বর্ষামুখর দিনে বর্ষার গান
বাঙালি বরাবরই রোমান্টিক। সে প্রকৃতি প্রেমিকও বটে। আকাশপানে মেঘ জমলেই তার মন চঞ্চল হয়ে উঠে। মেঘ ও বৃষ্টির অনুষঙ্গ তার বড়ই প্রিয়। বৃষ্টিধৌত প্রকৃতির রূপে বিমোহিত সে।
মাটির সোঁদা গন্ধে সমস্ত চরাচর ভিজে উঠলে আমরাও মনে মনে ভিজে উঠি। ছুটির কোনও বর্ষামুখর সন্ধ্যায় তেলে ভাজা আদা – চা সহযোগে জমাট আড্ডার আসরে গান না হলে কি চলে! বর্ষার টাপুর টুপুর দিনে বর্ষার গান শোনার একটা অন্যরকম মোহ মায়া আছে। আজকের এই গানের আড্ডাতে শোনাবো দেশ বিদেশের এমন সব অসাধারণ বর্ষার গান যা আপনার হৃদয়ে উৎসারিত হবে।
মেঘ মল্লার
রাগ সঙ্গীতের মাধ্যমে স্বাগত জানাই বর্ষাকে। ওস্তাদ রশিদ খানের গলায় এ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে আমার এই গানের ভেলায় আপনাদের সকলকেই আমার সঙ্গী হতে আমন্ত্রন জানাই।
বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল
আষাঢ়ের প্রথম দিনে প্রিয়তমার হাতে কদম ফুল দিয়ে এ গান গেয়ে উঠেননি এমন বাঙালি যুবক পাওয়া বেশ মুশকিল। বর্ষা বাংলার কবি সাহিত্যিকদের কাছে সবসময়েই প্রিয়। কিন্তু বর্ষাকে গানে- কবিতায় মহিমান্বিত করে গেছেন যিনি তিনি আর কেউ নন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার সাহিত্যের অধিকাংশ জায়গা জুড়ে এই ঋতুর গুনগান ।
রবীন্দ্রনাথের ঋতুভিত্তিক গান আছে ২৮৩টি এবং তার মধ্যে ১১৫টি বর্ষার গান। কবি তাঁর জীবনস্মৃতিতে লিখেছেন, ‘‘বৃষ্টি পড়ে টাপুরটুপুর’’—ঐ ছড়াটা যেন শৈশবের মেঘদূত। তাই তার গান দিয়েই শুরু হোক বর্ষার গান শোনার আমাদের এই প্রস্তুতি। ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী’-র মতই রবি ঠাকুরের অসাধারণ সব গান কর্নকুহুরে প্রবেশ করে মনকে করে তোলে আন্দোলিত। বুষ্টিভেজা মন তাইতো গেয়ে উঠে :
‘ আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে, আসে বৃষ্টির সুবাস বাতাস বেয়ে ॥ ’ কিংবা ‘ পাগলা হাওয়ার বাদল-দিনে পাগল আমার মন জেগে ওঠে ॥ ’ শুধু এ গান শুনে মন কি তৃপ্ত হয়? তাইতো মনের অজান্তেই গেয়ে উঠে :‘ আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে, আসে বৃষ্টির সুবাস বাতাস বেয়ে ॥ ’‘ আজ যেমন করে গাইছে আকাশ, তেমনি করে গাও গো ॥ ’ এতেও মন না ভরলে শুনুন আরো কিছু রবীন্দ্র সঙ্গীত –‘ শাঙনগগনে ঘোর ঘনঘটা, নিশীথযামিনী রে, কুঞ্জপথে, সখি , কৈসে যাও অবলা কামিনী রে॥ ’ অথবা‘ গহণ ঘন ছাইলো গগন ঘনাইয়া॥ ’, কিংবা‘ আমার নিশীথরাতের বাদল ধারা ॥ ’, অথবা ‘ বরিষ মাঝে শান্তির বারি॥ ’
বর্ষার প্রথম দিনে
বর্ষাকে গল্প উপন্যাসে যে লেখক নতুনভাবে আবিষ্কার করেছেন তিনি হচ্ছেন হুমাযুন আহমেদ। প্রেমিক-প্রেমিকা হাত ধরে বর্ষার প্রথম দিনে বৃষ্টিতে ভিজতে হেঁটে যাওয়া কিংবা রিক্সার হুড খুলে বৃষ্টিতে ভিজে তার চেনা শহরকে নতুন করে খুঁজেঁ ফেরা – এ সবই তো আমরা পেয়েছি হুমায়ুনের লেখাতে।
তাই শুনি তার এই জনপ্রিয় গানটি –
‘বরষার প্রথম দিনে ঘন কালো মেঘ দেখে
আনন্দে যদি কাঁপে তোমার হৃদয়
সেদিন তাহার সাথে করো পরিচয়
কাছে কাছে থেকেও যে কভু কাছে নয় ॥ ’
হুমায়ুন আহমেদের উড়ে যায় বকপক্ষী নাটকের এই গানটিও আসাধারণ:
‘ হুড়মুড় হুড়মুড় করে মেঘা হুড়মুড় হুড়মুড় করে
আমার ঘরের চালায় বিষ্টি ঝুমঝুমাইয়া পড়ে
সাঁইঝাকালে আমার মনটা কেমন জানি করে ’
নজরুলের বর্ষা প্রীতি
কাজী নজরুল ইসলাম কে হুমায়ুন আহমেদের পরে স্থান দেয়ায় কেউ যদি মনক্ষুন্ন হন তাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে তাদের মন ভালো করে দিতে চাই নজরুলের সেসব গান শুনিয়ে-
‘ এসো হে সজল শ্যামল ঘন দেয়া ॥ ’
কিংবা
‘ঘন ঘোর বরিষণ মেঘ ডমরু বাজে, শ্রাবণ রজনী আঁধার ’
বর্ষা অবলম্বনে নজরুলের প্রচুর গান আছে। তার বেশিরভাগ গানই রোমান্টিকতায় পূর্ণ। এই যেমন:
‘শাওন আসিল ফিরে’ কিংবা ‘শাওন রাতে যদি’।
তাতেও মন না ভরলে শুনুন
‘মেঘ-মেদুর বরষায় কোথা তুমি? ফুল ছড়ায়ে কাঁদে বনভূমি।’
‘’এ ঘোর শ্রাবণ দিন কাটে কেমনে
বলো তুমি বিনে প্রিয়তম মোর
চমকি’ চমকি’ উঠে বারিধারা পরশে ॥’
কলকাতার আধুনিক বাংলা গানে বর্ষা
প্রথেমেই শোনাতে চাই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের
‘এই মেঘলা দিনে একলা, ঘরে থাকে না তো মন’।
একই সঙ্গে মনে এল, হেমন্ত-কন্যা রাণু মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া-
‘ঝির ঝির ঝিরঝির বর্ষায়,
কিংবা-
‘রিমঝিম এই শ্রাবণে।’
অথবা, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া-
‘এল যে বরষা মনে তাই ’
আবার,
‘আকাশ এত মেঘলা যেও না কো একলা’
এই গান দুটি ভাবুক মন না শুনে থাকতে পারে!ও দিকে মান্না দে গেয়েছেন
‘রিম ঝিম ঝিম বৃষ্টি’
কিংবা ‘ বর্ষা তুমি ঝরো নাকো অমন জোরে’ শুনেই আবার শুনতে পারেন তালাত মাহমুদের গাওয়া বর্ষার এই গানটি ‘এই রিম ঝিম ঝিম’ চিত্তে আনে প্রশান্তি। এছাড়া সুধীন দাশগুপ্তের স্বরে ‘থই থই শ্রাবণ এলো ওই’, ‘টাপুর টুপুর সারা দুপুর নূপুর বাজায় কে’, ‘শ্রাবণ চলো চলো’। হৈমন্তী শুক্লার গাওয়াও একটা ভারি মিষ্টি গান ‘বর্ষা তুমি চোখের পাতা ছুঁয়ো না’, অজয় চক্রবতীর ‘সে এক বর্ষা রাতে স্বপনে’ । লতা মুঙ্গেশকরের গাওয়া বাংলা চলচ্চিত্রে অপর্ণা সেনের লিপে ‘বৃষ্টি বৃষ্টি বৃষ্টি এ কোন অপরূপ সৃষ্টি’। আবার ‘বৃষ্টি তুমি ঝোরো না’কো ওমন করে’, ‘এই বৃষ্টিতে ভিজে মাঠে চলো চলে যাই’। এখানকার আধুনিক বৃষ্টিগানগুলোর মধ্যে এই মুহূর্তে মনে আসছে শুভমিতার গাওয়া ‘বৃষ্টি পায়ে পায়ে’, অনুপ ঘোষালের ‘একখানা মেঘ ভেসে এলো আকাশে’, শ্রীকান্ত আচার্যের ‘আমার সারাটি দিন, মেঘলা আকাশ বৃষ্টি তোমাকে দিলাম’, মনোময়ের গাওয়া ‘চেয়ে দ্যাখো মেঘেরা’ রাঘব এর, ‘ওই মেঘে মেঘে’— এসবই আপনার ভাবুক মনকে কোন এক বর্ষায় মেঠো প্রান্তরে হারিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করবে। শান-এর গাওয়া একটা গানও মনে পড়ল
‘রিমঝিম ধারাতে, চায় মন হারাতে’।
বাংলাদেশের গীতিকবিদের বর্ষা প্রেম
কলকাতার আধুনিক গানতো শুনলেন, বাংলাদেশের গায়কদের বর্ষার গান না শুনলে কি ভালো লাগে। তাইতো আপনাকে শোনাতে চাই –
নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরীর ‘আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে’ বা ‘একি রিমঝিম বৃষ্টি এলো’,
সুবীর নন্দীর ‘আমি বৃষ্টির কাছ থেকে’,
শাহনাজ রহমতউল্লাহর ‘আষাঢ় শ্রাবন এলে’,
রুনা লায়লার ‘এই বৃষ্টি ভেজা রাতে’,
সাবিনা ইয়াসমীনের ‘এই রিমঝিম বরষাতে’ বা ‘চলো বৃষ্টিতে ভিজি’,
নীলুফার ইয়াসমীনের ‘এক বরষার বৃষ্টিতে ভিজে’,
মিতালী মুখার্জীর ‘শ্রাবন এই সন্ধ্যায়’,
তপন চৌধুরীর ‘শত বরষার জল’,
বাপ্পা মজুমদারের ‘অঝর ধারায়’ ,
হাবীবের ‘বাদলা দিনে মনে পড়ে’,
ফাহমিদা নবীর ‘বৃষ্টি ভেজা রাত’ ইত্যাদি ।
বাংলা ব্যান্ড এবং জীবনমুখী গানে বর্ষা
‘এসো করো স্নান নবধারা জলে বলবি কি আর শহরে বৃষ্টি জল কাদা মাখা নোংরা দেদার’ – কবির সুমনের এ গানের সাথে অঞ্জনের ‘আমি বৃষ্টি দেখেছি’ বা ‘এক দিন বৃষ্টিতে বিকেলে’, শিলাজিতের ‘ঝিন্টি তুই বৃষ্টি হলে পারতিস’, অর্ণবের ‘বৃষ্টি রাতে’ গানগুলোতে বর্ষার আবাহনের সাথে সাথে নগর জীবনের এর এক অনিন্দ্য রূপ চিত্রিত হয়েছে। ঠিক তেমনি বাংলা ব্যান্ড মেঘদলের ‘আকাশ মেঘে ঢাকা’ বা ‘শহর বন্দী মেঘ’ ,মহীনের ঘোড়াগুলির ‘তোমায় দিলাম আজ’, সোলসের‘বৃষ্টি’ বা ‘রিমঝিমঝিম বৃষ্টিতে মন দরিয়ায়’,ওয়ারফেজের ‘বৃষ্টি নেমেছে’– গানগুলো সবইআধুনিক নগর জীবনের বর্ষা সঙ্গীত।
লোক সঙ্গীতে বর্ষা
‘আল্লা মেঘ দে পানি দে ছায়া দে রে’– আব্বাস উদ্দিনের এ গানের চিরচেনা সুর গ্রামীণ জীবনের স্মৃতিকে সামনে নিয়ে আসে। বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা নয় শুধু, ঐতিহ্য ধরে রাখার দাবিও যেন ওঠে আসে লোক বাদ্যযন্ত্র থেকে।
লালন গীতিতে বর্ষার এই গানগুলোতে রূপকের আশ্রয় নেয়া হয়েছে।
’অমৃত মেঘের বারি, সে বারি
অনুরাগ নইলে কি যায় ধরা। ’
———————-
’আছমানে বরিষণ হ’লে
দাঁড়ায় জল মৃত্তিকা তলে
লালন ফকির ভেবে বলে’
শুনুন এমনি আরো কিছু লোক সঙ্গীত :
‘আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি রে/
পূবালী বাতাসে/
বাদাম দেইখ্যা, চাইয়া থাকি/
আমারনি কেউ আসে রে…’
—————–
‘ছাতা ধরো হে দেওরা , এতান সুন্দর শাড়ি আমার ভিজ নাহি যায়’
হিন্দী গানে বর্ষা ঋতুর ব্যবহার
হিন্দি চলচ্চিত্রের বর্ষা গানের সংগ্রহও দেখার মতো। কত জনপ্রিয় গান যে রয়েছে— প্রথমেই তো মান্না দে লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া ‘শ্রী ৪২০’ ছবির ‘প্যায়ার হুয়া ইকরার হুয়া’, কিশোর কুমার-এর ‘মিঃ ইন্ডিয়া’ ছবির ‘কাটে নহি’, ‘মোহরা’ ছবির অলকা ইয়াগনিক উদিতনারায়ণের গাওয়া ‘টিপ টিপ বরষে পানি’, কিশোর কুমার-আশা ভোঁসলের কণ্ঠে ‘নমক হালাল’ ছবিতে ‘আজ রপট যায়ে তো’। এ আর রহমানের সুরারোপিত শ্রেয়া ঘোষালের ‘বরষো রে মেঘা মেঘা’, ‘চলতি কা নাম গাড়ি’-তে কিশোরকুমারের ‘এক লড়কি ভিগি ভাগি সি’, ‘মঞ্জিল’ ছবিতে লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে‘রিমঝিম ঘিরে শাওন’, ১৯৪২-এ লভ স্টোরি’তে রাহুল দেববর্মন-এর সুরারোপিত ‘রিমঝিম রিমঝিম রুমঝুম রুমঝুম’, ‘লগন’ ছবিতে উদিত নারায়ণের ‘ঘনন ঘনন ঘনা আয়ি বরখা’, বরষাত কি এক রাত’ ছবির ‘শাওন আয়ো রে’, ‘পরখ’ ছবির ‘ও সজনা বরখা বাহার আয়ি’লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে, ‘গুড্ডি’ ছবিতে বাণী জয়রামের গাওয়া ‘বোলে রে পাপিহারা’ `দেহাক’ ছবির ‘সাওন বরষে তরসে দিল’, `আফসানা পেয়ার কিয়া ছবির’‘টিপ টিপ বারিষ শুরু হো গেয়ি ভিগিভিগি রাত মো’গানগুলি সত্যিই অসাধারন। সবশেষে ‘ইজাজৎ’ ছবির গুলজারের লেখা সেই মরমী গানটি ‘ছোটি সি কাহানি সে, বারিষো কি পানি সে’ – গানগুলো একএকটি লোভনীয় পাকোড়া।
জনপ্রিয় বিদেশী গানে বর্ষার ঝংকার
বিদেশী কিছু জানপ্রিয় গান দিয়ে বর্ষা গানের এই লেখার ইতি টানব। এই ভরা বর্ষায় আমার এই গানের আড্ডায় শুনিয়ে গেলাম কিছু শ্রুত-অশ্রুত গান । এ গানগুলি সহজেই আপনার কালেকশনে রাখতে পারেন। এখন শুনুন তাহলে জনপ্রিয় কিছু বিদেশী গান- অবশ্যই বর্ষাকে নিয়ে।
BJ Thomas – ‘Raindrops Keep Falling On My Head’ ,
The Cascades – ‘Rhythm of the Rain’,
Trisha Yearwood- ‘Rainy Night in Georgia’
Eric Clapton -`Let It Rain’
The Beatles – ‘Rain’
Bob Dylan- ‘ Buckets of Rain’ or ‘A Hard Rain’s A-Gonna Fal’
Creedence Clearwater Revival –‘Have You Ever Seen The Rain?’
Neil Sedaka – Laughter In The Rain
Led Zeppelin ‘Fool in the Rain’
Guns N’ Roses ‘November Rain’
The Jimi Hendrix Experience ‘Rainy Day, Dream Away’