| 29 মার্চ 2024
Categories
গদ্য সাহিত্য

বোশেখের মঙ্গলপুরাণ

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

এই শহরজুড়ে যখন তপ্ত লু হাওয়া বয়ে যায় তখন আমার মন হাতড়ে ফেরে একটি তালপাতার পাখা বা করতোয়া পাড়ের এক ছায়াময় বিকেল বা শ্রাবণধারার অবিচ্ছিন্ন গান। আমি খুঁজতে থাকি কচুরিপানায় ঢেকে যাওয়া বদ্ধ পুকুরে ময়ূরপেখম মেলে ধরা অজস্র বেগুনী ফুলের অবিরাম মায়া, নাজুক কদমের বিরতিহীন ভিজে যাওয়া বা বৃষ্টিজলের টোকায় সবুজ জলের পুকুরে আছড়ে পড়া জারুলের সমর্পণ।

 

কিন্তু, আমার এই শহরে তা শুধু খুঁজে বেড়ানোয় সই। তপ্ত সময়ে শ্রান্ত মনের জন্য সে সব আয়োজন বুঝি শুধুই স্মৃতির নকশিকাঁথায় বরাদ্দ। ভুল করে ভুল সময়ে চেয়ে ফেলা বিভ্রান্ত মনের জারিজুরি। তবুও অবাধ্য আমার চোখ নির্বিকার খুঁজে চলে এক পশলা স্নিগ্ধ মায়া, এক খন্ড সবুজ সময়।

 

আর বরাবরের মতোই এই শহর আমাকে নিরাশ করে না। তীব্র রোদের ঝলকানি ছাপিয়ে উঁকি দেয় এক মায়ার আধার। নাম তার হাইড্রানজিয়া। নীল, বেগুনী, গোলাপি, সবুজ রঙের রূপের পসরা নিয়ে হাজির হয় এই হিমালয় কন্যা। চীন, তিব্বত, জাপান আর আমেরিকায় এদের দেখা মিললেও এরা জন্মায় মূলত হিমালয়ের কোলে। আর হিমালয় কন্যা বলেই বুঝি এদের রূপের চমক বিহ্বল করে দেয়, অফুরাণ স্নিগ্ধতায় হাতছানি দেয় আর দেয় চোখ জুড়িয়ে এদের রূপ। এরা করে বিভ্রান্ত! হ্যাঁ, ঠিক পড়েছেন বিভ্রান্ত। একই গাছে যখন কয়েকরঙের হাইড্রানজিয়া আলো ছড়াতে থাকে তখন বিভ্রান্ত না হয়ে কী উপায় থাকে।

 

তবে বিভ্রান্ত সময় পেরিয়ে গিয়ে সেই যে এক পশলা স্নিগ্ধ আলো, তাতে অবিরাম ভিজে আমার তপ্ত শহর ঠিক ঠিক জুড়ায় বা তাকে জুড়াতে হয়।

 

হেমন্তলগন

 

আকাশ থেকে চুইয়ে পড়া আলো চুপি চুপি দ্যুতি ছড়ায় পাতায়,বৃষ্টিমেঘের দিনের অবকাশে রঙের ধনু আমার চারিপাশে।

 

অসময়ের শ্রাবণ ধারায় সদ্য আলো ছড়ানো কৃষ্ণচূড়া অবিরত ভিজে যে মায়া ছড়ায় তাতে চোখ ভেজানো হয় না অনেকদিন বা বৃষ্টির তুমুল ছটায় বারান্দার টবে রাখা বেলির তিরতির কেঁপে যাওয়া, কতদিন ছুঁয়ে দেখিনি! পাশের বাড়ির ছাদে যখন বৃষ্টি নুপুরের নিক্কণ সুর তোলে তখন চোখের কার্ণিশে সেই ছবি ধরে রাখাও হয় না আজ অনেকদিন।

 

আর এই “না” গুলো যখন মনের ভিতর ঘুণপোকা হয়ে কুটুর কুটুর আওয়াজ তোলে তখন সত্যিই চারপাশটা বড্ড ধূসর হয়ে আসে। কিন্তু জীবন তো! একমুখী গতির জীবনে আমি থমকে গেলে সময় এগিয়ে যাবে  আমাকে পিছনে রেখে! আর ঠিক একারণেই আমাদের চলতে হয় সময়ের লয়ে লয় মিলিয়ে।

 

এখানে হেমন্তপ্রহরে কিছুদিন আগের সবুজ গাছগুলো মেতে ওঠে রঙের খেলায়। এ শহরে সকাল হয় জানালার গ্লাসে বৃষ্টির স্কেচ দিয়ে, জলের গ্রাফিতি দিয়ে। হেমন্তবৃষ্টি, বড় নিত্য এ শহরে। এই বৃষ্টি ছোঁয়াতেই গাছে গাছে চলে আলোড়ন। ঘর ছাড়ার ডাক এসেছে যে! হরেকরঙের আভায় বৃষ্টির ধুসরবেলাও কেমন রঙীন হয়ে ওঠে। নিউইয়র্ক এখন রঙবিভোর। যে রঙে চোখ মেললে হারিয়ে যায় ক্লান্তি, শ্রান্তি এসে ভর করে সেখানে। মনের অন্তঃপুর হয়ে ওঠে রঙিন। জলভরা মেঘের আকাশ সামিয়ানা হয়ে ঝুলে থাকে। না জানি কোন যাদুর পরশে পৃথিবীর সব রঙ জড়ো হয় এ শহরে। এসব অনিন্দিতা রঙবাহারীরা হাওয়াই দুলে, বৃষ্টিমেখে যেন পৃথিবীর সব ঐশ্বর্য এনে হাজির করে আমার আঙিনায়। এতটুকু আবাস আমার, এত ঐশ্বর্যে আকুল হই! আপ্লুত হই! প্রাণভরে দু’চোখের কোলে মেখে নেই এদের রঙ।

 

রঙ জমিয়ে রাখি আগত ধুসরবেলার জন্য। বেহাগের সুরে বৃষ্টিজলের ভেলায় যে রঙ দেশান্তরী হবে, তা কি ফিরবে কখনো অন্তঃপুরের রূপকথা হয়ে

 

বাসন্তীক আলাপন

 

বহুবছরি অশত্থের অবিচল ছায়া পেরিয়ে, দু’পাশে বেগুনি জারুল, হলুদ সোনালু, লাল কৃষ্ণচূড়ার মায়ায় মধ্যমণি হয়ে হেঁটে যাওয়া হয় নি অনেকদিন। আকন্দ, ভাঁটফুল বা ফণিমনসা’র ছোট্ট লাল ফুলে সেজে উঠিনি অনেকদিন। হিজলের বন, ভেজা কদমের তলা, ঝিঙ্গের মাচায় সাদা ফুল সেই কবে হাত ফসকে হারিয়ে গেছে! নিকানো তুলসীতলায় জাফরানি বোঁটার শিশিরজল মাখা শিউলির অর্ঘ্য, উঠোনের কোণে সাদা টগরের পেলব সময় আর শ্বেতকাঞ্চনের নিভৃত ভোর সে কি এই জনমের গল্প? কি জানি, সে সময় বুঝি স্বপ্নে এসে আবার স্বপ্নেই লীন হয়ে গেছে। তাই তো আমি চুলে জারুলের পরশ মেখে, সোনালুর দুল কানে ঝুলিয়ে, কদমের সোঁদা গন্ধ গায়ে জড়িয়ে, কোঁচড়ে টগরের পেলব সময় ভরে সেই নিকানো উঠোনের নিভৃত রক্তকরবী হয়ে রই। স্বপনে? না না, জাগরণে খুব সজাগ সময়ে সচেতন ভাবেই হয়ে রই আমি রক্তকরবী, হৃদয়ের রক্তক্ষরণে!!

 

আমার মনের সে ছবি বুঝতে পেরেই বুঝি আমার চারপাশ এমন করে ফুলের পসরা সাজায়। হোক না তা ক্ষণিকের। তবুও সাদা, গোলাপি ম্যাগনোলিয়া, রেডবাড, ডগউড, চেরির এমন অনিন্দ্য সময় আমার মনের আঁধার কাটিয়ে দেয়, নয়নের বসন খুলে আমি চোখের কোলে মেখে নেই এদের রঙ। পথের সবুজে, বনতলের ছায়ায় এরা নিজেদের রঙ বিলিয়ে বিদায় নেয় স্বল্প সময়ে। তবুও ক্ষণিকা পুষ্পিত সময় অর্ঘ্য হয়ে রয় জীবনের।

 

জীবনপুরাণ

 

অনেকরকম দিন ভিড় করে এখানে। ধুলো ওড়ানো শূন্য দিন, গতি হারানো মন্থর দিন, আকাশ ফুরানো মিথ্যে দিন বা ছায়া হারানো নির্লিপ্ত দিন। সেসব দিন বুকের ভিতর অবিরত পুড়িয়ে চলে সুগন্ধি ধূপ। খাগের কলম দোয়াতে ডুবিয়ে সময় বসে রচনায়। মহাকাল রচনায়। তানপুরার তারে আশাবরির সুর। সে সুর ওক, বার্চের শুকনো ডালে জীবনের চরকি কাটে। লাল-নীল সুতো ম্যাগ্নোলিয়ার গন্ধ আড়াল করে বিপ্রতীপ ঘূর্ণি তোলে। পশ্চিম আকাশে সূর্যের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে কৃত্তিকা। ক্ষয়ে যাওয়া নিথর দিন আচমকা উত্তাল হয়। কোথা থেকে ছূটে আসে স্কুয়ালের তীক্ষ্ণ তুষারছাট। সময়ের উপত্যকায় বন্দি হয় এক ডাহুক। সব হারানো জন্মান্ধ সে ডাহুক নিরবিচ্ছিন্ন কেঁদে চলে একটি হাওয়াই মিঠাই দিনের অপেক্ষায়।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত