| 28 মার্চ 2024
Categories
গীতরঙ্গ

গীতরঙ্গ: গানের বই বইয়ের গান । সংগ্রামী লাহিড়ী

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,Book discussion of songs

সাদাকালো ছবির পর্দায় একটা অ্যাম্বাসাডর। স্টিয়ারিংয়ে সুদর্শন নায়ক। পাশে সুন্দরী নায়িকা। কিছুটা জড়সড়। যতই বল না কেন, মনটা কখনোই ঠিক খোলে না। কেমন যেন একটা দেওয়াল তুলে রাখে। অথচ জিজ্ঞেস করলেই ঝেড়ে অস্বীকার করবে, “কই না তো?”

খোলস থেকে তাকে বার করা যায় কী করে? বুদ্ধিমান নায়ক এক উপায় ভাবল। হাসিঠাট্টা করে যদি পরিবেশটা একটু লঘু করে দেওয়া যায়? যে ভাবনা, সেই কাজ।

“আচ্ছা এই গাড়িটা যদি সামনে না এগিয়ে পিছনে চলত?”

“ওমা, সে কী!”

“ধরো তোমার কলেজটা যদি হুস করে উড়ে গিয়ে ডায়মন্ডহারবারের নদীর ধারে চলে যেত? সেখানে গাছের ছায়ায় বসত ক্লাস, একজনই স্টুডেন্ট, একজনই প্রফেসর।”

“তাই নাকি? তা কী পড়াশোনা হত এমন কলেজে? ডাক্তারি?” কৌতুক ঝিকিয়ে ওঠে চোখে।

“ডাক্তারি! ক্ষতি কী? বল?”

স্টিয়ারিংএ বসা নায়কের ঠোঁটে উঠে এল শ্যামল গুপ্তের লেখা অবিস্মরণীয় গান,

‘ক্ষতি কী, নাহয় আজ পড়বে, মেটিরিয়া মেডিকার কাব্য

নয়তো বা ফার্মাকোলজিটাই নিয়ে আজ লেকচারে নাবব’

একটু শুনে নেওয়া যাক গানটি, স্মৃতির নুড়ি কুড়িয়ে নিজের গলায় গাইলাম।

খুব দ্রুত লয়ে শুরু হয় গান, ছোট ছোট সুর, সঙ্গে বেশ কিছু বাজনার অনুষঙ্গ, স্যাক্সোফোন আর ড্রাম দিয়ে তৈরী করা উচ্ছল রিদম। গাড়ির গতির সঙ্গে গান যেন তাল মেলাচ্ছে। আড়ষ্ট নায়িকার মুখে হাসি, গানের তালে তালে দুলছে মাথা। গুটির আড়ালে যেন প্রজাপতির পাখনার রং দেখা যায় ওই।

‘তারপর দৃষ্টির ছুরিতে মনের ডিসেকশন শিখবে

কিংবা স্টেথোস্কোপ লাগিয়ে নোটবুকে সিমটম লিখবে’

এই পর্যন্ত এসেই সব আমূল বদলে গেল।

সুরের টুকরোগুলো একপলকেই দুই সপ্তক জুড়ে লম্বা লম্বা টানে মায়া ছড়িয়ে দিল। বিট থেমে গেল, তবলার কাহারবা বোল রাজার মত মেজাজে জাঁকিয়ে বসল গানের মাঝে। এ যেন ছিল রুমাল হয়ে গেল বেড়াল।

কিন্তু না, গান আবার ফিরেছে দ্রুতলয়ের বিট আর স্যাক্সোফোনে।

‘ওরাল জবাবগুলো হওয়া চাই রীতিমত তালে সুখশ্রাব্য

নয়তো বা ফার্মাকোলজিটাই নিয়ে আজ লেকচারে নাবব’

ড্রামের বিট আর তবলার কাহারবা বোল লুকোচুরি খেলতে থাকে, গাড়ি এগোয় যেন পাখির মত ডানা মেলে। সঙ্গে গান।

‘হয়তো আউটডোরে এমনি ডিউটিটা কোনোদিন পড়বে

প্রেসক্রিপশন মত হয়তো মিক্সচারগুলো সার্ভ করবে

সবদিক আগে দেখে তবে তো ডিগ্রি দেবার কথা ভাবব!

নয়তো বা ফার্মাকোলজিটাই নিয়ে আজ লেকচারে নাবব!’

একদম শেষে উদ্দাম হয়ে ওঠে বিট। সুর চড়তে থাকে ধাপে ধাপে। ঝড় ওঠে গানে। তারসপ্তকে যখন মেটিরিয়া মেডিকার কাব্য ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছয়, ততক্ষণে ঝরণার মত স্বতঃস্ফূর্ত হাসিতে ভেঙে পড়ছে নায়িকা, তাল মিলিয়ে হাসছে স্টিয়ারিংএ বসা নায়ক। তার উদ্দেশ্য সফল। খোলস ছেড়ে গুটিপোকা বেরিয়ে এসে প্রজাপতি হয়ে গেছে। মহাত্মা হ্যানিম্যান কি স্বপ্নেও ভেবেছিলেন, তাঁর মেটিরিয়া মেডিকার বই এমন অসাধ্যসাধন করতে পারে? ঠিকঠাক সুর আর তাল মেশাতে পারলে প্রেসক্রিপশনের তেতো মিক্সচারও যে কত মিষ্টি হয়ে যায়, তা হাতেকলমে দেখিয়ে দিলেন সুরকার ও গায়ক মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়।

গানে বইয়ের প্রসঙ্গ বা বিখ্যাত বইয়ের ছায়ায় বাঁধা গানের উদাহরণ ভুরি ভুরি।

যেমন ধরা যাক মেঘদূতম। কালিদাসের অমর মহাকাব্য। আষাঢ়মাসের প্রথম দিনে আকাশে ঘনিয়ে এসেছে মেঘ। সজল হাওয়া ভেসে আসে দূর থেকে। বর্ষাঋতুর সূচনায় রামগিরি পর্বতে নির্বাসিত যক্ষের বিরহী হৃদয় ব্যাকুল হয়ে ওঠে। আকাশের মেঘকে পাঠায় তার দূত হিসেবে, দূর অলকাপুরীতে ফেলে আসা প্রিয়ার কাছে। মন্দাক্রান্তা ছন্দে রচিত হয় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গীতিকাব্য – মেঘদূত।

“আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে মেঘমাশ্লিষ্টসানুং

বপ্রক্রীড়াপরিণতগজপ্রেক্ষণীয়ং দদর্শ।।”

এর সম্মোহন এড়ান শক্ত। তাই প্রেমিকের আকুল বার্তা বয়ে নিয়ে উড়ে চলা বর্ষার প্রথম মেঘ অনেক গানেই তার সজল-শ্যামল ছায়া ফেলে গেছে। নজরুল যেমন মিয়ামল্লারে বাঁধলেন মেঘদূতের গান।

‘যাও মেঘদূত দিও প্রিয়ার হাতে

আমার বিরাহলিপি লেখা কেয়া পাতে’

গানটির ছত্রে ছত্রে কালিদাসের বিরহকাব্যের ছায়া, প্রিয়ার বিরহদশার বর্ণনা।

কেমন সে বর্ণনা? পড়ুন গানটি শুনতে শুনতে।

‘আমার প্রিয়ার দীরঘ-নিশাসে, থির হয়ে আছে মেঘ, যে দেশের আকাশে…’

কালিদাস তাঁর কাব্যে লিখলেন,

“রুদ্ধাপাঙ্গপ্রসরমলকৈরঞ্জনস্নেহশূন্যং

প্রত্যাদেশাদপি চ মধুনো বিস্মৃতভ্রূবিলাসম

ত্বয়াসন্নে নয়নমুপরিস্পন্দি শংকে মৃগাক্ষ্যঃ…”

কোমর ছাপিয়ে নিচে নেমেছে অলকের ঢল, নয়নে তার স্নিগ্ধ অঞ্জন নেই, প্রসাধনী দিয়ে ভ্রূবিলাস ভুলে গেছে, দীর্ঘনিঃশ্বাসে বাতাস ভারী। মেঘ, তুমি গিয়ে থির হয়ে দাঁড়ালেই সেই মৃগনয়নী চঞ্চল নেত্রে উপরের দিকে দৃষ্টিপাত করবে।

গানের সঞ্চারীতে নজরুল বলছেন কী করে যক্ষপ্রিয়াকে চিনে নিতে হবে।

‘পাইবে যে দেশে কুন্তল সুরভি বকুল ফুলে

আমার প্রিয়া কাঁদে কেশ এলায়ে সেই মেঘনা কূলে’

কলমের এক আঁচড়ে কবি সার্থকভাবে ফুটিয়ে তুললেন প্রিয়ার ক্রন্দসী রূপটি। বকুলের গন্ধভরা এলোচুল ঢেকে দিয়েছে মুখ। প্রিয়বিরহের বেদনায় যক্ষপ্রিয়ার চোখে আজ ধারাশ্রাবণ।

কালিদাসের উত্তরমেঘের পংক্তির মধ্যে পাই সে বর্ণনা।

“নূনাং তস্যাহ প্রবলরুদিতোচ্ছু ন নেত্ৰং প্রিয়ায়াঃ

নিঃশ্বাসানামশিশিরতয়া ভিন্নবর্ণাধরোষ্ঠম।

হস্তন্যস্ত মুখমসকলব্যাক্তি লম্বালকত্বা

দিন্দোৰ্দৈন্যং ত্বদনুসরণক্লিষ্টকান্তেবিভর্তি।।”

অঝোর ধারায় অশ্রুতে স্ফীত নয়নদুটি, অধরোষ্ঠ বিবর্ণ, লুটিয়ে আছে খোলা চুল। তার ফাঁক দিয়ে অল্প দেখা যায়, মুখটি হাতের ওপর স্থাপিত, যেন মেঘ এসে ঘিরেছে চাঁদকে।

“তস্মিন্নদ্রৌ কটিচিদবলাবিপ্রযুক্ত স কামী

নীত্বা মাসান কনকবলয়ভ্রংশরিক্তপ্রকোষ্ঠঃ।।“

বিরহে শরীর কৃশ হয়েছে, মণিবন্ধ ক্ষীণ, তাই কনকবলয় স্খলিত হয়েছে, প্রকোষ্ঠ (হাত) এখন শূন্য, রিক্ত।

নজরুলের গানের চতুর্থ স্তবকে আসে সেই উল্লেখ।

‘স্বর্ণলতার সম যার ক্ষীণ করে, বারে বারে কঙ্কন, চুড়ি খুলে পড়ে

মুকুলবাসে যথা বরষার ফুলদল বেদনায় মুরছিয়া আছে আঙিনাতে।’

মিয়ামল্লারে বাঁধা গানটি সামান্য ঢিমে চালে চলে, বর্ষার মেঘের ছায়া ঘনিয়ে আসে অন্তরে।

আধুনিক যুগের কিংবদন্তী কম্পোজার সলিল চৌধুরীও মেঘদূতের মায়া এড়াতে পারেননি। আশির দশকে ‘মৌচোর’ নামে একটি ছায়াছবিতে নায়িকার গলায় গান দিলেন,

‘মেঘ তুই যা যা যা

যেথা মোর প্রিয় আছে সেথা বরষা।

যদি জল না থাকে তোর, দুচোখের জল নিয়ে যা, যা, যারে যা।’

এখানেও সেই মেঘের হাতেই পাঠানো হচ্ছে প্রেমিকের মান অভিমানের সংবাদ।

কালিদাসের আরেকটি বিখ্যাত রচনায় আসি এবার – অভিজ্ঞানশকুন্তলম। দুষ্মন্ত-শকুন্তলার প্রেমকাহিনি নিয়ে টান টান নাটক। রাজার ছেলে দুষ্মন্ত আংটি পরিয়ে দিলেন আশ্রমকন্যা শকুন্তলাকে। ভুলে যেতেও দেরি হল না অবশ্য। বেচারা দুর্বাসা দোষের ভাগী হলেন বটে, তাঁর অভিশাপেই নাকি এমন ভুল! কিন্তু বুদ্ধিমান পাঠক হাড়ে হাড়ে জানেন ক্ষণিকের চিত্তচাঞ্চল্যের থেকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাজা সাধারণত ভুলেই যান।

কালিদাস অবশ্য তাঁর জাদু লেখনীতে অমর করে রাখলেন এক আশ্রমকন্যা আর এক রাজাধিরাজের অসম প্রেমগাথা।

সলিল চৌধুরীর বিখ্যাত গানে প্রাণ পেল অভিজ্ঞান শকুন্তলম নাটকের একটি খন্ডচিত্র।

দুষ্মন্ত ফিরে গেছেন নিজের রাজ্যে, কিন্তু প্রণয়মুগ্ধ রাজার অন্তর জুড়ে আছে ফুলের মত নিষ্পাপ, আশ্রমবালিকা শকুন্তলা।

‘নাম শকুন্তলা তার, যেন বৃন্তচ্যুত ফুলভার

ছন্দময়ী যেন তটিনী, বনহরিণী, সে আমার, সে আমার’

প্রিয়বিরহে শকুন্তলাও কাতর, মন উচাটন। দুই প্রিয়সখীর কাছে মর্মবেদনা জানাচ্ছে,

‘সখীরে প্রিয়ংবদে, অনসূয়ে বল না

এ কী রে আমার হল, মনে মন রয় না

কেন তারে হেরিলাম, হরিল সবই আমার

রাজাধিরাজ কুমার, মনমৃগ সে করে শিকার

অন্তরালে যায় চলিয়া, হৃদি দলিয়া, লীলা তার বোঝা ভার।’

দুষ্মন্তও ভুলতে পারছেন না কণ্বমুনির আশ্রমে কয়েকদিনের সেই মধুময় স্মৃতি। রাজসিংহাসন তুচ্ছ হয়ে যাচ্ছে প্রণয়ের টানে।

কিসেরই রাজা আমি, কী হবে সিংহাসনে

হীরামণি মাণিক্যে, বিলাসে ও ব্যসনে?

ভিখারি তাহারি প্রেমে হয়েছি, মেনেছি হার।’

‘শ্রীকান্তের উইল’ ছবিতে দুষ্মন্ত-শকুন্তলার নাটক অভিনয় হচ্ছে। সে দৃশ্যে অন্য মাত্রা এনে দিয়েছিল যেশুদাস ও সবিতা চৌধুরীর কণ্ঠে গাওয়া বিখ্যাত গানটি। এখানে গাইলাম ছোট্ট করে।

গানওলা সুমনের প্রথম সুপারহিট অ্যালবামটির নাম ‘তোমাকে চাই’। যে গানের নামে অ্যালবামটির নাম, সেটিও ততধিক বিখ্যাত। ‘তোমাকে চাই’ ঝড় তুলেছিল শ্রোতার মনে। কথা ও সুরের আবেদনে অনন্য গানটি প্রতিমুহূর্তে শুধু একটিই নিবিড় চাওয়া নিয়ে ঘুরে ফিরে আসে। আর কিছু না, শুধু ‘তোমাকে চাই’।

এক কাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই

ডাইনে ও বাঁয়ে আমি তোমাকে চাই

দেখা না দেখায় আমি তোমাকে চাই

না-বলা কথায় আমি তোমাকে চাই…

শীর্ষেন্দুর কোন নতুন নভেলে

হঠাৎ পড়তে বসা আবোলতাবোলে

অবোধ্য কবিতায় ঠুংরি খেয়ালে

স্লোগানে স্লোগানে ঢাকা দেয়ালে দেয়ালে

সলিল চৌধুরীর ফেলে আসা গানে

চৌরাশিয়ার বাঁশি মুখরিত প্রাণে

ভুলে যাওয়া হিমাংশু দত্তর সুরে

কোন্ কবেকার অনুরোধের আসরে

তোমাকে চাই, তোমাকে চাই, তোমাকে চাই, তোমাকে চাই…

তোমাকে চাই, তোমাকে চাই, তোমাকে চাই, তোমাকে চাই…

পছন্দের বই পড়া, গান শোনা, জীবনের সব রং আর রসে, অনুভবে, উৎসবে শুধু একটিই চাওয়া – ‘তোমাকে চাই’। শীর্ষেন্দুর উপন্যাসের সঙ্গে সুকুমারের আবোলতাবোল মিলেমিশে যায় গানে, শ্রোতার মনে চিরস্থায়ী হয়ে যায় অমোঘ দুটি কথা, ‘তোমাকে চাই’।

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত