| 25 এপ্রিল 2024
Categories
গীতরঙ্গ

গীতরঙ্গ জ্বর সংখ্যা: বাংলার মরণব্যাধি কালাজ্বর । মাহবুব আলম

আনুমানিক পঠনকাল: 10 মিনিট

বড় লাট লিটন তাকে কাইজার-২ হিন্দ উপাধি দিয়েছেন ১৯২৪ সালে। ১৯১৯ তৈরি করেছেন নিজস্ব ল্যাবরেটরি, সেখানে প্রস্তুত করেছেন কালাজ্বরের ওষুধ ইউরিয়া স্টিবামিন, কালাজ্বরের সবচেয়ে কার্যকরী ওষুধ। মৃত্যুঞ্জয়ী এক ওষুধ। আর এ কীর্তিমান পুরুষের নাম উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী। তার আবিষ্কৃত কালাজ্বরের ইনজেকশন সে সময়ে এ জ্বরের নিরাময়ে সর্বশ্রেষ্ঠ ওষুধ হিসেবে শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও বিপুলভাবে সমাদৃত হয়েছিল। ১৯১৫ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত— এ সময়টায় তিনি টানা— মরণঘাতী এ জ্বরের প্রতিষেধক আবিষ্কারে অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন। ইউরোপ থেকে বহুদূরে এ ব্রিটিশ বাংলায়, প্রায় নিভৃতে, একাকী।

সে সময়, ১৯২২ সালে প্রচারবিমুখ এ চিকিৎসা বিজ্ঞানীর কঠোর পরিশ্রমের ফসল কালাজ্বরের ওষুধ লাখ লাখ মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছিল। ফলে কালাজ্বরের যুগান্তকারী এ আবিষ্কারে গবেষকের সম্মান পেতে খুব বেশি দেরি হয়নি উপেন্দ্রনাথের। গভর্নর জেনারেল লর্ড মিন্টো পদক, রায়বাহাদুর ও নাইট হুডের মতো অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি পরবর্তীতে। ১৯২৯ সালে কালাজ্বরের প্রতিষেধক এবং কালাজ্বর-পরবর্তী চর্মরোগ ডার্মালরিশ ম্যানোয়েড আবিষ্কারের জন্য নোবেল কমিটির কাছে তার নামও উপস্থাপিত হয়েছিল। এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে সুইডিশ একাডেমির দুজন সদস্য হান্স ক্রিশ্চিয়ান জাকোবিয়াস ও গোরান লিজেসস্ট্রান্ডকে আমন্ত্রণও জানানো হয়েছিল উপেন্দ্রনাথের মনোনয়নের যথার্থতা যাচাই করার উদ্দেশ্যে। তবে সে বছর (১৯২৯ সাল) তাকে নোবেল পুরস্কার দেয়া হলো না, চিকিৎসাবিজ্ঞানে অবদানের জন্য নোবেল পেলেন ক্রিশ্চিয়ান এজিকম্যান ও ড. ফ্রেডারিক জি. হপকিন্স— ভিটামিনের ওপর তাদের মূল্যবান গবেষণা কাজের জন্য।

উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর জন্ম ১৯ ডিসেম্বর ১৮৭৩ সালে, বর্ধমান জেলার পূর্বস্থলীর নিকটবর্তী সারদঙ্গা গ্রামে। তার বাবা নীলমণি ব্রহ্মচারী পেশায় ছিলেন একজন চিকিৎসক, ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়েতে চাকরি করতেন। উপেন্দ্রনাথের মায়ের নাম ছিল সৌরভ সুন্দরী দেবী। উপেন্দ্রনাথের শিক্ষার প্রথম পর্যায় কাটে জামালপুরের ইস্টার্ন রেলওয়ে বয়েজ হাইস্কুলে। ১৮৯৩ সালে উপেন্দ্রনাথ হুগলি মহসিন কলেজ থেকে বিএ পাস করেন গণিত ও রসায়নশাস্ত্রে, সম্মানসহ। তারপর তিনি উচ্চতর রসায়ন নিয়ে মেডিসিনে পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯০০ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে মাস্টার ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ওই বছরই এমবি পরীক্ষায় মেডিসিন ও সার্জারিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন, এ কৃতিত্বের জন্য তাকে গুডইভ ও ম্যাকলিওড পুরস্কার দেয়া হয়। ১৯০২ সালে উপেন্দ্রনাথ তার এমডি ডিগ্রি এবং ১৯০৪ সালে পিএইচডি সম্পন্ন করেন। অবশ্য এর আগেই ১৮৯৮ সালে ননীবালা দেবীর সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হয়েছেন তিনি।

মেধাবী উপেন্দ্রনাথ যথেষ্টই কপালে মানুষ ছিলেন বলা যায়, প্রেসিডেন্সিতে পড়ার সময় তার রসায়নের শিক্ষক ছিলেন আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। যার প্রভাব তার জীবনে গভীর রেখা ফেলেছিল এবং গুরু-শিষ্যের এ সম্পর্ক বজায় ছিল সারা জীবনই।

 উপেন্দ্রনাথ প্রাদেশিক মেডিকেল সার্ভিসে যোগ দিলেন প্যাথলজি ও মেটেরিয়া মেডিকার একজন শিক্ষক হিসেবে। ১৮৯৯ সালের সেপ্টেম্বরে। ১৯০১ সালে তিনি পূর্ববঙ্গের ঢাকা মেডিকেল স্কুলে চিকিৎসক হিসেবে যোগ দিলেন।

যে গবেষণা ও আবিষ্কার উপেন্দ্রনাথকে জগেজাড়া খ্যাতি এনে দিয়েছিল, সেই গবেষণার বীজ বপন হয়েছিল তদানীন্তন পূর্ব বাংলার এই ঢাকা মেডিকেল স্কুলের ক্ষুদ্র এবং সাধারণ একটি ল্যাবরেটরিতেই। ঢাকা আসার আগেই তিনি ফিজিওলজিতে পিএইচডি করে ফেলেছেন। এমবি পাস করার পরের দুই বছরেই এমডি পেয়েছিলেন অনায়াসেই— রসায়ন, মেডিসিন ও ফিজিওলজিতে। ফলে গবেষণার কাজে শুরু থেকেই তার বুনিয়াদ ছিল মজবুত।

ঢাকা মেডিকেল স্কুলের অধ্যক্ষ স্যার জেরাল্ড চেল্মসফোর্ড তাকে কলকাতা থেকেই চিনতেন। আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের সাবেক এ ছাত্রের মেধা ও গবেষণার প্রতি আগ্রহকে তিনিও দ্রুত শনাক্ত করতে পেয়েছিলেন। ফলে চেল্মসফোর্ডের উৎসাহ ও সহানুভূতি না পেলে উপেন্দ্রনাথ সম্ভবত চিকিৎসা-গবেষক না হয়ে চিকিৎসকের পেশায় দ্রুত অর্থ উপার্জনের লোভনীয় পথকেই বেছে নিতেন। জেরাল্ড চেল্মসফোর্ড তাকে কষ্টলব্ধ গবেষণাকর্মের দিকেই ধাবিত করতে উৎসাহ জুুগিয়ে গেলেন।

মেধাবী উপেন্দ্রনাথ গবেষণা জীবনের শুরুতেই, ঢাকায় থাকতেই একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করেন; ওই সময়ে ভারতবর্ষে কোয়ারটন জ্বর এক বিরল রোগ হিসেবে খ্যাত। সচারচর দেখা যায় না। কিন্তু উপেন্দ্রনাথ প্রমাণ করেন কোয়ারটন জ্বর তখনো ঘাপটি মেরে আছে ঢাকা আর কলকাতাতেই।

১৯০১ সালে ইন্ডিয়া মেডিকেল গেজেটে তার রিপোর্ট ‘ফাইভ কেসেসে অব কোয়ারটান ফিবার’ প্রকাশের পর আন্তর্জাতিকভাবেও এ গবেষণার স্বীকৃতি মিলল। উপেন্দ্রনাথ দেখালেন ম্যালেরিয়ার মতো কোয়ারটান জ্বরও ছড়ায় অ্যানোফিলিস মশা দিয়েই।

ঢাকা গবেষণা পর্বে উপেন্দ্রনাথ বিপুল উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। ঢাকা মেডিকেল স্কুলে কোয়ারটন জ্বরের বাইরে আরো বেশ কয়েকটি রোগ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় হাত দেয়ার পরিকল্পনা করলেও শেষে তিনি মনোযোগ নিবদ্ধ করেন সুনির্দিষ্ট দুটি বিষয়ের ওপর; তার একটি ম্যালেরিয়া, বাংলায় যাকে বলা হতো পালাজ্বর, আর অন্যটি কালাজ্বর। এ নিয়ে গবেষণা শুরু করে বাকি জীবন অর্থাৎ গবেষণা জীবনের পুরো সময়টাতেই তার মনোযোগ নিবদ্ধ ছিল এ দুটি বিষয়ের উপরেই।

পালাজ্বর অর্থাৎ ম্যালেরিয়ার পরই আসাম ও বাংলাদেশে সবচেয়ে প্রাণঘাতী আরেক জ্বরের নাম ছিল কালাজ্বর। উপেন্দ্রনাথের ম্যালেরিয়া নিয়ে গবেষণাকর্ম থাকলেও তার কালাজ্বরের ওপর কাজের প্রচার হয়েছে বেশি। ম্যালেরিয়ার গবেষণাকালেই তিনি ভারতে অ্যানোফিলিস জাতের আরেকটি মশা চিহ্নিত করেছিলেন, যা চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের কাছে তখনও অজ্ঞাতই ছিল। একেবারে শুরুতে অবশ্য ভাবা হয়েছিল এটি নতুন প্রজাতির কোনো মশা, কিন্তু উপেন্দ্রনাথ এ ভুল সংশোধন করে প্রমাণ করেন, এটি এ অ্যানোফিলিস প্রজাতিরই অন্য আরেকটি মশা।

উপেন্দ্রনাথ ঢাকায় চার বছর কাটিয়ে ১৯০৫ সালে কলকাতার ক্যাম্পবেল মেডিকেল স্কুলে যোগদান করেন। এখানেই তার জীবনের পরবর্তী ২০টি বছর কাটে। এখানে গবেষণাকর্মেরই ফল কালাজ্বর নিরাময়ের ওষুধ।

কর্নেল স্যার রবার্ট নেইল ক্যাম্পবেল ছিলেন ঢাকা মেডিকেল স্কুলের সুপারিনটেনডেন্ট। উপেন্দ্রনাথ যখন ফ্যাকাল্টি সদস্য ক্যাম্পবেলের সঙ্গে তখনই কালাজ্বরের গবেষণা শুরুর বিষয়ে পরামর্শ করেন, ক্যাম্পবেলের সমর্থনেই উপেন্দ্রনাথ জীবনের সবচেয়ে কঠিন ও দীর্ঘ সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন।

২.

উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী তার ‘আ ট্রিটিজ-অন কালাজ্বর’ বইয়ে লিখেছেন: কালাজ্বরের কালা কথাটি আক্রান্ত হওয়ার পর রোগীর দেহের চামড়া রঙ কালো হয়ে যাওয়ার লক্ষণকেই শুধু বোঝায় না, কালাজ্বরের এ কালা অর্থ মৃত্যুও। তাই দুই অর্থ মিলেই হয়েছে কালাজ্বর।

তবে কালাজ্বরকে বিভিন্ন সময়ে মানুষ নানা নামে শনাক্ত করার চেষ্টা করেছে। যেমন— আসামের গারো পাহাড়িদের কাছে এ রোগের নাম ছিল কালা বিমার। তখন আসামবাসীরা বিশ্বাস করত এ রোগ আসামে আমদানী হয়েছে বৃটিশ শাসনের কারণে। অভিযোগ ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকাল শেষে ব্রিটিশরাজের শাসনে, প্রায়ই আসাম থেকে বর্মা মুলুকে নানা অভিযান পরিচালিত হত। এবং এসব অভিযানে অংশ নেওয়া সৈনিকদের মাধ্যমেই বর্মা থেকে কালাজ্বর আসামে প্রবেশ করেছে। বর্মাফেরত সপাহিদের মাধ্যমেই যে এ রোগটি আসামে প্রবেশ করেছে এমন ধারণা আসামের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল তখন। ফলে আসামে নতুন এ রোগের নামকরণও হয় স্থানীয়ভাবে ‘সরকারি বিমার’ নামে। আসামের সিক্সথ অ্যানুয়াল রিপোর্ট অফ দি স্যানিটারি কমিশন (১৮৬৯) থেকে আসামে এ রোগ কি ভয়াবহ মাত্রায় বিস্তার করেছিল তা বোঝা যায়। রিপোর্ট বলছে, কালাজ্বরের প্রাদুর্ভাব ঘটলে গারো পর্বতমালার একেকটা পাহাড়ের পুরোই জনশূন্য হয়ে যেত। ১৮৯৪ সালে এ রোগ আরও অগ্রসর হয়ে জলপাইগুড়িতেও ছড়িয়ে পড়ে ভয়াবহরূপে, তখন এর নাম দেয়া হয় ‘পুষ্কর’। বছর চারেক পরে এর আবির্ভাব ঘটে দার্জিলিংয়ে, নাম হয় কালাজ্বর। পূর্ণিয়ায় কালাজ্বর দেখা দিলে স্থানীয়ভাবে নাম হলো ‘কালাদুখ’। সাহেবদের মুখেও এ জ্বরের রকমারি নামের উল্লেখ পাওয়া যায়: কখনো এটা ‘বর্ধমান ফিভার’,

কলকাতার উপকণ্ঠে পাওয়া এ রোগের নাম কোনো কোনো ইংরেজ মারফত প্রচারিত হল ‘দমদম ফিভার’ নামে, আবার কখনো শ্রেফ ‘আসাম ফিভার’, কিংবা ‘ব্ল্যাক ফিভার’ বা ‘ব্ল্যাক সিকনেস’।

মরণব্যধি কালাজ্বরের নিরাময়ের কোনো উপায় তখনও কারো জানা ছিল না, ফলে পাহাড়ে কালাজ্বরের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে গারোরা মনে করত এ মরণব্যাধি থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হলো রোগাক্রান্ত গ্রাম ও অঞ্চল থেকে দ্রুত অন্যত্র সরে যাওয়া। শুধু তা-ই নয়, কালাজ্বরের ভয়াবহ প্রকোপে এমন একটা ধারণা চালু হয়ে গিয়েছিল যে এক স্থানে দীর্ঘদিন বসবাস করলে এ রোগের শিকারে পরিণত হওয়া অনিবার্য। তাই কালাজ্বর থেকে বাঁচার স্থানীয় কৌশলের একটি হয়ে দাঁড়াল; কিছুদিন পর পরই স্থান পরিবর্তন করা। এরফলে দ্রুতই বিশাল এক আবাদি অঞ্চল জনশূন্য হয়ে পড়ল। আর যাদের সরে যাবার কোনো উপায় ছিল না, তাদের মধ্যে যারা প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল এ রোগকে মোকাবেলা করে, তাদের মধ্যেও বৃটিশরাজের প্রতি এক ধরনের বিদ্বিষ্ট মনোভাব গড়ে উঠল— এমনকি তারা সরকারী চা বাগানে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানাতে শুরু করল।

ফলে বহুল প্রশংসিত চা বাগান অর্থনীতি প্রায় মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হল। ছোট নাগপুর থেকে তখন সস্তা শ্রমিক এনে এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হলেও তা সফল হয়নি। কারণ নতুন আসা শ্রমিকরাও দ্রুত রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যেতে লাগল। ফলে শুধু অর্থনীতিই নয় কালাজ্বর বিশাল এক সমস্যা রূপে দেখা দিল বৃটিশ রাজের জন্য। চারদিকে তখন আতঙ্ক; কালাজ্বর ভয়াবহ রূপ নিয়ে সবাইকেই গ্রাস করতে এগিয়ে আসছে— প্রভু, ভৃত্য, শ্রমিক, আড়কাটি— কেউই রেহাই পাচ্ছে না কালাজ্বরের মরণথাবা থেকে। আসামের স্থানীয়দের দেওয়া নাম ‘সরকারি বিমার’, নিয়ে এতদিন পর্যন্ত সরকারের তেমন মাথাব্যথা ছিল না ঠিক, কিন্তু এই যাত্রায় উদ্বিগ্ন না হয়ে উপায় রইল না। কারণ ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি ও কালাজ্বরে মৃত্যুহার তখন ৯০ শতাংশে পৌঁছে গেছে।

আসামের চা বাগানের উপার্জন উদ্বেগজনক হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি কালাজ্বরে বাংলার হুগলি-বর্ধমানের একেক অংশ উজাড় হয়ে যেতে শুরু করল। বেশি মাত্রায় কুইনিন গিলিয়েও এ রোগটিকে কিছুমাত্র কাবু করা গেল না। আর অতিরিক্ত কুইনিনের যোগান দিতে সরকারের খাজনায় টান পড়ল।

৩.

কালাজ্বর রোগটি কি ম্যালেরিয়া, না অন্য কোনো ঘাতক ব্যাধি— এ নিয়ে দীর্ঘদিন টানাপড়েন চলেছে চিকিৎসক ও সরকারি মহলে। রোগটির ধরন-ধারণ ঠিক করতে সার্জেন্ট-ক্যাপ্টেন লিওনার্ড রজার্সকে নিয়োগ করল সরকার। বহু অনুসন্ধানের পরও তিনি কোনো নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেননি। অন্যদিকে বর্ধমানের সিভিল সার্জেন্ট বহু অনুসন্ধানের পর কালাজ্বরকে ম্যালেরিয়া বলেই রায় দিয়েছিলেন।

পরে এ রোগ নির্ণয়ের নতুন দায়িত্ব পেলেন বিখ্যাত বৃটিশ চিকিৎসক রোনাল্ড রসকে, তার কাজ হল আসামে গিয়ে রোগটির আসল চেহারা খতিয়ে দেখা ও এ রোগের উপসম কৌশল নির্ণয় করা। কিন্তু রোনাল্ড রস তখন এ দেশের আবহাওয়ায় ক্লান্ত এবং বিরক্ত। ম্যালেরিয়ার পর কালাজ্বরের প্রতিষেধক খুঁজতে তার তেমন আগ্রহ ছিল না। তিনি তখন বিলাত ফিরে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছেন। অন্যদিকে রসকে নিযুক্ত করার পেছনে ব্রটিশ সরকারের মনোভাব ছিল সে সময়ের প্রচলিত ধারণা দ্বারা প্রভাবিত, সরকারও মনে করত— কালাজ্বরও  ম্যালেরিয়ারই একটি রূপান্তর মাত্র, সুতরাং সদ্য গঠিত কালাজ্বর কমিশনের জন্য ম্যালেরিয়ায় গবেষক রসই উপযুক্ত ব্যাক্তি। উপায়ন্তর না দেখে, দায়িত্ব নিতে অনিচ্ছুক রস তখন মনের দুঃখে বলেছিলেন, ‘Columbus having sighted America was orders off to discover the North Pole.’ এখানে তিনি তার অবস্থাকে তুলনা করছেন কলম্বাসের সঙ্গে, আমেরিকা বলতে তিনি বুঝিয়েছেন ম্যালেরিয়া আর উত্তর মেরু হলো তার প্রেক্ষিতে কালাজ্বর। শেষ পর্যন্ত তিনি আসামে গিয়ে রোগটির স্বরূপ খতিয়ে দেখেন এবং সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে ব্যর্থ হন। কালাজ্বর নিয়ে তার পর্যবেক্ষণ ছিল: ম্যালেরিয়ার প্যারাসাইটের প্রতি দেহের প্রতিরোধক্ষমতা কমে গেলে অন্যান্য সংক্রমণের কারণে মানবশরীরে কালাজ্বরের লক্ষণগুলো পরস্ফুিট হয়।

উল্লেখ্য এই রোনাল্ড রস ১৯০২ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে অবদান রাখার সুবাদে নোবেল পুরস্কার পান, তিনিই প্রথম বৃটিশ যে নোবেল খেতাব পান। রস ১৮৯৭ সালে ভারতবর্ষে ম্যালেরিয়ার গবেষণায় এই রোগ সংক্রমণের জীবাণু আবিষ্কার করেন, তিনি প্রমাণ করতে সক্ষম হন ম্যালেরিয়া এক প্রকার মশা দ্বার সংক্রামিত রোগ। তার এই আবিষ্কার থেকেই পরবর্তীতে ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক আবিষ্কারের ভিত তৈরি হয়।

৪.

কালাজ্বরের জীবাণু আবিষ্কার হয় ১৯০৩ সালে।

আর্মি মেডিকেল স্কুলের ডাক্তার উইলিয়াম লেইসম্যান দমদম ক্যান্টনমেন্টে কালাজ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া এক সৈনিকের প্লীহা পরীক্ষা করে একটি নতুন ধরনের জীবাণু পেলেন। তিনি পরীক্ষা করে দেখলেন যে এই জীবাণু স্লিপিং সিকনেসের একটি পরিবর্তিত রূপ। তার তখন অনুমান হল: কালাজ্বর স্লিপিং সিকনেসেরই একটি বিশেষ ধরন। ওই একই সময়ে মাদ্রাজ মেডিকেল কলেজের ফিজিওলজির অধ্যাপক চার্লস ডেনোভানও সেখানে কালাজ্বরের রোগীর প্লীহা থেকে একই ধরনের প্যারাসাইট পেলেন। নতুন প্যারাসাইট, যা কালাজ্বরের জন্য দায়ী, তার নাম হলো লেইসম্যানিয়া-ডেনোভানি।

জীবাণুর খোঁজ পাওয়া গেল, এবার তার চিকিৎসা। তখন অ্যান্টিবায়োটিকের মুখও দেখেননি চিকিৎসকরা। তাদের ঝুলিতে গোটা কয়েক বাঁধাধরা ওষুধের বাইরে আর কোনো কার্যকরী ওষুধ নেই কালাজ্বর প্রতিরোধে।

তবে চিকিৎসকরা কালাজ্বরের চিকিৎসায় আশার আলো দেখতে পেলেন ১৯১৩ সালে যখন অ্যান্টিমোনির (লাতিন নাম স্টিবিয়াম) ব্যবহার করে দক্ষিণ আমেরিকায় এ রোগ নিরাময়ে ভালো ফল পেলেন গ্যাসপার ভিয়েনা নামে এক চিকিৎসক। তিনি রোগীদের টার্টার অ্যামেটিক অর্থাৎ টার্টারিক অ্যাসিডের সঙ্গে পটাশিয়াম ও অ্যান্টিমোনির যৌগ মিশিয়ে ইনজেকশন দিতে শুরু করলেন। কলকাতার স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের প্রতিষ্ঠাতা, চিকিৎসক গবেষক লিওনিড রজার্স ১৯১৫ সাল থেকে রোগীর শিরার মধ্যে টার্টার অ্যাসেটিক যৌগ প্রয়োগ শুরু করলেন। ওষুধটির প্রয়োগে ভালো ফল দিলেও এর বিষক্রিয়া ছিল মারাত্মক। সঙ্গে এর প্রভাব পড়ত রোগীদের হূদযন্ত্রেও, কারো কারো বমিও হত। তাই পটাশিয়ামের বদলে সোডিয়ামের সঙ্গে অ্যান্টিমোনির যৌগ প্রয়োগ করে ব্যবহার শুরু শুরু হল, কিন্তু তাতেও কাঙ্খিত ফল মিলল না। কারণ রোগীর সেরে উঠতে এত বেশিদিন চিকিৎসা চালাতে হত যে রোগী সুস্থ না হয়েই পালিয়ে যেত। ফলে বিজ্ঞানীরা বাধ্য হয়ে এবার এমন একটি যৌগ খুঁজতে লাগলেন, যার বিষক্রিয়া কম হবে, চিকিৎসা সহজ হবে, আর সময়ও কম লাগবে। আর এ সময়েই বঙ্গসন্তান উপেন্দ্রনাথ দৃশ্যপটে হাজির হলেন। কালাজ্বরের যথার্থ ব্যবহারযোগ্য একটি ওষুধ উদ্ভাবনে উপেন্দ্রনাথ ১৯১৫ সালে ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুলের (পরবর্তীতে যার নাম হয় নীল রতন মেডিক্যাল কলেজ  হাসপাতাল) ছোট্ট একটি ঘরে গবেষণা শুরু করলেন। তিনি শুরুতে ধাতব অ্যান্টিমোনির সূক্ষ্ম বিভাজন কাজে সফল হলেন, তবে তিনি তার নিজস্ব পদ্ধতিতে কলইডাল অ্যান্টিমোনি তৈরি করলেন। কয়েক বছর ধরে কয়েকশ যৌগ তৈরি করে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালালেন: প্রথমে ইঁদুরের ওপর, পরে মানুষের ওপর।

এ গবেষণা কাজে উপেন্দ্রনাথের হাতে খুব বেশি অর্থকড়ি ও উপকরণ ছিল না। পর্যাপ্ত লোকবলও ছিল না, তার গবেষণার সহযোগী বলতে ছিল এক কম্পাউন্ডার আর সদ্য এমএসসি পাস তিন ছাত্র। ১৯১১ সালে এসে তার গবেষণার কাজের ফলফলা দেখে ইন্ডিয়ান রিসার্চ ফান্ড অ্যাসোসিয়েশন কাজ চালিয়ে যাওয়ার মতো কিছু আর্থিক সহায়তা নিয়ে এগিয়ে এল। এ পর্যায়ে উপেন্দ্রনাথ নাফল্যের দেখা পেলেন: তিনি সোডিয়াম ছেড়ে দিয়ে ইউরিয়ার সঙ্গে অ্যান্টিমোনির ইউরিয়া যৌগ তৈরি করে ফেললেন। নাম দিলেন ইউরিয়া স্টিবামিন। নিজেই পরীক্ষা করে দেখলেন এ নতুন যৌগ রোগ নিরাময়ে সবচেয়ে বেশি কার্যকর। সাত বছর একটানা চেষ্টার পর তার এ সাফল্য এল। উপেন্দ্রনাথের বয়স তখন ৫২ বছর।

৫.

কালাজ্বরের চিকিৎসায় ব্রহ্মচারীর গবেষণাগারে প্রস্তুত ইউরিয়া স্টিবামিন (ইউরিয়ার সঙ্গে স্টিবামিন অ্যাসিডের যৌগ) অন্যান্য ওষুধের চেয়ে বহুগুণে শ্রেষ্ঠ প্রমাণিত হতে শুরু করল। ১৯২২ সালে ইন্ডিয়ান জার্নাল আ মেডিকেল রিসার্চে স্টিবামিনের সাফল্য ও দৃষ্টান্তমূলক কেসগুলো প্রকাশ হলে উপেন্দ্রনাথের যুগান্তকারী আবিষ্কারের খবর সবার নজরে পড়ল। কালাজ্বরের প্রচলিত ওষুধ প্রয়োগে যেখানে ১২ সপ্তাহের আগে রোগের আরোগ্যের কোনোরকম দেখা মিলত না, সেখানে ব্রহ্মচারীর উদ্ভাবিত ইউরিয়া স্টিবামিন মাত্র দুই থেকে আড়াই সপ্তাহেই রোগ সারিয়ে তুলতে সমক্ষম প্রমাণিত হল। আর কষ্টবিহীন এ ওষুধ রোগীর সহ্যক্ষমতাকে বিপর্যস্ত করে না। বিষক্রিয়ার কোনো ব্যাপার নেই, প্রয়োগের পর রোগীর বমিও হয় না।

শুধু এই নয়, অচিরেই দেখা গেল ব্রহ্মচারীর এ ওষুধের ব্যবহারের পর জ্বর আর ফিরে আসে না। এবং সবচেয়ে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত কালাজ্বরের রোগীকেও সুস্থ করে তুলতে এ নতুন ওষুধটি সমান কার্যকর। ১৯২৩ সালে মেজর ড. শ্রফট ও তার সহকারী লুই পাস্তুর ইন্সটিটিউটের ড. সেন ভারতীয় কালাজ্বর কমিশনে জানালেন, ‘আমরা বিবেচনা করি ভারতীয় কালাজ্বরের চিকিৎসায় ইউরিয়া স্টিবামিন ভারতে প্রচলিত কালাজ্বরের সব ওষুধের মধ্যে সর্বাপেক্ষা কার্যকর বলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমাদের এ সিদ্ধান্ত শুধু ইউরোপীয় ও ভারতীয় কয়েকটি কেস স্টাডির ওপরই ভিত্তি করে গঠিত হয়নি। এক বৃহত্তর সংখ্যার কেস অর্থাৎ প্রায় একশ কেস পর্যালোচনা করেই উপরোক্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি আমরা। সংক্ষেপে বলতে গেলে, যে চারটি গুণ থাকলে ওষুধ সর্বতোভাবে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে, তার সব কয়টিই ব্রহ্মচারীর এ ওষুধে ছিল। যেমন— সংক্ষিপ্ত চিকিৎসা কাল, দৃঢ় উপাদান, শ্রেষ্ঠতম কার্যকারিতা এবং অতি অল্প মাত্রার বিষক্রিয়া।

 

.

এ মহৌষধ উপেন্দ্রনাথের শ্রমসাধ্য দীর্ঘদিনের ঐকান্তিক গবেষণার ফসল। পূর্বসূরিদের ভুলভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিয়ে উপেন্দ্রনাথ সঠিক পথে পা ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন। একটি ক্ষুদ্র গবেষণাগারে প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে সাফল্য লাভে কৃতকার্য উপেন্দ্রনাথ তার এ গবেষণাগারকে বলেছেন ‘তীর্থক্ষেত্র’। তিনি লিখেছেন, ‘আমি আনন্দের সঙ্গে (কলকাতার ক্যাম্পবেল হাসপাতালে) সেই অবিস্মরণীয় রাত্রির স্মৃতিচারণ করছি। দিনভর দীর্ঘ ও কঠিন পরিশ্রমের পর রাত প্রায় ১০টার দিকে দেখলাম পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল আমার প্রত্যাশা পূর্ণ করতে পেরেছে। আমি তখনো জানতাম না যে অদৃষ্ট আমার হাতে তুলে দিয়েছে একটি ক্ষুদ্র অথচ অসাধারণ বস্তু, যা একদিন লাখ লাখ স্বদেশবাসীর জীবন বাঁচাতে সক্ষম হবে। আমি কোনো দিন সেই ক্ষুদ্র কক্ষটির কথা ভুলতে পারব না, যেখানে ইউরিয়া স্টিবামিন আবিষ্কৃত হয়েছিল। সেই ছোট ঘরটিতে আমি মাসের পর মাস গ্যাস সংযোগবিহীন বা জলের কল ছাড়াই অক্লান্ত পরিশ্রম করেছি, তা আমি কোনো দিনই ভুলব না। রাতের বেলায় কাজের জন্য একটি কেরোসিন লণ্ঠনই ছিল আমার একমাত্র সহায়। এ ঘরটির যেখানে ইউরিয়া স্টিবামিন আমার মনে উদ্ভাসিত হয়েছিল, তা আমার কাছে সারা জীবন এক তীর্থক্ষেত্র হিসেবে জাগরূক হয়ে রবে (Gleanings from my reasearches, vo17 কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৪০)।’ পরবর্তী দিনগুলোয় ইউরিয়া স্টিবামিন কালাজ্বর চিকিৎসার গোল্ড স্ট্যান্ডার্ডে পরিণত হলো চা বাগান এবং কলকাতার সব প্রধান মেডিকেল কলেজে। যে মরণব্যাধি গত আধা শতকের বেশি প্রধান ঘাতক হিসেবে পরিচিত ছিল, তাকে কাবু করে ইউরিয়া স্টিবামিনের আবিষ্কার এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল। মৃত্যুর হার যেখানে ৯০ শতাংশ ছিল, তার এ ওষুধ ব্যবহার করার ফলে তা ১০ শতাংশে নেমে এল। উপেন্দ্রনাথের আশ্চর্য ওষুধের খ্যাতি সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়তে একটুও দেরি হলো না।

তবে খ্যাতি ব্রহ্মচারীকে তার গবেষণা থেকে বিরত করতে পারেনি। ওষুধ আবিষ্কার করার পরও তিনি কালাজ্বরের ওপর আরো গবেষণা চালিয়ে গেলেন। কলকাতায় তার বাসস্থানে ব্রিটিশ এবং ভারতীয়দের এক ভোজসভায় আমন্ত্রণ জানিয়ে তার গবেষণার ক্ষেত্রে আরও নতুন নতুন কী অগ্রগতি হয়েছে, আমন্ত্রিতদের সঙ্গে মতবিনিময়ে তাও বিস্তারিত তুলে ধরলেন।

The fare was always good and conversation was even better. তার মৃত্যুর পর The Lancet পত্রিকা শোকবার্তায় উপরের বাক্যটি ব্যবহার করে তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিল (৯ মার্চ, ১৯৪৬)। উপেন্দ্রনাথ সফল হলেও তার ওষুধের প্রসারের জন্য তত্কালীন কিছু সাহেব কর্মকর্তা মোটেই আগ্রহ দেখাননি বলে উল্লেখ করেছেন স্বাতী ভট্টাচার্য। ক্যালকাটা স্কুল অব  ট্রপিক্যাল মেডিসিনের প্রধান রজার্স এবং তার সহকারীরাও কালাজ্বরের গবেষণা চালাচ্ছিলেন। তাদের প্রধান অস্ত্র জার্মান ওষুধ নিওস্টিবোসান। সাহেব কর্তারা জার্মান ওষুধ বাদ দিয়ে এক দেশীয় গবেষকের ল্যাবরেটরিতে তৈরি ওষুধের প্রতি মোটেই আগ্রহ দেখাননি। কিন্তু অচিরেই উপেন্দ্রনাথের ওষুধ জার্মান নিওস্টিবোসানের চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর প্রমাণিত হয়েছিল।

ওদিকে শুধু সাহেবদের একাংশই নয়, ভারতীয়দেরও সবাই যে উপেন্দ্রনাথের সাফল্যে খুশি হয়েছিলেন এমন নয়। ইন্ডিয়ান মেডিকেল সার্ভিসের কেউ কেউ বলতে শুরু করেন যে, স্রেফ কপাল জোরে ঠিক ওষুধটা ধরে ফেলেছেন উপেন্দ্রনাথ। সঙ্গে এও বলতে ছাড়লেন না যে, তার ওষুধটা বাজারে চালু ওষুধগুলোর চেয়ে সামান্য একটু ভালো। এমন আহামরি কিছু নয়। উল্লেখ্য, সাহিত্যিক সুকুমার রায় কালাজ্বরে ভুগে মারা যান। তাকে ইউরিয়া স্টিবামিন দেয়া হয়নি।

 

.

উপেন্দ্রনাথের বিশেষত্ব এই যে, তিনি কেবল আবিষ্কার করেই ক্ষান্ত হননি। তার আবিষ্কৃত ওষুধের বাণিজ্যিক দিকটির গুরুত্বও তিনি ভুলে যাননি। ওষুধ আবিষ্কারের পর এ পণ্যের বাণিজ্যিক উদ্যোক্তা হিসেবে তিনি আবির্ভূত হতে দেরি করেননি। ১৯২৪ সালে কলকাতায় তার বাসভবনে স্থাপন করলেন ল্যাবরেটরি— ইউরিয়া স্টিবামিন তৈরির জন্য। পরে কারখানা স্থানান্তর হয়েছিল হাতি বাগানে। ইউরিয়া স্টিবামিন বাজারে ছাড়লেন বাথগেট অ্যান্ড কোম্পানির মাধ্যমে এবং দ্রুতই তিনি প্রচুর বিত্তের মালিক হয়ে গেলেন। গবেষক হিসেবে যেমন তিনি সাফল্য লাভ করেছিলেন, ব্যবসায়ী হিসেবেও তেমনি সফল হন।

তবে উপেন্দ্রনাথের সম্পর্কে একটি সমালোচনা সে আমলে খুব চালু ছিল, তা হলো— ইউরিয়া স্টিবামিনের ফর্মুলা ছেলেদের ছাড়া আর কাউকে শেখাননি তিনি। পরিবারের সদস্যদের মধ্যেই কুক্ষিগত করে রেখেছিলেন। তার বংশধররা অবশ্য এ মন্তব্যের ঘোর প্রতিবাদ করেন। তারা এ কথাও বলেন, উপেন্দ্রনাথ কখনই পেটেন্ট নেননি তার আবিষ্কারের জন্য। এটা অবশ্য ঠিক, উপেন্দ্রনাথ তার ওষুধের পেটেন্ট কখনো নেননি। তবে এ নিয়ে তার প্রতিযোগীদের সঙ্গে মামলা-মোকদ্দমা হলে তার ওষুধকে ইউরিয়া স্টিবামিন ব্রহ্মচারী নামে বাজারে ছাড়েন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ম্যালেরিয়া দমনে ব্যাপক হারে ডিডিটি ছড়ানো হয়, তখন শুধু মশাই নয় সঙ্গে সঙ্গে চরাঞ্চলের স্যান্ড ফ্লাই মশাও প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। জ্বর-জারির প্রকোপও কমে আসে ফলে ইউরিয়া স্টিবামিনের চাহিদাও কমতে থাকে। ১৯৬৩ সালে ব্রহ্মচারীর রিসার্চ ইনস্টিটিউট বন্ধ হয়ে যায়।

দীর্ঘদিন ধরে উপেন্দ্রনাথ ডায়াবেটিসে ভুগছিলেন। কিন্তু ভগ্ন শরীর নিয়েও গবেষণার কাজ চালিয়ে যান পুরোমাত্রায়। ১৯৪৬ সালে তার জীবন প্রদীপ নিভে আসে।

ইউরিয়া স্টিবামিনের প্রয়োজন ফুরিয়েছিল, সবাই নিশ্চিত ধরেই নিয়েছিল যে কালাজ্বর একেবারে নির্মূল হয়ে গেছে উপমহাদেশ থেকে। কিন্তু এই ১৯৭৭ সালেই আবার কালাজ্বর হাজির হয়ে যায়। তবে চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞদের বহু চেষ্টার পর সোডিয়াম অ্যান্টিমোনি গ্লুকামেট (এসএজি) ব্যবহার করে কালাজ্বরে আক্রান্ত ৯০ শতাংশ রোগীকেই ভালো করা সম্ভব হয়েছে। এ সময়ে ভারতের উত্তর প্রদেশ, ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ এবং নেপালে ৫২টি জেলায় এর দেখা পাওয়া যায়।

তবে সুখের বিষয়, কালাজ্বরের জেনোম আবিষ্কার করার পর থেকে এ ব্যাধির মোকাবেলা অনেক সহজতর হয়ে গেছে।

একেবারে শেষে এসে ব্রহ্মচারীর আরেকটি কৃতিত্বের কথা না বললে এ লেখার অঙ্গহানি হবে।

উপেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মচারীই ব্রিটিশ ভারতে কলকাতার ট্রপিক্যাল মেডিসিন হাসপাতালে প্রথম ব্লাড ব্যাংক গঠন করেছিলেন, ১৯৩৫ সালে । ব্রহ্মচারী তখন বাংলা রেড ক্রসের চেয়ারম্যান।

দুর্ভাগ্যবশত ব্রহ্মচারী ঐতিহ্য ও স্মৃতি আজ বিলুপ্তপ্রায়। খুব কম লোকই তার অবদান মনে রেখেছে। এমনকি কলকাতায় কর্ন ওয়ালিশ স্ট্রিটে তার বসতবাড়িটি আজ নানাজনের বেদখলে কালস্য কুটিল গতি।

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত