| 3 অক্টোবর 2024
Categories
গীতরঙ্গ

গীতরঙ্গ: সেকালের সাহিত্য-দ্বন্দ্ব । শমিতকুমার দাস

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,book-review-jyotirindranath-nandi-gitoranga-special
জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী একালে বহুপঠিত নন, যদিও অত্যন্ত শক্তিশালী এই কথাকারের উপন্যাস, বিশেষত ছোটোগল্প এখনও যথেষ্ট চিন্তার খোরাক জোগায় মননশীল পাঠকের কাছে। তাঁর সাহিত্যক্ষেত্রে আবির্ভাব-লগ্নটি বাংলার এক টালমাটাল পরিস্থিতিতে। সেসময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেমন উত্তাল, বাংলা কথাসাহিত্যেও তেমনই নতুন আঙ্গিক ও বার্তা নিয়ে আবির্ভূত হচ্ছেন একঝাঁক কথাসাহিত্যিক–সমরেশ বসু, বিমল কর, রমাপদ চৌধুরী, অমিয়াভূষণ মজুমদার, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে নিভৃতচারী জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী এবং আ-জীবন তা-ই থেকে যাবেন। তিন বন্দ্যোপাধ্যায় আছেন স্বমহিমায়,যদিও জ্যোতিরিন্দ্রর প্রথম উপন্যাস প্রকাশের আগেই মর্ত্যজীবন থেকে বিদায় নেবেন বিভূতিভূষণ (১৯৫০) এবং কয়েকবছর পরেই মানিক(১৯৫৬)। তারাশঙ্কর আরো অনেক বছর থাকবেন, কিন্তু তাঁর দীপ্ত প্রতিভা যেন অবসন্ন, ম্লান হয়ে আসার মুখে।
জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর প্রথম উপন্যাস সূর্যমুখী প্রকাশিত হয় ১৯৫২ সালে। এই দশকে যে উপন্যাসগুলো তিনি লেখেন নিঃসন্দেহে তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ বারো ঘর এক উঠোন (১৯৫৬),যা আজও তাঁর প্রধান সাহিত্যকীর্তি হিসেবে গণ্য ও মান্য। কিন্তু এই দশকেই লেখা গ্রীষ্মবাসর উপন্যাস ততটা পরিচিতি পায় নি, কিন্তু এই ছোটো উপন্যাসটিতে সে সময়ের এমন এক সাহিত্যদ্বন্দ্ব ও সাহিত্যিকদের পারস্পরিক সম্পর্কের ছবি ফুটে উঠেছে যা বাংলা উপন্যাসে খুব বেশি দেখা যায় না এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে আজও প্রাসঙ্গিক। 
গ্রীষ্মবাসর প্রকাশিত হয় ১৯৫৯ সালে। সেইসময় অর্থাৎ পাঁচের দশকে আ-মূল ঝাঁকুনি দেওয়া এক ঝাঁক কবি ও গদ্যকার উঠে আসতে থাকেন যাঁরা বাংলা সাহিত্যের গতানুগতিক ধারাকে অন্যমুখে ঘুরিয়ে দিতে চাইলেন। প্রবীন ও নবীনের এই দ্বন্দ্বকে কাহিনিধারায় নিয়ে এসেছেন লেখক তপতী চরিত্রর সূত্রে অথবা আরেকটু নির্দিষ্টভাবে বললে তপতীর বাড়িতে অনুষ্ঠিত হওয়া গ্রীষ্মবাসর নামক সাহিত্যসভার সূত্রে।
খুব সংক্ষেপে কাহিনি কাঠামো এই যে তপতী এক কলেজছাত্রী, কিন্তু সেই বয়সেই সে গল্পকার হিসেবে সাড়া জাগিয়ে তুলেছে। সেই কারণে তার গর্বিত বাবা ইঞ্জিনিয়ার সচ্চিদানন্দ এবং মা বিভা বাড়িতে সাহিত্যপাঠ ও আলোচনার আয়োজন করেছেন এবং নিমন্ত্রণ জানিয়েছেন প্রবীন নবীন সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সংবাদপত্রের সম্পাদক ও প্রকাশকদের। বিভাকে মনে হয় সাহিত্য অনুরাগী, পরে বোঝা যায় এই আয়োজন তপতীর পাত্রানুসন্ধানের জন্য যতটা, ততটা সাহিত্যের জন্য নয়। অন্তত বিভার কাছে। কিন্তু তপতী যাকে ভালোবাসে এবং যে একদিন তপতীকে বলেছিল, ‘তপতী, তোমায় যত বেশি দেখছি আমার তত গল্প লিখতে ইচ্ছে করছে,আমার মনে হয় আমি খুব ভালো গল্প লিখতে পারব’–সেই নবীন সাহিত্যিক অরুণ তপতীর সুন্দরী এবং বিধবা দিদি জয়তীর সঙ্গে দীর্ঘসময় অতিবাহিত করে অন্ধকার বাগানে। এই ঘটনা এবং বিভাবতীর ঘোষণা যে অরুণের চেয়ে জাস্টিস রাধারমণের দাদার ছেলে নীরদ, যার আমেরিকা যাওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল, অনেক ভালো পাত্র, তপতীকে আত্মহননের চেষ্টার দিকে ঠেলে দেয়।

আসলে এই কাহিনির আড়ালে লেখক বুনে তুলছেন তৎকালীন সাহিত্যজগতের টানাপোড়েন। উপন্যাসে যার প্রথম ইঙ্গিত পাই ইতিহাসের অধ্যাপক সুধাবিন্দু রায় ও সোম প্রকাশনীর কর্ণধার পিনাকী সোমের ঘটনায়। বিখ্যাত সোম প্রকাশনীতে সুধাবিন্দু কলিঙ্গ-যুদ্ধের ওপর লেখা তাঁর ধারণায় ‘চমৎকার গবেষণামূলক মূল্যবান’ বইয়ের পাণ্ডুলিপি জমা দেন। দুবছর পর পিনাকী সোম তাঁকে বলেন, ‘গল্প-উপন্যাস ছাড়া আমি এখন কিছু ছাপব না।’ অথচ এই পিনাকী সোমই আবার লেখিকা-যশোপ্রার্থী চামেলি নাগের স্বামী পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক নবারুণ নাগকে বলেন, চামেলির ছোটোগল্পর পাণ্ডুলিপি দেখে, ‘ছোটগল্প অচল। উপন্যাস নিয়ে আসুন। কালই আমি আপনার স্ত্রীর উপন্যাস ছাপতে পারি।’ অর্থাৎ সে যুগটা যেন উপন্যাসের যুগ। এখন অবশ্যই অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। প্রবন্ধর বইয়ের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে,ছোটগল্পও তা-ই, কিন্তু আম পাঠকের কাছে উপন্যাস আজও একনম্বরে। বাণিজ্যিক পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যাগুলোয় বহুল পরিমানে উপন্যাস প্রকাশিত হওয়াই সে কথা প্রমাণ করে। এখানে জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর তীর্যকতা লক্ষণীয় যে, তিনি মূলত কথাসাহিত্যিক হয়েও অনায়াসে তৎকালীন উপন্যাস-প্রবণতাকে ঈষৎ ব্যঙ্গ করেছেন, প্রকাশকের মনোভাবকেও।
কিন্তু এর চেয়েও আগ্রহ জাগানো বিষয় হল সাহিত্যিকদের পরস্পরের প্রতি ব্যবহার। সামনে গভীর বন্ধুত্ব,  প্রশংসা, মনে পোষণ করা ঈর্ষা বা অবজ্ঞাকে গোপন করে। এতো আধুনিক যুগের চিত্র। আরও বেশি হয়তো, কারণ এখন প্রতিদ্বন্দ্বিতার যুগ, অপরকে যেনতেনপ্রকারেণ মেরে বেরিয়ে যাওয়ার সময়। সাহিত্যিক মতভেদ, প্রবীন নবীনের দ্বন্দ্ব সে তো চিরকালীন,  থাকবেই। এই উপন্যাসেও তা আছে, আসব সে কথায় পরে, কিন্তু এই যে পারস্পরিক ঈর্ষাজাত অবজ্ঞা ও বিদ্বেষ তা চমৎকার প্রকাশ পেয়েছে নানা ঘটনার বর্ণনায়। এখানে যেমন যুগসন্ধির সম্পাদক ভূমেন্দ্রনারায়ণ তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু বাংলার সবচেয়ে বিক্রীত সাহিত্যিক  ব্যোমকেশের একটিও উপন্যাস না পড়ে তাঁর সম্পর্কে ভাবেন, ব্যোমকেশ কম মেমরির মাথামোটা লোক। আজেবাজে চরিত্র সাজিয়ে মোটা দাগের হাজার দেড়হাজার পাতার উপন্যাস রচনা করেন। অথচ নিজের কাগজে তিনি ব্যোমকেশের লেখা ছাপেন। অন্যদিকে ব্যোমকেশও ভাবেন ভূমেন্দ্র কোনো নীতি আদর্শ নেই। থাকার মধ্যে আছে বেনিয়াবুদ্ধি আর তাই সে ডানদিকে একবার বাঁদিকে ঝুঁকে চলেন। হায় রে,জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী যদি দেখে যেতেন এখন কত্ত ভূমেন্দ্রনারায়ণ আাছেন সংবাদের জগতে!
 

এমন আরও কিছু ঘটনা আছে, কিন্তু প্রধান বিষয় হয় উঠেছে নবীন-প্রবীনের দ্বন্দ্ব। সাহিত্যে এটা নতুন কিছু নয়, যুগের পরিবর্তনের বিষয়, কিন্তু তা বিদ্বেষ হয়ে উঠলেই সমস্যা। তরুণ সাহিত্তিকদের মধ্যে আছে কথাকার অরুণ, মোহন, চন্দ্রনাথ, শিতিকন্ঠ, কবি জয়দ্রথ, রামবিজয়, নরহরি, শিবশংকর আর নাট্যকার মস্কো ঘুরে আসা কৃত্তিবাস। এদের মতে, ‘ভালমানুষি সাহিত্যের দিন শেষ হয়েছে। সমাজ এখন অনেক বেশি জটিল, অন্ধকারাচ্ছন্ন মানুষের মন’ তাই এখন সাহিত্যে সরলতা চলবে না। পশ্চিমি সাহিত্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগ এদের তাই  কথায় কথায় “‘ইনট্যুইশন’, উপলব্ধি, চৈতন্য, সুররিয়ালিজম, প্রতীকী, রিলকে, এলুয়ার্ড, এলিয়ট, জীবনানন্দ, অ্যাডমিশনস অব নেচার, পোয়েটিক সিম্বল’ উঠে আসে। ব্যোমকেশরা অর্থাৎ ব্যোমকেশ,  প্রবীন কবি প্রভুদয়াল (যার কবিতা সম্পর্কে নরহরি বলে স্কুলের ছেলেদের পাঠ্যবইয়ের কবি বলে তার পাঠক বেশি), অপেক্ষাকৃত অল্পবয়সী অনাদি, নীলাদ্রি এই বিদেশী বিষয়গুলোকে তত গুরুত্ব দেয় না। মূল  দ্বন্দ্ব সাহিত্যে শালীনতার, যা সে সময় সাহিত্যজগৎকে দ্বিধাবিভক্ত করেছিল, তাকেই ব্যক্ত করেছেন জ্যোতিরিন্দ্র আশ্চর্য নৈর্বযক্তিকতার সঙ্গে। ব্যোমকেশ যেমন পুরনো যুগের প্রতিনিধির মত অনায়াসে বলেন যে আধুনিক কালের সাহিত্য কিছুই হচ্ছে না (আমরাও তো এখন তাই বলে থাকি অহরহ), কিন্তু আশ্বাস দেন উন্মার্গগামিতার ঝোড়ো হাওয়া থেমে গেলে সাহিত্য নবপত্রে সেজে উঠবে। বাংলার সবচেয়ে বিক্রীত লেখকের কথার প্রতিবাদ তরুণরা করলেও ব্যোমকেশ পাত্তা দেন না। এই শালীন ব্যোমকেশ নিজের মেয়ে অনেক রাতে বাড়ি না ফিরলেও গুরুত্ব দেন না, কারণ তাঁর কাছে নতুন উপন্যাসের প্রুফ দেখে পরদিন প্রেসে পাঠানো অনেক জরুরী। স্ত্রীর উদ্বেগের উত্তরে বলেন, ‘মরুক গে তোমার মেয়ে।’এখানে জ্যোতিরিন্দ্র যেমন ব্যোমকেশের শালীনতার মুখোশ খুলেছেন, তেমনি ব্যোমকেশের মেয়ে লিলির সূত্রে উন্মোচন করেছেন তরুণ সাহিত্যিক উদয়নাগের স্বরূপ। মদ্যপানে অনভ্যস্ত লিলিকে বারে নিয়ে মাতাল করে নিজের লেখা গল্প পড়ে শোনায়। গল্প শোনার পর অভিভূত লিলি যখন বলে, ‘এত ভাল হয়েছে আপনার লেখাটা, ইচ্ছে করছে বুকে করে রাখি’, তখন উদয় তার বুকের কাছে হাত ওঠায়। “আমি পারব আমি রাখছি।’ লিলি হঠাৎ একটু কুঁজো হয়ে হাসে, ‘আচ্ছা দাঁড়ান দাঁড়ান, ব্লাউজের বোতামটা খুলে নিই।” পরিচ্ছেদ শেষ হয় বুক ও গলার কাছে পুরুষের উষ্ণ নিশ্বাস অনুভব করতে করতে লিলির নেশাচ্ছন্ন হয়ে পড়ায়।
কিন্তু এই প্রবীন-নবীনের দ্বন্দ্বে বলি হয় তপতী, বলা যায় তার গল্প। তার দিদি জয়তীর আদলে বিধবা নারী রুনির চরিত্র গড়ে তোলে তপতী। রুনি দেখে তার ভাইয়ের মাস্টারের বলিষ্ঠ দেহ,  সে রুনিকে দেয় তার কবিতা পড়তে। এরপর পরিণতি টানতে গিয়ে তপতী দো-টানায় পড়ে। শারীরিক মিলন গল্পর স্বাভাবিক পরিণতি হলেও তপতী জানে যে বাংলার সবচেয়ে খ্যাতিমান সাহিত্যিকের তা ভালো।লাগবে না। তরুণ লেখকদের প্রশংসার চেয়ে সে শেষপর্যন্ত গুরুত্ব দেয় ব্যোমকেশের পিঠ-চাপড়ানিকে এবং গল্প শেষ করে রুনির ত্যাগে চাঁপাগাছ তথা প্রকৃতিকে আপন করে নিয়ে। নবীন সাহিত্যকরা তাকে ‘এসকেপিস্ট’ বলে, বলে সত্যকে বিকৃত করেছে, কিন্তু প্রত্যাশামতোই ব্যোমকেশ এবং তার দল ধন্য ধন্য করে। কিন্তু বাস্তবে জয়তী অন্ধকার বাগানে তপতীরই প্রেমিক অরুণের সঙ্গে সময় কাটিয়ে বুঝিয়ে দেয় শরীরের চাহিদা প্রকৃতি  পূরণ করতে পারে না। এই তীব্র আয়রনি জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর বৈশিষ্ট্য। তাঁর একাধিক উপন্যাসে এটা দেখা যায়। জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী বাংলা সাহিত্যের একজন নিষ্ঠুর লেখক, কোনো চরিত্রর প্রতিই যাঁর পক্ষপাতিত্ব নেই। এই গ্রীষ্মবাসর উপন্যাস সমকালকে ছাড়িয়ে যায় এই শৈল্পিক নিষ্ঠুরতার কারণেই।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত