সপ্তম প্রজন্মের উত্তরাধিকার। আপনার পরিবারের ঐতিহ্য জানতে চাই।

উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী ও জনপ্রিয় নৃত্যধারা কত্থকের সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক পণ্ডিত ঈশ্বরী প্রসাদের বংশধর আমি। শ্রী ঈশ্বরীজি ছিলেন এহালাবাদের হানদিয়া তেহশিলের মিশ্র-ব্রাহ্মণ। কথিত আছে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বপ্নে হাজির হয়ে তাকে বলেছিলেন—কত্থকনাচকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। তারপর ঈশ্বরীজির নিজের তিন ছেলে আডগুজি, খারগুজি এবং তুলারামজিকে কত্থকের শিক্ষা দিয়ে গেছেন। পণ্ডিত আডগুজির তিন সন্তান প্রকাশজি, দয়ালজি, হরিলালজিও ছিলেন খ্যাতিমান কত্থকগুরু। তারা নৃত্যশিল্পী হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন নবাব আসাফ-উদ্দৌলার দরবারে। পণ্ডিত প্রকাশজির ছিল তিন ছেলে—মহারাজ দুর্গাপ্রসাদ, মহারাজ ঠাকুরপ্রসাদ এবং মহারাজ মানপ্রসাদ। জানা যায়, নবাব আসাফ-উদ্দৌলা মানপ্রসাদকে ‘সিং’ উপাধি দিয়েছিলেন। মহারাজ ঠাকুরপ্রসাদ ছিলেন নবাব ওয়াজেদ আলী শাহের কত্থকনাচের শিক্ষক। মহারাজ দুর্গাপ্রসাদের তিন ছেলে—বৃন্দাদিন মহারাজ, কালকাপ্রসাদ মহারাজ এবং ভাই রণপ্রসাদ মহারাজও কত্থকনাচের খ্যাতিমান গুরু ছিলেন। তবে বৃন্দাদিন মহারাজের পরিচিতি ছড়িয়ে পড়েছিল সমগ্র ভারতবর্ষে। তিনি পাঁচ হাজার ঠুমরি, দাদরা, পদ, কবিতা, ভজন ইত্যাদি রচনা ও কম্পোজিশন করেছিলেন। পণ্ডিত কালকাপ্রসাদ মহারাজের তিন ছেলে—অচ্ছন মহারাজ, লচ্ছু মহারাজ এবং শম্ভু মহারাজ। আমার বাবা পণ্ডিত অচ্ছন মহারাজ। আমাদের পরিবার বংশ পরম্পরা লক্ষ্নৌ ঘরানার কত্থক নৃত্যের শুদ্ধ চর্চা ও প্রসারে নিবেদিতভাবে কাজ করছে।

কেমন ছিল আপনার ছেলেবেলা?

মুখে যখন কথাও ফোটেনি—সেই বয়স থেকে আমার নাচের শুরু। দুই বছর থেকে নাচ করি। নাচ আমার রক্তে, আমার চেতনায়। সংগীতও তাই। বাবার কোলে বসে আমি নাচের বোল মুখস্ত করেছিলাম। ছোটবেলায় কলকাতায় নেচে অনেক তারিফ পেয়েছিলাম, বাঙালিরাই আমাকে দিয়েছিল জীবনের প্রথম পুরস্কার। একদিকে পরিবারের উৎসাহ এবং বাবা পণ্ডিত অচ্ছন মহরাজের তালিমে আমি শৈশব থেকে নিয়মিত মঞ্চে পারফরম্যান্স করছি। তা ছাড়া লক্ষ্নৌ ঘরানার কত্থক নাচের প্রতিষ্ঠাতা আমার পরিবার। আমার বাবা দিল্লির সংগীত ভারতীর প্রশিক্ষক থাকাকালে কানপুর, এলাহাবাদ, গোরাখপুর, জানুপুর, মাধুবানী, কলকাতা, মুম্বাইসহ ভারতবর্ষের নানা স্থানে যে পারফরম্যান্স করেছিলেন—তখন তার সঙ্গী হয়েছিলাম আমি, সেই কৈশোর বয়সে। তিনি কত্থক নাচকে দিয়েছেন সুমহান মর্যাদা। তবে মাত্র নয় বছর বয়সে আমার বাবা মারা যাওয়ায় আমাকে সীমাহীন কষ্ট করতে হয়েছে। অত্যন্ত দুঃখময় ছিল আমার শৈশব।

সারা জীবন আপনি নৃত্য সাধনা করেছেন, আপনার অভিজ্ঞতা জানতে চাই।

নাচ হলো অভিব্যক্তি ও শরীরের কৌশল। শরীরকে ভালোবেসে যে মুভমেন্ট করা হয় সেটাই তো নাচ। এ জন্য নিজেকে ভালোবাসতে হয়। হাওয়া যখন গাছের পাতায় কাঁপন ধরায়, উড়বে বলে পাখি যখন ডানা ঝাপটায়, কিংবা মেয়েরা যখন রান্নাঘরে রুটি বানায়—সবখানে আমার চোখ খুঁজে পায় নাচের মুদ্রা—ধা ধিন ধিন ধা। মঞ্চের মন্দিরে হৃদয়ের কম্পন ছন্দবদ্ধ দেহভঙ্গিতে হয়ে ওঠে নাচ; আমি হয়ে উঠি বিরজু মহারাজ। দেখুন, সারা দুনিয়াই নাচছে! এই দেখুন না, বাতাস নাচছে, চাঁদ নাচছে, পৃথিবী নাচছে, পাতা নাচে, ফুল নাচে। কৃষ্ণ বাঁশি বাজায়, শিব ডমরু বাজায়, নাচে তো বটেই। ভগবান আসলে আমাদের সবার মধ্যে কেমন এক অদ্ভুত ছন্দ দিয়েছেন। আমি বলি কি, হৃদয়ের কম্পনই তো নাচ। এই নাচ কেউ খুঁজে পায়, কেউ পায় না। মানুষের অন্তরে নাচ, বাহিরে নাচ। যা ভগবানের দান; কখনো মানুষে, কখনো আবার প্রকৃতির বিভিন্ন অনুষঙ্গে। একটি পাখি বাচ্চাকে খাওয়াচ্ছে, সে যদি ডানা না ঝাপটাতো তবে সে পড়ে যেত। বাচ্চা যদি ঠিক সময়ে মুখ না খুলত, তবে পাখি তাকে কি করে দানা খাওয়াত? মেয়েরা রান্নাঘরে রুটি বানায়। তাদের দুই হাতের এক-দুই-তিন-চার এর সাথে যদি আপনি ধা ধিন ধিন ধা করেন, তবে আপনি ঠিকই করছেন। আপনি বুকের বাম পাশে হাত দিয়ে দেখুন। নাচছে। এ সব কিছুই তো টাইমিং। সব কিছুই আসলে ছন্দ। যখন আপনি হাসেন, কোনো কথায় খুশি হন—সেটাও গান, নীরব গান। সংগীতই আপনাকে হাসায়। না হলে প্রতিটি জিনিস আমাদের কাঁদাত, যন্ত্রণা দিত।

মহারাজজি, একজন শিক্ষার্থীর নাচ শেখার জন্য কোন বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি?

আপনি নাচ শিখছেন, এজন্য আপনার গান শোনার ইচ্ছা জাগতে হবে। তবলায় কী বাজে—সেটা বুঝতে হবে। এসব হোমের মতো। নিচের দিক থেকে উপরের দিকে ছড়িয়ে যায়। নিচের থেকে উপরে সমস্ত শরীর টিউন আপ হয়ে যায়, সুর-বাজনা সব টিউন আপ হয়ে যায়। তখনই তো নাচ হয়। তার সুর ও ছন্দজ্ঞান, পাঠ, নিষ্ঠা, ধৈর্য এবং সাধনা থাকতে হবে।

আপনি মঞ্চে এলে মনে হয় সাক্ষাৎ শিব নাচছেন। তখন সব কিছু ভুলে দর্শক আপনার নাচ দেখে।

নাচকে বলা হয় আত্মার স্বচ্ছন্দ আন্দোলন। নাচের ভাষা সবার কাছে বোধগম্য। সেই শৈশব থেকে ছেলেদের যখন মাঠে খেলবার সময় তখন থেকে আমি নাচ অনুশীলন করি। নাচই ছিল আমার খেলা, অবসর যাপনের সঙ্গী। নাচ, সংগীত ছাড়া আমার জীবনে কোনো কিছু গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি। এর অসম্ভব শক্তি রয়েছে কারণ আমি যখন মঞ্চে উঠি তখন দর্শক আমাকে দেখে না, দেখে আমার পারফরম্যান্স। আর পারফরম্যান্সই আমার প্রার্থনা। মঞ্চ আমার দেবালয় (পূজার ঘর)। সেখানে আমি ঈশ্বরকে খুঁজে পাই। আমার অনুশীলন, আমার সাধনার মধ্যে ঈশ্বরকে খুঁজে পাই। তিনি আমাকে অফুরন্ত প্রেরণা, শক্তি, সাহস জোগান দেন; তখন পারফরম্যান্স ছাড়া আমি কিছুই ভাবতে পারি না। নাচ শেখার জন্য আমাকে যেমন সাধনা করতে হয়েছে, তেমনি প্রচুর পড়াশোনা করতে হয়েছে। আমি এখনো শিখি। নিয়মিত কঠোর অনুশীলন করি। 

সত্যজিৎ রায় তার সিনেমায় আপনাকে দিয়ে নৃত্য পরিচালনা করিয়েছেন। তার সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা জানতে চাই?

লক্ষ্নৌর নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ ছিলেন কবি, নৃত্যশিল্পী এবং শিল্পকলার একজন বড় পৃষ্ঠপোষক। ভারতীয় কথক নৃত্যে তার অবদান অসামান্য। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের এক বছর আগে ১৮৫৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্রিটিশদের কাছে তার আওয়াধ রাজ্যের পতন ঘটে। এ ঘটনা এবং তার সমসাময়িক পরিপার্শ্বিকতার সঙ্গে তৎকালীন সমাজের রাজনীতি, আচার-অনুষ্ঠান ইত্যাদির মিশেলে চলচিত্রকার সত্যজিৎ রায় তৈরি করেন একমাত্র হিন্দি ভাষার চলচিত্র ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’। মুন্সী প্রেমচাঁদের লেখা উর্দু গল্প ‘শতরঞ্জ কি বাজি’ অনুসারে ১৯৭৭ সালে তিনি এটি নির্মাণ করেন। ওই চলচ্চিত্রে নৃত্য পরিচালনার জন্য তিনি আমাকে নির্বাচন করেন। মানিক ভাইয়ের (সত্যজিৎ রায়) ধারণা ছিল, আমার পরিবার যেহেতু কয়েক শ’ বছর কত্থক নাচ করে সে জন্য আমি হয়তো ভালো করব। অন্যদিকে আমার প্রপিতামহ ছিলেন নবাব ওয়াজেদ আলী শাহর নাচের শিক্ষক। মানিক ভাইয়ের অনুরোধ আমি উপেক্ষা করতে পারিনি। ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ চলচ্চিত্রে আমি দুটি নৃত্য পরিচালনা করেছি। তিনি কাজের শুদ্ধতা প্রত্যাশা করতেন। আবহসংগীত, আলো, ক্যামেরার টেকনিক্যাল দিকগুলো তার নান্দনিক হওয়া চাই। হয়তো আমার মধ্যে তার প্রত্যাশা পূরণের ক্ষীণ আলো দেখেছিলেন।

‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ চলচ্চিত্রে আপনি তো একটি ঠুমরি গেয়েছেন।

হ্যাঁ, ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ চলচ্চিত্রে ‘কানহা ম্যায় তোসে হারি’ ঠুমরিটি আমি গেয়েছি। ওই ঠুমরির সঙ্গে একক কত্থক নাচ পরিবেশন করেছেন আমার শিষ্য শাশ্বতী সেন।

পরবর্তীতে আপনি একাধিক চলচ্চিত্রে নাচের কোরিওগ্রাফি করেছেন। যেগুলো খুব প্রশংসিত হয়েছে।

সত্যজিৎ রায়ের আহ্বানে ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ চলচ্চিত্রে নৃত্য নির্দেশনার পর একাধিক পরিচালক তাদের চলচ্চিত্রে নৃত্য পরিচালনার জন্য অনুরোধ করেছিল। আমি আগ্রহ দেখাইনি। পরে আমার সিদ্ধান্ত পাল্টিয়ে কিছু চলচ্চিত্রে পুনরায় নৃত্য নির্দেশনা দেই। তার মধ্যে চলচ্চিত্র পরিচালক খুকু কাহলির ‘দেড় ইশকিয়া’ (২০১৪), আয়েশ চোপড়ার ‘দিল তো পাগল হ্যায়’ (১৯৯৭), অনিল শর্মার ‘গাদ্দার’ (২০০১), জে পি দত্তের ‘উমরাও জান’ (২০০৬); সঞ্জয় লীলা বানসালির ‘দেবদাস’ (২০০২) ও ‘বাজিরাও মাস্তানি’ (২০১৫) চলচ্চিত্রে নৃত্য পরিচালনা করেছি। এসব চলচ্চিত্রে আমার কম্পোজিশন দেশ-বিদেশের মানুষ দেখেছে। আমি ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্য কত্থককে একটি আন্তর্জাতিক মাত্রা দেওয়ার চেষ্টা করেছি।

চলচ্চিত্রের জন্য যখন নাচ কম্পোজিশন করেন, তখন কিছু বাণিজ্যিক চাহিদা থাকে। একজন শাস্ত্রীয় নৃত্যগুরু হিসেবে সেটাকে কীভাবে সামলান?

চলচ্চিত্রের চাহিদার সঙ্গে আমি কখনো আপস করিনি। মাধুরী দীক্ষিত, দীপিকা পাড়ুকোনকে যখন নাচ করিয়েছি, তখন কত্থকই করিয়েছি। তবে এমনও হয়েছে, গানের বাণী ভালো না হওয়ায় অনেককে আগেই মানা করে দিয়েছি। কোনো কোনো চলচ্চিত্রে কত্থককে দেখানো হয় যৌনপল্লীর নাচ হিসেবে। এটা ঠিক নয়। ভারতবর্ষের রাজা-মহারাজাদের দরবার, মন্দিরেই কত্থক বেশি হয়েছে। কত্থক বহু পুরনো। এটা এসেছে মন্দির প্রাঙ্গণে ‘কথাবচন’ হিসেবে। কথা থেকেই কত্থক এসেছে। কথা মানে গল্প। পৌরাণিক বিভিন্ন গল্প দিয়ে কত্থক নাচের শুরু। এরপর ধীরে ধীরে হিন্দু-মুসলমান রাজা, জমিদারদের কাছে এটি জনপ্রিয় হয়েছে। কত্থকের মতো বৈচিত্র্য অন্য কোনো শাস্ত্রীয় নৃত্যে দেখা যায় না।

আপনার নির্দেশিত নৃত্যনাট্য সম্পর্কে জানতে চাই।

রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট, মুসাফির, গীত-গোবিন্দসহ মোট ১৭টি নৃত্যনাট্য নির্দেশনা দিয়েছি। এগুলো ভারতীয় পুরাণ, ইতিহাস ও ঐতিহ্যনির্ভর। নৃত্যনাট্যগুলো দর্শক দেখেছে।

আপনি কবিতা লেখেন, বই লিখেছেন, আত্মজীবনী লেখার পরিকল্পনা আছে কিনা?

দুই সহস্রাধিক কবিতা লিখেছি। কাজের অবসরে কবিতা লিখি। এ পর্যন্ত দু-খানি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। বাকিগুলো সংকলনের চেষ্টা চলছে। এ ছাড়া কত্থক নাচ নিয়ে একটি গবেষণামূলক বই লিখেছি। বইটিতে কত্থক নাচের হস্ত ও পদ সঞ্চালনবিষয়ক আধুনিক ভাবনা যুক্ত হয়েছে। এখানে প্রতিটি মুভমেন্টের আলোকচিত্র সংযোজিত হয়েছে তাতে শিক্ষার্থীরা সহজে মুদ্রাগুলো শিখতে পারবে।

মহারাজজি, আপনি শিল্প-সংস্কৃতির সব মাধ্যমে অভিজ্ঞ, পারদর্শী মানুষ। এত সব কী করে পারেন?

আমি পাখোয়াজ, সরোদ, সেতার, বাঁশি, বেহালা, সারেঙ্গি, তবলাসহ নানা রকম যন্ত্র বাজাতে পারি। অল ইন্ডিয়া রেডিওর আমি নিয়মিত সংগীত ও যন্ত্রশিল্পী। আমার ধ্যান এক জায়গায়। সাধনায় সবকিছুই সম্ভব। একটি বাতির আলোতে ঘরের দরজা-জানালা—সবকিছুই দেখা যায়। তেমনি আমার আত্মিক আলো থেকেই নাচ, কণ্ঠসাধন, যন্ত্রবাদন, ছবি আঁকা, লেখালেখি সব আসে। আমি হয়তো শিখিনি, কিন্তু অনেক বড় বড় ওস্তাদের সান্নিধ্য পেয়েছি। ওস্তাদ হাফিজ আলী খাঁ, ওস্তাদ আমির খাঁ, পণ্ডিত রবিশঙ্কর, পণ্ডিত ভীমসেন যোশি প্রমুখ। এর মধ্যে ওস্তাদ আমির খাঁ, পণ্ডিত রবিশঙ্করের সঙ্গে আমি তবলা বাজিয়েছি। গান করেছি।

আপনার কণ্ঠসংগীতের প্রশংসা করেছেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়, পণ্ডিত রবিশঙ্কর।

আমি ছোটবেলা থেকে ঠুমরি, দাদরা, ভজন এবং গজল পরিবেশন করি। নিজে নিজেই শিখেছি। সত্যজিৎ বাবুর অনুরোধে তার চলচ্চিত্রে ঠুমরি পরিবেশন করেছি। পণ্ডিত রবিশঙ্করও আমার ঠুমরি, ভজন পছন্দ করতেন।

ছবি আঁকা শুরু করলেন কবে থেকে?

আট-দশ বছর হলো ছবি আঁকছি। ইতিমধ্যে চার শতাধিক ছবি এঁকেছি। আমার চিত্রকলার বিষয়বস্তু হলো প্রকৃতি, নিসর্গ, ফিগারধর্মী, নৃত্যরত নারী-পুরুষ, প্রোট্রেট এবং ড্রয়িং। জলরঙ আমার পছন্দ। আমার মেয়ে অনিতা চিত্রশিল্পী। ও আমার আঁকা দেখে উৎসাহিত করে।

আপনার আঁকা শিল্পকর্ম নিয়ে কোনো প্রদর্শনীর পরিকল্পনা আছে কিনা?

আমি ছবি আঁকি আমার ভালোগালা থেকে। আমার অপ্রকাশিত অনুভূতি সেখানে প্রকাশ করি। প্রদর্শনী করতে পারলে ভালো, দর্শক শিল্পকর্মগুলো দেখতে পাবে।

দিল্লিতে ‘কলাশ্রম’ নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। এর কার্যক্রম কী?

দিল্লি কত্থক কেন্দ্র থেকে অবসর নেওয়ার পর ১৯৯৮ সালে কলাশ্রম প্রতিষ্ঠা করি। এর উদ্দেশ্য কত্থক নাচের শুদ্ধ চর্চা ও প্রসার। এখানে গুরু-শিষ্য পরম্পরায় কত্থক নাচের তালিম, কর্মশালা, মাস্টার ক্লাস, লেকচার ডেমোনেস্ট্রেশন, সেমিনার, পারফম্যান্স এবং বিভিন্ন উৎসব আয়োজন করা হয়। কলাশ্রম বছরে চারটি উৎসব আয়োজন করে, যথা—বসন্ত উৎসব, সাধনা, দীক্ষান্তসভা ও হলি উৎসব। কলাশ্রমে নাচের পাশাপাশি কণ্ঠসংগীত, যন্ত্রসংগীত, ইয়োগা, চারুকলা, নাটক, মঞ্চসজ্জা, মঞ্চব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা সাত শতাধিক। এশিয়ার চীন, ভারত, জাপানসহ আমেরিকা ও ইউরোপের নানা দেশের শিক্ষার্থী রয়েছে কলাশ্রমে।

মহারাজজি, এবার বাংলাদেশে এসে আপনার অনুভূতি কী?

বাংলাদেশে এলে মনে হয় আমার নিজেরই আরেকটি দেশ। এখানকার অনেক শিল্পী আমার সান্নিধ্যে এসেছে। মুনমুন আহমেদ, শিবলী মহম্মদ, সাজু আহমেদ, তাবাচ্ছুম আহমেদ, কচি রহমানসহ অনেকেই আমার কাছে তালিম নিয়েছে। এজন্য বাংলা ভাষা, বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে আমি পরিচিত। কদিন আগেই আরব আমিরাত সফর থেকে এসেছি। শরীর ভালো নেই; তবুও সাজু আহমেদের ডাকে চলে এলাম বাংলাদেশে। ও আমার শিষ্য। সাজু আহমেদ নিজ উদ্যোগে পর পর পাঁচ বছর তিন দিনব্যাপী কত্থক নাচের উৎসব করছে। বাংলাদেশে শুদ্ধ কত্থক নাচের চর্চা ও প্রসারে তার উদ্যোগ প্রশংসনীয়। তার আহ্বানে আমাকে তো আসতেই হবে। কথা বলতে হবে নাচ নিয়ে। বাংলাদেশে আসতে পেরে খুব ভালো লেগেছে। এখানকার তরুণ নৃত্যশিল্পীরা ভালো শিখছে। কাজ করছে। আমি আনন্দিত।

ঢাকার কোন জিনিস আপনার পছন্দ?

ঢাকার মানুষের আতিথেয়তা। এখানকার খাবার। যদিও আমি নিরামিশভোজী। ঢাকার মিষ্টি, রসগোল্লা আমার ভালো লাগে।

আপনার আগামীর পরিকল্পনা কী?

শিল্পই আমার জীবনের প্রথম ও শেষ আরাধনা। সংগীত ও নৃত্য পরস্পর সম্পর্কিত। ছন্দ, লয় ছাড়া সংগীত হয় না, নৃত্যও হয় না। ছন্দের স্বর্গীয় সুধা নিয়েই শিল্প জীবন। মঞ্চ আমাদের কাছে মন্দির। মঞ্চে আমরা শিল্পের মধ্য দিয়ে ধর্মীয় নানা আচারও পালন করি। আমৃত্যু সেটাই করব।

আপনি ভালো থাকুন, সুন্দর থাকুন।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>