Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

বিষ

Reading Time: 6 minutes

এত ফর্সা আর চাঁপাফুলের  পাপড়ির মত সুন্দর আঙুল  জীবনে চোখে দেখেনি রানা । শুধু কি আঙুল ! লম্বা নাকের নিচে গোলাপি সরু ঠোঁটের এমন বাঁকা হাসিও খুব কম দেখেছে সে । আর চোখ !চোখ তো নয় ,যেন কালো দীঘির আহ্বান । যতবার এই ব্যাঙ্কে আসে সে মনে হয় আরো খানিকক্ষন থাকি । ওই চোখের গভীরতায় স্নান আর আঙুলে আঙুল ছুঁইয়ে যদি… দূর কি সব ভাবছে সে । মুহূর্তে  যামিনীর মুখ মনে পরে যায় । না যামিনী এর তুলনায় কিছুই নয় ।মাঝারি উচ্চতা,শ্যামলা রঙ ,পুরু ঠোঁটের যামিনী নেহাতই… কিন্তু সেই তার জীবনে মরুভূমির মাঝখানে জলাশয় । সেই জল পান না করলে এতদিনে তার যে কি হাল হত ভাবতে ভাবতে রানা আবার সামনে আসীন মহিলার দিকে তাকালো । দীর্ঘ ষাট মাস কিস্তি টানার পর অবশেষে আজ ঋণমুক্ত হচ্ছে তারা । যেন বুকের থেকে ষাট মন  ভারি পাথর সরে গেল । আজ থেকে এক রুমের ফ্ল্যাটটার মালিকানা তাদেরই ।অবশ্য এর জন্য পুরো কৃতিত্ব যামিনীরই । দিন রাত পরিশ্রম করে সে বেচারা হাড়মাংস এক করে ফেলেছে । রানার খুব ইচ্ছে হল মহিলাকে বলতে ,আর দেখা হবে না । জানেন আপনি যদি অভিনেত্রী হতেন তাহলে আর … বলতে গিয়েও চুপ করে গেল রানা । কি দরকার অযথা কথার ! সে একবার মুগ্ধ চোখে তার দিকে তাকিয়ে, আচ্ছা চলি তাহলে , বলে উঠে পড়ল ।

এই ফ্ল্যাটে তারা এসেছে  তিন বছর হল ।এখনো সবটা গুছিয়ে উঠতে পারেনি । কিছুটা সময় আর কিছুটা উদাসীনতা । থাক না যেমন  চলছে চলুক গোছের মনোভাব এর জন্য দায়ী । যামিনী  শহরের একটা নামী পার্লারে কাজ করে । আশেপাশের বড় হোটেলের বিদেশী কাস্টমাররাই বেশি আসে সেখানে । বিদেশী ক্ল্যায়েন্টের সাথে চোস্ত ইংরেজিতে কথা বলে সে । মাইনেটাও রানার থেকে হাজার ছয় বেশি ।তাছাড়া মাটির পাত্রের ওপর সে চমৎকার ছবি   আঁকে ।সেটাও তার পার্লারে বিদেশী কাস্টমার টানে । আর এর থেকেও টাকা কিছুটা আসে । নইলে কী এটা সম্ভব হোত ! অথচ এত পরিশ্রম করার পরও যামিনী ক্লান্তিহীন । মুখে সারাক্ষন হাসি । এটাই রানার নেই । তার কোনো কাজেই সে ভাবে ভাল লাগা নেই ।চলার জন্য চলা,যেন বেঁচে থাকতে হবে বলে বাঁচা । ক্লাস নাইনে  মা মারা যাবার পর বাবা আবার বিয়ে করলেন ।তখন থেকেই জীবনটা বিষিয়ে গেল, নিত্য অশান্তি আর গাল খেতে খেতে একদিন ঘর ছাড়া হল ।আর আজ তার নিজের আস্ত একটা ফ্ল্যাট ! যদি যামিনী না আসতো তার জীবনে, তাহলে … ভাবতে ভাবতে সে আটতলার বারান্দা থেকে সামনের দিকে তাকালো । জায়গাটাকে কোনোভাবেই শহর বলা যাবে না ।তবু শহরের কাছেই নিজের তো…একটা সুখের অনুভূতি তার শরীরে ছড়িয়ে পড়ল ।

যামিনীর বাবা মারা গেছে সে যখন দশ । তারপর থেকেই স্কুল ছেড়ে মার সাথে এবাড়ি ওবাড়ি বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম শুরু ।মামার বাড়িতে  রান্নার কাজ সামলাতে সামলাতে মা’ও হঠাৎ চলে গেল । আগুনে পুড়ে যাওয়া মা আত্মহত্যা করেছিল কিনা সে প্রশ্নের জবাব আজও মাঝে মঝে তার মাথায় ঘোরে। তখন সে সবে পনেরো । মামতো বোনেদের বই পড়েই তার স্কুলে যাবার শখ মিটেছিল ।তখন থেকেই মাটির পটের ওপর আঁকা সামগ্রী বিক্রি করে সেই টাকায় একবছরের ইংরেজি বলা ও চলার মত লেখার কোর্স  করেছিল সে ।আর তারপর বিউটিশিয়ান কোর্সও । যামিনীর স্বপ্ন ছিল  এই কাজ করেই বিশ্বজয় করবে সে ।মনের জোরও ছিল অসম্ভব । কোনো কিছুতে না ছিল না তার । না শব্দটার জন্ম তার অভিধানেই ছিল না । রানার সাথে তার পরিচয় হয়েছিল একই  ট্রেনে যাতায়াতের দৌলতে । ক্রমশ বন্ধুত্ব ও তারপর বিয়ের সিদ্ধান্ত । চাল  চুলো হীন রানার স্বল্প বেতনের চাকরী তাকে দমাতে পারেনি ।বিয়ের একবছরের মধ্যেরানা সেই চাকরীও ছেড়ে দিল । এত দূর যাতায়াত তার শরীর ও মনকে ক্লান্ত করে তুলছিল । সে শেষমেশ যামিনীর কথামত কাপড়ের ব্যবসা শুরু করল । বড়বাজার থেকে পাইকারী দামে কাপড় কিনে এনে অল্প মার্জিনে বিক্রি করতে শুরু করল। প্রথম দিকে আশেপাশের বাসিন্দা আর বন্ধু বান্ধবদের বাড়িতে গিয়ে বিক্রি করলেও দু’বছর যেতে না যেতেই একটা দোকান ঘর নিয়ে ফেলেছে সে । মা লহ্মীর কৃপায় এখন তার ব্যবসা ভালই চলছে ।

যামিনীর অবশ্য এই ব্যবসায় সে রকম আগ্রহ নেই। রানা স্থায়ী ভাবে একটা কাজ করছে এতেই সে খুশি । মাথা গোঁজাবার ঠাঁই  হয়েছে , ভদ্রভাবে সংসার চলছে তাতেই তার শান্তি।এখন সে চায় পড়াশনা করতে ।এই একটি চাহিদা এখনো তাকে মাঝে মাঝেই পাগল করে দেয় । পার্লারের চাকরী তাকে অর্থ দিয়েছে কিন্তু তার স্বপ্ন এখনো অধরা ।তার মনে হয় পড়াশোনা না করলে সেই আশা কখনো পূরণ হবার নয় । তার পার্লারে এক ফরাসি মহিলা আসেন মাঝে মাঝেই ।তিনি ফ্রান্সের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্টের হেড ।যামিনী তাকে মাটির কলসির উপর নিজের আঁকা একটি ছবি উপহার দিয়েছিল । ছবিটি একদল নৃত্যরত সাঁওতাল মেয়ে –ছেলের ।এই ছবিটিই যামিনীর জীবনে স্বপ্ন পূরণের প্রথম ধাপ খুলে দিল হঠাৎ

করে। আনা মারিয়া নামের সেই মহিলা যামিনীকে দুই বছরের জন্য স্কলারশিপের ব্যবস্থা করে দিলেন নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছোট থেকে দারিদ্র আর সংসারের চাপে যে স্বপ্ন অধরা ছিল তা আজ হাতের তালুর মধ্যে এল । প্রথমে একটু আপত্তি জানালেও রানা মেনে নিল দু বছরের জন্য এই বিচ্ছেদ ।

সমস্ত প্রস্তুতি শেষ করে যামিনী উড়ে গেল স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করার আশায় । রানার মাস খানেক একা লাগলেও এখন আর সেভাবে যামিনীর অভাব অনুভব করেনা ।তার মনে হয় যামিনী কাছে থাকা আর না থাকার মধ্যে  আর সেভাবে কোনো প্রভেদ নেই। হোয়াটস এপ আর ফেসবুকের দৌলতেদূরটা আর সেভাবে দূর নয় ।তাছাড়া সে থাকলেই বা এমনকি পরিবর্তন হচ্ছিল রোজ রোজ ! সেই তো একই সকাল ,একই জানলা দিয়ে একই রাস্তা দেখা, ধোঁয়ায় মোড়া ধূসর আকাশ … তারচেয়ে এই বেশ ভালো । আবার ব্যাচেলর দিন যাপন ।ফাঁকা ঘরে বন্ধুদের সাথে স্কচ সহ আড্ডা ।তার মধ্যেই জেগে ওঠে শরীর ।স্বমেহনে আর কল্পনায় সেই দুধ সাদা লাল নেলপলিস লাগানো সরু আঙুলের আক্ষরিক টের পায় স্নায়ুতে । যামিনীর অনুপস্থিতি জৈবিক ক্ষুধা বাড়িয়ে দেয় । বন্ধুরাই বলে তার নাকী মাঝে মাঝে ম্যাসেজ পার্লারে যাওয়া উচিত যতদিন না যামিনী ফিরছে । লাইফে যা স্ট্রেস তাতে এটা ছাড়া সামলানো নাকী চাপের । অবশ্য মেম্বার আর রেফারেন্স ছাড়া তাতে প্রবেশ প্রায় নিষিদ্ধ । তবে চিন্তার কোনো কারন নেই।সেটা ম্যানেজ হয়ে যাবে।

ক্রমশ সূর্যের আয়ূ কমে ,দিন ক্ষয় হয় । বন্ধুদের নিয়ে একই রকম আড্ডা আর ভালো লাগেনা । যামিনীও নিয়মিত আর চ্যাটে বা স্কাইপে আসেনা।তার এখন ভয়ঙ্কর ব্যস্ততা । নানান সেমিনার,ওয়ারকশপ ।পরপর কয়েকদিন অনুযোগ জানিয়েও কোনো ফল হয়নি । বরং সে জানিয়েছে বারবার তাকে বিরক্ত করলে তার কাজের ক্ষতি হবে।তাছাড়া সে আরো এক বছর থাকার মেয়াদ বাড়িয়েছে তার সুবিধার জন্য । এরপর রানা আর তাকে বিরক্ত করা বাঞ্ছনীয় বলে মনে করেনি । আজকাল খুব একা লাগে তার ।মাথাটাও অকারনে ধরে আসে । শরীরে মনে কোনো উৎসাহ পায়না সে ।আত্মীয় পরিবার পরিজনবিহীন ক্লান্ত রানা একদিন সত্যিই হাজির হয় সব প্রটোকল পূর্ণ করে এক নামকরা ম্যাসেজ পার্লারে ।শরীরটা একটু আরাম চায়,মালিশ চায় ।

ধবধবে সাদা নরম বিছানা ।সুগন্ধিযুক্ত মোমের আবেশ, নানা রকম ফুলে সাজানো স্পা । নিমেষে ক্লান্তি দূর ।সে নিজেও এতটা ভাবেনি । মনে মনে বন্ধুকে ধন্যবাদ জানায় সে ।সময় যেন থমকে গেছে এখানে । বুকের ভিতর অগ্নিস্ফুলিঙ্গের বিস্ফরণ । কোন সোনার কাঠির ছোঁয়ায় শরীরটা যেন হাওয়ায় ভাসছে, উড়ছে আবার ভাসছে ।

প্রায় বস্ত্রহীন হয়ে উল্টো হয়ে শুয়ে আছে রানা । একটি নরম কোমল হাত ক্রমাগত তার পিঠ ,ঊরু, পায়ের পাতা, সহ সমস্ত শরীর ম্যাসেজ করে দিচ্ছে। একটিও  শব্দ নেই মুখে  তার । ঘরময় ঝর্নার কুলকুল আওয়াজ। যেন সে সত্যি ঝর্নায় স্নান করছে । মুহূর্তে মুহূর্তে পালটে যাচ্ছে রানার মনোজগতের দৃশ্যপট । এ  যেন স্বর্গে প্রবেশের অনুভূতি । হঠাৎই তার সুখানুভূতি স্তব্ধ হয়ে আসে । যামিনীর পার্লারও কি এরকম ছিল ? তাই কি এত বেতন পেত ? তাই কি এত সহজে ফ্ল্যাটের লোন শোধ হয়ে গেল ! না না এরকম কিছু না ।সেতো বাইরে থেকে দু এক বার দেখেছে সেই পার্লারকে । তাছাড়া বিখ্যাত মহিলাদের সাথে ছবি তুলে এনে মোবাইলে তাকে কতবার দেখিয়েছে যামিনী । সে এমন মেয়েই নয় । কি সব ভুলভাল ভাবছে সে ! নিজেকেই বোঝাবার চেষ্টা করছিল রানা । তখনি চিন্তার স্তর ভেদ করে প্রশ্ন ভেসে আসে তার দিকে ।

“ আর ইউ রেডি ফর টস অফ ?”একটা মায়াবী কণ্ঠস্বর । গলাটা কি শুনেছে সে এর আগে ?

রানার সম্বিৎ ফেরে ।হ্যাঁ সেতো এটাও চেয়েছিল । ফর্মে সেটা লিখেওছিল ।

সোজা হল সে ।আবছায়া ঘরের ভেতর ওর চোখ পরল সাদা এপ্রোন পরিহিত ম্যাসিউরের ওপর ।কেমন যেন চেনা চেনা মুখ। কোথায় দেখেছে ঠিক মনে করতে পারল না সে ।আলোটা স্পষ্ট হলে হয়তো … কিন্তু তার আগেই ওর নিম্নাংশের তোয়ালের নিচে লতিয়ে প্রবেশ করেছে ব্যস্ত আঙুল সমৃদ্ধ হাত ।এত কল্পনাতীত সুখ সে আগে কখনো অনুভব করেনি । ঠিক করে সে চোখ খুলতেও পারছে না গভীর সুখে ।অনুভব এত সুন্দর ! যেন জীবনে এই প্রথম সে এই স্বর্গীয় সুখ উপলব্ধি করছে ! ফুলেল সুগন্ধ আর নরম স্পর্শ … সমস্ত শরীরে যেন ঝড় । কয়েক মিনিটের মধ্যেই টরনেড আছড়ে পড়ল তলপেট জুড়ে। উৎথান ও পতন এত দ্রুত ঘটে গেল যে রানার মনে হল এ যেন আকস্মিক স্বপ্ন ভঙ্গ । ঠিক কৈশরের হস্ত মৈথুনের সুখ সে ফিরে পেল আজ হঠাৎ ।

যদি সে তার কাজে স্যা্টিস্ফাই হয়ে থাকে তবে যেন সার্ভিস রিভিউতে সেটা উল্লেখ করে এবং পরের বার এলে তাকেই  দেবার কথা মেন্সন করে , একথা বলতে বলতে তোয়ালে বদলে দিল ম্যাসিউর । এখনো স্পষ্ট নয় তার মুখ । একটা অজানা তেলের সুগন্ধ আর কর্পূরের গন্ধে চোখ পুরো খুলতে পারছিল না রানা ।তার সময়ও শেষ । বেরবার আগে সেই অবয়ব কে দেখার প্রবল ইচ্ছায় বারবার চোখ কচলালো সে । অবয়ব তখন পাশে রাখা সরঞ্জাম গোছাচ্ছে । রানার চোখ আটকে গেল তার আঙুলে । অবিকল সেই আঙুল ।লাল নেল পলিস ,চাঁপার পাপড়ির মত সাদা সে আঙুল ।হুবহু এক ভঙ্গীতে আঙুল চালাচ্ছে । মাথার মধ্যে আকাশ ভেঙে পরার উপক্রম হল তার । এতদিন যে আঙুল ছোঁয়ার কল্পনা করে সে স্বমেহন করত ,যে তার কল্পনার নারী আজ সে এখানে ? সেই ব্যাঙ্কের সুন্দরী  ! তাও কি সম্ভব ? না না এ কী সব ভাবছে সে ! সবটাই একটা ভ্রম ।মাথার ভিতর নিউরনের দুরন্ত ছোটাছুটি । এই যে সাময়িক সুখ ,এই নিরাভরণ ভোগী শরীর –এ সবই কি তার কল্পনা নাকী  কোনো ভয়ঙ্কর সাপ তার সারা অঙ্গ প্রতঙ্গকে আষ্টেপিষ্টে বেঁধে ফেলছে ,সেই বিষ ঝেড়ে সে আর উঠে দাঁড়াতে পারবে না ভাবতে ভাবতে রানার মেরুদন্ড বেয়ে একটা শীতল স্রোত নেমে এল ।

 

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>