| 23 এপ্রিল 2024
Categories
লোকসংস্কৃতি

বাঙালি জাতির সমাজ পরিচয় ও ধর্ম

আনুমানিক পঠনকাল: 11 মিনিট

কোন একটি জাতি বা গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় দর্শনের মধ্যে সুপ্ত থাকে তাঁর ঐতিহাসিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট। কেননা মানুষ যেমন স্বয়ংভু নয় তেমনি সমাজ বিচ্ছিন্নও নয়। একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে ও পরিবেশে সে ও তার গোত্রটি সমাজে বিশেষ প্রভাব ছড়ায়। আর এজন্যই কোন গোত্রের ধর্ম , দর্শন ও সংস্কৃতির স্বরূপটি উদঘাটন করার আগে তার পারিপার্শিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ জরুরী হয়ে ওঠে।

বঙ্গদেশে(বর্তমান বাংলাদেশ নয়) চৈতন্য প্রভাবিত যুগ যেমন ঐতিহাসিক তেমনি চৈতন্যপূর্ব সময় বা কালও ঐতিহাসিক। সেই ঐতিহাসিক কাল পর্বের বাংলা, ইংরেজ আমলের সীমা দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল না। সেই সময় বাংলার সীমা নির্দেশিত হয়েছিল-
‘উত্তরে হিমালয় এবং হিমালয়ধৃত নেপাল, সিকিম ও ভোটান রাজ্য, উত্তর-পূর্ব দিকে ব্রহ্মপুত্র নদ ও উপত্যকা; উত্তর-পশ্চিম দিকে দ্বারবঙ্গ পর্যন্ত ভাগীরথীর উত্তর সমান্তরালবর্তী সমভূমি; পূর্ব দিকে গারো-খাসিয়া-জৈন্তিয়া-ত্রিপুরা-চট্টগ্রম শৈলশ্রেনৗ বাহিয়া দক্ষিণ সমূদ্র পর্যন্ত; পশ্চিমে অরণ্যময় মালভূমি; দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর।১ ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় বলেন-‘ এই প্রাকৃতিক সীমা বিধৃত ভূমিখন্ডের মধ্যেই প্রচীন বাঙলার গৌড়-পুন্ড্র-বরেন্দ্রী-রাঢ়- সুহ্ম-তাম্রলিপ্তি- সমতট-বঙ্গ-বঙ্গাল-হরিকেল প্রভৃতি জনপদ; ভাগীরথী-করতোয়া-ব্রহ্মপুত্র-পদ্মা মেঘনা এবং আরো অসংখ্য নদ-নদী বিধৌত বাঙলার গ্রাম, প্রান্তর, পাহাড়, কান্তার। এই ভূমিখন্ডই ঐতিহাসিক কালের বাঙালীর কর্ম ও নর্মভূমি।’২ বৃৃহত্তর এই বাঙলার সামাজিক পরিচয় সম্পর্কে জানতে গবেষকগণ একে দুটি বিশেষ সময় পর্বে ভাগ করেছেন- ১. আদি বৈদিক বা ঋকবৈদিক যুগ ও ২. উত্তর বৈদিক যুগ।
‘ঋক বৈদিক পর্বের সূচনা ১৮০০ বা ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। অনেকে মনে করেন ঋকবেদের শেষ স্তোস্ত্রগুলো গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাবের অন্তত ৫০০ বছর পূর্বে রচিত হয়েছিল। সে হিসেবে ১০০ খ্রি:পূ: নাগাদ ঋক বৈদিকের শেষ স্তোস্ত্রগুলো রচিত হয়েছিল বলে অনুমিত হয়। এ বিবেচনায় খ্রি:পূ ১৮০০ থেকে খ্রি:পূ ৯০০ একালপর্ব ঋক বৈদিক কাল হিসেবে আনুমিত হয়’৩। আর উত্তর বৈদিক যুগের বিস্তৃতি আনুমানিক ১০০০ থেকে ৬০০ খ্রি:পূ: পর্যন্ত। গবেষণায় প্রমাণ হয়েছে যে ঋক বৈদিক যুগে আর্যরা বঙ্গদেশ সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানতে পারেনি। খ্রিস্টের জন্মের ২০০০ বছর আগে আর্যরা ভারতে প্রবেশ করলেও বঙ্গদেশে তাদেরও অনুপ্রবেশ ঘটে আরো অনেক পরে। ধারণা করা হয় এদেশে আর্যদের অধিকারে আসে গুপ্তযুগের কিছু আগে অর্থাৎ উত্তর বৈদিক যুগের শেষ পর্বে। গবেষকগণ বলেন যে, ঋকবৈদিক পর্বে বঙ্গে আর্যদের কোন অস্তিত্ব ছিল না। এ সময় বঙ্গদেশে আদিম অধিবাসীদের ধর্মই প্রচলিত ছিল। এ ধর্মকে ড. অতুল সুর প্রাক-আর্য ধর্ম বলে অভিহিত করেন। ‘মৃত্যুর পর আত্মার অস্তিতে বিশ্বাস, মৃতব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধা, বিবিধ ঐন্দ্রজালিক প্রক্রিয়া ও মন্ত্রাদি, মানুষ ও প্রকৃতির সৃজন শক্তিকে মাতৃকারূপে পূজা, ‘টোটেম’এর প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা এবং গ্রাম, নদী, বৃক্ষ, অরণ্য, পর্বত ও ভ‚মির মধ্যে নিহিত শক্তির পূজা, মানুষের ব্যাধি ও দূর্ঘটনাসমূহ দুষ্ট শক্তি বা ভূতপ্রেত দ্বারা সংঘটিত হয় বলে বিশ্বাস ও বিবিধ নিষেধজ্ঞা-জ্ঞাপক অনুশাসন ইত্যাদি নিয়েই প্রাক-আর্য ধর্ম গঠিত ছিল।’৪
ড. শিবপ্রসাদ ভট্টাচার্য ভারতীয় সভ্যতার সাথে বিশ্বের আদিম সংস্কৃতির মিল খুঁজে পান-“আদিম সভ্যতার যুগে ভারতীয় জীবনের এই জাতীয় যাদুশক্তি বা প্রজননশক্তি পূজার পেছনে যেমনটি সক্রিয়, অত্যন্ত বিস্ময়ের কথা, বর্হিভারতে, সুদূর ইউরোপ, আফ্রিকা, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে ও সভ্যতার এই পর্বে মানব মনের ধ্যান-ধারণা অবিকল এক ও অভিন্ন”।৫ কেবল দেবীপ্রসাদই নন, একই মত প্রকাশ করেন ড. নীহাররঞ্জণ রায়ও। “প্রাচ্য দেশে অবৈদিক ব্রাত্য ধর্মের প্রসার ছিল এতথ্য সুবিদিত। অথর্ব বেদের সঙ্গে যোগধর্মের সম্বন্ধ বোধহয় ছিল ঘনিষ্ট এবং এই যোগধর্মের অভ্যাস ও আচরণ প্রাচীন বাংলারও হয়তো অজ্ঞাত ছিল না। কিন্তু, যোগধর্মের সঙ্গে বৈদিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মের কোন ঘনিষ্ট সম্বন্ধ ছিল, এমন মনে করবার কারণ নাই। বরং সিন্ধু-সভ্যতার আবিষ্কারে পন্ডিতেরা মনে করতে আরম্ভ করিয়াছেন যোগধর্ম প্রাক-বৈদিক এবং শৈব ও তান্ত্রিক ধর্মের সঙ্গে যোগের সম্বন্ধ ঐতিহাসিক পর্বের।”৬ দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় তন্ত্রসাধনার প্রবল প্রভাব লক্ষ করে ভারতীয় ধর্মচর্চার ধারাকে প্রধান দুইটি ভাগে ভাগ করেছেন। একটি বৈদিক ধারা অপরটি তান্ত্রিক ধারা। ড. রতনকুমার নন্দী বলেন- ‘বাংলার আদি ধর্ম বিশ্বাস ও ধর্মাচারে এই তান্ত্রিক সাধন পদ্ধতির ব্যাপক প্রচলন ছিল। পরবর্তীকালের বাংলার ধর্মাচারে এই প্রভাব ক্রিয়াশীল ছিল’৭। পরবর্তীকালে বৌদ্ধ, জৈন., শাক্ত, বৈষ্ণব প্রভৃতি সম্প্রদায়ের দর্শনের সাথে সক্রিয় হয়েছে তন্ত্র সাধন পদ্ধতি বা তান্ত্রিক ধারা। বাংলার সহজিয় সাধনা বলতে যা বোঝায় তার মধ্যেও তন্ত্রাচার ক্রিয়াশীল।

সমাজের প্রান্তিক স্তরের মানুষের মধ্যে আর্যপূর্ব ধ্যানধারণা ও সংস্কৃতির অস্তিত্ব সবচেয়ে বেশি লক্ষ করা যায়। ভারতে আর্য আগমনের পর তাদের প্রভাবে বৈদিক ধর্মমত ব্যাপক পরিচিতি পায় যারা কিনা বেদের অপৌরেষেয়ত্বে বিশ্বাস করে। কিন্তু বৈদিক ব্রাহ্মণ্যবাদের কট্টর নীতির জন্য সমাজের নিন্ম স্তরের মানুষ বৈদিক ধর্মাচারের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে ভারতীয় ধর্মচিন্তার জগতে প্রতিবাদী ধর্মমতের আবির্ভাব ঘটে। ব্রাহ্মণদের সর্বাত্মক প্রাধান্যের বিরুদ্ধে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের মত অন্যান্য নতুন ধর্মমতাদর্শীরাও বৈদিক যাগ-যজ্ঞ ও ক্রিয়া কর্মের অসারতা ঘোষণা করতে থাকে। এসব প্রতিবাদী ধর্মমতে গৃহিত হতে থাকে সর্বশ্রেণির মানুষের সমান অধিকার।
জৈন, আজৗবিক ও বৌদ্ধ এই তিনটি ধর্মমতই বেদ-বিরোধী। ইতিহাস সাক্ষদেয় যে- বৌদ্ধদের তুলনায় জৈনরা বাঙলাদেশের খোঁজখবর একটু বেশি জানতেন। তাদের প্রতিষ্ঠাকালে ও প্রসার কালে তারা বাঙালাকে চারটি ধর্মাঞ্চলে বিভক্ত করে ভিক্ষুদের শ্রেণিবিভাগ করেছিলেন- ১. তামলিত্তিয়া-তাম্রলিপ্ত অর্থাৎ (মেদিনীপুর) ২. কোডিবর্ষীয়া, বা কোটীবর্ষ অর্থাৎ (দিনাজপুর) ৩. পোংডবর্ধনীয়া, পুন্ড্রবর্ধন অর্থাৎ (বগুড়া) এবং ৪. খব্বডিয়া, খর্বাট বা কর্বট অর্থাৎ পশ্চিম বঙ্গের কোন স্থান।৮ জৈন ধর্মাবলীদের একটি বড় অংশ ছিল দিগম্বর সম্প্রদায় যারা নগ্ন অবস্থায় চলাফেরা করত। জৈন সম্প্রদায়কে নির্গ্রন্থ সম্প্রদায়ও বলা হয়। জৈন সম্প্রদায়ের মতো আজীবিক সম্প্রদায়ও বাঙলাদেশে প্রভাব বিস্তার করেছিল। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, ‘সম্রাট অশোকের সময় আজীবিকরা বাঙলাদেশে বেশ সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় ছিল এবং জৈনদের সঙ্গে তাদের বিশেষ প্রভেদ ছিল না। জৈনধর্মের প্রতিষ্ঠাতা মহাবীর এবং আজীকিব ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গোসাল ছিলেন পরস্পর বন্ধু। তারা একত্রে ছয় বছর বজ্রভ‚মিতে কাটিয়েছিলেন। বুদ্ধের জন্মের প্রায় দুই শ বছর আগে অর্থাৎ খি.পূ. ষষ্ঠ শতকে তারা জন্ম গ্রহণ করেন। এদিকে বৌদ্ধ ধর্ম বুদ্ধের আমল থেকেই বাংলাদেশে প্রসার লাভ করে। ততদিনে একটু একটু করে ব্রাহ্মন্যধর্ম বাংলার বিস্তার লাভ করতে শুরু করেছে। ৯

মৌর্য সম্রাট অশোকের আমলে বৌদ্ধধর্ম বাংলায় সুপ্রতিষ্ঠিত ধর্ম। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে পুন্ড্রবর্ধনে বৌদ্ধধর্ম প্রসার লাভ করে। প্রাচীন কালের বৌদ্ধধর্ম ছিল থেরবাদী। এরা শূন্যতা জ্ঞান পূর্বক মোহমুক্তি বা নির্বাণ লাভে সচেষ্ট ছিলেন। এরা ছিলেন হীনযানপন্থি। এর অব্যবহিত পরে মহাযানপন্থির আবির্ভাব। অষ্ঠম ও নবম শতকেই বৌদ্ধধর্মে গুহ্য সাধনতত্ত্ব, নীতিপদ্ধতি ও পূজাচারের প্রভাব লক্ষ করার মত। বাংলাদেশে এরা তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মের বিশেষ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কেননা শূন্য ও বিজ্ঞানের দর্শন সাধারণ মানুষের ভেদবুদ্ধির অতীত। তারা বরং আদি সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কযুক্ত মতবাদে তুষ্ট থাকতে পছন্দ করে। ফলে পাল আমলে এই সব সিদ্ধাচার্যদের উপস্থিতি লক্ষ করার মত। এরাই প্রথম তন্ত্রের গূঢ় সাধন পদ্ধতি লিখিত রূপে প্রকাশ করে। এই সাধনতন্ত্রকে বজ্রযান বা সহজিয়া সাধন পদ্ধতিও বলা হয়। এরা শরীর বা কায়াকে পৃথিবীর সঙ্গে তুলনা করেন। বজ্রযানীদের মতে আদিবুদ্ধ হচ্ছে সৃষ্টির কারণ, তিনি শূন্য আর শূন্যই হচ্ছে বজ্র। একক অবস্থায় তিনি শূন্য আর প্রজ্ঞাপারমিতার সাথে যুক্ত হয়ে তিনি বোধিচিত্ত। একটি শূন্যতা অপরটি করুনা।

বোধিজির মহাসুখের অনুভূতি ছাড়া আর কোন অনুভূতি থাকে না এই মহাসুখের মধ্যে চিত্তের নিমাজ্জিত হওয়াই পরম নিধান।

প্রাচীন বাঙলার তান্ত্রিক ধর্মের ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণে বৌদ্ধ সিদ্ধাচর্যরা বৌদ্ধতান্ত্রিক ধর্মের প্রবর্তন করেছিলেন বলে জানান ড. অতুল সুর। তান্ত্রিক সাধনায় যৌন মিলন অবশ্যপালনীয়।

গুপ্তযুগে ব্রাহ্মন্য ধর্ম বাংলায় অনুপ্রবেশ করলেও এর বিকাশ ও প্রসার লাভ করেছিল তন্ত্রসাধনার মাধ্যমে। বৈদিকধর্মে তন্ত্রের কোন স্থান নেই কিন্তু গুপ্তযুগেই তারা অজ্ঞাত সব দেব দেবীর শুভদৃষ্টি লাভ করেন ফলে বৈদিকধর্ম সম্পূর্ণ ভাবে নতুন রূপ লাভ করে। শুধু তাই নয়, এ যুগেই তারা বৈদিক আচার অনুষ্ঠানে অবৈদিক আচার অনুষ্ঠান ও পূজা পার্বণে অভ্যস্ত হয়ে পরেন। পুরান ও তন্ত্র পুঁথির রচনাও শুরু হয়ে যায় এ যুগে।
ড. সুর বলেন, পাল রাজাগণ বৌদ্ধ হলেও ব্রাহ্মন্য ধর্মের যথেষ্ট পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। আর সেন রাজাগনের তো কথাই নেই, তারা ব্রহ্মন্যধর্ম প্রসারের কাজে নিজেদের ব্যপৃত রেখেছিলেন। বস্তুত তাঁদের সময়েই বাঙলায় ব্রাহ্মন্যধর্ম তুঙ্গে উঠেছিল। কিন্তু সম্ভবত ব্রাহ্মন্য ও বৌদ্ধ ধর্ম সমধারায় প্রবাহিত হয়ে উভয়ে উভয়কে প্রভাবান্বিত করেছিল। বস্তুত মুসলমান যুগের অনতিপূর্বে উভয়ধর্মই বাঙালার নিজস্ব তন্ত্রধর্ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল । প্রাক বৈদিকধর্মের আচরনীয় ক্রিয়াকর্মই এর মূল ভিত্তি। শুদ্ধচারী ব্রাহ্মণ বা বৌদ্ধ কেউ এই তন্ত্রধর্মের কথা ভাবতে পারেননি। ড. সুর বলেন, তন্ত্রধর্মের উদ্ভব হয়েছিল নবোপালীয় যুগে ভূমি কর্ষণের ব্যপার নিয়ে। তন্ত্রধর্ম বহুল দেবদেবী নির্ভর যা ক্রমে বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য বা বৈদিক ধর্মকে আছন্ন করে ফেলে। এ প্রসঙ্গে নাীহাররঞ্জন রায় বলেন- “এইভাবে ধীরে ধীরে বেদবিরোধী, যজ্ঞবিরোধী- বুদ্ধদেব ব্রাহ্মণ্য ধ্যানের স্বাঙ্গীকৃত হইয়া গেলেন। বৌদ্ধ ধর্মের তন্ত্রমার্গী সাধনা ও ব্রাহ্মণ্য তন্ত্রমার্গী সাধনার সঙ্গে মিলিয়া প্রায় এক হইয়া গেল। বৌদ্ধদেবায়তন আর ব্রাহ্মন্য দেবায়তনে প্রতিমার রূপ কল্পনার পার্থক্য প্রায় আর রহিল না।”১০

এই মিশ্রনই বাঙলায় নানারকম লোকায়তধর্মের জন্ম দিয়েছিল। যেমন বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকদের মাধ্যমেই সৃষ্টি হয়েছিল নাথধর্ম। তেমনি ব্রাহ্মন্য তান্ত্রিক সাধকদের শাখাও বিস্তৃত হয়ে সৃষ্টি হয়েছিল বৈষ্ণব ধর্মের। কালক্রমে নানা রকম বিষ্ণুমূর্তির মধ্যেও বৌদ্ধের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। পৌরাণিক বিষ্ণু কালক্রমে মৌখিক দেবায়তনে বিস্তার লাভ করেন পাল ও সেন পর্বে। এছাড়া জৈন ও আজীকিব সম্প্রদায়ের মত সাধনপন্থি ছিল অবধূতমার্গীরা। এরা ভিক্ষান্নে জীবন ধারণ করত, এরা বর্ণশ্রম মানতনা, শাস্ত্র মানত না। কোন কিছুতেই এদের আসক্তি ছিল না এরা ছিল উন্মাদ বা পাগল।

বাংলাদেশে প্রায় গোড়ার দিকে যারা বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের সাধনপন্থা, বিশেষ কওে যারা বজ্রযানী-সহযানীদের তন্ত্রপদ্ধতি মেনে চলেছেন তারা বাউল। এরা কায়া সাধনাকেই মুক্তির উপায় বলে মনে করে। এরাও অবধূতমার্গীদের মতই অনেকটা উন্মাদ। এদিকে আবার বলা হয়ে থাকে যে, বৌদ্ধধর্মের উৎপত্তি সাংখ্য মত থেকে। বুদ্ধদেবের গুরু আড়ার কলম ও উদ্রেক দুজনই ছিলেন সাংখ্যাবলম্বী।১১
আর সাংখ্য দর্শনেও পুরুষ-প্রকৃতির আদি-মৈথুন স্বীকৃত। যা তান্ত্রিকদের কায়সাধনকে উস্কে দেয়।

বাউল মতাবলম্বীরাও ‘দেহের সাধন’কে ‘সর্বসার’ বলে মনে করেন।

যতই ব্রাহ্মন্য ধর্ম লোকায়ত ধর্মের আচার-অনুষ্ঠান রপ্ত করুক না কেন, কৌলিন্য প্রথা তৎকালীন বাঙালিসমাজকে কলুষিত করে দিয়েছিল। পাল ও গুপ্তযুগে এ প্রথা বা বর্ণশ্রম মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারলেও সেনামলে এসে কৌলিন্য প্রথা জন্ম দেয় ভয়ানক সব অমানবিয় প্রথার। কৌলিন্য যেহেতু বজায় রাখতে হত মেয়ের দিক থেকে তাই ব্রাহ্মন কুলিনের মেয়েকে বিয়ে দেয়া হত কম বয়সেই তাছাড়া ব্রাহ্মন ছেলে যে কোন মেয়ে বিয়ে করতে পারলেও ব্রাহ্মন কুলিনের মেয়েকে কুল রাখতে হত। ব্রাহ্মনের ছেলেকে বিয়ে কারার মাধ্যমে। ফলে সমাজের চেহারাটাই ভয়ংকর রূপধারণ করতে শুরু করল এসময়। বয়স্ক পাত্রের সাথে বিয়ের ফলে-বৈধব্য বরন করতে হত মেয়েদের। পাত্র না পাওয়া গেলে দেবদাসী হিসেবে মন্দিরে জীবন পার করতে হত। কখনও কখনও ব্রাহ্মন বাপ তার মেয়েকে গঙ্গায় ভাসিয়েও দিতো। এসময়ই প্রাদুর্ভব ঘটল সহমরন প্রথার। এভাবে মধ্যযুগের সমাজ ব্যবস্থায় শ্রেনির ভেদজ্ঞান তৈরী হয়েছিল মারাত্মক ভাবে। শুধু তাই নয় এই দূরত্ব উস্কেও দেয়া হতে লাগল। নানারকম প্রাত্যহিক আচার আচরনেও তৈরী হল বিধি-বিধান যেমন- “রজক, কর্মকার, নট, বরুড়, কৈবর্ত, মেদ, ভিল্ল, চন্ডাল, পুককশ, কাপালিক, নর্তক, তক্ষন, সুবর্নকার, শৌডিক এবং পতিত ও নিষিদ্ধ বৃত্তিজীবী ব্রাহ্মণদের দ্বারা স্পৃষ্ট বা পক্ক খাদ্য ব্রাহ্মণের পক্ষে ভক্ষন নিষিদ্ধ ছিল, এই নিষেধ অমান্য করিলে প্রায়শ্চিত করিতে হইত। শূদ্র পক্ক অন্ন ভক্ষনও নিষিদ্ধ ছিল, নিষেধ অমান্যা করিলে পূর্ণকৃচদ্র প্রায়শ্চিত্তের বিধান ছিল।”১২ এছাড়া ব্রাহ্মন-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শুদ্র কেউ-ই চন্ডাল ও অন্ত্যজদের পাত্রের জল পান করতে পারত না, করলে পুরোপুরি প্রায়শ্চিত করতে হত।

এই নিকৃষ্ট প্রথাটি অর্থাৎ ব্রাহ্মন্য আধিপাত্যবাদকে উস্কে দিয়েছিল গুপ্তযুগের রাজারাই। গুপ্তযুগের রাজা কতৃক ব্রাহ্মনদের ‘ভূমিপ্রথা’ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ভাবে রাষ্ট্রকে সামন্ততন্ত্রের দিকে ধাবিত করেছিল। ভূমি দানের কারনে ব্রাহ্মন প্রভুত্বের পথ সুগম হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে রাম শরন শর্মা বলেন “অতঃপর ভূমিদানের বহুল ব্যবহার শুধু যে ব্রাহ্মন প্রভুত্বের পথ সুগম করে দিয়েছিলো তাই নয়, ব্রাহ্মনরা শাসন কার্য পরিচালনা করতেন রাজ্য পুরুষদের ক্ষমতার বাইরে থেকে, প্রায় স্বাধীনভাবে। তাদের কোন রাজকীয় পদস্থ ব্যক্তির অধীনে থাকতে হত না।”১৩

নীহাররঞ্জন রায় বলেন-‘গুপ্ত আমলেই দেখিয়াছি, এই রাজতন্ত্র ছিল সামন্ততন্ত্র নির্ভর। এই আমলেও দেখিতেছি তাহার ব্যতিক্রম নাই বরং সামন্ততন্ত্রের প্রসারই দেখা যাইতেছে।”১৪এজন্য সেন আমলের রাষ্ট্র সংঘকে বলা হয়-ব্রাহ্মন তান্ত্রিক সেন রাষ্ট্র যার সংবিধান হল স্মৃতি পুরান। বলা হয়ে থাকে সেনযুগে রচিত স্মৃতি ও পুরানে ব্রহ্মন সমাজের সংরক্ষনী মনোভাবই পরিস্কার হয়ে উঠেছিল।১৫

ব্রাহ্মন্যবাদের কঠোর বিধি নিষেধের মধ্যে তুর্কি বিজয় ভারতের ইতিহাসে একটি নতুন যুগের সূচনা করে। দ্বাদশ শতক থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত এই যুগের বিস্তার যার নাম ‘মধ্যযুগ’। এসময় পর্বে পাঠান-মোঘল ও তাদের সুবেদাররা এবং নবাবরা ছিলেন শাসক। কেন্দ্রিয় মুঘল শাসনের ফলে বাঙলায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা হলেও ধর্মান্ধতার প্রতিক্রিয়ার ফলে তা টিকে থাকেনি । ফলে ত্রয়োদশ ও চর্তুদশ শতক ইতিহাসে ঘোর অন্ধকারাচ্ছন্ন সময় ছিল। তবে এর ভিতর দিয়েই বাঙালির বিবর্তন সূচিত হতে থাকে ।

“ তুর্কি মুসলমান আক্রমনের পর হিন্দু সমাজে তাহার পুরাতন খুঁটি ধরিয়া বসিয়া থাকে নাই। হিন্দু সমাজে বিপুল পরিবত’ন সাধিত হইয়াছে; বাহিরের আক্রমন এবং অব্যন্তরীন কর্মব্যবস্থায় সংরক্ষনশীলতার ফলে বর্তমান হিন্দু সমাজ বিবর্তিত হইয়াছে”।১৬ বাঙালি যখন সেনদের আমলাতান্ত্রিক শক্তি ও ব্রহ্মন্যবাদের আস্ফালনে নুব্জ তখন তুর্কি বিজয়ের ফলে এদের মধ্যে একটি মিশ্্রন প্রক্রিয়া সূচিত হল এবং এই অন্ধকার পর্বজুড়ে এই প্রক্রিয়ায় বাঙালি একটি ঐক্যবদ্ধ চেহারা লাভ করে।১৭তা সত্বেও  সমকালীন হিন্দু ও মুসলমান তাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে উপাদানগত বহু সাদৃশ্য থাকা সত্বেও পারালাল ভাবে চলছে-কোন সমন্বিত অভিপ্রায় সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়নি ফলে-‘হিন্দু সমাজ যে একটি প্রতিরোধী সাংস্কৃতিক ঐক্য গড়েছে মুসলমান সমাজের কাছে তা তাৎপর্যহীন।’১৮ আর এভাবে বাঙালি সমাজে নতুন সংকট ক্রমে হাজির হয়ে যায় কেননা উভয়ের সামাজিক মনস্তত্ত্বের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য বা ভিন্নতা রয়েছে।
প্রাক ইসলামপর্বে ভারতবর্ষে বিভিন্ন জাতির আগমন ঘটেছে। এই সব সম্প্রদায় অচিরেই ভাব বিনিময়ের সূত্রে ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গেই মিশে গিয়েছিল, কিন্তু ইসলামের ক্ষেত্রে তা ঘটল না। বাংলা এবং সাধারণ ভাবে ভারতেও ইসলাম আপন স্বতন্ত্র বজায় রাখতে সক্ষম হয়।১৯ এর কারণ উল্লেখ করে আল বিরুনী বলেন- “ধর্ম বিষয়ে উভয়ের ধারণা একেবারে আলাদা, হিন্দুরা যাহা বিশ্বাস করে আমরা তাহার কিছুবই বিশ্বাস করি না, আমরা যাহা বিশ্বাস করি হিন্দুরা তাহার কিছুই বিশ্বাস করে না।”২০ ফলে ইসলাম আবির্ভাবের পর হিন্দু মুসলমানের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হলো সেই দ্বন্দ্ব  ইসলামই সর্বাধিক সুবিধা লাভ করে। এর কারণ, ধর্মীয় বিষয়ে ইসলামে প্রবেশের সুবিধা বেশি, কিন্তু হিন্দু ধর্মে সেই সুযোগ নেই বললে চলে। যেমন- ব্রাহ্মণ্যবাদে প্রবেশের চেয়ে বহিষ্কারের সুযোগ বেশি ছিল। ব্রাহ্মণদের ধর্মীয় গোড়ামী এত প্রকট ছিলো যে সমাজের সাধারণ মানুষ আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলো ইসলামের পতাকা তলে। ইসলামের মূল কথা হলো-“ সামাজিক সাম্য”। আর এভাবেই ভারতে ইসলামের প্রসার সহজ হয়ে গিয়েছিলো।
বিরামহীন রাজনৈতিক দুর্য়োগ, হিংসা বিদ্বেষ যুদ্ধ বিগ্রহ নারী ও সিংহাসন লোভী রাজপুরুষের বর্বরতা অন্তর্দন্দ, জায়গীর প্রথা, রাজকর্মচারীদের বিদ্রোহ, ভূম্যাধিকারী প্রাপ্ত ব্যাক্তিদের অনৈতিক উচ্চাভিলাষ ইত্যাদি নানা কারণে বাংলা ও বাঙালির সমাজ ও মানসপটে বিভিষিকাচ্ছন্ন হয়ে যায়। এ সময় পর্বে সবচেয়ে দুর্ভোগের শিকার হয় নিন্মবর্গের মানুষ ও নারী। দাসপ্রথা মারাত্মক  আকার ধারন করে। জোর করে ধর্মান্তকরণের প্রক্রিয়া এবং নারী ধর্ষনের মাধ্যমে ধর্মন্তকরণও অব্যাহত থাকে। এ সময় ধর্ষিতা নারীর হিন্দু সমাজে ঠাঁই ছিল না। বাধ্য হয়ে সে মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করত।
খ্রিস্টিয় ত্রয়োদশ শতকের শেষ দিকে বাংলায় মুসলমান বিজয় শুরু হলেও এই শতকেই তারা বাংলা অধিকার করতে সক্ষম হয়। চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতকে নানা রকম রাজনৈতিক সংঘাত ও ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে ইসলাম ধারাবাহিক ভাবে ধর্মীয় ও ও সামাজিক ক্ষেত্রে বিজয়ী হতে থাকে। কিন্তু নিন্ম শ্রেণির ধর্মান্তরিত বাঙালি শেষ পর্যন্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম হলেও এরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাদের পূর্ব সংস্কার ত্যাগ করতে পারেনি। এ প্রসঙ্গে গোপাল হালদার বলেন-“সাধারণ পল্লীজীবী বাঙালী মুসলমান শরিয়তি ইসলামকে গ্রহণ করতে থাকে অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকে। তৎপূর্বে শরিয়তি জীবনযাত্রা প্রভাব বিস্তার করিতে পারিত একমাত্র শহর ও রাজধানীর নিকটস্থ মুসলমানদেও উপর, দূর পল্লীগ্রামের জনতার উপর নয়।”২১ অচিরেই নও মুসলিমরা যে আশায় ইসলাম গ্রহণ করে সেই আশাও দুরাশায় পর্যবসিত হয়। শহুরে শরিয়তপন্থি পীর ফকিরদের নানা রকম ফতোয়ায় পল্লীর সাধারণ নও মুসলিমরা অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে।
নিন্ম বর্গের মানুষের পরিস্থিতি যখন ত্রাহি ত্রাহি তখন চৈতন্যদেবের আবির্ভাব সেই সময়ের এক বৈপ্লবিক ঘটনা। চৈতন্যদেব প্রবর্তিত ধর্মমতে সমাজে ভেদাভেদে ও তারতম্য ঘুচে গেল।ফলে সেখানে সমাজের অন্ত্যজ মানুষ আশ্রয় পেল , মর্যাদা পেল। যবন হরিদাসকে বুকে টেনে নেবার ঘটনা এপ্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পরে। জাতিভেদ দূর করতে তিনি সাম্যবাদের উপর গুরুত্ব দেন। প্রেম আর ভাতৃত্বের আহ্বানই ছিল চৈতন্যদেবের বৈষ্ণব ধর্মের মূল শ্লোগান। তিনি ভক্তি মার্গের মন্ত্রোচায়ন করে মানুষের মুক্তির পথ বাতলে দেন। জ্ঞান নয়, কর্ম নয় বরং ভক্তিপূর্ন প্রেমই স্রষ্টালাভের পরম উপায়। বেদে প্রবর্তীত বৈষ্ণব ধর্ম তার শাস্ত্রিয় খোলস ছেড়ে গৌড়িয় বৈষ্ণবে পূর্নতা পায়। কেননা চৈতন্যদেবের মতবাদ ছিল বেদ বিরোধী।২২ কেবল হরি নাম সংকীর্তনেই সাধারণ মানুষের হৃদয়ের আবেগ ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। ঈশ্বর প্রেমে উন্মাদ হয়ে তাঁর সহচর হয়েছে অনেকেই। নদীয়া থেকে নবদ্বীপ, ওড়িশা ও বাংলায় তখন হরি নামের জয় জয়কার। চৈতন্যের ধর্ম এই আহ্বানে ‘ষোল শতকেই বাংলায় ইসলামের অব্যাহত প্রসার রুদ্ধ হয়ে যায়।২৩

এদিকে বাঙালার মুসলিম সমাজে শাস্ত্রীয় ইসলাম প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হয়নি। কেননা এদেশের জল হাওয়ার ভাববাদ, তন্ত্র যোগ। ‘ফলে, আঁটঘাট বাধা শাস্ত্রীয় ইসলামের গভীর বাহিরে আসিয়া, যে সকল সুফিগণ ইসলামের সহিত এদেশীয় চিন্তাধারার যোগ ঘটাইলেন, তাঁহারাই সাধারণ শ্রেণির মুসলমানের হৃদয় অধিকার করিলেন। ইহাতে ফল হইল এই যে, বাঙ্গালার সাধারণ শ্রেনীর মুসলমানদের মধ্যে এমন একপ্রকার নতুন ইসলাম জন্মলাভ করিল, যাহাকে লৌকিক ইসলাম’ বলিয়া নাম দেয়া যায়। ইহাতে হিন্দুধর্মস্থান পাইয়াছে, বৌদ্ধধর্ম জায়গা করিয়া লইয়াছে এবং অনার্য্য ও বৈষ্ণব-বিশ্বাস প্রবেশ করিয়াছে।’২৪ বৈষ্ণব ধর্মের মত সুফি ধর্ম হচ্ছে প্রেমবাদ। আত্মবিস্মৃত হয়ে প্রীতিদান করাই হচ্ছে একজন সুফি সাধকের কাজ। ‘সুফিদের ভাববাদে বৈদান্তিক সর্বেশ্বরবাদের প্রভাব থাকলেও বৌদ্ধদের নিধানবাদও ফানাতত্ত্বের উন্মেষের সহায়ক হয়েছে, সে সঙ্গে গুরুবাদও।’২৫সব মরমীয়া ভাবধারার
তত্ত্ব সমন্বিত করার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয় সুফিবাদে। তা সত্ত্বের পাক-ভারত উপমহাদেশে চারটি সূফি মতবাদ লক্ষ করা যায়। যে গুলোর একটির সাথে অন্যটির বিস্তর ফারাক। আহমদ শরীফ বলেন-নকশাবন্দীয়া মতবাদে ও সাধনতত্বে ভারতীয় দেহতত্ব ও যোগের প্রভাব পরেছে সবচেয়ে বেশী’।২৬ একারণেই বাঙালির সংস্কৃতিতে ধর্ম একটি বিশেষ শাস্ত্রীয় বিধান হয়ে উঠতে পারেনি। এখানে লোকায়ত বলয়ের বাইরে যেতে পারেনি শাস্ত্র সর্বস্ব ধর্মগুলোও। আর এভাবে বাঙলা হয়ে ওঠে আউল-বাউল লালনের দেশ। প্রাচীন বাঙলায় বাউলমার্গের সন্ধান পাওয়া গেলেও বাউল মতবাদের উৎপত্তি চৈতন্যোত্তর যুগে। গবেষকগন বাংলার বাউলমতবাদকে সহজিয়া বৌদ্ধ সাধনার স্পষ্ট প্রভাব লক্ষ করেছেন। আহমদ শরীফ ‘বাউলদের উপর মুসলিম প্রভাব বা সূফী মতের প্রত্যক্ষ সংযোগ লক্ষ করেছেন।’২৭ কিন্তু ইরানে ইসলাম ও আর্যসভ্যতার সংমিশ্রণে যে সুফিমতের উদ্ধব হয়েছে তা ভারতে এসে রুপান্তরিত হয়ে যায়। বৌদ্ধ ও নাথদের সংস্পর্শে এসে দেশী সূফী-মত হিসেবে পরিচিত হয়। এর পরবর্তী সময় চৈতন্য মতবাদের প্রভাবে সূফী মতবাদকে বাউল মতবাদের উদ্ভব ঘটায়।২৮

বাউল মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হবার পর ‘শেষ আঠারো শতকে পূর্ব ও উত্তর বঙ্গের বিপুল পরিমান শূদ্র ও গরিব মুসলমান বাউল বা ফকিরি ধর্মে দীক্ষা নিয়ে বৃহত্তর হিন্দু ও মুসলিম সমাজ ত্যাগ করতে থাকে। দেখা যায়, বাউল ফকিরদের মধ্যে মুসলমান ধর্মত্যাগীদের সংখ্যাছিল খুব বেশি।’২৯

কিন্তু শরিয়তবাদী মুসলিমদের কারণে বাউলরা নান রকম নির্যাতন নিপীড়নের শিকার হয়। তাদের ঝুঁটি কেটে নেয়া হয়। ওহাবী, ফারায়জী ও আহলে হাদীস আন্দোলন মুসলিম বাউলদের বিরুদ্ধে ফতোয়াজারি করে। শরিয়তপন্থিদের দলে ফিরেয়ে আনার জন্য বাউলদের উপর অত্যাচার আর উৎপীড়নের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। জানা যায় অভিভক্ত বাংলায় তখন ষাট লক্ষ বাউল ছিল।৩০ এখনও বাংলার বাউলেরা কোনঠাসা হলেও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। বাউল মতবাদের গুরুদের সৎ জীবন যাপন, অসাম্প্রদায়িক আদর্শ, সমন্বয়বাদী চিন্তা এবং সরল ও উদার মানসিকতা বাউল সম্প্রদায়কে আজো টিকিয়ে রেখেছে। কাজি আবদুল ওদুদ জানান- ‘ইসলাম কিভাবে বাঙালীর জীবনে সার্থকতা লাভ করবে, তার সন্ধান যতটুকু পাওয়া যাবে বাংলার এই মারফৎ পন্থীদের কাছে, ততটুকুও পাওয়া যাবে না বাংলার মওলানার কাছে, কেননা সমস্ত অসম্পূর্নতা সত্তে¡ও মারফৎ-পন্থীর ভিতরে রয়েছে কিছু জীবন্ত ধর্ম, সৃষ্টির বেদনা, পরিবেষ্টনের বুকে সে এক উদ্ভব; আর মওলানা শুধু অনুকারক, অনাস্বাদিত পুঁথির ভান্ডারী,সম্পর্ক শূন্য ছন্দহীন তার জীবন।’ ৩১
ভারতীয় ধর্মদর্শনে‘যোগাচার ভিত্তিক সাধন পদ্ধতি’র একটা বিশিষ্ট স্থান রযেছে। কি বৌদ্ধ-জৈন, কি বৈদিক- বৈষ্ণব , কি ইসলাম শেষপর্যন্ত বাংলায় কোন ধর্ম মতইই তার স্বাতন্ত্র বজায় রাখতে পারেনি। ড. রতনকুমার নন্দী বলেন, “বিভিন্ন ধর্মীয় আন্দোলনের ঘাত-প্রতিঘাতে এই সাধন প্রকরণটি নানা ভাবে প্রভাবিত হলেও তা অবলুপ্ত হয়নি। তাছাড়া ব্রাহ্মণ্য সংস্কার সমাজের উপরিস্তরে প্রবল প্রভাব বিস্তার করলেও দেশের বৃহৎঅংশে পরিপূর্ণ আধিপত্য বিস্তার করতে পারেনি। তার ফলে এই সুপ্রাচীন সাধন- প্রকরণটি অন্তসলিলা ভাবে লোকায়ত জনসাধারনের মধ্যে প্রবাহিত হয়েছে।”৩২ একারণেই ভারতে সহজিয়া বৌদ্ধ মতবাদ, ইসলামের সুফিমতবাদ এবং চৈতন্যত্তোর কালে সহজিয়া বৈষ্ণব মতবাদে যোগাচার নির্ভর তন্ত্র সাধনার প্রভাব পরিলক্ষিত হতে দেখি।

তথ্যসূচি

১. নীহাররঞ্জন রায়, বাঙালীর ইতিহাস আদিপর্বÑ দেজ পাবলিশিং, কলকাতা, ৭ম সংস্করণ: পৃ: ৪০২
২. প্রাগুক্ত. পৃ: ৭০-৭১
৩. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন, প্রাচীন বাঙলার রাষ্ট্র ও প্রশাসন, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, পৃ:৫
৪. ড. অতুল সুর, বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন, সাহিত্য লোক, কলকাতা চতুর্থ সংস্করণ, পৃ: ১১২
৫. রতনকুমার নন্দী, কর্তাভজা ধর্ম ও সাহিত্য,বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ, কলকাতা-২০০৮, পৃ: ২০।
৬. প্রাগুক্ত, পৃ: ২১।
৭. প্রাগুক্ত, পৃ: ২১।
৮. নীহাররঞ্জন রায়, প্রাগুক্ত., পৃ: ৪৯২।
৯. প্রাগুক্ত. পৃ: ৪৯২।
১০. ড. সুর: প্রাগুক্ত. পৃ: ১১৪।
১১. আহমদ শরীফ, চৈতন্য মতবাদ ও ইসলাম(প্রবন্ধ), রায়হান রাইন, বাংলার ধর্ম ও দর্শন, সংবেদ-২০০৯, পৃ: ২২১।
১২. নীহাররঞ্জন রায়, প্রাগুক্ত,পৃ : ২৫৩।
১৩. রামশরণ শর্মা, ভারতের সামন্ততন্ত্র, কে. পি বাগচী অ্যান্ড কোম্পানী, কলকাতা-তৃতীয় সংস্করণ, পৃ:২১০।
১৪. নীহাররঞ্জন রায়, প্রাগুক্ত, পৃ: ৩২৬।
১৫. প্রাগুক্ত, পৃ: ২৩৭-৩৮।
১৬. ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, ভারতীয় সমাজ পদ্ধতি (৩য় খন্ড),বর্মণ পাবলিশিং হাউস, কলকাতা- ১৯৪৬, পৃ:১৭৫।
১৭. শম্ভুনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, মধ্যযুগের বাংলা কাব্যে সমাজতত্ত¡, পুস্তক বিপণি, কলকাতা-২০১২, পৃ: ২০।
১৮. প্রাগুক্ত, পৃ: ১৭।
১৯. রতন কুমার নন্দী, প্রাগুক্ত, পৃ: ২৫।
২০. প্রাগুক্ত, পৃ: ২৫।
২১. প্রাগুক্ত, পৃ: ২৭।
২২. আহমদ শরীফ, প্রাগুক্ত, পৃ: ১৭১।
২৩. প্রাগুক্ত, পৃ: ১৭১।
২৪. মুহম্মদ এনামূল হক- বঙ্গে লৌকিক ইসলাম এর উদ্ভব, রায়হান রাইন( সম্পা:) প্রাগুক্ত, পৃ: ১৫৯।
২৫. আহমদ শরীফ, প্রাগুক্ত, পৃ: ২২৬।
২৬. প্রাগুক্ত, পৃ: ২২৯।
২৭. ড. শরদিন্দু ভট্টাচার্য, সিলেটের বাউলসঙ্গীতে শাহজালাল ও চৈতন্যেও প্রভাব, রোদেলা প্রকাশনী, ঢাকা- পরিমার্জিত সংস্করণ-২০১১, পৃ: ২৫।
২৮. প্রাগুক্ত, পৃ: ২৬।
২৯. সুধীর চক্রবর্তী, গভীর নির্জন পথে, আানন্দ পাবলিশার্স প্রা: লি; কলকাতা- ষষ্ঠ মুদ্রণ- ২০১২ পৃ: ২১।
৩০. প্রাগুক্ত, পৃ: ২১।
৩১. প্রাগুক্ত, পৃ:২২।
৩২. রতনকুমার নন্দী, প্রাগুক্ত, পৃ: ২৮।

One thought on “বাঙালি জাতির সমাজ পরিচয় ও ধর্ম

  1. তথ্যবহুল লেখনী। ?
    ধন্যবাদ ?
    অতুল সুর, নীহাররঞ্জন রায়, আহমদ শরীফ, এঁরা প্রিয়, এঁরা অদ্বিতীয় ?

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত