| 29 মার্চ 2024
Categories
পাঠ প্রতিক্রিয়া সাহিত্য

নিদাঘ দিনে— কবি আমাদের হৃদয়ের কথা বলেন

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

তালুকদার শরীফুল ইসলাম


নিদাঘ দিন মানে নিতান্ত দগ্ধ যে সময়। বলা যায়, আগুনের দিন। দগ্ধ যৌবনের দিন! যৌবন অমিত সম্ভাবনা আবার তুমুল সংকটেরও দিন। এ সময় প্রকৃতিতে বসন্তের মতো মানুষের জীবনে প্রেম আসে। ঝড় আসে, বিরহ আসে। আসে সব হঠাৎ বৃষ্টির মতো। ভেঙ্গেচুরে বিষণ্ণ করে দেয়। এই সময়টার বোধ অন্তহীন। কত কিছুর জন্য সংগ্রাম এবং প্রতীক্ষা থাকে অথচ “কখনও কখনও মনে হয়, আমার কারোর জন্য নয়; কারোর আমার জন্য— কোথাও কোন প্রতীক্ষা নেই!” সত্যি কী কোথাও কোন প্রতীক্ষা নেই?— প্রতীক্ষা থাকে। শেষ পর্যন্ত প্রতীক্ষাই জীবন।

চিরকালের এক বালক হৃদয় জমিয়ে রাখে অভিমান। কৈশোর-উত্তীর্ণ তারুণ্যে দগদগে বিরহে কাতর হৃদয় নিয়ে ‘দুঃখের অধিক কিছু দুঃখ দিক’ কবিতায় কবি বলেন, “সে আমারে কেবলই দুঃখ দ্যায়/ বলেছে আর দেয়ার কিছু নেই/ তবু আমি রাখি তাঁরে গোপন গহীন হৃদয়েই।” এ তো প্রতীক্ষারই নামান্তর। স্বভাবজাত ভালোবাসায় আত্মসমর্পণের চিরাচরিত নিয়মের বাইরে কেউ যেতে পারে না! তবুও, “সহস্র ভুলের বিক্ষুব্ধ বারুদে বৃথাই সোনার কয়েনের মতো বুকের গহীনে উষ্ণতা জমাই!” এ উষ্ণতাই মানব হৃদয়ের ঐশ্বর্য। শত দুঃখ কষ্টের বেড়াজালে আবদ্ধ থেকেও দুঃখকে বুকে নিয়ে পাখির মতো নিরবিচ্ছিন্ন ভালোবাসার গান গেয়ে যাওয়া এক হৃদয়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় এ কবিতা।

প্রেমহীন এ নগরে প্রেমিকের অন্তহীন নৈঃশব্দ অথবা চিৎকার কেউ শুনতে পায় না, স্পর্শ করে না প্রেমিকার মন! তবু তো ভালোবাসার জন্য ছিল ঐকান্তিক সব আয়োজন। নিষিদ্ধ দেয়াল পেরিয়ে ঘৃণা নয়, প্রেম হয়ে উঠুক মানুষের মৌলিক অনুভূতি। প্রয়োজনে প্রেমিক হয়ে উঠুক স্বৈরাচারী। তেমনটাও খুঁজে পেলাম  প্রেমস্বৈরশাসনকবিতায়!

নতুন এক অধ্যাদেশ জারি হোক,

শহরের রাস্তায় দুজনের বেশি এক সঙ্গে পথ চলতে পারবে না!

নিষিদ্ধ হোক অনাহুত জনসমাগম

কারফিউ জারি করে আমাদের শহরে চলুক প্রেমস্বৈরশাসন

আমাদের প্রত্যেকেরই জীবনে কিছু অতীত স্মৃতি মনের কোণে দাগ কেটে থাকে, যে দাগের ক্ষত কখনো সুখের হাওয়ায় ভাসায়, কখনো ফিরে পেতে চায় ফেলে আসা সেই সোনাঝরা দিনকে! বলে ফেলতে ইচ্ছে করে জীবনের না বলা কালের ধুলোয় ম্লান সেই অনুভূতিকে! ‘চৈত্রের দুপুরে’ কবিতায় খুঁজে পাই সে আহবান।

কি হয় যদি জোর করে রাজ্যটাকে নিজের করে নেওয়া যায়, ভালোবাসার মানুষটার হৃদয়রাজ্যে দখল করতে চাওয়া প্রেমিকের কণ্ঠস্বর শুনতে পাই ‘স্বৈরাচারী প্রেমিক হব’ কবিতায়,

ক্ষমতা আর রাজ্য নয় তোর জন্য স্বৈরাচারী প্রেমিক হব

ভালোবাসার উন্নয়নে নতুন করে রুদ্ধদ্বার এক শপথ নেব

তুই চাসনা

তবুও তোর জন্যস্বৈরাচারী প্রেমিক হব!”

স্বপ্ন দেখতে কে না ভালোবাসে! কিন্তু সব স্বপ্ন কী আমরা ছুঁয়ে দেখতে পারি? নাকি কিছু স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়? কাব্যগ্রন্থের সূচনাতেই দেখতে পাই,

“আমি স্বপ্ন দেখলেই সব মলিন হয়ে যায়

বুড়িগঙ্গার দূষণের মতো কালচে হয়ে ওঠে স্বপ্নের স্বচ্ছসব টলমল জল…

পুড়ে যায় প্রস্তুত পাণ্ডুলিপি

শরতের সাদা মেঘ করে আয়োজন অঝোর শ্রাবণ…

আরব্য রজনীর সহস্র এক রাত্রি জেগে স্বপ্ন দেখে

ব্যাকুল মিলন বাসনায় হাত বাড়াই

দেখি প্রেয়সীর চোখেও নামে আসহাবে কাহাফের ঘুম!”

প্রেমিকের মন জোছনা-বিধৌত রাত চিরকালই রহস্যময় সুন্দর আবেদন জাগায়। অনুভূতির সঙ্গে প্রকৃতির চিরকালই নিজস্ব বোঝাপড়া ছিল। জোছনায় জ্বলে উঠে হাজারো ভালোবাসার পঙক্তিমালা আর নিজেকে মিলিয়ে নেয় প্রকৃতির পরম স্পর্শে!  “অতন্দ্রিলাকবিতায়যদি চাঁদ হও নির্জন রাত হব, জোছনামাখা প্রহর হয়ে ছুয়ে দিও রাতের শরীর  লাইনদ্বয়ে এ আবেদন খুঁজে পাই

“সহস্র বছর ধরে অজস্র আলিঙ্গনের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আমি কেবল তোমার দিকেই চিরকাল ছুটছি!” লাইনদ্বয় ভাবতে বাধ্য করে, কতটা আবেগ, কতটা অনুভূতির মিথস্ক্রিয়া থাকলে এতটা গভীরভাবে প্রণয়ের আবেদন করা সম্ভব? প্রণয়ের পরিনতি প্রেমিকের কাছে এক আরাধ্য কাব্য! যে কাব্য সবাই রচনা করতে পারে না, কেউ কেউ তো অনুভূতির জায়গাটা কতটা প্রবল সেটাও প্রকাশ করতে পারে না, অথচ “অজস্র আলিঙ্গনের আকাঙ্ক্ষা” পুরো কবিতায় কবি অবলীলায় ব্যক্ত করেছেন। এতো গেল প্রেমের উপাখ্যান !

কবির শৈশব-কৈশোর কেটেছে গ্রামে। সেসব স্মৃতি আজও নস্টালজিক করে। সময়ের প্রয়োজনে ইট পাথরের যান্ত্রিক জীবনে অভ্যস্ত হলেও ফেলে আসা ফেরারী স্মৃতি তো ফিরে ফিরে আসেই। শিশুদের সুন্দর শৈশব কেঁড়ে নেওয়া এই নগর নিয়ে তো হাহাকার, খেদ দেখতে পাই,

শৈশবে আমি চমকে উঠতাম উঠোন থেকে দুরে,

 বৃষ্টিভেজা সবুজ বৃক্ষ গুল্ম লতার ফাকে বুলবুলি

আর দেখে দোয়েল পাখি

বসতে শিখে এই শহরে খোকন দেখে উঠোন নেই

পাখি নেই

সুনীল আকাশ, বাড়ির পাশে ছোট্ট একটা নদী

টিনের চালে বৃষ্টিভেজা সবুজ কোনও বৃক্ষ নেই…

কবিতার লাইনগুলো মুহুর্তের মধ্যে আমাদের অবারিত শৈশবের কথা মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু আমাদের প্রজন্ম বেড়ে উঠবে এ কোন বিরান শহরে! পৃষ্ঠা উল্টালেই চোখ পড়ে ‘ট্রেন যায় রাজার খাজাঞ্চিখানায়’ কবিতায়, আরো বিভোর হয়ে স্মৃতিচারণ করতে থাকি, ফিরে পাই ছোট্টবেলার স্কুলে যাওয়া সময়, স্কুলে যেতে যেতে কত স্মৃতি, কুমার নদীর পাশ বেয়ে রাস্তা ধরে যেতে হত আমার স্কুলে। কুমার নদী থেকে অনেক দূরে সুরমার স্মৃতিকে আরাধ্য করে কবি লিখলেন,

শ্রীহট্টের ট্রেন যায়

রাজার খাজাঞ্চিখানায়

পথে পড়ে আমাদের ইশকুল,

হেমন্তে ক্ষীণকায় সুরমা নদীর খালের দুকুল!

ক্লাসে মন নেই,

কার্তিক শেষে অঘ্রানে পেকে আসা ধানের ঘ্রাণ সে!

ফসলভরা মাঠের স্বপ্নবিস্ময় নিয়ে বালক তাকায়

কেন রোজ ট্রেন যায় রাজার খাজাঞ্চিখানায়!

কাব্যগ্রন্থে খুব স্বাভাবিকভাবেই ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক কিছু স্মৃতি-বিস্মৃতির কথা খুঁজছিলাম আনমনে! ক্যাম্পাসে প্রেম হয়, বিরহ হয়, মিছিল হয়, আন্দোলন হয়, বিক্ষোভ হয়, জাতীয় প্রয়োজনে একই সারিতে এসে আমরা দাড়াই! প্রেম-বিরহ-অনন্ত আড্ডার জন্য যেমন টিএসসি, এসএম হলের ফুলার রোডের নাম উঠে আসবে, তেমনি শাহবাগের নাম উঠে আসবে আন্দোলনের খাতায়! যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে রাজপথে নির্ঘুম থাকা কবি সেই উত্থাল দিনগুলিতে লেখা তাঁর ‘শাহবাগ’ কবিতায় দ্বিধাহীন চিত্তে লিখলেন,

ছাপান্নো হাজার বর্গমাইলের বসন্ত প্রহরে

তোমাকে বলি, আমার পক্ষের নামশাহবাগ!”

কখনও ভালোবাসা হারিয়ে যায় গহীন বালুচরে। চোরাবালিতে। প্রেমিকের আর্তনাদ নিয়ে তাই বললেন,

এক আশ্চর্য শহর!

নিয়ন আলোয় রোজ ছিনতাই হয়ে যায় আমাদের ভালোবাসা!” কতোটা সহজভাবে বলে ফেলা যায় হৃদয় নিঃসৃত অভিব্যক্তি!

দেশ, দেশপ্রেম ও মানুষের জীবনবোধ নিয়ে আমাদের ভাবনা তো থাকেই। আমাদের অনন্ত অনুভূতির কতোটা জুড়ে দেশ ও দেশপ্রেমের প্রবল উপস্থিতি সেটা আবারো উপলব্ধি করলাম ‘নির্বাসন’ কবিতায়,

শরীরে সচল শিরার মতো তুমি

মাটির পরতে পরতে আইল

ছাপ্পন্নো হাজার বর্গমাইল

আমার জন্মভূমি।” অথবা

“এ সোনার মাটি আমার শিমুল তুলোর বালিশ

আমাকে মাটির পরে ঘুম পাড়িয়ে রাখিস!” তাছাড়া, দেশটা যে সকলের ‘আমার আর নিরঞ্জনের দেশ’ কবিতা তারই বহিঃপ্রকাশ।

যতবার সীমান্তে গেছি

পাহাড় আর নদীর মতো

এক বুক দুঃখ নিয়ে ফিরেছি!

 

“সীমান্তের সীমাবদ্ধতা ভুলে আসুক দিন

বিশ্বময় মানুষ পাখির মতো হয়ে উঠুক স্বাধীন।”

 “কাটাতারের সুখ-দুঃখ” কবিতায় বিশ্বজনীন চেতনায় ঋদ্ধ এক কবিকে আবিষ্কার করি। যিনি স্বপ্ন দেখেন মানুষ একদিন পাখির মতো স্বাধীন হয়ে উঠবে। শুধু মানব প্রেম নয়, শুধু গ্রামবাংলা নয়, দেশভাগে উদ্বাস্তু মানুষ নয়, কৃষকের কান্না নয়, দেশ ও দেশপ্রেমের সঙ্গে কবির বিশ্বজনীন চেতনা এবং আন্তর্জাতিকতাবোধও পাঠক হিসেবে আমাদের মুগ্ধ করে। উত্তরাধুনিক সময়ে, বিশ্বায়নের কালে লেখক, প্রাবন্ধিক ও গবেষক আলমগীর শাহরিয়ার তাঁর অবিচ্ছিন্ন কবি সত্তায় ‘নিদাঘ দিনের গান’-এ নানাভাবে আমাদের হৃদয়ের কথাই বলেন। কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ করেছে চৈতন্য। প্রচ্ছদ এঁকেছেন গুনীশিল্পী ধ্রুব এষ।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত