পদ্মগামী জলের গল্পের পাঠ প্রতিক্রিয়া
ঋষি অরুণ চন্দ্র
‘পদ্মগামী জলের গল্প’ গল্পের আড়ালে আবমান সংস্কৃতির এক নান্দনিক উপমা। বর্তমান বাংলা সাহিত্যে যারা গল্প লিখছেন তাঁদের মধ্যে যাদেরকে মৌলিক লেখনীর মাধ্যমে পৃথক করা যায় আমার দৃষ্টিতে কর্মকার অনুপ কুমার তাঁদের মধ্যে অন্যতম। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০এ নৃ প্রকাশন প্রকাশ করেছে কবি ও কথাসাহিত্যিক কর্মকার অনুপ কুমারের দ্রুপদি সংস্কৃতির আখ্যানমূলক গল্পগ্রন্থ ‘পদ্মগামী জলের গল্প’। বইটিতে রয়েছে লেখকের বাছাইকৃত ছয়টি নান্দনিক গল্প। লেখক ছয়টি মৌলিক বিষয় নিয়ে এসব গল্প রচনা করেছেন তাঁর দক্ষ হাতে। প্রতিটি গল্পের কাহিনী ও চরিত্র বিশ্লেষণে লেখক যে দক্ষতা দেখিয়েছেন তাতে সচেতন পাঠকরা বইটি পাঠ করার সময়ে বাংলা সংস্কৃতির আবহমান স্রোতে প্লাবিত হবেন। পাঠকদের সুবিধার্থে বইটির প্রতিটি গল্পের কাহিনীর উপর আলোকপাত করার চেষ্টা করছি।
বইটির প্রথমেই পাঠকরা পাবেন গাল নামের একটি প্রেম প্রথা বিরহের আখ্যানমূলক একটি চমৎকার গল্প। এই গল্পে মোহন মানের প্রধান চরিত্র নিয়ে গল্পের পটভূমি চিত্রায়িত করেছে লেখক। সদ্য পাশ করে চাকুরিতে যোগদান করা মোহন কৃষ্ণকলি নামের এক রমণীর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলো। সেই প্রেম এক সময়ে বিরহে পরিণত হয় কোন এক অজানা কারণে। হারিয়ে যায় কৃষ্ণকলি। কিন্তু মোহন কৃষ্ণকলির এই অজানা কারণে হারিয়ে যাওয়াকে মেনে নিতে না পেরে অদম্য এক পণ করে বসে। কী সে পণ? সে পণে কি মোহন কৃষ্ণকলিকে খুজে পেয়েছিলো? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে পাঠক কখন যে এক রহস্যের মধ্যে প্রবেশ করবেন তা পাঠক নিজেও টের পাবেন না। লেখকের সার্থকতা এখানেই যে তিনি পাঠককে অত্যন্ত সচেতন ভাবে রহস্যের পথে হাঁটিয়ে গল্পের শেষ পর্যন্ত নিয়ে যাবেন। গল্পের চরিত্র উপাত্ত উপাদান ও সংস্কৃতি বোধ আমার কাছে অসাধারণ বলে মনে হয়েছে। একজন পাঠক হিসেবে যদি আমি রেটিং দেই তবে গাল গল্পটিকে আমার দৃষ্টিতে ১০এ ৯.৫ দেবো।
বইয়ের দ্বিতীয় গল্প পিশাচসিদ্ধ সন্ন্যাসী। এ গল্পেও লেখক রহস্যে দোলা দিয়েছেন পাঠকের মনে। সমাজের কুসংস্কার ও কান কথায় মানুষের বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে যে যেকোনো ধরনের অপকর্ম করা সম্ভব তা এই গল্পে লেখক খুব সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। সেই সাথে লেখকের নান্দনিক আবহ বর্ণনা প্রশংসনীয়। গল্পটি পাঠে পাঠক যেমন রহস্য উন্মোচনের আনন্দ পাবেন তেমনি সমাজ সচেতনতার বার্তাও পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে যাবে। এই গল্পটির পাঠ-প্রতিক্রিয়ায় আমি ১০এর মধ্যে ৮.৫ দিতে চাই।
বইয়ের তৃতীয় গল্পের নাম হিতৈষণা। এই গল্পের নামকরণ থেকে শুরু করে গল্পের আবহ, ভাষার প্রয়োগ ও চরিত্র নির্মাণ এক কথায় অসাধারণ। লেখকে এই গল্পটি লিখেছেন তাঁর বাস্তব জীবনে দেখা এক পল্লী চিকিৎসকের মহানুভবতার আখ্যান হিসেবে। একজন সাধারণ পল্লী চিকিৎসক কীভাবে এবং কতটা মহানুভবতার সাথে গ্রামের মানুষকে চিকিৎসা সেবা প্রদান করে থাকেন তাঁর বাস্তবতা এখানে খুব সুন্দর ভাবে অঙ্কন করেছেন লেখক। এই গল্পের পাঠ প্রতিক্রিয়ায় শুধু আমি কেন যে কোন পাঠক ১০এর মধ্যে ১০ দিতে বাধ্য।
বইয়ের চতুর্থ গল্প পোড়া নটীবাড়ি। এটি মূলত একটি প্যারানরমাল কাহিনী ভিত্তিক গল্প। কয়েকজন বন্ধু তাদের শখের বশে আনন্দ করতে গিয়ে জড়িয়ে পড়েন এক প্যারানরমাল গোলকধাঁধায়। গল্পটিতে প্রতি মুহূর্তে রহস্যের পট পরিবর্তন ও রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা দেবে পাঠকদের। গল্পের ভাষা ও চরিত্র নির্মাণের ব্যাপারে আর নতুন করে কিছু বলার নেই এক কথায় অসাধারণ। গল্পটির পাঠ প্রতিক্রিয়ায় আমি ১০এর মধ্যে ৯ দেবো।
এবার আশা যাক পঞ্চম গল্পের কথায়। বইয়ের পঞ্চম গল্প কল্যানেশ্বরী। কল্যানেশ্বরী একটি আধ্যাত্ববাদের গল্প। বিশ্বাসই যে মানুষের আপদ মুক্তির কারণ হতে পারে সে সম্বন্ধীয় একটা চমৎকার ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে গল্পটিতে। গল্পটিতে পুষ্প নামের একটি শিশু চরিত্রের অবতারণা করেছন লেখক। একটি শিশুর নিষ্পাপ বিশ্বাস যে কতটা গভীর হতে পারে এবং এখান থেকে মানুষ কীভাবে আপদ মুক্তির পথ খুঁজে পেতে পারে তা জানতে পাঠক জানতে পারবে এই গল্প পড়লে। এক গল্পতিও আমার কাছে খুব ভালো লেগেছে। তবে গল্পটি আর একটু দীর্ঘ হতে পারত। অত্যন্ত স্বল্প পরিসরে গল্পটির কাহিনী শেষ হয়ে গেছে। তবুও পাঠকের গল্পটি ভালো লাগবে বলে আমার বিশ্বাস। আমি এই গল্পের পাঠ প্রতিক্রিয়ায় ১০এর মধ্যে ৮.৫ দেবো।
বইয়ের সর্বশেষ গল্প অন্তর্জাল। অন্তর্জাল গল্পটি একটি প্রযুক্তি সচেতনতা মূলক গল্প। একটি কিশোর বয়সী ছেলের মনে কিশোর বয়সে কি কি বিষয় ভালো লাগতে পারে এবং সেই ভালো লাগার প্রভাব তাঁর জীবন ও পরিবারের জন্য কতটা প্রভাব ফেলে তা এই গল্পে লেখক খুব সুন্দর ভাবে বর্ণনা করেছেন। গল্পটির বিষয়বস্তুর প্রধান আলোচ্য হচ্ছে বর্তমান সময়ের কিশোর থেকে সব বয়সী লোকজন যে ভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে তার কুপ্রভাব সম্পর্কে। বাংলা সাহিত্যে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কোন গল্পকার এযাবৎকালে কোন গল্প লিখেছে কিনা তা আমার জানা নেই তবে লেখক কর্মকার অনুপ কুমার সেই প্রয়োজনীয় ও জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি অত্যন্ত চমৎকার ভাবে তার গল্পে বর্ণনা করেছেন। পাঠক এই গল্প পাঠে গল্পের আনন্দ লাভের পাশাপাশি ইন্টারনেটে আসক্তির কুপ্রভাব সম্পর্কে চমৎকার কিছু তথ্য পাবেন। এই গল্পের পাঠ প্রতিক্রিয়ায় আমি ১০এর মধ্যে ৯.৫ দেবো।
সব শেষে বলতে হয় বইয়ের বাঁধাই, কাগজ ও মেকআপ সম্পর্কে। এ বিষয়গুলো নিয়ে বলতে গেলে বইটি হাতে নিয়ে এক কথায় অসাধারণ বলতে বাধ্য হবে যে কোন পাঠক। চমৎকার বাঁধাই, সুন্দর কাগজ ও নান্দনিক মেকআপে বইটির আবেদন চমৎকার। এখানে প্রকাশককে ১০এর মধ্যে ৯.৮ দেয়া যায়।
সব শেষে একটা কথাই বলবো। যারা ছোটগল্প পড়তে ভালোবাসেন তারা নির্দ্বিধায় পদ্মগামী জলের গল্প বইটি কিনতে পারেন। বইটি প্রকাশ করেছে নৃ প্রকাশন। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় বইটি পাওয়া যাচ্ছে নৃ প্রকাশনের স্টলে (স্টল নং ৩৮৪) এবং লিটলম্যাগ চত্বরে নৃ সাহিত্যপত্রের স্টলে (স্টল নং ৩৯)। চমৎকার এই বইটির প্রচ্ছদমূল্য ২০০টাকা। কমিশন বাদে পাঠকরা বইটি কিনতে পারবেন ১৫০ টাকায়।