| 20 এপ্রিল 2024
Categories
পাঠ প্রতিক্রিয়া সাহিত্য

বিতর্কিত সম্পাদ্যের  ব্ল্যাকবোর্ড 

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট
দেবযানী বসু
কবি শীলা বিশ্বাস শূন্য দশকের ব্যতিক্রমী কবিদের ট্রেন্ডটিকে ধরে রেখেছেন এই কবিতা বইয়ে। কবিতার গায়ে লাগছে বহুমুখিনতার হাওয়া। মানুষের মনে মননে ও জীবনযাপনের গোধূলিমায় এই বহুমাত্রিকতা থাকে। কবিতার নানা স্তরে টুকরো টাকরা জীবন তাই কথা বলে মাতলার খরস্রোত নিয়ে। সংক্রমণ ঘটে যাচ্ছে জীবনের হিসেবে যেখানে সিদ্ধান্ত গুলো প্রমাণ ও কার্যকারণের উপর দাঁড়িয়ে। যা বিশেষ করে লক্ষ্য করা হয় নি সেই উৎসে সেই গঙ্গোত্রীতে উজান বাইতে হবে, কবির ভাষায় যা পাঠককে ‘ব্যাক ক্যালকুলেশন’ করতে শিখিয়েছে। সুতরাং ‘কবিতা’ শব্দটিকে এক্স  ধরে জগৎ ও জীবনের নানা ভূলভুলাইয়া রাস্তা যা রোম আর অজস্র রোমকূপ দুদিকে যাত্রা করবে তার নানা বিন্যাস আমরা দেখে নেব। ‘মিয়াঁওনামা’ অধ্যায়ের কবিতাগুলো পোস্টমডার্ন বিড়ালের লোম দিয়ে তৈরি। তবে বিড়াল রূপক কবিতায় ব্যবহার করেন নি এমন কবি কমই আছেন। স্বয়ং জীবনানন্দ দাশ আছেন। অন্যে পরে কা কথা। 
এখানে শীলা বিশ্বাসের অন্তর্লোকের বিড়ালটি অতীন্দ্রিয় দ্যোতক তৈরি করেছে। দেখা গেছে যে সমস্ত এলিগোরি শেষপর্যন্ত বাস্তবতার সীমা ধরে উঠে আসছে। দ্যোতক কি করে চুপ করে থাকবে। তার কাজই তো উন্মোচন করা। জীবনের টারময়েলিং পর্বের কাঁটাছেঁড়ায় নেমে পড়া কবি কবিতাগুলোকে অ্যানিমেশনের পথে যাত্রা শুরু করিয়ে দিয়েছেন।
অতএব ‘বিড়াল জন্মের ভূমিকা ‘ নামক কবিতাটি জন্ম নেয়। সাধু ভাষার গাম্ভীর্যের আড়ালে গ্ৰানাইট চিন্তা ভাবনা গুলো আশ্রয় পেয়েছে। পাথরের ফাঁকে ফাঁকে গুজে দিয়েছেন লজিক্যাল ক্রাফ্ট শব্দের মায়ায়। তর্ক বিদ্যার প্রশ্ন উত্তর আর ফ্যালাসির সমাধান করতে করতে ও করাতে করাতে পাঠককে উন্মুখ করে তুলেছেন। এই প্রসঙ্গে মিয়াঁওনামার ৪ নং কবিতাটা একটু পড়ব —
‘অসুস্থ লালী বিড়ালী সেবা শুশ্রূষা নেবে বলে ফিরে এসেছে।তার হারানোর গল্প আর প্রতিদিনের দেখা দৃশ্যাবলীও কবিতায় আশ্রয় চায়।’ — শেষ পর্যন্ত একটি কলোনি বানান কবি। তার কলোনিতে থাকে সত্যমিথ্যা ভাঙচুর করা এক গৃহত্যাগী বিড়ালীর জীবন কথা।
কবিকে দেখছি পরিহাস বসিয়ে দিতে আকাশের মেঘের। কখনো প্রাচীন ললিতকলার লালিত্যকে দলিত জীবনের বেমানান দূরত্বে এঁকে দেখান।
যাদুগরের চালাকির উপর ঘটনাগুলোর অবস্থান। ভাষা আদ্যন্ত কবিতা বইয়ের ঝরঝরে সপ্রতিভতাসহ ফ্রেমবন্দি হয়ে পড়া আনন্দদায়ক। মনে রাখার মতো পংক্তি পেয়ে যাচ্ছি : ‘ সীমিত লাইফ লাইন নিয়ে শুশ্রূষা দেবে ভার্চুয়াল হিরণ্যজল ‘।
 
 
বারো ঋতুর ছন্দ কবি শীলা বিশ্বাসের প্রকৃতিপ্রেম চেতনায় এসে লাগে। সাধারণ জীবনের ভিতর অসাধারণ শিশির ঝরে। ‘দেজাভু’ কবিতাটি যেন নাট্যকারের বদলে কবির হয়ে ছটি বা ভিন্ন মাত্রার চরিত্রের কথা বলে। মনোজগতের এই সংমিশ্রণ ইনফিউশন সবই কবিতার উপলব্ধির ও শিল্পময় বিস্ময়বোধকে আবর্তন করে চলেছে। ‘বাস্তুঘুঘু’ কবিতাটি এক আশ্চর্যজনক রচনা। কবিতাটির আবেদন সার্বজনীন।
কবি শীলা বিশ্বাসের নিত্যনতুন আবিষ্কারে পাঠক মুগ্ধ —‘ কবিতার জন্ম মানুষের নাভিতে’ অর্থাৎ ঠিক ব্রক্ষ্মার নাভিকমলের মতো। বিষ্ণুর নাভিপদ্মে অবস্থিত ব্রক্ষ্মার অপর নাম পদ্মযোনী। সৃষ্টিকর্তার এই রূপকধর্মী অবস্থান বলে দেয় এই যৌনতাময় মায়া সমস্ত শিল্পের উৎস। এই একটি পংক্তি ধরে বিশ্বভ্রমণ করে আসা যায়। শীলা বিশ্বাসের কবিতায় রয়েছে সেই জারণ যা গোপন রাখার সাগ্ৰহে হাতভেল্কি দেখিয়েও গোপন করে নিচ্ছে নিজস্ব বিড়াল সুলভ সাবধানতায়। যত রাইজোমেটিক হয়ে গেছে কবিতার মাটি। পাঠক স্মিতহাস্যে বলবেন — ‘ টেক্সচুয়াল মিনিং ইজ ফ্রাগাইল’।
নিজেকেও খুঁজে পাই সহজ করে বলা অথচ উল্টোনো তাঁবুর চাদরে লেখা এই পংক্তির ভিতর — যেদিন জলের ভেতর জেগে থাকা মরুভূমি অনুভব করতে শিখে যাবে সেদিন থেকে তুমিও কবি’। চলো সাধনভূমে। কল্পনার জাল বুনে কবির ইউটোপিয়া দেশ পেতে হলে ‘পাথরে পাথর ঘসে এঁকে নিতে হবে মায়া সভ্যতার অ্যালগোরিদম আর অবশ্যই মানবিক ভাষার ‘ মায়া’ লেগে থাকবে কবিদের বুকে। দুয়েকটা ব্যঞ্জনাময় পংক্তি পড়ি — ‘জিভের তলায় কঠিন আয়ু’
‘জীবন জুড়ে জ্বালানো থাকে জীবনের চিতা’ ‘গুটিকয়েক মানুষ ঈশ্বরে পরিণত হচ্ছে ‘
আছে কিছু গল্পমায়ালাগা কবিতা যেখানে পারিপার্শ্বিক বাস্তব সমাজ থেকে উঠে আসছে মানসীর একমাত্র ইম্পোটেন্ট দাদা ও অন্যান্যরা। ঘটনা ঘটে যাওয়ার স্রোতের কাছে মানুষ কতো অসহায়। কবি শীলা বিশ্বাস সামনে দর্শক ও শ্রোতাবন্ধু বসিয়ে কথোপকথন করছেন তাদেরকে নির্দেশ দেন উপদেশ দেন আর সমস্যার কাব্যিক সমাধানও দেন। ‘গাছভাষা ‘ নামক কবিতাটি পাঠকের বিবেকদহনস্বরূপ।
কবিরও রয়েছে বিস্ময়বোধ যা প্রশ্নাকারে রূপ পেয়েছে।
শেষ পর্যন্ত সুন্দর সুন্দর যৌনতা মাখা প্রেমের কবিতা পেলাম। এগুলো একেবারে নখশিল্পের পারিপাট্য ও সৌন্দর্য নিয়ে উপস্থিত। কাঁচা মাটির গয়না নয়। অসম্ভব সুন্দর উচ্চারণ পেলাম — ‘ প্রতিটি কথাসঙ্গম ধরা দেয় পদ্মযোনির নতুন বন্দিশে’ — লিনিয়ার লিরিক্যালিটি। এগুলো অ আ ই ঈ ইত্যাদি নাম দিয়ে লেখা। সত্যিই তো প্রেম প্রথমত স্বরবর্ণের আর স্বভাবে প্লুত। রয়েছে প্রেমের পদাবলীজাত মেঘ ও কুয়াশা , উচাটন, সাবধান, বিশ্রাম, উচ্ছ্রিত ফোয়ারা আর একাকীত্ব। যমুনার সঠিক নীলের গভীরতা মাপতে মাপতে নির্বাচিত শূন্য পড়া শেষ হয়ে আসবে।
 
 নির্বাচিত শূন্য 
শীলা বিশ্বাস
সুতরাং প্রকাশনা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত