| 25 এপ্রিল 2024
Categories
ব্রহ্মপুত্র ও বরাকের গল্প

ব্রহ্মপুত্র ও বরাকের গল্প: সীমানা । দীপেন্দু দাস

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

খোল কর্তাল আর গানে দারুণ জমে উঠেছে কীর্তন। একটু আগে শুরু হয়েছে গান। কেউ পেশাদার শিল্পী নয়। হয়তো সেভাবে গানও শেখেনি । মাঝবয়সী মাত্র পাঁচজনের দলটি যে এত ভালো গাইবে আগে ভাবা যায় নি। 

পুজো ঘরটা বেশ বড়। নয়নার ইচ্ছেয় বাস্তু মেনে ঈশান কোনে দশ বাই দশ একটা রুম। নয়না কিছু বলার আগেই টাইলসের মিস্ত্রি মুসলমান হওয়ায় শুধু ঠাকুর ঘরের জন্য হিন্দু মিস্ত্রী নিয়ে এসেছিল ঠিকাদার। পুজোর ঘর আর সামনের খানিকটা খোলা জায়গা মিলিয়ে আসর পাতা হয়েছে। একটা ছোটো আসনে ফোটো ফ্রেমে গোপাল ঠাকুর আর গৌর নিতাই । আসরে লোক খুব একটা নেই। সাকুল্যে বারোজন। এর থেকে বেশি বসার জায়গাও হবে না।      

এরই মধ্যে হঠাৎ চোখে পড়ল পাগলা নুরুল। করিডরের ও মাথায় দাঁড়িয়ে। গায়ে নীল শার্ট, কোমরে সবুজ লুঙ্গি। নুরুল রহমান। রাজমিস্ত্রির যোগালি। গেটের সামনে টিনের অস্থায়ী চালা ঘরে থাকে। গত এক বছর ধরে বাড়ি বানানোর শুরুর দিন থেকে ও থাকে এখানে। রাতে পাহারা, দিনে যোগালি। এতে অবশ্য প্রতিদিন একশো টাকা গচ্চা দিতে হয়েছে। খুব নাকি চুরি হয় এই পাড়ায় । সুতরাং ঠিকাদারের এই বন্দোবস্ত মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। আজ সকালে গৃহ প্রবেশ হল। কাল ও চলে যাবে। আর ওর থাকার দরকার নেই।    

গান শুনতে এখানে চলে এসেছে। দূর থেকেই মাথা দুলিয়ে হাত তালি দিয়ে কীর্তনের সঙ্গে সঙ্গতে ভাগ নিচ্ছে। ছেলেটা আধ পাগল। মা বাবা নেই ওর। ঠিকাদারের মুখে শোনা, ছোটো বেলায় ওদের হারিয়েছে নুরুল। সঙ্গীদের কাছে ও পাগলা নুরুল। বড্ড বক বক করে। কি বলতে মাঝে মধ্যে কি বলে ফেলে ! মাত্রা জ্ঞান একটু কম। তবে গানের গলা ভালো। বালি সিমেন্টের কাজ করতে করতে খালি গলায় গান গায়। অনেকগুলো যন্ত্র নাকি বাজাতে পারে। একটা ভাঙ্গা দোতারা আছে ওর। ওটা বাজিয়ে মাঝ রাত অব্দি গান গায়। রাজমিস্ত্রির দলের অন্য আরেকটা কাজের ছেলে ওর সঙ্গে এক রাত থেকেছিল। নুরুলের সঙ্গীত সাধনার ঠেলায় সারা রাত ঘুমাতে পারেনি ছেলেটা। পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই ও বাড়ি চলে গিয়েছিল। অনেক বলেও আর কখনও রাতে থাকার জন্য ওকে রাজি করানো যায়নি। কীর্তন শুনতে এলেও ঠাকুর ঘরের সামনে কিন্তু আসেনি নুরুল। ক্ষ্যাপা হলেও হিন্দু পুজোয় লক্ষণ রেখা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল সে।  

আজ দুপুর অব্দি নারায়ণ পুজো এবং যজ্ঞ হয়েছে। শালগ্রাম শিলা নিজের সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন ঠাকুরমশাই। নিজের সঙ্গেই নিয়ে গেছেন। এই ঠাকুর স্পর্শের অধিকারে বর্ণভেদ আছে। সূচি হলেও সাধারণের অধিকার নেই এই ঠাকুর পুজোয় সরাসরি অংশ নেওয়ার। পুরুত ঠাকুর যখন পুজো করেন অলিখিত একটা সীমানা টানা থাকে। তা ডিঙিয়ে যাওয়ার জো নেই। এই জন্যেই হয়তো সন্ধেবেলা কীর্তন ছাড়া গৃহপ্রবেশ মানতেই চায়নি নয়না। এখানে কোনও সীমারেখা টানা নেই।  কীর্তন মাটির গান। আর মাটির প্রতি টান ওর চিরদিনের।

বিবাহিত জীবনের তেইশ বছর নিত্য যাপনে মাটির সঙ্গে সংযোগের সুযোগ বড় কম ছিল। ভাড়া বাসায় দোতালায় ঘুপচি ঘরে প্রথম পাঁচ বছর এবং তিন তলায় খানিকটা আলো হাওয়ায় চব্বিশটা পরিবারের সঙ্গে বাকি আঠারো বছর আবাসনের তথাকথিত গোষ্ঠী জীবনে এক ধরনের খোলসের মধ্যে নিজেকে আষ্ঠে পৃষ্টে বেঁধে ও যেন হাঁপিয়ে উঠেছিল। ঘরের মেঝে থেকে অনেকটা পথ ডিঙিয়ে তারপর এক চিলতে মাটির ছোঁওয়া পাওয়া । ভাড়াটে বলে, কয়েকটি ফুল গাছ আর কিছু আগাছা ছাওয়া দশ বাই চল্লিশ ফিট লনের মাটির ওপর তিরিশটি ফ্ল্যাটের আবাসনে ঘর মালিকের ভগ্নাংশ হিসেবে ভাগের অংশের খালি জমির ওপর আইনত তাদের কোনও অধিকার থাকার কথা নয়। কারণ মাস পুরতে ভাড়ার সাত হাজার টাকা তুলে দেওয়া শুধু ফ্ল্যাটে বসবাসের জন্য। আবাসনে লিফট নেই। তবু ভোর বেলা ঘুম থেকে ওঠে তিন তলা সিঁড়ি ভেঙে প্রায় দিন মাটির সোঁদা গন্ধ অনুভব করার চেষ্টা করত নয়না। আর্থারাইটিসের সমস্যার জন্যে রোজ অযথা এই সিঁড়ি ভাঙতে মানা করত শৈবাল। ব্যথা বাড়লে এক একটা সিঁড়ি দুর্লঙ্ঘ পাঁচিল ঠেকত তার কাছে। তবু এই অভ্যাসটা ছাড়তে পারেনি সে।

শহরের মেয়ে হলেও, জন্ম তার গ্রামে দাদুর বাড়িতে। ওখানে দিদিমার অপত্য প্রশ্রয়ে কেটেছে শৈশবের অনেক ছুটি। অবারিত মাঠ, উদ্দাম নদী, উঁচু বাঁধ ঘেঁসে ঝির ঝির হাওয়া, গ্রীষ্মের ছুটিতে আম কাঁঠাল দিয়ে বাটি ভরে মুড়ি মাখা, পুজোর ছুটিতে কাঁথা গায়ে প্রাক শীতের দুপুরে দিদিমার কাছে গল্প শোনা, মাঝে মধ্যে এবাড়ি ওবাড়ি কীর্তনের আসরে ভিড় করা, অনেকবার নয়নার মুখে শোনা শৈশবের এই স্মৃতিতে কতটা কল্পনা আর কতটা বাস্তব আজ বলা মুশকিল । তবু মাটির প্রতি এই অমোঘ টান যেন নয়নার মজ্জায় ঢুকে গেছে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই হয়ত সেই অর্থে শহুরে হওয়া তার এই জন্মে আর হয়ে উঠল না।      

শহরের মধ্যে জমি আকাশছোঁয়া দাম। ব্যাঙ্ক লোন নিয়েও মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে। ফ্ল্যাট হয়ে যেতো। কিন্তু ফ্ল্যাটে আপত্তি ছিল নয়নার। প্রায় দুবছর ঘোরাঘুরি করে অবশেষে শহরের এক প্রান্তে গলির ভেতর তিন কাঠা জমি কেনা হল। গলিটার একটু পরেই বিশাল নিচু জমি। বৃষ্টির মরসুমে এখনও জল জমে। অনেকে বলল জায়গাটা ভালো না। চুরি হয় । নয়না পাত্তা দিল না ।এই শহরে কোথায় চুরি, ডাকাতি, খুন হয়না ! এই কদিন আগে শহরের ব্যস্ততম রাস্তার মোড়ে বাচ্চা একটা মেয়েকে খুন করে রাতের অন্ধকারে কে বা কারা গাছের ডালে ঝুলিয়ে দিয়ে চলে গেল। এখনও অব্দি খুনির হদিশ মেলেনি। এমন মোক্ষম যুক্তির পর আপত্তি করার আর কোনও উপায় থাকে না।

কলেজের বন্ধু মৈনাক এই শহরে ট্রান্সফার হওয়ায় সুবিধে হয়েছে। ওর ব্যাঙ্ক থেকে সহজে ঘর বানানোর লোন পাওয়া গেল। মাটির ওপর নিজের বাড়ি তৈরি করার নেশা পেয়েছে নয়নাকে। ইএমআই –এর বড় অঙ্কটা ওর বেতন থেকেই কাটা পড়ছে। অনেক হিসেব করে মেপে খরচ মেলাতে হবে আগামী দিনগুলোতে। আগামী কয়েক বছর ছুটিতে ঘোরাঘুরি বন্ধ। তবু এই সমস্ত ত্যাগের আশঙ্কা মাথায় নিয়েও অবশেষে একচিলতে জমির ওপর নয়নার স্বপ্নের ছোট্ট একটা বাড়ি একদিন তৈরি হয়ে গেল।  

নিতান্ত মধ্যবিত্ত জীবনে বিশাল এই কর্মকাণ্ডে তার অবদান অস্বীকার করা না গেলেও ঘর বানানোর স্বপ্নের কপিরাইট নিঃসন্দেহে নয়নার। সুতরাং প্রাথমিক পর্যায়ে ইচ্ছে না থাকলেও গৃহপ্রবেশে কীর্তনে সম্মতি দিতেই হল শৈবালকে। 

বাড়ি বানিয়ে হাত খালি। ব্যাঙ্ক নামক কাবুলিওয়ালার কাছে আকণ্ঠ ঋণে নিমজ্জিত। বাধ্য হয়ে দুজনের সম্মতিতে নির্ধারণ হল যে ছোট্ট মাপে হবে গৃহপ্রবেশের অনুষ্ঠান। খরচের বহর ছাঁটতে গিয়ে দু-চার জন নিকট আত্মীয় বাদে পরিচিত আর কাউকে নিমন্ত্রণ না করার মত ছোট শহরের মাপে খুব অস্বস্তিকর সিদ্ধান্ত নিতে হল। ব্যয়ে লাগাম ধরার প্রভাব পড়ল কীর্তনের দল নির্বাচনে। কোনও পেশাদার প্রতিষ্ঠিত দলের রেট সামলানো মুশকিল, তাই খোঁজ পড়ল অপেশাদার কীর্তনিয়াদের। 

শেষ পর্যন্ত ছোড়দির চেষ্টায় যোগাড় হল কিছু কীর্তনিয়া। পাঁচ জনের দলে প্রধান গায়ক শুধু একটি অফিসে চাকরি করেন। বেসরকারি এক ব্যাঙ্কে চতুর্থশ্রেণির অস্থায়ী কর্মী। বাকিরা দিন মজুর। কেউ রিক্সা চালায়, কেউবা ঠেলা। সবাই অন্ত্যজ সম্প্রদায়ের। শহরের এক প্রান্তে সীমানা ঘেঁষে এদের বাস। আগে বিল ছিল ওখানে। শীতে শুকনো থাকত। চেপে বৃষ্টি নামলে শহরের নালা বেয়ে উপচে পড়া নোংরা জল নীলকণ্ঠের গরল পান করার মতো নিজের মধ্যে ধারণ করে ফুলে ফেঁপে উঠে বিশাল জলাশয় হয়ে উঠত। ওদের ওই বিলেই থাকার জায়গা করে দেওয়া হয়েছিল। স্বাধীনতা লাভের বহু বছর পর নাকি ওপারে হিন্দু হওয়ার অপরাধে আজকের বাংলাদেশ সীমান্ত পেরিয়ে এপারে এসেছে ওরা। অথচ দেশভাগের সময় সিলেট রেফারেন্ডামে ওরা নাকি পাকিস্তানে থাকার পক্ষে মত দিয়েছিল। বর্ণ হিন্দুদের বিশ্বাস করতে পারেনি তখন। যেহেতু ধর্মাচরণ কোনোদিন তার পেটে ভাতের যোগান দেয়নি, সেই ধর্ম পালন যে তার পেটে একদিন লাথি মারবে হয়তো সেটা বুজতে পারেনি ওরা। 

কেউ কেউ বলে কিছু নেতা তখন কৌশল করে ওদের এই বিলে বসিয়েছিলেন। শহরের চারপাশে মুসলমান গ্রাম। সীমানা ওপারের সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার প্রভাব পড়েছিল এপারেও। মধ্যবিত্ত হিন্দু অধ্যুষিত শহরে সীমান্ত প্রহরীর নাকি তখন প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। ওপার থেকে আসা অশিক্ষিত উদ্বাস্তুদের আর হারানোর কিছু ছিল না। সুতরাং দাঙ্গা বাঁধলে  তরোয়াল মোকাবিলার জন্য শুধু হকি স্টিক আর ক্রিকেট ব্যাট নয়, শহরে দা-বল্লমের মতো কার্যকরী অস্ত্রের যাতে অভাব না হয়, সে ব্যবস্থা করা হল। দেখতে দেখতে বিলের ওপর মাটির ঢিপির ছোট ছোট দ্বীপ গজিয়ে উঠল। শন বাঁশের সঙ্গে টিনের চালা ঘরও মাথা ওঠাল একসময়। শহরে কাজের মাসি, ঠেলা, রিক্সা ও অন্যান্য দিন মজুরের যোগান বেড়ে গেল। পোড়ো জমি বেচা কেনায়ও দালালির রমরমা ব্যবসা শুরু হল। কিছু পাতি নেতার জন্ম হল। এই সব কিছুর সুফলের ভাগ বড় বড় নেতাদের ভোটের বাক্সে ধরা পড়ল। এঁদের অনেকের এনারসিতে নাম উঠেনি । প্রয়োজনীয় নথি যোগাড় করার কথা মাথায় আসেনি আগে। আবার রাষ্ট্রহীন হওয়ার খাড়া ঝুলছে অনেকের মাথায়।     

মাত্র এক ঘণ্টার টানা বৃষ্টিতে আজকাল যখন তখন জল জমে যায় শহরের অনেক অভিজাত এলাকায় । বৃষ্টির মরসুমে অহরহ নালা উপচে পড়া জমা জলে নরক যন্ত্রণাতে ভুগতে হয়। বিল বুজিয়ে বসত তৈরি হওয়ায় শাপান্ত করে অফিস যাত্রী। শৈবাল ভাবে, গরীব-অন্ত্যজ-ছিন্নমূল মানুষগুলোকে নিজের বুকে আশ্রয় দিয়ে প্রান্তবর্তী প্রায় বিলীন হয়ে যাওয়া এই বিল কোনও না কোনও ভাবে কিন্তু এই শহরকে লালন করে চলেছে।

গান শুরু হওয়ার আগে কীর্তন দলের সঙ্গে বেশ খানিকক্ষণ গল্প হল। দিনের হাড়ভাঙা খাটুনীর পর কীর্তন এঁদের মুখ্য বিনোদন। দলের কর্তা দুঃখ করলেন,  পরিবেশ পাল্টে যাচ্ছে আজকাল। পাড়ায় বেশ কিছু ঠেক গজিয়ে উঠেছে। সন্ধ্যের পর মদ, গাঁজা, জুয়ায় মেতে ওঠে অনেকে। আজকাল কমবয়সী ছেলে মেয়েরা কীর্তন গাইতে সংকোচ করে। কীর্তনের আসরে লোকও কমে যাচ্ছে ধীরে ধীরে । আগামী দিনে এই ভাবে কীর্তন গাওয়া হয়তো উঠেই যাবে।

দলের কর্তা আর দোহার মিলে কীর্তন চূড়ান্ত পর্যায়ে। তেহাই দিয়ে একটা গান শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা গান ধরা হচ্ছে। এক ঘণ্টা গান গাওয়ার বরাত ছিল এঁদের। নির্দিষ্ট সময় কখন পেরিয়ে গেছে খেয়াল নেই। হরিনাম সংকীর্তনে  সবাই যেন বিভোর। করিডরের ওপাশে কিছুটা দূরে নুরুল গানে মশগুল। মেঝেতে বসে সারা শরীর দুলিয়ে হাত তালি দিয়ে সঙ্গত করছে।

নুরুলের মুখেই শোনা, গুরুর কাছে নাড়া বেঁধে ও নাকি কিছুদিন গানও শিখেছে। লোক সঙ্গীত ও বাংলা সুফি গান। সুফি গান গেয়ে নাকি আল্লার মধ্যে বিলীন হওয়া যায়। নুরুলের গানের মুর্শিদ বাংলাদেশের এক লোক শিল্পী। মূলত হোয়াটসআপ আর ইউ টিউবে গানের দীক্ষা। মুর্শিদ অন্তত একবার ওকে বাংলাদেশ যেতে বলেছিলেন। দীক্ষা ও শিক্ষা দুইয়ের জন্যই দরকার ছিল গুরু শিষ্যের মিলন। 

দু’দেশের সীমান্ত প্রহরীর চোখে ধুলো দিয়ে সুরমা নদীর মধ্য দিয়ে সীমান্ত পেরিয়েছিল নুরুল। নদীর দুপারে দুই দেশ। দুপারেই লোকগুলো দেখতে এক, ভাষা এক, আচার এক, পোশাক এক । নদীর জলে ইঞ্চি মেপে কাঁটাতারের বেড়ায় সীমানা নির্ধারণ হয় না। মানুষের দেওয়া সীমানা তোয়াক্কা করে না নদী। নদীর জলে গা ভাসালে নদীর মাছের মতো মানুষও আলাদা ভাবে চেনা মুশকিল।

এক দালাল নাকি ওকে বাংলাদেশ যাবার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। সুরমা নদীর জলে ভেসে দুই দেশের সীমান্ত প্রহরীর চোখে ধুলো দিয়ে বাংলাদেশ পাড়ি দেওয়া। বিনিময়ে লোকটাকে আধ মাসের কামাই গুঁজে দিতে হয়েছিল। প্ল্যান মতো ইণ্ডিয়ার দিকে সাদিরখাল গ্রামে সুরমা নদীতে স্নান করতে নামে নুরুল। তারপর সাতার কাটতে কাটতে একসময় মাঝ নদীতে চলে যায়। আগের কথামত দালালের একটা লোক বাংলাদেশের ওপার থেকে একটা ডিঙি নৌকো নিয়ে এসে আগে থেকে নদীতে মাছ ধরছিল। তারপর মাঝ নদীতে এসে উড়িয়ে জাল মারতে গিয়ে ইচ্ছে করে নদীর জলে পড়ে যায়। ওদিকে নদীর জলে ভেসে থাকা নুরুল সাঁতার কাটতে কাটতে ওই নৌকোয় গিয়ে ওঠে। তারপর সেই নৌকোয় জেলে সেজে বাংলাদেশে পারে গিয়ে নৌকা ভিড়ায়। আর দালালের লোক সাঁতার কেটে একসময় নিজের দেশে নদী পারে গিয়ে পৌঁছায়। সে যাত্রায় মুর্শিদের সঙ্গে ছ মাস ছিল। গ্রামে গঞ্জে তাঁর সঙ্গে থেকে গান শিখেছে মনে আনন্দে। গান শেখার এই তাগিদে সীমানা পেরোনোর এই বৃত্তান্ত নুরুলের মুখেই শোনা।   

কীর্তনের লয় বাড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নুরুলের দুলুনিও বেড়ে গেছে। গান বাজনার প্রচণ্ড শব্দের মধ্যেই কি মনে হওয়াতে হঠাৎ শৈবাল হাতের ইশারায় ওকে ডেকে নিল। এই আমন্ত্রণের জন্য প্রস্তুত ছিলনা নুরুল। দুপাটি হলুদ দাঁত বের করে গাল ভরা সংকোচের হাসি নিয়ে এগিয়ে এল। কীর্তনের আসরে ওকে বসতে বলল শৈবাল। অপ্রস্তুত ভাবে এর ওর দিকে তাকিয়ে সবার পিছনে গুটি সুটি বসে পড়ল ছেলেটা। ছোড়দি অবাক হয়ে বড় চোখ আরও বড় করে তাকাল। বলল না কিছু। শৈবাল ছোড়দির দিকে তাকাতে ভয় পেল। ব্যাপারটাতে ছোড়দির খুব খুশী হওয়ার কথা নয়। বিরানব্বইর ছয় ডিসেম্বরের দাঙ্গায় ডবকাতে ওর শ্বশুর বাড়ির ঘর পুড়েছিল। নয়না এদিকে পেছন দিয়ে আরেক সেট ধূপ-কাঠি জ্বালাচ্ছে। এখনও ওর চোখে পড়েনি ঘটনাটা। শৈবাল প্রমাদ গুনল। কীর্তনের দল যদি আপত্তি করে। যদি আর গান গাইতে রাজী না হয় ! কীর্তনিয়া দু’একজন আসরে নতুন সদস্যের আগমন লক্ষ্য করলেন। নুরুলের দিকে তাকিয়ে হাসলেন একজন। স্বস্তিতে শ্বাস ফেলল যেন শৈবাল। নুরুলের মুখেও হাসির ছোঁয়া। গান শুরু হওয়ার আগেই ওদের সঙ্গে জমিয়ে ফেলেছিল ও।পাঁচিল ভাঙার অসাধারণ ক্ষমতা আছে ছেলেটার।  

কীর্তন চলছে সমান তালে। গানের মধ্যেই নিজের পাশে রাখা বাড়তি কাঁসরটা ওর দিকে এগিয়ে দিলেন একজন। অবাক হলেও এখন আর সংকোচ নেই নুরুলের অভিব্যক্তিতে । প্রচণ্ড আগ্রহের সঙ্গে হাত বাড়াল সে। এটাই যেন চাইছিল মন থেকে। একবার বাজনার বিট লক্ষ্য করল ভালো করে। তারপর পূর্ণ উদ্যমে  সামিল হল কীর্তনে।

ধূপ-কাঠি সবগুলো জ্বালানো শেষ। নয়না পেছন ফিরল। নুরুলকে দেখতে পেয়েছে এখন । ওর প্রতিক্রিয়া উদগ্রীব হয়ে লক্ষ্য করছিল শৈবাল। প্রশ্রয় হাসির ঝিলিক চোখে। নুরুলকে খুব পছন্দ করে ও। বলে, ছেলেটাকে দেখলে মায়া হয়। গত কয়েক মাস ধরে প্রতি রবিবার এক বাটি মাংস তরকারী নুরুলের জন্য ঘর থেকে নিয়ে আসতে হত। 

কীর্তন শেষ পর্যায়ে। দাঁড়িয়ে পড়েছেন গায়কের দল। নুরুল গান গাইছে না। পদ হয়তো জানা নেই। কিন্তু সমান উৎসাহে কাশর বাজিয়ে সঙ্গত করছে । ধূপ, ধূনা, কীর্তন আর নুরুল! সব মিলিয়ে অদ্ভুত একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এই সব কিছু মাঝখানে বসে থাকতে থাকতে কেমন একটা অনুভূতি হল শৈবালের। ধর্মকে বর্ম করে চারপাশে গণ্ডি টেনে, জাতপাত আর শ্রেণী বিভাজনের যে রাজনীতি, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েই তো সাধারণের কীর্তন, সুফি গান। এখানে ভক্ত আর ভগবান শুধু। মাঝখানে আর কেউ নেই। 

প্রচণ্ড দ্রুত লয়ে চলছে কীর্তন। এক্ষুনি শেষ হবে বোধহয়। কীর্তনিয়ারা ফোটোর মহাপ্রভুর মতো উদ্বাহু। হঠাৎ দেখা গেল নুরুল গানের তালে দু হাত ছড়িয়ে নাচতে নাচতে চক্কর দিচ্ছে প্রচণ্ড ভাবে । কেমন একটা ঘোরের মধ্যে যেন। পরনের লুঙ্গিও চারপাশে ছড়িয়ে পাক খাচ্ছে ওর সঙ্গে। চারপাশে ছড়ানো লাট্টুর মতো পাক খাওয়া লুঙ্গি, উপর দিকে তাকিয়ে দুহাত মেলে গানের মধ্যে বিলীন হয়ে যাওয়া দেখতে দেখতে হঠাৎ নুরুলকে কেমন সুফি সাধকের মতো লাগছিল।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত