গল্প সংগ্রহ
লেখিকার জীবনের বড় কাছ থেকে উঠে এসেছে প্রতিটি গল্প। বিচিত্র জীবনের নানারকম সম্পর্কের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি এঁকেছেন চরিত্রগুলিকে। প্রতিটি সম্পর্কের টানাপোড়েন এত সুখপাঠ্য যে টেনে রাখে গল্পের শেষ অবধি।বেশ কয়েকটি গল্পের কথা আলাদা করে না বললেই নয়।
অন্যভূমিকায় গল্পে অনুরাধার অনেক বছর বাদে তার প্রিয় “নাচ” কে সে নতুন করে আবিষ্কার করতে থাকে মেয়ের নাচ শেখা নিয়ে। সেই নিয়ে স্বামীর সঙ্গে প্রতিনিয়ত সংঘাত বা কথাকাটাকাটি থেকে বোঝা যায় নাচপাগল মেয়েটা নাচ কে কতটা ভালোবাসত। স্বামীর বক্রোক্তি, বচসা উত্তুঙ্গে উঠতেই থাকে। হঠাত একদিন নাচের অনুষ্ঠান শেষে নিজের বৌকে নতুন করে আবিষ্কার করে তার স্বামী। সেখানেই বেশ পজিটিভ উত্তরণ এই ছোট গল্পটির। সিংহবাড়ির পরীরা গল্পে তিনবোন যেন একই ছাঁচে ঢালা হয়েও তিনজন তিনরকম। উঠে আসে কালো বোনটির কালো হয়ে জন্মানোর দুঃখ। পরপর তিনটি মেয়ের জন্মে বাড়িতে চিরাচরিত লিঙ্গবৈষম্যের কথাও সুন্দর করে বর্ণিত সেখানে। সিংহবাড়িতে শিউলিফুল কুড়োতে যেতে তিনবোন। উঠে আসে তাদের বিয়ে নিয়ে টানাপোড়েন। বাগানের পরীরা পুতুলের মত সুন্দর হয়ে দাঁড়িয়েই থাকে শুধু। তাদের জীবনে তেমন টানাপোড়েন নেই। কাজ নেই। কিন্তু এই তিনবোনের অনেক কাজ। এই তিনবোনের মধ্যে দ্ইয়ে বারেবারে তিনপরীকে খুঁজেছেন লেখক। ওরা পরী। তাই ওরা আলাদা রক্তমাংসের তিন বোনের থেকে। একজনের রূপ সর্বস্বতা, একজনের অংকের মাথা আর অন্যজনের অপা চরং নিয়েই বাড়িতে মাতামাতি। এমনকি পিরিয়ডসের দোহাই দিয়ে সন্ধে দেওয়ার হাত থেকে নিস্তার পেতে হয় এদের।
এদের মধ্যে একজনকে পুড়ে মরতে হয়। তখন লেখকের মনে হয় এ যেন সত্যিসত্যিই পরী হয়ে গেছে। ডানাকাটা পরী ছিল সে। চরম বাস্তবের সঙ্গে কল্পনার মিশেল। উত্তরাধিকার গল্পটি স্মৃতিমেদুরতায় ভরা সুখপাঠ্য। সংযোগ রূঢ় বাস্তবের গল্প। তবে নামটি সংযোগ না হয়ে নীলমাছি হলে আরো ভালো হত। ঘরবাড়ি কেও আমি একটি সার্থক ছোটগল্প বলব। লেখকের সাবলীল গদ্যের মুনসিয়ানায় আবর্তন ইতিহাস নির্ভর গল্প। তার কাহিনীর সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে যুগপত গেঁটে চলে গল্পের কুশীলব। বিক্রম-মল্লিকাই যেন দেশকাল, ধর্মের বেড়াজাল অতিক্রম করে, কাঁটাতার পেরিয়ে কখন সুজয়-সুপর্ণা হয়ে ওঠে আমাদের চোখের সামনে। উভয়েরি সীমা লঙ্ঘনে প্রহরী কোনো প্রশ্ন করেনা। ইতিহাসের তথ্যভারে পাঠক ক্লান্ত হয় না।
দ্বীপ গল্পটি অসামান্য। ঝঞ্ঝা বিধ্বস্ত হওয়া জাহাজডুবি দিয়ে গল্পের শুরু। অচেনা সমুদ্র সৈকতে তিনটি প্রাণ পড়ে থাকতে থাকতে জীবন্ত হয়ে ওঠে। এদের মধ্যে মেয়েটি জাহাজের মনোরঞ্জনকারী গণিকা। ছেলেটি অপরিচিত হয়েও ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠ হতে থাকে তার সঙ্গে। আর তৃতীয়জন একটি শিশু। গল্পের মধ্যে কখন এই তিনজন অপরিচিত মানুষ তাদের অচেনা স্পর্শ দিয়ে এক অচ্ছেদ্য বন্ধনে জড়িয়ে পড়ে। বন্ধন দৃঢ় হয়। মেয়েটি আর ফিরে যায়না আগের জীবনে। অতীব সুখপাঠ্য গল্প ।
ঊষরের জন্মবৃত্তান্ত গল্পে নীলার সঙ্গে আকাশের বিবাহ বিচ্ছেদ বড় বেদনা বয়ে আনে। নীলা সবার সয়না আর যার সয় তার খুব উন্নতি হয়। পড়তে পড়তে থমকে যাই। এমন রূপকধর্মী গল্পের যাদু টেনে নিয়ে যায় অবলীলায়। মনে হয় আশেপাশের চেনা ঘটনা প্রত্যক্ষ করছি। প্রতিপক্ষ গল্পে ওঅ বিবাহ বিচ্ছেদের করুণ স্মৃতি প্রথম থেকে শেষ অবধি তাড়িয়ে নিয়ে যায়। একটি অতি চেনা গন্ধ যেন তাড়া করে শুভেন্দুকে। বারেবারে ভুলতে চেয়েও সে ভুলতে পারেনা প্রাক্তন স্ত্রী নীরা কে। দ্বিতীয় স্ত্রী তনিমা ব্যস্ত তার কেরিয়ার নিয়ে। সন্তান চায়না সে। কারণ প্রথমপক্ষের সন্তান আছে শুভেন্দুর। এদিকে সেই পরিচিত পুরনো গন্ধটাই রোগ হয়ে দাঁড়ায় শুভেন্দুর। একদিন সে বোঝে নীরার প্রতি তার অবিচার। আর সেই নীরার গন্ধটা দিয়েই তনিমাকেও ঠেলে সরিয়ে দেয় শুভেন্দু। ধাক্কা লাগে পাঠকের মনে।
বইটিতে এমন ১৬ টি ছোটগল্প রয়েছে।
এভাবেই এই বইয়ের প্রত্যেকটি গল্পই যেন লেখকের মাথায় ভীড় করা অভিজ্ঞতা থেকে জন্ম নেয়। চারিপাশে জমে ওঠা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ জীবনদর্শণই বুঝি গল্পলেখকের অন্যতম সম্পদ। মনে হয়, আরে! এ তো আমার দেখা, আমার চেনা একটা গল্প। সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায় আরো গল্প লিখুন। তাঁর সার্বিক সুস্থতা কামনা করি।
গল্প সংগ্রহ / সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
ধানসিড়ি
মূল্য– ২৫০ টাকা
উত্তর কলকাতায় জন্ম। রসায়নে মাস্টার্স রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে। বিবাহ সূত্রে বর্তমানে দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা। আদ্যোপান্ত হোমমেকার। এক দশকের বেশী তাঁর লেখক জীবন। বিজ্ঞানের ছাত্রী হয়েও সাহিত্য চর্চায় নিমগ্ন। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায়। প্রথম উপন্যাস সানন্দা পুজোসংখ্যায়। এছাড়াও সব নামীদামী বাণিজ্যিক পত্রিকায় লিখে চলেছেন ভ্রমণকাহিনী, রম্যরচনা, ছোটোগল্প, প্রবন্ধ এবং ফিচার। প্রিন্ট এবং ডিজিটাল উভয়েই লেখেন। এ যাবত প্রকাশিত উপন্যাস ৫ টি। প্রকাশিত গদ্যের বই ৭ টি। উল্লেখযোগ্য হল উপন্যাস কলাবতী কথা ( আনন্দ পাবলিশার্স) উপন্যাস ত্রিধারা ( ধানসিড়ি) কিশোর গল্প সংকলন চিন্তামণির থটশপ ( ধানসিড়ি) রম্যরচনা – স্বর্গীয় রমণীয় ( একুশ শতক) ভ্রমণকাহিনী – চরৈবেতি ( সৃষ্টিসুখ) ২০২০ তে প্রকাশিত দুটি নভেলা- কসমিক পুরাণ – (রবিপ্রকাশ) এবং কিংবদন্তীর হেঁশেল- (ধানসিড়ি)।অবসর যাপনের আরও একটি ঠেক হল গান এবং রান্নাবাটি ।
সুন্দর গল্পের বিষয়বস্তুগুলো।