তোমাকে খুব খুঁজছি । দেবরাজ দাশগুপ্ত (শুভ)
এক
রূপা, সত্যি বলছি,তোমাকে প্রথম যেদিন দেখেছিলাম,আমার মনে শুধু প্রশ্ন জন্ম নিচ্ছিল, তুমি কি অক্সিজেনের অভাব বোধ করছ না? বেশ বড় একটি শপিং মলের বেশ বড় একটি জুতার শোরুমের কাচের শোকেসে তুমি আর তোমার সহকর্মী যখন একটি বহুজাতিক ব্র্যান্ডের মডেল হয়ে সেখানে ছিলে অতি আধুনিক পোশাকের আবরণে,মানুষদের কেউ কেউ তার মন্দ চোখে তাকিয়েছিল, জানতাম।হয়ত তুমিও জানতে, তবু তুমি ও আমি, যারা বৃহৎ নগরীতে উপার্জনের ধান্দায় নিজেকে টিকিয়ে রেখেছি অনেক আপস ও সমঝোতায়, তাদের কাছে সে আর নতুন কি ছিল।
সত্যি বলছি, প্রথম দিনেই আমি বুঝেছিলাম তুমি যতটা সুন্দরী, তার চেয়ে বেশি মানুষ। একটু চাপা রঙ যেন একটু বেশি করেই ফুটিয়ে তুলেছিল যে তুমি ক্ষমতা রাখো হৃদয় দিয়ে অনুভবের। ছোট্ট একটি শহর থেকে কাজের খুঁজে বড় শহরে এসে অন্তরে যত আঁচড় নিয়ে বেড়াচ্ছি,মনে হচ্ছিল, তুমিই সেরকম মানুষ যার কাছে সেসব প্রকাশ করা যায়।
তোমার মত আমিও সেদিন শপিং মলে গিয়েছিলাম কাজের খাতিরেই। জান তো, আমার কাজ ছিল বিদেশী টুরিস্টদের নিয়ে। পুনে শহরের আকর্ষণ বিদেশিদের কাছে মোটেই কম নয়। তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল ইচ্ছেমতে ঘুরে শপিং করার জন্য, আর আমি বারে বারে দূর থেকে তোমাকে দেখছিলাম শুধু। সেদিন কিন্তু একবারের জন্যও মনে আসে নি আমার জীবনের সাথে এভাবে জড়িয়ে যাবে তুমি।
সেই শপিং মলেই যখন দেখা হল বন্ধু অজিতেশ এর সাথে, জানাল, তোমাদের প্রমোশনাল ক্যাম্পেইনিং তার তত্ত্বাবধানেই হচ্ছে, তারপর তোমার কাজ শেষে আমরা পরিচিত হলাম। সত্যি বলছি, সেদিন রাতে অনেক দেরীতে আমার ঘুম এসেছিল। একটি মেয়েকে নিয়ে আমি সেদিন অনেক ভেবেছিলাম। সে মেয়েটি আর কেউ নয়, তুমি।
দুই
অফিসের বস আমাকে ডেকে নিয়ে বলল, সুবিনয়, তোমার দুবাই অফিসে ট্রান্সফারের বিষয়টি গ্রিন সিগনাল পেয়েছে। তবে সেখানে যাওয়ার আগে তোমাকে বিয়েটা সেরে নিতে হবে।
বারো ঘাটের জল খাওয়া আমিও মিথ্যে বলে দিলাম অবলীলায়, হ্যাঁ স্যার। আমিও সেরকমই ভাবছি।
একটু অন্যরকম শোনাতে পারে কথাগুলো কিন্তু খুবই বাস্তব সম্মত ছিল কথাগুলো। একজন বিবাহিত মানুষ সহজে চাকরি ছেড়ে দেয় না বা উল্টাপালটা কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে না। দুবাই এর মত শহরে,যেখানে অভিবাসী সকলেই আছে আরো বেশি টাকা আয়ের চিন্তায়, সেখানে একজন কর্মচারী বিবাহিত হলে মন দিয়ে কাজ করবে।
মাথার ভেতরে চিন্তাগুলো প্রায় নিভে যাওয়া আগুনের মত ফু পেয়ে জেগে উঠল। হারিয়ে গেল ন্যায় অন্যায়ের বোধ। যেভাবেই হোক, দুবাই যেতেই হবে। কিন্তু বিয়ের শৃঙ্খলে নিজেকে বেধে নয়। আমারও চাই অনেক অর্থের অধিকার হবার স্বপ্নের পূরণ। বিয়ে সেখানে নিশ্চয়ই এক বাধা।
বড় শহরে এসে এক রুমে কয়েকজন ফ্লোরে বিছানা পেতে ঘুমলাম, কল সেন্টারে কাজ করে রাতের ঘুম বিকিয়ে দিলাম সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে। বাবা মা পরিবার পরিজন থেকে দূরে মেট্রো শহরে বেসরকারি কোম্পানির চাকরির শাসনে যে দিনগুলো আমরা কাটাই সেখানে সুখ নেই,পয়সার বিনিময়ে কিনে নেওয়া কিছু সামগ্রী উপভোগের আরাম থাকতে পারে।
তাহলে কেন সেসবের প্রতিশোধ নেব না? রাস্তায় খুঁজেছিলাম সবচে সস্তার খাবার,বসের অন্যায় আচরণেও মাতা নিচু ছিল শুধু বেতনের জন্য। প্রথমে দুবাই,তারপর আরো উন্নত কোন দেশ। কিংবা দুবাইয়েই যথেষ্ট টাকা হয়ে গেলে তারপর নিজের ব্যবসা।বিয়ে বিষয়টা দুই দিন পরে হলেও হবে।
ফোন করলাম অজিতেশকে। অনেক মডেলের সাথে তার জানাশোনা।তাকে খুলে বললাম বিষয়টা। বিয়ের কথা বলে অফিস থেকে ছুটি নেব পনেরো বিশ দিনের।তারপর চলে যাবো অন্য কোনো শহরে। সেখানে একজন মেয়েকে বউ সাজিয়ে কিছু ফটো তুলে নিলেই হবে। কোম্পানির মানুষেরা বিয়ের কথা বিশ্বাস করে নেবে। দুবাই ট্রান্সফার হতে আর বাধা থাকবে না। অজিতেশ জানাল, হয়ে যাবে।
তিন
রূপা, তোমার কি মনে আছে গোয়ার ফটোশুটের দিনগুলো?
অজিতেশ অনেক সাহায্য করেছিল সত্যি। কাজটায় তোমাকে যুক্ত করা থেকে শুরু করে গোয়াতে বাড়ী ভাড়া, তার সাহায্য পাওয়াতে প্রায় সবকিছু নিয়েই আমাকে তেমন মাথা ঘামাতে হয়নি। তবে সেই দিনগুলোতে তোমাকে ধন্যবাদ জানাতে চেয়েছিলাম তোমার সাহায্যের জন্য, যদিও তোমার কাছে সেটা শুধু একটা পেশা ছিল। তুমি সেজেছিলে বাঙ্গালী সাজে। আমার মত একটা বাঙ্গালী ছেলের বউ তো বেনারসি আর শাখা সিঁদুরই পরবে। তোমার কি মনে আছে, যে বাড়িতে আমরা ফটোশুট করেছিলাম, সে বাড়ির মালিক বলছিল, আরে, সত্যি সত্যি বিয়ে করে নাও।
আমরা দুজনেই হয়ত সেই কথাগুলো শুনেও না শুনার ভান করেছিলাম। মনে আছে তোমার, আমরা যখন ফটোশুট হয়ে যাবার পর ঠিক করলাম আরো দুই দিন গোয়াতে থেকে যাব, একদিন সন্ধ্যায় সৈকতে হাটতে হাটতে বলেছিলে, তুমি কিন্তু সত্যি সত্যি একটা বিয়ে করে নিলে পারতে। আমি বলেছিলাম, তাকেই বিয়ে করতে চাই যাকে ভালোবাসি । কিংবা, যাকে আজীবন ভালোবেসে যেতে পারব।
আমার কথাগুলো একটু অবাক করেছিল তোমাকে। নীরব ছিলে কিছুক্ষণ। সেদিন সৈকতের নির্জনতা আর সাগরের ঢেউ আমাকেই প্রশ্ন করেছিল, যে মানুষটি এই মুহূর্তে তোমার পাশে, তাকে জীবনের সাথে জড়িয়ে নেওয়া কি যায় না?
আচ্ছা , একই কথা তো আমি ও বলতে পারি। তুমি বিয়ে কবে করছ?
উত্তরে একটু হেসেছিলে তুমি।
আচ্ছা তোমার কোন ছেলে বন্ধু নেই? মানে,বয়ফ্রেন্ড বা প্রেমিক, এই জাতীয় কোনো কিছু ।
উত্তরে আবার হেসেছিলে তুমি ।
আরে, হাসার কী হল?
আরেকদিন বলব।
সেদিন রাতেও অনেক দেরিতে ঘুম এসেছিল। আর যে মেয়েটিকে নিয়ে অনেক ভেবেছিলাম, সে আর কেউ নয়, তুমি।শুধু তুমি।
চার
ছোট্ট একটি অফিসের সামান্য কয়েকজন কর্মচারী সহজেই আমার কথা বিশ্বাস করে নিলে বুঝতে পারলাম, একজন সাধারণ স্টাফ অনেক দূরের কোনো এক গ্রাম বা শহরে নিজের বাড়িতে বিয়ে করে সেখানে বউ রেখে এসেছে, এমন বিষয় নিয়ে তাদের মাথাটাকে কষ্ট দেওয়ার কোনো প্রয়োজন বোধ করছে না তারা।
রূপার কথা যদিও মনে পড়ছিল, কিন্তু কিছুক্ষণ ভাবার পড়ই প্রশ্ন এসে পড়ে, যে সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নেই, যে সম্পর্ক নিয়ে নিজেই সন্দিহান তা নিয়ে ভেবে কী হবে? বিয়ে বা প্রেমে জড়ানো বিষয়টা লিস্ট থেকে কেটে ফেলে আশে পাশে তাকিয়ে দেখি, আমার বয়সী অন্যরা অনেকেই এ শহরে নিজের ফ্ল্যাটে থাকছে, নিজের গাড়ী চালিয়ে অফিসে যাচ্ছে।
সেদিন অফিসে আমার বস নিজের রুমে ডেকে ব্রায়ানের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল।“ব্রায়ান, দুবাই অফিসে তোমার বস। হংকং এ ওর লিডারশীপে কোম্পানি অনেক সাকসেস করেছে।”
আমি শুধু হালকা স্বরে কথা বলছিলাম। নতুন বসের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা জরুরি। রাতে আমরা কয়েকজন রেস্টুরেন্টে ডিনার সারলাম। সেখানে এক ফাঁকে পিটার বলল, ব্রায়ান কয়েকদিনের জন্য গোয়া বেড়াতে যাবে। একটি মেয়েকে ঠিক করা হয়েছে ব্রায়ানের সাথে যাওয়ার জন্য । অর্থাৎ তাকে ‘সঙ্গ’ দেওয়ার জন্য। আমার মাথায় প্রশ্ন জন্ম নিচ্ছিল, সঙ্গ দেওয়া মানে কি?
পিটার বলল, কাল বিকালে ব্রায়ানের ফ্লাইট। তার আগে দুপুরে তুমি মেয়েটাকে রিসিভ করে এয়ারপোর্টে পৌছে দেবে।
মেয়েটিকে নিতে একটি রেস্টুরেন্টে এসে রূপাকে দেখে আমি তো প্রথমে যার পর নাই বিস্মিত হলাম, তার পর নিজেকে সামলে নিলাম, একজন পেশাদার মানুষ টাকার বিনিময়ে একজন বিদেশী মানুষের সাথে বেড়াতে যাওয়ার এসাইনমেন্ট নিতেই পারে। রূপাও অবাক হয়েছিল। তবে কোনও আবেগের বহিঃপ্রকাশ ছাড়াই বলল, কেমন আছো?
–এই তো।নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম।
–দুবাই কবে যাচ্ছ?
–প্রসেস চলছে। এক দু মাসের মধ্যে হয়ে যাবে।
আমরা ক্যাবে গিয়ে বসলাম। নতুন করে রূপার প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ কোনো শব্দ বা ভাবনা মাথায় না আসলেও এটা ভাবছিলাম যে সে কেন এই কাজটা নিতে গেল? মনে পড়ছিল পিটারের কথা, গোয়াতে নারীসঙ্গ সহিতে একজন শিশু যায় না বালি নিয়ে খেলতে। ক্যাবের পেছনের সীটে পাশে বসা রূপাকে প্রশ্ন করেই বসলাম, এই কাজটা না নিলেও পারতে।
–কেন?
– ব্রায়ান মানুষটা ভাল না। সে তোমাকে শারীরিকভাবে জোর করতে পারে।
– তোমার কি মনে হয়, আমার কাজ সম্পর্কে আমার ধারনা নেই? কঠিন কণ্ঠে যেন এক পেশাদারের প্রশ্ন। একটু সময় চুপ ছিলাম আমি। তারপর কি ভেবে বলেই ফেললাম, আসলে গোয়ার ফটোশুটের পর তোমাকে খুব কাছের মানুষ মনে হচ্ছে। তাই সাবধান করাটা জরুরী, এরকম মনে হচ্ছিল। রূপা কী ভাবল , কী বুঝল কে জানে। ড্রাইভারকে বলল, ট্যাক্সি থামাও।
পাঁচ
পিটারের ঘরে ব্রায়ান ছিল না, সে গোয়াতেই চলে গেছে, কিন্তু আমার ভেতরে অনেক ভয় ড্রাম বাজনার জন্ম দিয়ে যাচ্ছিল। আমি বুঝতেই পারছি না কেন তুমি মেয়েটিকে নিয়ে আসলে না? পিটার আমাকে সামনের চেয়ারে বসিয়ে খুব ঠাণ্ডা ভাবে কথাগুলো বলল।
–স্যার, সে নিজে থেকেই নেমে গেছে ট্যাক্সি থেকে। এই শব্দগুলোতে তেমন শক্তি ছিল না বুঝতে পারি।
–তুমি জানো না পিটার তোমার দুবাই অফিসের বস। সে যদি খুশি না থাকে তোমার দুবাই যাওয়া আর সেখানে টিকে থাকা অসম্ভব। পিটারের বাস্তবসম্মত কথার পর আমি চুপ থাকি। পিটার বলল, আমি তোমার রেজিগনেশন লেটারের ড্রাফট রেডি করে রেখেছি। সেটা তোমার ইমেইল আই ডি থেকে পাঠিয়ে দাও। আরো কয়েকটা বাক্য বিনিময় এই বিষয়টা পাল্টাতে পারল না যে , কোম্পানি থেকে আমি বরখাস্ত।
বিকালে ডিউটি শেষে একা একা আকাশটাকে দেখতে চাইলাম খুব। জীবন আর জীবনের চাওয়া পাওয়ার খেলা এত অনিশ্চিত , আরেকবার নিজের জীবনের উদাহরণ দিয়েই বুঝে নিতে হল। একজন মানুষের হাত ধরতে চাইছিলাম খুব। রূপা নামের মেয়েটির কথা খুব মনে পড়ছিল।