| 25 এপ্রিল 2024
Categories
পাঠ প্রতিক্রিয়া সাহিত্য

রফি হকের দুটি বইয়ের পাঠ প্রতিক্রিয়া

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

 

 

একজন রফি হকের পরিচিতি শিল্পী হিসেবে হলেও সাহিত্য তাঁর মজ্জাগত। লেখালেখির শুরু আশির দশকে। ১৯৮২তে পেয়েছেন ‘একুশে সাহিত্য পুরস্কার’, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন ১৯৮৪ সালে। এ ছাড়াও বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকা গুলোতে তাঁর লেখা বেরিয়েছে, প্রসংশিত হয়েছে। তাঁর সাহিত্য বা চিত্রকলা নিয়ে লেখার যোগ্যতা আমার নেই। আমি কেবল এই বই দুটি পড়ে আমার যে ভালোলাগা ও মুগ্ধতার অনুভূতি সেটিই লেখার চেষ্টা করবো।

রফি হকের কাব্যগ্রন্থ ‘ক্রিমসন রেড’ ২০১৪-তে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর প্রদর্শনী উপলক্ষে প্রকাশ হয়। আমি সেটার শেষ কপিটি সংগ্রহ করেছিলাম পাঠক সমাবেশ থেকে ২০১৭ -তে। বইটি হাতে নিয়ে তখন অভিভূত, চমকিত, শিহরিত আমি বিমুগ্ধ হয়েছিলাম! বইয়ের পাতা উল্টাতে লাগলাম। ছোট বড় মিলিয়ে একুশটি কবিতা বইটিতে। আর অসংখ্য পেইন্টিং গুলোও যেন কবিতার মতো। বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই। পড়তে লাগলাম…

কবিতার সাথে প্রতি পাতায় পাতায় দু’তিনটি পেইন্টিং পাশের পাতায় চোখ পড়লেও সেখানে অপূর্ব সব ছোট বড় পেইন্টিং। কবিতার সাথে চিত্রকলা আমার ভীষণ পছন্দের। কেননা যে কবিতা বোঝে, সে ছবির ভাষাও বুঝবে। কবিতা আর চিত্রকলা যেন পাশাপাশি দুটো মুখ।

‘ক্রিমসন রেড’ এর শেষের কবিতা দিয়ে শুরু করি-
…. এ নদী আমার নয়- তবু
এপার-ওপার করি প্রতিদিন।

এ নৌকা আমার নয়- তবু
এপার – ওপার করা কাজ।
তুমিও আমার নও
জেনো তবু, বয়ে যাওয়া যখন-তখন…!

আবার পাতা উল্টাই… চিত্রকলা দেখি, কবিতায় ডুব দেই… এক কোটি বছর আগে মানুষের জীবনে যা ঘটেছিলো
তার কিছুই ফেসবুক টাইমলাইনে নাই
গত পরশু ইয়োলো বৃষ্টির ভেতর একা হেঁটেছি, চুপচাপ
এক কোটি বছর পরেও বৃষ্টি হবে,
পয়ার ছন্দের মতো ক্রিমসন বৃষ্টিতে অলিভ গ্রিন মানুষেরা

ভিজবে, ভালোবাসবে-
পৃথিবীর মানুষ বৃষ্টিপাত ভালোবাসে।

বারোটি ছোট ছোট চিত্রকর্মের ভেতর কেবল একটি লাইন ধুসর হয়ে জেগে আছে –

‘সমস্ত পৃথিবীময় যেন ছড়িয়ে আছে আলগা অভিমান ‘

‘ক্রিমসন রেড’ পড়ছি, আর চিত্রকর্মের ভাষা খুঁজতে যেয়ে দুপুর থেকে সন্ধ্যে পার হলো নান্দনিক মুগ্ধতায়, ভালো লাগায়। তিন বছর আগের পড়া বইটি তাই আমার পছন্দের তালিকায় রেখে দিয়েছিলাম, তখনই। একদিন সামান্য কিছু লিখবো বলে।

‘ক্রিমসন রেড’ এর প্রথম কবিতা দিয়ে শেষ হোক আমার এ প্রয়াস-
‘মেঘেদের উচ্চারণে নানা রকম টানাপোড়েন থাকে
পিকাসোর নারীদের মতো।

যেমন পরশু সকালে বৃষ্টি হবে, হলো না।
এসব টানাপোড়েনেরও এক স্নিগ্ধতা আছে
যেমন প্রুশিয়ান ব্লুর সঙ্গে ইয়োলো আকারের মাখামাখি লাবণ্যতা’।

মনে হলো, রফি হকের কবিতা ও ছবিগুলো তাঁর থিসিসের বিষয়ের মতোই ‘ছবি কবি কবিতা’।

নিভৃত জীবনের ঘ্রাণ

রফি হকের প্রথম প্রকাশনা “নিভৃত জীবনের ঘ্রাণ”। এটি মূলত একটি জার্নাল । একজন মানুষের যাত্রা। একজন মানুষের ফেলে আসা পথের ঘুমহীন রাতের প্রচ্ছদ কিংবা জীবনের অলীক কোনো জ্যোৎস্নাস্নাত রাত ফুল ফোটায় প্রেমের, ভালোবাসার, মায়ার। কিংবা নিজের জীবনকে নিজেকেই কাঁধে তুলে দীর্ঘ আলোয় নিঃসঙ্গ ছায়া ফেলে হেঁটে যাওয়া, নয় চোখ ভরা জলে এফোঁড় -ওফোঁড় করা শূন্যতা হাতরে ফেরা।

দিনলিপির জার্নাল
‘একা একা’ , ‘আমার বয়েসী অন্ধকার’, ‘আশির্বাদ ইন্সপিরেশন অভিজ্ঞতা’, ‘জীবন কাঁধে করে বয়ে বেড়াচ্ছি’, ‘ভালোবাসা কী অভিশপ্ত বস্তু’, ‘স্বপ্নটা আরও দীর্ঘ হতে পারতো’, ‘ঘুরে দাঁড়াবার মন্ত্রণা’, ‘আমার চোখ ভিজে গেল’, ‘চাল চুলোহীন আর্টিস্ট.. রাস্তার ছেলে’, ‘বাস্তব আর পরাবাস্তবতার মাঝখানে’, ‘অপেক্ষায় আছে অন্ধকার গর্ত’, ‘বিবিসি থেকে ইন্টারভিউ’, ‘ঘুণপোকা কেটেছে কুট্ কুট্ করে’, ‘পা দুটোয় কারা যেন পেরেক মেরেছে’ ‘বুক ভর্তি স্বপ্ন- ভারসিলিয়ন রেড’, ‘চারুকলা চারুকলা’, ‘মানুষ না অন্যকিছু’, ‘জীবন এত সুন্দর’।

দিনলিপিগুলো জানুয়ারি ২, ১৯৯৪ থেকে শুরু, শেষ জানুয়ারি ১৬,১৯৯৬ তে সেন্টমার্টিনদ্বীপের সৌন্দর্য বর্ণনায়।

‘এমন শুভ্র জ্যোৎস্না হয়…! বিশ্বাস হতে চায় না। চারপাশ জুড়ে সমুদ্র, মাঝখানে! জেট সাবানের ফেনার মতো ঢেউ যেন আছড়ে পড়ছে জ্যোৎস্নার গায়ে। আমরা পুরো দ্বীপ ঘুরে ঘুরে জ্যোস্নায় স্নান করছি। সালভাদার দালীর পেইন্টিং এর মতো স্বপ্নময় রাত’।

বইটি শেষ হয় ‘মম একটি স্যুরিয়ালিস্ট’ নামের গল্প দিয়ে। গল্পটি পড়তে পড়তে একটা স্বপ্নের ভেতর ঢুকে গেলাম। গল্প শেষ করে দেখি, আমার চোখে টলটল জল, আবেগ ও বেদনার ছায়া পড়লো চোখে মুখে, বুঝলাম, ‘একজন শিল্পী বা লেখকের জীবন সাধারণের জীবন নয়’।

রফি হকের কবিতা ও জার্নাল এর দিনলিপির তারিখগুলো-গল্পের টানাপোড়েনগুলো, আমার ভেতরে একটা গভীর ছায়া ফেলেছিল। অন্য একটি প্রান্তে আমিও সেই সময়টায় যৌথজীবন যুদ্ধে এমনই এঁফোড় ওফোঁড় দৌঁড়াচ্ছিলাম…

আমার তপু এক দিনও আমার হাতটি ছাড়েনি কিন্তু রফি হকের মম দূরের অন্ধকারে হারিয়ে গেছিল, আর ফিরে আসেনি!

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত