ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খাঁ সাহেবের সান্নিধ্যে

Reading Time: 3 minutes

শৌনক গুপ্ত


আজ ২ এপ্রিল ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খাঁ সাহেবের জন্মদিন। ইরাবতী বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করছে এই মহান সঙ্গীত প্রতিভাকে।



১৯৪৯-১৯৫০ সাল। সে সময় জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের ডিক্সন লেনের বাড়িতে একটি ঘরে থাকতেন ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খাঁ। এমনই সময় ওঁর কাছে ‘গান্ডা’ বেঁধেছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। গুরুর মুখে মিষ্টি দিয়ে, প্রণাম করে তাঁকে বরণ করে নেন শিষ্য-শিষ্যা। গুরু তখন হাতে সুতো বেঁধে তার শিষ্যত্ব স্বীকার করেন। পাতিয়ালা ঘরানায় এই অনুষ্ঠানকেই বলে ‘গান্ডা’ বাঁধা। বড়ে গোলাম আলি খাঁ সাহেবের কাছে উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে উচ্চতর তালিম নিতে থাকেন সন্ধ্যা। সুরমণ্ডল হাতে সারাদিন ধরে গান শেখাতেন খাঁ সাহেব। দুপুরে ডিক্সন রোডের বাড়িতেই কিছু খাওয়াদাওয়ার বন্দোবস্ত হত। বিকেলে আবারও তালিম নেয়া। সন্ধ্যার সঙ্গে তালিম নিতেন মীরা চট্টোপাধ্যায়ও (পরে বন্দ্যোপাধ্যায়)। একে একে জৌনপুরী, গাওতি, মিয়াঁ কী টোরি, গুর্জ্জরি টোরি, বেহাগ, কোমল ঋষভ আশাবরী, কৌশিকধ্বনি, কামোদ, গুনকেলি, প্রভৃতি রাগ শিখেছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। শিখেছিলেন বেশ কিছু ঠুংরিও। এক একটা রাগ বেশ কিছু মাস ধরে শেখাতেন খাঁ সাহেব। বলতেন – “একটা গুরুত্বপূর্ণ রাগ, যেমন ইমন – এই ইমন তুমি টানা চার-পাঁচ বছর ধরে শিখতে শিখতে এমনভাবে নিজেকে তৈরী করে ফেলতে পারবে যাতে সমস্ত রাগ সম্বন্ধেই একটা পরিষ্কার ধারণা তোমার এসে যাবে। এরপর ওই রাগগুলো তুমি সাধবে। যেটা তুমি ধরেছো তার ভিতরে ঢুকে গিয়ে একদম মনেপ্রাণে সাধবে। ওই রাগটাকে বারবার তুমি প্র্যাকটিস করে যাবে।” কোনও রাগের বন্দিশ শিখিয়ে বলতেন – “দেখো বেটা, এ যো বন্দিশ তুমকো আজ শিখায়া এ লাখো রুপিয়ামে নেই মিলতা হ্যায়। আগে তুমি ভালোভাবে বুঝে নেবে। আমি প্রথমে পাঁচ-ছ’বার করে গেয়ে যাব। তারপর তুমি আমাকে শোনাবে।” গান শেখানোর ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন খাঁ সাহেব। কনফারেন্সে ঠিক যেভাবে গাইতেন, শেখানোর সময়েও ঠিক সেভাবেই – আপন মনে, নানা কারুকার্য্যের মধ্য দিয়ে বিস্তার করতেন অপূর্ব রাগরূপ। সবসময় বলতেন, গান শেখার ক্ষেত্রে গান শোনার ভূমিকা বিরাট। উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের যাবতীয় অনুষ্ঠানে শ্রোতার আসনে উপস্থিত থাকতেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, ‘বাবা’ বড়ে গোলাম আলি খাঁর নির্দেশে।


ছবিঃ সংগৃহীত


 বড়ে গোলাম আলি খাঁ সাহেবের কাছে একটানা অনেকদিন শিখতে পারেন নি সন্ধ্যা। খাঁ সাহেব তখন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কনফারেন্সে যেতেন – তখন কিছুকাল স্বাভাবিক কারণেই গান শেখানো সম্ভব হতনা। ওঁর সঙ্গে বেশ কিছু কনফারেন্সে গানও করেছেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। উত্তরপাড়ার বিখ্যাত ‘সঙ্গীতচক্র কনফারেন্স’ শুরু হয় ১৯৫৭ সালে। সে বছর সারারাত্রিব্যাপী উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করেন ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খাঁ ও গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।


সন্তোষ বসুমল্লিক, যামিনী গঙ্গোপাধ্যায়, আশু মল্লিক, ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খাঁ ছাড়াও, পন্ডিত চিন্ময় লাহিড়ী, পন্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, পন্ডিত এ টি কানন, ওস্তাদ মুনাব্বর আলি খাঁর কাছে তালিম নিয়েছেন গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, বিভিন্ন সময়ে। ছায়াছবির গান গাওয়ার সূত্রেও জ্ঞানবাবুর কাছে শিখেছেন সন্ধ্যা। ‘বসন্তবাহার’ (১৯৫৭) ছবিতে, বসন্তবাহার রাগে, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের (ও পরবর্তীকালে ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খাঁর) অন্যতম শিষ্য, পন্ডিত প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে গেয়েছিলেন গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় – “বাঁধো ঝুলনা তমালবনে এসো দুলি দু’জনে”, তবলা সঙ্গতে ছিলেন পন্ডিত শ্যামল বসু। জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের পরিচালনায় বেশ কিছু ভজনও রেকর্ড করেছিলেন সন্ধ্যা। ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খাঁ সাহেবের কাছে শেখা নানা রাগের খেয়াল ও বেশ কিছু ঠুংরি বিভিন্ন সময় আকাশবাণীতে ও দূরদর্শনে পরিবেশন করেছেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। ১৯৭১ ও ১৯৭৯ সালে হিস্ মাস্টার্স ভয়েস কোম্পানি থেকে দীর্ঘবাদন রেকর্ডে পাতিয়ালা ঘরানার ‘ফ্লেভার’ অক্ষুন্ন রেখে কোমল ঋষভ আশাবরী, শঙ্করা, মালকোষ, ভাটিয়ার, ইত্যাদি রাগে খেয়াল ও ঠুংরি পরিবেশন করেন তিনি। ৭০-এর দশকে, ওস্তাদ মুনাব্বর আলি খাঁ সাহেবের পরিচালনায় আটটি গান রেকর্ড করেন শিল্পী। তার মধ্যে চারটি ছিল ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খাঁ সাহেব গীত ঠুংরির বাংলা ‘ভার্সান’ ও অন্য চারটি ছিল, ওঁরই কাছে শেখা গাওটি, ললিত ইত্যাদি রাগের ওপর বাংলা গান।


ছবিঃ সংগৃহিত






        

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>