bjornstjerne bjornson, irabotee.com

অনুবাদ গল্প: জনক । নোবেলজয়ী বিওর্নস্ট্যারনে বিওর্নসন

Reading Time: 4 minutes


অনুবাদ : মোবারক হোসেন খান

[লেখক পরিচিতি : বিওর্নস্ট্যারনে বিওর্নসন [bjornstjerne bjornson], নরওয়ের সাহিত্যের অন্যতম জনক হিসেবে গণ্য। ১৮৩২ সালে তিনি নরওয়ের কিউনকে শহরে জন্মগ্রহণ করেন। লেখাপড়া করেন ক্রিশ্চিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সাহিত্যজীবনে তিনি ছিলেন নাট্যকার, সমালোচক, কবি এবং ঔপন্যাসিক। তা ছাড়া একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবেও সুখ্যাতি অর্জন করেন। ১৯০৩ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিকদের মধ্যে তিনি তৃতীয়। তার লেখা ‘দি ফাদার’ শীর্ষক অসাধারণ গল্পটি ১৮৮১ সালে প্রকাশিত হয়। ১৯১০ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ‘দি ফাদার’ গল্পের অনুবাদ ‘জনক’।]


যে মানুষটির কথা এখানে বলা হচ্ছে তিনি একজন খুবই ধনী ব্যক্তি। তিনি যে জেলায় বাস করেন সেখানে তার প্রভাব ও প্রতিপত্তি অঢেল। তার নাম থোর্ড ওভেরাস। দেখতে-শুনতে বেশ লম্বা। আচার-আচরণে নম্র। একদিন তিনি জেলার পাদ্রির বাড়িতে এসে হাজির হলেন। তিনি পাদ্রিকে বললেন, ‘আমার এক ছেলে। তার নাম রাখতে চাই। তাকে কোন দিন আনব জানতে এসেছি।’
‘তার নাম কী রাখবেন, ঠিক করেছেন?’ পাদ্রি জিজ্ঞাসা করলেন।
“হ্যাঁ, আমার বাবার নামে তার নাম হবে ‘ফিন’।”
‘তার নাম রাখার প্রস্তাব কে করবেন, ঠিক করেছেন?’
থোর্ড তার কয়েকজন আÍীয়ের নাম বললেন। তারা খুব নামিদামি এবং সমাজের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি।
‘আর কিছু বলার আছে?’ পাদ্রি থোর্ডের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন। থোর্ড খানিকটা ইতস্তত করে বললেন, ‘আমার ইচ্ছা লোকজন না ডেকে আমার ছেলের নাম রাখার কাজটা এমনিতে সেরে ফেলি।’
‘কোন দিন আসতে চান?’
‘আগামী শনিবার দুপুর ১২টায়।’
‘আর কিছু?’ পাদ্রির প্রশ্ন।
‘না, আর কিছু নেই।’ থোর্ড মাথার টুপিটা একটু চেপে যেতে উদ্যত হলেন।
পাদ্রিও উঠে দাঁড়ালেন। তিনি থোর্ডের কাছে এগিয়ে গেলেন। থোর্ডের হাত ধরে তার চোখের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বললেন, ‘আপনার পুত্র আপনার জন্য আশীর্বাদ বয়ে আনুক, ঈশ্বরের কাছে এই প্রার্থনা করি!’

ষোল বছর পর একদিন। থোর্ড আবার পাদ্রির কাছে এলেন। থোর্ডের দিকে তাকিয়ে পাদ্রি তার চেহারায় কোন পরিবর্তনা না দেখে বললেন, ‘আপনার স্বাস্থ্য বয়সের তুলনায় খুব ভালো আছে দেখছি!’
‘কারণ আমার কোন অশান্তি বা ঝুট-ঝামেলা নেই।’ থোর্ড জবাব দিলেন।
পাদ্রি থোর্ডের কথার প্রত্যুত্তরে কিছু বললেন না। শুধু জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তা আজ এসেছেন কেন?’
‘আগামীকাল আমার ছেলে গির্জার সদস্য হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবে।’
‘আপনার পুত্র বুদ্ধিমান এবং মেধাবী।’
‘পাদ্রি মহোদয়ের পারিতোষিক পরিশোধ করার আগে আমার ছেলে গির্জায় কোন সারির কোথায় দাঁড়াবে জানতে এসেছি।’
‘সে প্রথম সারিতে সবার সামনে দাঁড়াবে।’
‘আমিও সে কথাই শুনেছি। এই নিন পাদ্রির পারিতোষিক ১০ ডলার।’
‘আপনার জন্য কি আমি আর কিছু করতে পারি?’ থোর্ডের দিকে নিবিষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে পাদ্রি জিজ্ঞাসা করলেন।
‘না, আর কিছু নেই।’
থোর্ড চলে গেলেন

আরও আট বছর কেটে গেল। একদিন পাদ্রি ঘরের বাইরে কোলাহলের আওয়াজ শুনতে পেলেন। দেখলেন, একদল লোক তার কাছে আসছে। সবার আগে থোর্ড। থোর্ড ঘরে ঢুকলেন।
পাদ্রি থোর্ডকে চিনতে পারলেন। বললেন, ‘কী ব্যাপার! আজ অনেক লোক নিয়ে এসেছেন দেখছি!’
‘গুডমান্ডের কন্যা কারেন স্টোরলিডেনের সঙ্গে আমার ছেলের বিয়ে। সে কথাই বলতে এসেছি। আপনাকে বিয়ের অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে হবে। গুডমান্ডও এসেছে। আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে।’ থোর্ড শেষের কথাগুলো গুডমান্ডকে দেখিয়ে পাদ্রিকে বললেন।
‘কারেন তো এ জেলার সবচেয়ে ধনী মেয়ে।’
‘হ্যাঁ, সবাই তা-ই বলে।’ থোর্ড মাথার চুলগুলো এক হাত দিয়ে ঠিক করতে করতে বললেন।
পাদ্রি বেশ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ বসে রইলেন। মনে হল, কি যেন ভাবছেন। তারপর কোন কথা না বলে বিয়ের খাতায় বর-কনের নাম লিখলেন। হবু শ্বশুররা খাতায় সই করলেন। থোর্ড টেবিলের রপর তিনটি ডলার রাখলেন।
‘এক ডলার দিলেই হবে। ওটাই আমার পারিতোষিক।’ পাদ্রি বললেন।
‘সে কথা আমি ভালো করেই জানি। কিন্তু আমার একমাত্র ছেলের বিয়ে। আমি কোন কার্পণ্য করতে চাই না।’ পাদ্রি আর কোন কথা না বলে টাকা তুলে নিয়ে থোর্ডকে বললেন, ‘আপনি এ নিয়ে আপনার পুত্রের জন্য এখানে তিনবার এলেন।’ ‘আমার আসার কাজ বোধহয় আজ শেষ হয়ে গেল।’ এ কথা বলে পাদ্রির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দলবলসহ থোর্ড চলে গেলেন।
এক সপ্তাহ পরের কথা। দিনটা বেশ শান্ত। পিতা-পুত্র নৌকা বেয়ে লেক দিয়ে বিয়ের আয়োজন ঠিকঠাক করতে স্টোরলিডেনদের বাড়ি যাচ্ছিল।
‘আমার আসনটা নড়ছে। ঠিক করে বসিয়ে নিচ্ছি।’ পুত্র তার আসন থেকে উঠে আসনটা ঠিকমতো বসাতে বসাতে বলল। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে নৌকার পাটাতলে পা পিছলে লেকে পড়ে গেল। হাত বাড়িয়ে নৌকাটা ধরতে গিয়েও পারল না। তার কণ্ঠ ছিঁড়ে একটা চিৎকার বের হয়ে এলো।
‘বৈঠাটা শক্ত করে ধর। পিতা এ কথা বলে আসন ছেড়ে ছেলের দিকে নিজের হাতের বৈঠা বাড়িয়ে দিলেন। পুত্র কয়েকবার চেষ্টা করে বৈঠা ধরতে পারল না। আস্তে আস্তে তার শরীর শক্ত হয়ে আসতে লাগল।
‘দাঁড়াও! আমি তোমার কাছে নৌকাটা ভেড়াচ্ছি।’ এ কথা বলে পিতা জোরে বৈঠা চালাতে লাগলেন। পুত্র পিতার দিকে শেষবারের মতো করুণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পানির নিচে তলিয়ে গেল।
থোর্ডের কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। তিনি নৌকা থামিয়ে পুত্র যেখানটায় তলিয়ে গেছে সেদিকে তাকিয়ে রইলেন। তার যেন মনে হচ্ছিল, এক্ষুনি তার পুত্র আবার ভেসে উঠবে। তার বদলে বুদ্বুদ উঠছে দেখতে পেলেন। কিছুক্ষণ পর আবার কিছু বুদ্বুদ। তারপর একটা বড় বুদ্বুদ উঠে ফেটে গেল। লেকের পানি আস্তে আস্তে আয়নার মতো মসৃণ আর নিস্তরঙ্গ হয়ে গেল।
তিন দিন আর তিন রাত্রি পিতা না খেয়ে না ঘুমিয়ে ছেলের ডুবে যাওয়ায় চারদিকে ঘুরে ঘুরে ছেলেকে খুঁজলেন। তিন দিন পর ছেলের লাশ পাওয়া গেল। পিতা কোলে করে ছেলের মৃতদেহ তার খামার বাড়িতে নিয়ে এলেন।
এ ঘটনার পর প্রায় এক বছর পর। শরৎকালের এক সন্ধ্যায় পাদ্রি তার দরজার সামনে পায়ের শব্দ শুনতে পেলেন। কে যেন দরজা খুলতে চেষ্টা করছে। পাদ্রি দরজা খুলে দিলেন। একজন লম্বা-পাতলা লোক ঘরে ঢুকল। শরীরটা সামনের দিকে নুয়ে গেছে। মাথার চুলগুলো সব সাদা। অনেকক্ষণ ধরে পাদ্রি লোকটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। চিনতে বেশ দেরি হল। চেহারা সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। পাদ্রি চিনতে পারলেন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন থোর্ড।
‘আপনি কি সন্ধ্যাবেলা হাঁটতে বের হয়েছেন?’ পাদ্রি থোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।
‘ও হ্যাঁ, অনেক রাত হয়ে গেছে, তাই না?’ থোর্ড কথাগুলো বলে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন।
পাদ্রিও বসলেন। তার মুখে কথা নেই। দু’জনেই নীরব। অনেকক্ষণ কেটে গেল। অবশেষে নীরবতা ভেঙে থোর্ড বললেন, ‘আমি গরিবদের জন্য আমার ছেলের নামে কিছু করতে চাই।’
থোর্ড উঠে এক থোকা টাকা টেবিলের ওপর রেখে আবার বসে পড়লেন। পাদ্রি টাকাগুলো গুনতে লাগলেন। গোনা শেষ হলে বললেন, ‘অনেক টাকা’।
‘আমার খামার বাড়ি আজ বিক্রি করে দিয়েছি। অর্ধেক টাকা আপনার হাতে তুলে দিলাম।’
‘আপনি কী করতে চান?’ মৃদুকণ্ঠে থোর্ডকে জিজ্ঞাসা করলেন পাদ্রি।
‘ভালো কিছু।’
দু’জনেই নীরবে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। থোর্ডের দৃষ্টি অবনত আর পাদ্রির দুই চোখ থোর্ডের ওপর নিবদ্ধ। অবশেষে পাদ্রি মৃদুস্বরে ধীরে ধীরে বললেন, ‘আপনার পুত্র অবশেষে আপনার জন্য সত্যিকারের আশীর্বাদ এনে দিয়েছে বলেই আমার মনে হচ্ছে।’
‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন, আমারও তাই মনে হয়।’ থোর্ড মুখ তুলে কথাগুলো বললেন। তার চোখ থেকে অশ্র“র দুটো বড় ফোঁটা ধীরে ধীরে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল।

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>