চাঁদু খবরিয়ার ‘চন্দ্রকুমার’ নামটিতেও কি মিশে আছে মহাকাব্যের রেশ? দীনেশচন্দ্র সেন সঙ্কলিত মৈমনসিংহ-গীতিকা প্রথম খণ্ড দ্বিতীয় সংখ্যার ‘ভূমিকা’ অংশটিতে প্রথম বিভাগের শিরোনাম ‘এই গাথাসমূহের সংগ্রাহক চন্দ্রকুমার দে’। প্রাচীন মহিলা কবি চন্দ্রাবতী প্রসঙ্গে চন্দ্রকুমারের লেখা নিবন্ধ দীনেশচন্দ্রের নজরে আসে ১৯১৩-র সৌরভ পত্রিকায়। ময়মনসিংহের বহুজনকে প্রশ্ন করেও সেখানকার পল্লিগাথা প্রসঙ্গে তাচ্ছিল্য ছাড়া আর কিছুর হদিশ পাননি দীনেশচন্দ্র। ভূমিকায় আছে, “কেহ কেহ ইংরাজী শিক্ষার দর্পে উপেক্ষা করিয়া বলিলেন, “ছোটলোকেরা, বিশেষতঃ মুসলমানেরা, ঐ সকল মাথামুণ্ডু গাইয়া যায়, আর শত শত চাষা লাঙ্গলের উপর বাহুভর করিয়া দাঁড়াইয়া শোনে। ঐ গানগুলির মধ্যে এমন কি থাকিতে পারে যে শিক্ষিত সমাজ ততপ্রতি আকৃষ্ট হইতে পারেন?”” যদি ফিরে আসি উপন্যাসটির ‘গোড়ার কথা’য়, দেখব ঔপন্যাসিকের স্বীকারোক্তি— “বাবা ঋণ সালিশী বোর্ডের শুনানি করে বেড়াতেন… ময়মনসিংহ জেলার গ্রামে গ্রামে। তখন আমি জন্মাইনি… বাবার কাছে শুনেছি ঋণগ্রস্ত চাষীদের কথা। ঋণ মকুবের কথা। ৪৩-এর মন্বন্তরের কথা বলতেন মা… ময়মনসিংহর কথা লিখব, না ময়মনসিংহর গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে থাকা গীতিকবিদের কথা…? যাঁদের ঋণের কথা শুনতেন বাবা তাঁদের কথা? বাবা যা পারেননি, সেই না পারা কথা লিখব? ঋণ আমাদের। আমি সেই ঋণ শোধ করি।”
দীনেশচন্দ্র শিক্ষিতজনের যে উপেক্ষা দেখেছেন, তা পেরিয়েই তো চন্দ্রকুমারের সঙ্গে তাঁর বিনিময়! অমরের উপন্যাসের চলনে বিপুল সোম আর চাঁদু খবরিয়ার যৌথ অভিজ্ঞতায় দেখি, পাহাড় আসলে হস্তী, অচল হস্তী, নাকি পাহাড়ের ডানাগুলো মেঘ, এক কালে পাহাড় উড়ে বেড়াত (পৃ ১৬৭); টঙ্ক প্রথার বিরুদ্ধে হাজং কৃষক বলে, সব ধান জমিদারের খামারে তুলে দিলে কী দিয়ে ভরবে ভুখা পেট (পৃ ২৫৭-৫৮); গীতিকার বাইরের এ সব আখ্যান কখনও বলেন ও পারের নতুন আখ্যানকার অতীন, কখনও বা এ পারের কোনও নিরুদ্দিষ্ট বা অনাগত। দেনা শোধ করার দায় নিয়ে জীবন থেকে উপাখ্যানের দিকে যাত্রা। কোনও ইচ্ছাপূরণের দ্বারস্থ না হয়ে গুরুভার ব্যর্থতা বহন করে ফিরে আসা উপাখ্যান থেকে জীবনে। তাই বুঝি উপাখ্যানের অন্তিমে কালক্রম যথাবিহিত সাজিয়ে দিয়েছেন লেখক। যে ক্রমকে উপাখ্যান জুড়ে ভেঙেচুরে, হাতির অচল পাহাড় হয়ে যাওয়াকে, পাহাড়ের ডানা অকেজো হয়ে যাওয়াকে, বা এমন আরও কতশত প্রাকৃত বেদনাকে যুগযুগব্যাপী পথচলতি মানুষের চেতনায় বিদ্ধ করা; শেষ যেন বলে দেওয়া, ও তো ছিল আখ্যানকারের সৃজন, কালানুক্রমিক এই ইতিহাসযাপন গেঁথে তার নির্মাণ। সে গ্রন্থনায় যা কিছু ভাঙন, সবই তো শিল্পের সত্যে জীবনের সত্যি-মিথ্যেকে মেলাতে, অথবা গরমিলকে চেনাতে।
এ আখ্যানের শেষ নেই। টঙ্কের পর তেভাগা, কৃষকের প্রতিরোধের বয়ান যেন তৈরি হল বুনোহাঁসের লিখনে, তবু না লেখা রয়ে গেল আরও কত চিত্ররূপ। এমন উপাখ্যান যে কলমে লেখা হবে, তাকে যে হতে হবে ছবি লেখার কলম, সে শর্ত অমর মিত্রের সাহিত্যিক অভিজ্ঞতায় স্পষ্ট হওয়াই স্বাভাবিক। অমর পাঠককে বুঝতে দেন না, তিনি আধুনিকের বর্বরতা বিছিয়ে ফিরে দেখছেন ইতিহাসের ওঠাপড়া; নাকি লোককথা আর ইতিহাসকে বিনিসুতোয় বেঁধে বেঁধে দেখাচ্ছেন যে, আধুনিকের অমানবিকতার উৎস প্রোথিত ছিল মানবসভ্যতার আদিতেই। যেন ময়মনসিংহ গীতিকা-র পেলব প্রেমকাহিনির সন্ধানে বেরিয়ে লেখক না চাইতেই পেয়ে যাচ্ছেন গীতিকায় অনুক্ত কত রাজনীতির কথা, কত নির্মমতা-বঞ্চনার কথা, কত শোষণ-অত্যাচার আর তার সার্থক-অসার্থক বিরুদ্ধাচরণের আলেখ্য। তাই অগুনতি পালাকার, আরও অগুনতি পালার বিষয় নিয়ে এগিয়ে চলেছে একুশ শতকের ঋণশোধের কাহিনি।
যাত্রা শুরুর শূন্যতা যে কত দূর মর্মান্তিক, তা বুঝতে বুঝতেই পাঠক মোমেনশাহী উপাখ্যান-এর তিন-তিনটি পর্ব পরিক্রমা করে ফেলেন। আর শেষে এসে বোঝেন, না, বিষয় এখানে ময়মনসিংহ গীতিকা নয়; দেশহীন সফল মানুষের অসার্থক ঋণশোধের প্রয়াস দেশজ প্রকৃতি আর প্রাকৃত জীবনপ্রবাহের কাছে— এই বুঝি বিষয়!