| 28 মার্চ 2024
Categories
পাঠ প্রতিক্রিয়া সাহিত্য

‘নৈর্ঋতে’ পাঠের অনুভূতি

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

কোনো কোনো গল্প পড়তে পড়তে আমরা নিজেরাই সেই গল্পের অংশ হয়ে উঠি। গল্পের চরিত্রসমূহের অলীক সব উপলব্ধিতে শিহরিত হই, সূক্ষ্মতর গ্লানিতে ম্রিয়মান হই। নিভে যাই, জ্বলে উঠি দীপ্তিতে। বিষাদগ্রস্তও হয়ে পড়ি। নিবেদিতা আইচ তেমন গল্প লিখতে জানেন।

গল্পকার নিবেদিতা আইচ ইতিহাস থেকে পাওয়া তথ্য, শব্দালংকার বা দুর্বোধ্য বাক্য গাঁথুনিতে গল্পকে অযথা ভারাক্রান্ত করেন না। মানবিক সংকট আর সম্পর্কের ঐশ্বর্যের গোপন তোরঙ্গ গল্পে গল্পে পাঠকের সামনে মেলে ধরার কাজটি তিনি করেন নিপুণ হাতে। গল্পের দৃশ্যপট তৈরিতে যেনো কোনো তাড়া নেই তার, তাই তার গল্প বলার ভঙ্গিটি বড়ো শান্ত।

এবারের অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত নিবেদিতা আইচের দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘নৈর্ঋতে’ এ মোট ১৪ টি গল্প সংকলিত হয়েছে। গল্পগুলো নির্মিত হয়েছে আমাদের জীবনের নানান চেনা-অচেনা পরিসরকে ঘিরে।

বইয়ের ‘সন্ধ্যারাণীর কল্কাপাড় শাড়ি’ গল্পটি একজন দেশ ছাড়া মানুষের জীবনের হাহাকারকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। এই মানুষটি এক নদী জল বুকে নিয়ে ক্ষণে ক্ষণে স্মৃতিকাতর হয়। সেই জলের অক্ষরে পাঠকের চোখের সামনে মুদ্রিত হয় একটি চমৎকার দৃশ্যপট, “বেচারাম দেউড়ি থেকে অনেকটা পথ হেঁটে সদরঘাটের কাছাকাছি এলে ধীরে ধীরে নদীটা দৃশ্যমান হতো। বাবা আঙ্গুল তুলে বলতেন- ওই দ্যাখা যায় বুড়িগঙ্গা!”

দেখতে দেখতে দূরে মিলিয়ে যায় বুড়িগঙ্গার পাড়। নিজের দেশের মাটি দূরে সরে যায়। কিন্তু এপাড়ে এসেও দুঃখের নজর বারবার ওপাড়ে নোঙ্গর ফেলতে চায়। বুকের ভেতরে এই পাড়ভাঙ্গা কষ্ট নিয়ে কত সন্ধ্যারাণীর যে দিন কাটছে-এই অনুভবের তীক্ষ্মতায় বিদ্ধ হতে হতে সন্ধ্যারাণীর মতোন আমিও ভরদুপুরে নিরিবিলিতে বসি। সন্ধ্যারাণী যখন খাটের নিচ থেকে ট্রাংক হাতড়ে কল্কাপাড়ের রাণীরঙা জামদানি শাড়ি বের করে মায়ের শরীরের ঘ্রাণ খোঁজে, তখন এক নদী জল বুকে উথলে ওঠে। ইচ্ছে করে সন্ধ্যারাণীর বয়সী হাত দুখানা ধরে তার সকল বেদনার পারাপার করি, সকল হাহাকারকে ভাসিয়ে দিই বুড়িগঙ্গার বুকে। সন্ধ্যারাণীকে তার বাবার মতোন বলি, ‘‘বুড়ি চল নদী দেইখা আসি। ’’

‘নৈর্ঋতে’ গল্পগ্রন্থের অন্যতম শক্তিশালী গল্প ‘সন্ধ্যারাণীর কল্কাপাড় শাড়ি।’ দেশহারা মানুষকে নিয়ে লেখা এই গল্পটি পাঠের অনুভূতিটুকু লিখতে লিখতে মন আর্দ্র হচ্ছিল বারবার। সত্যি বড় কোমল হাত গল্পকারের, যে গল্পই লিখতে বসেন সেই গল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মায়ায় মুড়ে দেন।

এই বইয়ের আরেকটি কোমলস্বরের গল্প ‘বিষুব।’ যে গল্প পড়তে পড়তে বারবার মনে পড়ছিল পূর্ণেন্দু পত্রীর শুভংকর আর নন্দিনীকে।

শুভংকর আর নন্দিনী, এরা দুজন শুধু ‘কথোপকথন’র দুটি চরিত্র নয়, জীবনের প্রেম বিষয়ক ভাবনার অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। শুভংকর আর নন্দিনীর ভালোবাসার দ্যুতি নিয়েই যেনো নবনীতা সোম আর পারিজাতের জন্ম হয়েছে গল্পকার নিবেদিতা আইচের কলমে।

এই কলমে নির্ঘাৎ মন্ত্র পড়ে দিয়েছে কোনো দেবদূত। তাই তো নিবেদিতা আইচ ‘বিষুব’ গল্পে এই দৃশ্যটি আঁকতে পেরেছেন, ‘‘এই একটা দৃশ্য ভাবতে ভাবতে আমার সকালটা শুরু হয়। নীতা একটা হলদে দুপুরের নাম। নীতা, নীটা কিংবা নী। আমার যখন যা ইচ্ছে তখন তাই নামে ডাকি ওকে।
ভোর এলে বলি- নীটা, আমায় এক কাপ চা দেবে?
ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে একসা হয়ে বলি – নীতু, ছাতার ভেতর এসো, এভাবে ভিজবে না প্লিজ।
মাঝরাতে জেগে উঠে ডাকি – নী,আরেকটু কাছে এসো।
কোনো নামেই সেদিন বোধ হয় ওকে ডাকতে পারিনি। প্রথমদিন এত দুঃসাহস দেখানো যায় না। কিংবা ডেকেছি কয়েকবার। মনে নেই। অমন নেশাতুর দিনের স্মৃতিরাও টালমাটাল হয়।’’

এমন একটা গল্প পড়লে বৃষ্টি বৃষ্টি সন্ধ্যায় মন চায় ‘‘নীতা, নীটা কিংবা নী’’ নামগুলো বদলে নিজের খেয়ালখুশিমতো কারো নাম বসিয়ে দিই…।

আসলে মানুষের সম্পর্কের জগত এক অদ্ভুত সীমান্তহীন এলাকা, সব পেয়েছির দেশে থেকেও যেখানে বেমালুম রিক্ত শূন্য হয়ে থাকা যায়। এ এক দুর্বোধ্য ধাঁধা। সেই ধাঁধাাঁর রহস্যভেদ করতে গেলে মাঝেমাঝে হয়তো সম্পর্কছেদই ঘটে যায়। তাই ‘চতুষ্পদ’ গল্পের চার চাকার বাহনে বসে থাকা নিঃসঙ্গ ছেলেটা বৈভ্রাজের বাইরে বেরিয়ে এসে তিনসাধুর মাঠ পেরিয়ে রেইনট্রির ছায়ার কাছে পৌঁছে যায়, তার সঙ্গী হয় অদিতি, ইন্দু, নয়নতারা আর ‘সরোদজীবন’ গল্পের রজত অভিকে চিঠিতে লেখে, ‘আমাকে খুঁজিস না, খুঁজতে গেলে হারিয়ে ফেলবি।’

‘নৈর্ঋতে’ গল্পগ্রন্থের একটি উল্লেখযোগ্য ও সাহসী গল্প ‘সরোদজীবন।’ সাহসী এই অর্থে, এ দেশের প্রেক্ষাপটে এই ধরনের বিষয় লোকসম্মুখে কোনো ঝড়ঝাপটা ছাড়া আসা একেবারে অসম্ভব। গল্পকার নিবেদিতা আইচ সেই ট্যাবু থেকে বেরিয়ে দ্বিধাহীনস্বরে বলে গেছেন দুজন মানুষের মধ্যকার ভিন্ন এক সম্পর্কের গল্প।

রজত, লিলি আর অভির জীবনের গল্প ‘সরোদজীবন।’ গল্পটি মূলত প্রেমের। কিন্তু এই প্রেমের স্বর আর সুর নিঃসঙ্গ সরোদের মতোই কোলাহলহীন। প্রেমিক রজত তামাটে চাঁদের রাতে আঁধার সাঁতরে একা একা ডুবে যায় অতলান্তিক বিষাদে, নির্ঘুম রাত, অলস নিরেট দুপুরে সরোদ বাজাতে বাজাতে ভাবে তার নামহীন, সংজ্ঞাহীন গোপন প্রেমের কথা, যেই প্রেমকে সমাজ সংজ্ঞায়িত করে সমপ্রেম হিসেবে।

‘নৈর্ঋতে’ গল্পগ্রন্থটি পড়তে পড়তে অনুভব করেছি প্রখর অন্তর্দৃষ্টি নিবেদিতা আইচের আর তার শব্দভাণ্ডর ঈর্ষণীয়রকম সমৃদ্ধ। নির্মল শব্দমালা দিয়ে তিনি এমনভাবে গল্পের আখ্যান নির্মাণ করেন যে পড়তে পড়তে পাঠককে হোঁচট খেতে হয় না।

‘টুটুলের বাইনোকুলার’ গল্পের একটি দৃশ্যপটে চোখ বুলালেই শব্দ-বাক্যের স্ততঃস্ফূর্ততা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, ‘এই জায়গাটা শহরতলির মতো। বেশ একটা মফস্বলী ঘ্রাণ আছে। অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম আমাদের ওদিকটায় কেমন ইটসুরকির ঠাঁসাঠাসি জীবন। ছিরিছাদ নেই। মসৃণ রাস্তায় পা রাখলেই ভিমড়ি খেতে হয়। একটু বেখেয়ালেই হাতটা বা মাথাটা চলে যায় চাকার নিচে। আর এদিকটায় কেমন দিব্যি মাঝরাস্তায় হেঁটে বেড়াচ্ছি!”

দুই বন্ধুর গল্প ‘টুটুলের বাইনোকুলার।’ মামুলি একটা বাইনোকুলার গল্পের মুখ্য উপাদান। অথচ এই বাইনোকুলারে চোখ রেখে পাঠক দেখে নেয় জীবনের সূক্ষ্মতম এক অনুভূতি যা মনের আকাশে ঘূর্ণায়মান মেঘদলকে জলে ভরোভরো করে।

এভাবে দৃপ্ত হাতে নিবেদিতা আইচ লিখে চলছেন এই সময়ের গল্প, মাটির গল্প, মানুষের গল্প-যে গল্পগুলো ঘাপটি মেরে থাকে আমাদের মনের নৈর্ঋতে।

শুভাসিশ রইল গল্পকার নিবেদিতা আইচের জন্য।

 

 

গল্পগ্রন্থ : নৈর্ঋতে
প্রকাশকাল: অমর একুশে গ্রন্থমেলা, ২০২০
প্রকাশক: পেন্সিল পাবলিকেশনস
প্রচ্ছদশিল্পী : নির্ঝর নৈঃশব্দ্য
মূল্য: ১৯৫ টাকা( ২৫% ছাড়ের পর)
প্রাপ্তিস্থান: অমর একুশে গ্রন্থমেলা, ২০২০ (স্টল নম্বর ৩১৪)

পূর্ব প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ: কিছু গল্প অবাঙমুখ
প্রকাশকাল : ২০১৮
প্রকাশক: পেন্সিল পাবলিকেশনস

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত