এক ঘোরলাগা কাব্য : জিললুর রহমানের একটি মেরাজের রাত্রে ঘুমিয়েছি
বিচিত্রা সেন
“একটি মেরাজের রাত্রে ঘুমিয়েছি” এক ঘোর লাগানো কাব্য। পড়তে পড়তে কেমন এক ধাঁধায় পড়তে হয়।মনে হয় সাত আসমানের এই ভ্রমণে পাঠকও বুঝি কবির সাথী হয়েছে। কবির সাথে ঘুরতে ঘুরতে পাঠক যখন চেনা পরিচিত চরিত্রগুলোকে সামনে পেয়ে যায়, যখন দেখা যায় কবি তাঁদের প্রশ্নবানে কুপোকাত করছেন, তখন এক ধরনের অনির্বচনীয় অনুভূতি পাঠককে আপ্লুত করে।
যে কবি পাঠকের মনে এমন ঘোর লাগা অনুভূতির সৃষ্টি করেছেন তিনি হলেন উত্তর আধুনিকতার কবি হিসেবে খ্যাত কবি জিললুর রহমান। এ কাব্যগ্রন্থের শরীরগঠনে তিনি অভিনবত্ব দেখিয়েছেন। কবিতাগুলো সপ্তপদী। প্রতি চরণে সাত মাত্রার দুই পর্ব। অন্ত্যমিল বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কক খখ গগ ক,তবে কিছু কিছু কবিতায় ব্যতিক্রম ঘটেছে।
কবি বিজ্ঞানের ছাত্র,পেশায় চিকিৎসক। আবার কবি ধর্মেও বিশ্বাস রাখেন। এ কাব্যে কখনো কখনো ধর্ম ও বিজ্ঞান সমান্তরালে এসে কবিকে সংশয়ে ফেলেছে। মানুষ মরলে কোথায় যায়, এ নিয়ে কবির অনন্ত কৌতূহল। তিনি বলছেন–
“পড়েছি অ্যানাটমি পড়েছি অ্যালকেমি
আত্মা খুঁজে সারা করিনি আলসেমি
মরেছে নানিজান ছিলাম হাত ধরে
মরেছে কত লোক পাশেই ঘুরে ঘুরে
কোথাও দেখিনি তো আলোর ছিটেফোঁটা
হঠাৎ ফুস করে আকাশে ভেসে ওঠা
ঠিকুজি আত্মার মেলেনি কোনোদিনই”
এই কৌতূহল মেটাতেই হয়তো কবির আকাশ ভ্রমণ। এ শুধু আকাশ নয়,একেবারে সাত আসমান। স্বর্গ-নরক দর্শন করে তবে তাঁর কৌতূহল নিবৃত্তি। কবি জানেন স্বাভাবিকভাবে সাত আসমানে ভ্রমণ তাঁর দ্বারা সম্ভব নয়।তাই তাঁকে একটি মেরাজের রাতের আশ্রয় নিতে হয়েছে। কবির ভাষায়-
“একটি মেরাজের রাত্রে ঘুমিয়েছি
হঠাৎ দেবদূত বলল, ‘ঘুরে আসি’
বুঝেছি দফা শেষ, বউকে বলে যাই
জানাল ইশারায় ‘সময় অত নাই’
নেহাত হতাশায় উড়েছি বোররাকে
দেখেছি আসমান সাতটি পাকে পাকে
ভ্রমণ শেষে ভোরে আসব ফিরে বুঝি?”
বোররাকে সওয়ার হয়ে কবি উড়তে শুরু করলেন। আকাশের কথা বললেই প্রথমেই আমাদের মাথায় আসে চাঁদের কথা। আর চাঁদে যাবে আর চাঁদের বুড়িকে দেখবে না তা কি হয় নাকি? আসমানে উঠেই কবির সাথে দেখা হয়ে যায় চাঁদের বুড়ির। কবি তাঁর হাতে চরকা দেখে আবদারও করেন। শুধু তাই নয়,কবি খুঁজতে থাকেন শনি দেবতাকেও–
“যাবার কালে পথে দেখেছি কত গ্রহ
শনির গলা কাটা মোটেও দেখিনি তো
চাঁদের বুড়িমাকে বলেছি সুতো কেটে
আমাকে দুটো জামা বানিয়ে এনে দিতে
কেবল ভয় ছিল কখন ব্ল্যাকহোলে
বাবাজি বোররাক আমাকে নিয়ে ফেলে
এ মহাশূন্যেতে কত যে বিগ্রহ।”
এরপর কবির সাথে দেখা আদি পিতা আদমের। তারপরে লালন এবং হাছন রাজাকেও কবি দেখতে পান। এরপরে কবি চলে যান দ্বিতীয় আসমানে। এ আসমানে কবি প্রথম দেখা পান মুসা নবীর। আমরা জানতে পারি মুসা নবী আমাদের দেশের দুর্নীতির খবরও রাখেন।তাই কবিকে তিনি বলেন–
“যখন বোররাকে উড়েছি কোণেকানে
মুসার দেখা মেলে দ্বিতীয় আসমানে
বলল, ‘ভালো হল, লাঠিটা নিয়ে যাও,
তোমার দেশে নেমে মাটিতে ছেড়ে দাও
যেভাবে দুর্নীতি কাছারি দরগায়
যেন এ আজদাহা সকলে গিলে খায়’
আসাটা হাতে আছে আশাটা কোন্খানে?!”
এরপর কবির সাথে একে একে দেখা হয় প্রভু যীশু,লূত নবী,নূহ নবী এবং গৌতম বুদ্ধের সাথে।
এদের সাথে কথোপকথন সেরে কবি চলে যান তৃতীয় আসমানে। এ আসমানে উঠে প্রথমেই কবি দেখা পেয়ে যান বাল্মীকি মুণির। কবি বলেন-
“তৃতীয় আসমানে দেখেছি বাল্মীকি
মুকুটে মণি তার জ্বলছে ঝিকিমিকি
বলে অযোধ্যায় রামকে কোথা পাবে
সে ছিল কবি-মনে ছিল না ধরাধামে
তোমরা তাকে নিয়ে অযথা মরো লড়ে
এখন বিভীষণ, সীতাও ঘরে ঘরে
অথচ ভূভারত জ্বলছে ধিকিধিকি”
এরপর কবি দেখা পান কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তারপর কবি হন্য হয়ে খুঁজতে থাকেন রবি ঠাকুরকে। অবশেষে তাঁরও দেখা মেলে–
“সোনারতরী ধায় কবিকে একা ফেলে’
দাড়িটা চুলকায় নীরবে দুলে দুলে
বলো তো কবিগুরু ‘কী পেলে এত লিখে
রাজ পুরস্কার গলায় পরেছিলে?
নাকি সে অমিটের মতন চটুলতা
নিজেকে জাহিরের নানান গূঢ়কথা’
‘শতবর্ষ গেল’— ঈষৎ শ্লেষে বলে…”
এরপর কবির আরও ওপরে ওঠার পালা। চতুর্থ আসমানে গিয়ে কবি দেখা পান মহাকবি হোমারের। এরপর কবি দেখতে পান দার্শনিক এরিস্টটলকে। তাঁদের সাথে কথোপকথন সেরে কবি চলে যান পঞ্চম আসমানে। তারপর একে একে সাত আসমান পর্যন্ত পৌঁছে যান কবি। প্রতিটি আসমানে তাঁর সাথে দেখা হতে থাকে পৃথিবীতে নামে অমরত্ব পাওয়া একেকজন ব্যক্তিত্বের,একেকজন চরিত্রের। কখনো শরৎচন্দ্র, কখনো দান্তে,কখনো শেক্সপীয়র,কখনো কালিদাস একের পর এক এসে হাজির হতে থাকেন কবির চলার পথে।শেষ পর্যন্ত কবি স্বর্গ-নরকও দর্শন করেন। স্বর্গে গিয়ে যেমন তিনি দেখতে পান আদি মাতা ইভ,কুমারী মাতা মেরীকে,তেমনি সেখানে আছেন বিজ্ঞানী আর্কিমিডিস এবং নিউটনও। আছেন একিলিস এবং ইসরাফিলও। কবির ভাষায়–
“দেখি ইসরাফিল শিঙ্গা হাতে হায়
কোটি বছর ধরে দাঁড়িয়ে বেহুদাই
পাশেই সুরাপট পাশেই ফলাহার
বলছি এসো করি সুরার ব্যবহার
পায়ে তো ধরে খিল করছে ঝিনঝিন
সময় হলে পরে বাজাবে তবে বীণ
ইসরা উঁকি মেরে সুরাটা পিয়ে যায়”
কত কত প্রিয়মুখ স্বর্গে! কবি বিমোহিত সবাইকে দেখে।যুধিষ্টির,চাঁদ সওদাগর,ফেরদৌসী,গালিব আরও কত কত জন। সবার সাথেই কবি কিছু না কিছু বলেন। এদিকে সময় গড়িয়ে যায়,বোররাক চেঁচিয়ে ওঠে–
“এদিকে বোররাক চেঁচিয়ে ডেকে ওঠে
সকাল হয়ে গেলে নামাবো কোন্ গোঠে
বলেছি রাত্রিকে লম্বা করে দাও
দেখার কত বাকি দেখিনি সেই নাও
করে যে নৌকাটা বৈতরণীর পার
তাকে তো একবার দেখাটা দরকার
নাখোশ বোররাক হারিয়ে দিশা, ছোটে…”
এক পর্যায়ে কবি দেখতে চান সর্বশক্তিমান স্রষ্টাকে। কিন্তু তাঁকে দেখা যায় না। কবি বলেন–
“লওহে মহফুজে দু-চার কথা বলি
ভাবছি সে মহান কোথায় গেল চলি
জোরসে হেঁকে ডাকি আমাকে দেখা দাও
‘আমাকে বিশ্বাসে মনটা ভরে চাও’
এতটা টেনে এনে এ কোন্ লীলা কও
তুমি কি সকলের একক প্রভু নও!
তখতে ভেসে থাকে মেঘের পদাবলি”
মহফুজের এ কথায় কবি তৃপ্ত হন না। কবি আরও জানতে চান।তখন–
“জলদ গম্ভীর কণ্ঠে বাণী আসে
হৃদয় ভরে যায় স্বপ্ন আর ত্রাসে
‘তখতে বসে কেউ চালাতে পারে বুঝি
নিখিল বিশ্বটা চক্ষু দুটো বুজি’
কোথায় দেখা পাবো খুঁজতে কোথা যাই
বলল ‘সৃষ্টির ভেতরে খোঁজা চাই’
তখতে ঝিঁঝিঁ ওড়ে শুভ্র মেঘ ভাসে”
নিপীড়িত মানুষের প্রতিনিধি হয়ে কবি পরম করুণাময়ের কাছে জানতে চান, স্বর্গে এত এত জায়গা থাকতে পৃথিবীতে বাস্তুহীনের সংখ্যা এত বেশি কেন?
স্বর্গ দেখে ফিরে আসার সময় কবি নরকও ঘুরে আসেন। সেখানে যন্ত্রণাকাতর মানুষকে দেখে কবিও যন্ত্রণাবিদ্ধ হন। সেখানে যেমন আছে ক্লিুউপেট্রা,কামাখ্যাদেবী,জুলেখা, মেরিলিন, অড্রে, ইডিপাস,ওথেলো তেমনি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী হাজারো রাজাকার।
তারপর একসময় ভোর হয়।বোররাক ফিরে আসে এ মাটির পৃথিবীতে। শেষ হয় কবির স্বপ্নদৃশ্য। তবে কাব্যগ্রন্থটি এখানেই শেষ নয়। এরপরও আছে আরও অনেক সপ্তপদী। কী আছে সে কবিতাগুলোতে? একটি মেরাজের রাতের এ স্বর্গ-নরক ভ্রমণ কি সমস্তই কবির কল্পনা নাকি এর অন্তরালে আছে অন্য কোনো দর্শন তা জানতে গেলে সম্পূর্ণ কাব্যগ্রন্থটি পড়তে হবে। শেষ পর্যন্ত পড়ার পরই জানা যাবে কবির আসল আকাঙ্ক্ষা। একজন মাটির পৃথিবীর কবি কোন খেয়ালে সাত আসমান ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েছিলেন তার রসাস্বাদন করার জন্য আমাদেরকে পাঠ নিতে হবে “একটি মেরাজের রাত্রে ঘুমিয়েছি” কাব্যের। আমি আশাবাদী শরীরী অভিনবত্বে এবং বিষয়বস্তুর চমৎকারিত্বে কাব্যটি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে স্থান করে নেবে। এমন একটি অসাধারণ কাব্য পাঠককে উপহার দেওয়ার জন্য কবি জিললুর রহমানকে ধন্যবাদ জানাতেই হয়।