পাঠ প্রতিক্রিয়া: পথে প্রবাসে । অন্নদাশঙ্কর রায়
আজ ০৫ মার্চ কবি ও কথাসাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায়ের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবারের বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
পথে প্রবাসে: অন্নদাশঙ্কর রায়, বাণীশিল্প, কলকাতা / ১৯৯৯ / পৃষ্ঠা ১০৩; ISBN:
সাহিত্যের জগতে থাকেন কিছু কিছু জহুরি, সম্ভাবনাময় নতুন লেখকদের তাঁরা এক নজরেই শনাক্ত করতে পারেন। মনে পড়ছে ষাটের দশকে দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত অজ্ঞাতনামা এক লেখকের একটি গল্প পাঠ করে আবু সয়ীদ আইয়ুব দেশ-এ চিঠি লিখেছিলেন ওই লেখক আর কোনো গল্প যদি নাও লেখেন ওই একটি গল্পের জন্যই বাংলা সাহিত্যে তাঁর স্থান পাকাপোক্ত হয়ে থাকবে। গল্পটির নাম ছিল ‘শ্বেতপাথরের টেবিল’, লেখক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়। এর বহু বছর আগে পথে প্রবাসের ভূমিকায় তেমনই এক মন্তব্য করেছিলেন আর এক জহুরি : “আমি যখন বিচিত্রা পত্রিকায় প্রথম পথে প্রবাসে পড়ি, তখন আমি সত্য সত্যই চমকে উঠেছিলুম। কলম ধরেই এমন পাকা লেখা লিখতে হাজারে একজনও পারেন না।” এই জহুরি প্রমথ চৌধুরি। ভূমিকায় তিনি জানাচ্ছেন : ” পথে প্রবাসের ভূমিকা আমি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে লিখতে বসেছি দু-কারণে। বাঙলায় কোনো নতুন লেখকের সাক্ষাৎ পেলে আমি স্বভাবতঃ আনন্দিত হই। বলা বাহুল্য যে যিনি নতুন লিখতে আরম্ভ করেছেন তিনিই নতুন লেখক নন। যিনি প্রথমতঃ লিখতে পারেন, আর দ্বিতীয়তঃ যাঁর লেখার ভিতরে নূতনত্ব আছে, অর্থাৎ নিজের মনের বিশেষ প্রকাশ আছে, তিনি যথার্থ নতুন লেখক।”
পথে প্রবাসে বই আকারে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩১ সালে। তারপর এর অনেকগুলি সংস্করণ হয়েছে, যা পাঠকবর্গের সমাদরের নিদর্শন। বস্তুতপক্ষে অন্নদাশঙ্করের এক সময়ের বহুচর্চিত উপন্যাস পুতুল নিয়ে খেলা, রত্ন ও শ্রীমতী কিংবা মননশীল প্রবন্ধাবলী এখন বিস্মৃতপ্রায়। কিন্তু আধুনিক যুগের পাঠকের কাছে তাঁর রচিত ছড়াগুলির আকর্ষণ অপ্রতিরোধ্য, এবং এই ভ্রমণ সাহিত্য পথে প্রবাসেরও।
পথে প্রবাসের রচনাকাল ১৯২৭-১৯২৯। ইণ্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় সফল হয়ে শিক্ষানবিশির জন্য তখন তাঁর এই দুবছরের বিলাতবাস। বয়স তখন তাঁর তেইশ-চব্বিশ। ছুটির সময়ে লণ্ডনের বাইরের ইংলণ্ড ও ইউরোপের কয়েকটি দেশ ঘুরে দেখেছেন; তাঁর ভাষায় ‘আমার চোখজোড়া অশ্বমেধের ঘোড়ার মতো ভূপ্রদক্ষিণে বেরিয়েছে।’ অন্নদাশঙ্কর দেখেছেন চোখ চেয়ে, অনুভব করেছেন, বিশ্লেষণ করেছেন আর অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করেছেন। প্রমথ চৌধুরী লিখছেন : ‘তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্ত যথার্থ সাহিত্য হয়েছে। … আর এ লেখকের মতামতের পিছনে যে একটি সজীব মনের স্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়, সে বিষয়ে কিছুমাত্র সন্দেহ নেই।’
প্রবাসের অভিজ্ঞতার সিংহভাগই স্বাভাবিক কারণেই লণ্ডন এবং ইংলণ্ডকে ঘিরে। আর রয়েছে সুইজারল্যাণ্ডের লেজাঁ, ফ্রান্সের পারী, অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা, জার্মানি ও ইতালির কয়েকটি শহরে স্বল্পমেয়াদী ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। এইসব জায়গার চারিত্রিক ভিন্নতার ছবি তাঁর সজীব বর্ণনায় যেমন স্পষ্ট, সেইসব দেশের মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বিশ্লেষণও তেমনই অনুপুঙ্খ। লণ্ডন শহর তাঁর চোখে দক্ষিণ কলকাতার একটা বড়ো সংস্করণ, কিন্তু প্রভেদ তার পরিচ্ছন্নতা, ভিড়ের মধ্যেও শৃঙ্খলা, সাধারণ মানুষের কলরোলবর্জিত কর্মতৎপরতায়। ইংরেজ চরিত্রকে তিনি নানাভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। ইংরেজ উন্নাসিক, আলাপচারিতায় অপটু, কিন্তু শালীনতাবোধ তার প্রখর। তার কারণ হিসাবে তিনি বলেছেন : ‘ইংলণ্ডের আশ্চর্য একতার কারণ ইংলণ্ড দেশটা দৈর্ঘ্যে প্রস্থে ও উচ্চতায় অত্যন্ত আঁটসাট ও ছোট। …. খাঁটি প্রাদেশিকতা যাকে বলে তা দ্বীপবাসীতেই সম্ভব এবং আকাশহীন দ্বীপবাসীতে। কোনো একটা আন্তর্জাতিক আন্দোলন ইংলণ্ডে টিকবে না, খ্রীস্টধর্ম টিকল না, সোশ্যালিজ্ম্ টিকছে না। একদিন যেমন চার্চ অব ইংলণ্ড নিজস্ব খ্রীস্টধর্ম সৃষ্টি করল আজ তেমনি লেবার-পার্টি নিজস্ব সোশ্যালিজ্ম্ সৃষ্টি করছে। নির্জলা ন্যাশনালিজ্ম্ ইংলণ্ডেই প্রথম সম্ভব হয়, ইংলণ্ডেই শেষ পর্যন্ত স্থায়ী হবে। এর কারণ নৈসর্গিক।’
সমাজতন্ত্র মানুষকে সমান সুযোগ দেবার অঙ্গীকার করে। যে-নামেই ডাকা হোক না কেন, ইংলণ্ডে সোশ্যালিজমের ছাপ পড়েছে তার বোর্ডিং স্কুল, নার্সিং হোম, হাসপাতাল, পাব্লিক লাইব্রেরি ইত্যাদির অপক্ষপাত তত্ত্বাবধানে। অভিজাত শ্রেণী প্রায় অপসৃত হতে চলেছে, কিন্তু আভিজাত্যের প্রভাব সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁর পর্যবেক্ষণ হল : ” ‘রেসপেকটেবল’ বলে গণ্য হবার জন্যে ‘ইতরেজনাঃ’র একটা ঝোঁক আছে, ঝি-ঠাকরুণের শ্রেণীর মেয়েরাও মনে মনে এক একটি লেডি।” তিনি মনে করেন : ‘গণতন্ত্রের দেশের জনসাধারণ কোনো একজনকে অসাধারণ হতে দেয় না। আমেরিকা, ফ্রান্স ও রাশিয়ার চেয়েও ইংলণ্ডের গণতন্ত্র খাঁটি। সেইজন্যে ইংলণ্ডে একটি ফোর্ড বা আনাতোল ফ্রাঁস বা লেনিন সম্ভব হয় না।’ তাঁর মতে : ‘বিপ্লবকে ইংলণ্ড ঠেকিয়ে রাখে প্রতিদিন একটু একটু করে ঘটতে দিয়ে।’ এই সমাজবিপ্লব সম্ভবপর হয়েছে অত্যন্ত সাধারণ মানুষের অবসর সময়ের উদ্যোমের ফল হিসাবে, ‘মহাত্মা গান্ধীর মতো অসাধারণ লোকের সারা সময়ের কাজ নয়।’ তিনি আক্ষেপ করে বলেছেন : ‘আমাদের দেশে যদি সবাই সামান্য করেও কিছু করত – প্রতিদিন করত তবে আমাদের অসাধারণ মানুষগুলিকে অহরহ চরকার মতো ঘুরতে হতো না, চরকাও ঘোরাতে হতো না।’
ইংলণ্ড ভারতবর্ষকে তার কলোনি করেছিল। অন্নদাশঙ্কর মনে করেন এটা কোনো আকস্মিকতা নয়। ভারতবর্ষ ও ইংলণ্ড চরিত্রের জগতে antipodes। … আকাশের এককোণে বাতাসের অভাব ঘটলে অন্য কোণ থেকে যেমন বাতাস ছুটে যায়, ভারতবর্ষকে পরিপূর্ণতা দিতে ইংলণ্ড তেমনি ছুটে গেছে। … ফ্রান্স যদি ভারতবর্ষের হাত ধরত তবে ভারতবর্ষের সঙ্গে তার মনের অমিল ঘটত না, যেমন ইংলণ্ডের সঙ্গে ঘটেছে। কিন্তু তা’হলে ভারতবর্ষের চরিত্র কোনো দিন পূর্ণতা পাবার সুযোগ পেত না।’
শুধু ভারতবর্ষ নয়, ইংলণ্ডের সাম্রাজ্যবিস্তার ঘটেছিল আরও অনেক দেশে। অন্নদাশঙ্করের মতে: ‘ইংরেজ যত দেশকে শোষণ ও শাসন করেছে তত দেশকে একসূত্রেও বেঁধেছে, ঐক্য দিয়েছে। মৌমাছি যেমন ফুলেদের মধু নেয়, তেমনি মিলন ঘটায়।’ তিনি মনে করেন মৌমাছির কাজ এখনও শেষ হয়নি, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এক প্রকার লীগ অব নেশনসের ভূমিকা পালন করছে। তা’ছাড়া, ইংরেজি ভাষা ক্রমশ সার্বভৌম ভাষা হয়ে ওঠায় পৃথিবীর সবাইকে ওই ভাষার মাধ্যমে ভাব বিনিময় করতে হবে। আশি বছর পেরিয়ে এসে এই ভবিষ্যদ্বাণীর যাথার্থ্য আমরা উপলব্ধি করতে পারছি।
যে সময়টায় পথে প্রবাসে রচিত হয়েছিল তা প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অন্তবর্তী কাল। প্রথম মহাযুদ্ধ ইউরোপের অনেকগুলো দেশকে বিপর্যস্ত করেছে, কিন্তু এই সময় তারা সকলেই উদ্যোগী পুনর্গঠনের কাজে আর ভবিষ্যতের সম্ভাব্য যুদ্ধের মোকাবিলার প্রস্তুতিতে। যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে নেমেছে ইংলণ্ড, অথচ তারই সঙ্গে চলেছে air raid-এর মহড়া ভাবী যুদ্ধকে সামাল দিতে। জার্মানি ঘুরে এসে অন্নদাশঙ্কর লিখছেন: ‘যেরূপ উৎসাহ আগ্রহ ও সহিষ্ণুতার সঙ্গে যৌবনচর্চা করছে তা দেখে মনে হয় ভাবীকালের জার্মান জাতিকে নিয়ে আবার বিপদ বাধবে।’ তাঁর এ আশঙ্কা সত্য প্রমাণিত হয়েছে। তবে ভারতবর্ষের স্থবিরতার প্রতিতুলনায় ইউরোপীয় সমাজের গতিময়তা তাঁকে মুগ্ধ করেছে। তিনি মন্তব্য করেছেন: ‘ইউরোপের জীবনে যেন বন্যার উদ্দাম গতি সর্বাঙ্গে অনুভব করতে পাই, ভাবকর্মের শতমুখী প্রবাহ মানুষকে ঘাটে ভিড়তে দিচ্ছে না, এক একটা শতাব্দীকে এক একটা দিনের মতো ছোট ক’রে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে স্বাভাবিক বোধ হচ্ছে পরস্পরের সঙ্গে প্রতিদিনের প্রতি কাজে সংযুক্ত থেকে নর ও নারীর এক স্রোতে ভাসা।’
প্রথম মহাযুদ্ধ পরবর্তী ইউরোপে তখন নতুন করে ধর্মচর্চার প্রাবল্য চলছে। এই প্রসঙ্গে ধর্ম আর রিলিজিনের পার্থক্য নিয়ে তিনি নাতিদীর্ঘ আলোচনা করেছেন, ভারতবর্ষ ও ইউরোপের ধর্মভাবনার তুলনামূলক আলোচনাও করেছেন। তাঁর মনে হয়েছে : ‘সাত্ত্বিকতার চর্চা ইউরোপে নেই, কোনোকালে ছিল না। ইউরোপের খ্রীস্টধর্ম যীশুর ধর্ম নয়, সেন্ট পলের ধর্ম – রামের ধর্ম নয়, হনুমানের ধর্ম। তার মধ্যে বীর্য আছে, লাবণ্য নেই।’ যে খ্রীস্টিয়ানিটিকে তার বাড়ির পাশের আরব পারস্যের লোক গ্রহণ করল না, এমন কি তার বাড়ির লোক ইহুদিরা পর্যন্ত অসম্মান করল, তাকে ইউরোপ ডেকে মান দিল কেন ? তিনি মনে করেন, ‘সম্ভবতঃ ইউরোপের পরিপূরক রূপে এশিয়াকে দরকার ছিল।’ তবে তাঁর মতে এই খ্রীস্টধর্ম ইউরোপের প্রাণের ধর্ম নয়। ইউরোপের আপনার জিনিস তার ফিলজফি আর বিজ্ঞান, তাই প্রাচ্য রিলিজন মাত্রেই ইউরোপের পক্ষে পরধর্ম। ধর্মচর্চার এই প্রাবল্যকে তাঁর মনে হয়েছে নির্বাণ দীপের শেষ দীপ্তি। তাঁর বিশ্বাস, ‘এর পরে হয় খ্রীস্টিনিয়াটিকে ভেঙে বিজ্ঞানের আলোয় নিজস্ব করে গড়া হবে, নয় বিজ্ঞানের ভিতর থেকে নতুন একটা রিলিজন বার করা হবে।’
লেজাঁয় রমা রলাঁর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎকারের বিবরণ অন্নদাশঙ্কর একটি পূর্ণ পরিচ্ছদে বিবৃত করেছেন। ভাবী যুদ্ধের সম্ভাবনার কথায় রলাঁ উত্তেজিত হয়ে বলেছেন, ‘নেশনরা যতদিন না ঠেকে শিখছে যে এক নেশনের ক্ষতিতে সব নেশনের ক্ষতি, যুদ্ধ ততদিন থাকবেই। যুদ্ধের প্রতিষেধ শিক্ষা।’ শিক্ষা প্রসঙ্গে আর্টিস্টের কর্তব্য নিয়ে কথা উঠেছে। রলাঁর মতে, ‘যে মানুষ আর্টিস্ট সে মানুষ কেবল আর্টচর্চা করে ক্ষান্ত হবে না, সে ভালোর স্বপক্ষে ও মন্দের বিপক্ষে প্রোপাগাণ্ডা করবে, ভলতেয়ার ও জোলার মতো অন্যায়ের বিরুদ্ধে মসীযুদ্ধ চালাবে।’ রলাঁ আরও মনে করেন, ‘প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য কিছু করে কায়িক শ্রম করা; আর্টিস্টও যখন ব্যক্তি, তখন আর্টিস্টেরও এই কাজ করা উচিত।’ এই দুটি অভিমতই মেনে নিতে না পারলেও অন্নদাশঙ্কর সাক্ষাতে তাঁর প্রতিবাদ জানাননি। তাঁর নিজস্ব অভিমত, অসপত্ন পূজা না-পেলে আর্টের দেবী বরদান করেন না। আর আবশ্যিক কায়িক শ্রমের বিরুদ্ধে তাঁর যুক্তি : ‘মানুষ চায় স্রষ্টৃত্বের স্বাধীনতা, এছাড়া আর সমস্তই তার পক্ষে দাসত্ব। শূদ্রকে দাও স্রষ্টৃত্বের স্বাধীনতা, তার শ্রম হোক তার কাছে গান গাওয়া ছবি আঁকার মতো আনন্দময়, তার শ্রমের পুরস্কারে সে রাজা হোক – কিন্তু অশূদ্রকে স্বধর্মচ্যুত ক’রে পূর্ণতঃ হোক অংশতঃ হোক শূদ্র কোরো না; তার বীণা তুলি কেড়ে নিয়ে তাকে কাস্তে হাতুড়ি ধরিয়ো না; মাত্র আধঘন্টার জন্যে হলেও তাকে দিয়ে চরকা কাটিয়ো না।’ অন্নদাশঙ্কর অসংকোচে জানাচ্ছেন : ‘জাঁ ক্রিস্তফের স্রষ্টাকে তাঁর ফটোর সঙ্গে মিলিয়ে মনে মনে যে কল্পমূর্তিটিকে গড়েছিলুম সে মূর্তিটিকে ভেঙে ফেলতে হলো বলে দুঃখ হলো, কিন্তু মানুষটিকে ভালোবাসতে বাধল না।’ অন্নদাশঙ্করের সজীব বর্ণনায় আমরাও রলাঁর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে কিছুটা পরিচিত হয়ে উঠি।
এই সজীব বর্ণনা তাঁর সারা বই জুড়ে। বর্ণনা কাব্যময় হয়ে উঠেছে কোথাও কোথাও। ইতিহাস সচেতনতা তো তাঁর আছেই, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তাঁর নিজস্ব দার্শনিকতা। যখন তিনি লেখেন, ‘পৃথিবী দিন দিন বদলে যাচ্ছে, মানুষ দিন দিন বদলে যাচ্ছে – কিন্তু উন্নতি? প্রগতি? পারফেকশন? তা’ কোনো দিন ছিলও না, কোনোদিন হবারও নয়’, আমরা এক মুহূর্ত থেমে আত্মসমীক্ষণের চেষ্টা করি। কিন্তু তিনি থেমে থাকার পক্ষপাতী নন। পটপরিবর্তনের গতিময়তা ইউরোপের ব্যক্তিমানুষের জীবনে অনেক অস্থিরতা এনেছে, মূল্যবোধের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এই প্রসঙ্গে তিনি লিখছেন : ‘এটা পুনর্যাযাবরতার যুগ, আমরা সকলকেই চাই, কাউকেই চাইনে, আমাদের আলাপী বন্ধু শত শত, কিন্তু দরদী বন্ধু একটিও নেই, আমরা বিশ্বশুদ্ধ প্রসিদ্ধ লোকের নাড়ীর খবর জানি, কিন্তু আমাদেরই পাড়াপড়শীদের নাম পর্যন্ত জানিনে। … তবু এও সুন্দর। আমরা পথিক, আমাদের স্নেহ প্রীতি বন্ধুতার বোঝা হালকা হওয়াই তো দরকার, নইলে পদে পদে বাঁধা পড়তে পড়তে চলাই যে হবে না।’
অন্নদাশঙ্করের পথে প্রবাসে আমাদেরও চালিত করে – তাঁর সঙ্গে সেই ১৯২৭-২৮ এর ইউরোপে – আর সেই অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে আমাদের বর্তমান পথ চলার মূল্যায়নে।