ভাবতে অবাক লাগে ৯ মে ১৯৩০ বিয়ের দিনই ডায়েরিতে লিখছেন,’ লাবণ্য ও বেবির মধ্যে তফাত : বেবিই বাস্তব কিন্তু বেবি টিকবে না।’ লিখছেন যৌনতার কুৎসিত বাস্তব দিকগুলির কথা। লিখছেন একা বিছানায় শুয়ে নিজেকে ব্যাচেলার মনে করে নিলেই হল।
কী এমন ঘটলো যে বিয়েটাকে প্রথমদিন থেকেই দুর্ভাগ্য মনে হবে। শুধু তাই নয়,১৯৩০-এর ‘দুর্ভাগ্য’ (wretchedness) ১৬ ডিসেম্বর ১৯৩৩- এ ‘জঞ্জাল’ (scrap) হয়ে ১৯৪৭-এ ‘শ্বাসরোধী’ (suffocating) হয়ে দাঁড়াবে।
বাসর রাতের ‘অচেনা বিছানা’ (strange bed) সারাজীবন জীবনানন্দ দাশকে তাড়া করে বেড়াবে। ‘মাল্যবান’-এ দেখব ওপরের ঘরটায় উৎপলা শোয় আর একতলার ঘরটাতে মাল্যবান।
বিয়েটা কী খুব তাড়াতাড়ি করে ফেললেন? কোনও প্রস্তুতি ছাড়াই? অর্থনৈতিক প্রস্তুতি তো ছিলই না, জীবনানন্দ জানতেন দিল্লির চাকরিটা তাঁর নেই, তিনি এখন বেকার। তবু পারিবারিক কোনও চাপে সাত-তাড়াতাড়ি বিয়ের পিঁড়িতে বসতে বাধ্য হলেন।বেবির সঙ্গে সম্পর্কটা জানাজানি হয়ে গিয়েছিল!নাকি অন্য কোনও অঘটন?
১৯৩১- এ লেখা ‘বিবাহিত জীবন’ গল্পে চমৎকার ধরা পড়েছে বিয়ের দিনগুলোর কথা, জীবনানন্দ বেবি ও লাবণ্যর মধ্যে সম্পর্কের জ্যামিতিক পরিসর ও আততির কথা।
অজিত বিয়ে করে সুপ্রভাকে নিয়ে ফিরছে অথচ সুপ্রভার ‘নারীসৌন্দর্য’ তাকে স্পর্শ করে না।অজিতের চোখ খুঁজে বেড়ায় সতীকে।
বিয়ের ‘হুলুস্থুল’ এড়িয়ে অতঃপর অজিত সতীকে নিয়ে একটা ‘অনাবিষ্কৃত কোঠায়’ যায়।আর কী কথা হয় তাদের মধ্যে!
অজিত বলে সে নববধূর প্রতি কোনও প্রয়োজন বোধ করছে না। বরং সতী চলে গেলে ভোজবাজি ফুরিয়ে যাবে, কেননা জাদুগুলো একমাত্র সতীই জানে।দশ বারো দিনের জন্য নয়, সারাজীবনের জন্য।
এরপর যখন অজিত বলে এই বিয়ের প্রয়োজন ছিল না, উত্তরে সতী বলে, কেন করলে তবে বিয়ে। শোভনা আমাদের সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, মিলুদার বিয়ে করবার কী প্রয়োজন ছিল। সেই ৮১/৮২ বছর বয়সেও শোভনা তবে ‘সতী’ই তো!
ভূমেন্দ্র গুহর বোন ও আলোক সরকারের স্ত্রী মিনু সরকার লাবণ্য দাশের ঘনিষ্ঠ। তিনি লিখছেন, ‘জীবনানন্দের বিবাহিত জীবন তেমন সুখের ছিল না’। বিরাম মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে কবি জানতে চাইছেন, স্ত্রী যদি আপনার আমন্ত্রণে ঘনিষ্ঠ হবার প্রস্তাবে সায় না দেয় তখন কী করবেন?
দাম্পত্য নিয়ে খুব খারাপ সময় যাচ্ছে জীবনানন্দর।১৬ ডিসেম্বর ১৯৩৩ লিখছেন,’ সারাদিন কাঁদে…আমাকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়…কি করব? আত্মহত্যা?’ ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৩,’ সেই এক পুরনো প্রত্যাখ্যান…কথা বন্ধ…অনুভূতিহীন নঞর্থক’।
৩১ আগস্ট ১৯৩৪ ডায়েরিতে লিখছেন,’ তিন চারদিন ধরে ভয়ঙ্কর অবস্থা… দরজা বন্ধ, নাওয়া না, খাওয়া না, শুধু মুড়ি…উপোস করে মরে যাবে… ওকে ভূতে পায় নাকি?’ আর এই বছরই লিখবেন ‘রূপসী বাংলা’। লিখবেন, ‘মাথুরের পালা বেঁধে কত বার ফাঁকা হল খড় আর ঘর’।
দাম্পত্যের ‘ভূত’ ই তো!নেটের মশারি তুলে মাল্যবান যখন উৎপলার কাছে পৌঁছাতে চায়, প্রথমে মাল্যবানকে ‘বলির কুমড়ো’ তারপর ক্রমে ক্রমে ‘ড্যাকরা মিনসে’, ‘ইঁদুরে’, ‘ঘানির বলদ’ হয়ে শেষে ‘বেহায়া মড়া’ বলে নিরস্ত্র করে উৎপলা।
জীবনানন্দের কাছে দাম্পত্য ‘বেহায়া মড়াই’।একজন সৌন্দর্য তান্ত্রিক যার ওপর বসে আজীবন সাধনা করে গেছেন।তাই তো লিখতে পারেন,’সময় তোমাকে সব দান করে মৃতদার বলে?/সুদর্শনা তুমি আজ মৃত’।
বিয়ের প্রায় দেড় বছর পর প্রথম কবিতার পান্ডুলিপিটি পাই আমরা। কী লেখেন সেখানে?
‘এক দিন ভাবি নি কি আকাশের অনুরাধা, নক্ষত্রেরা বোন হবে’, লেখেন ‘তেমন শিহরণ’-এর কথা।
এতো বেবির কথা।
লেখেন,’ আবার বছর কুড়ি পরে এক দিন তার সাথে দেখা হয় যদি’।
এতো মনিয়ার কথা।
তবে লাবণ্য কোথায়?
লাবু লাবুরানী…স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যায়…বুকে বিষম কষ্ট…অনেক রাতে বিছানা পেয়েছ…রক্তাক্ত হৃদয় মুছে ঘুমের ভিতর রজনীগন্ধার মতো মুদে থাক।
প্রেতিনী, শঙ্খমালা, বনলতা, শ্যামলী, সুরঞ্জনা, শেফালিকা, উৎপলা, উষা, অরুণিমা, মৃণালিনী, মনিয়া, কাঁকনমালা…এমন অজস্র নারী, মেয়েমানুষ, মহিলা, ছোট্টমেয়ে, মানুষী, রমণীর ভিড় জীবনানন্দের ‘টেক্সট’-এ…লাবণ্য এখানেই কোথাও ‘সাব টেক্সট’ হয়ে থেকে যান।
লাবণ্যর নাম নিয়ে জীবনানন্দের নকশা।
কবি,সমালোচক,গবেষক