| 29 মার্চ 2024
Categories
ব্রহ্মপুত্র ও বরাকের গল্প

ব্রহ্মপুত্র ও বরাকের গল্প: অলীক গন্ধ । হিমাশিস ভট্টাচার্য

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

এমন গ্রাম এখনও এদেশে আছে কল্পনায়ও ছিল না। গ্রেজুয়েশন করে চাকরির জন্যে হাপিত্যেস করে ছোটাছুটি করছি। হঠাৎ করে জুটে গেল একটি সরকারি চাকরি। প্রোজেক্ট এর কাজ। নানা জায়গায় ঘোরাঘুরি করে তথ্য সংগ্রহ করা। সারাবছর ছোটাছুটি করতে হবে। চাকরি বলে কথা। আবার সরকারি। বাছবিচারের অবকাশ নেই। যথারীতি জয়েন করলাম। প্রথমেই দায়িত্ব পড়ল মেঘালয়ে যেতে হবে। বিস্তারিত কাজ সমঝে নিতে গেলাম শিলং অফিসে। চারদিন থাকতে হল। তিনদিন কাজের প্রশিক্ষণ। শেষের দিনে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র বুঝে নেওয়া। পরদিন রওয়ানা হলাম গন্ত্যব্যের পথে। কাজ মেঘালয়েই। তবে বড় কোন শহরে নয়। যেতে হবে অনেক ভেতরে, কোন এক অচেনা গ্রামে।

শিলং থেকে জোয়াই। জোয়াই থেকে পর পর কয়েকটি আকাশ ছোঁওয়া পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে টুক করে ঢুকে গেছে একটি পথ। আগে থেকে বোঝার উপায় নেই। মনে হচ্ছিলো বাসটা বোধহয় সোজা গিয়ে পাহাড়েই ধাক্কা লাগবে। যত এগিয়ে যাচ্ছিল টেনশন ততই বাড়ছিলো। একেবারে শেষে যেখানে পাহাড়টাও শেষ হয়ে গেছে ঠিক সেখানেই বাসটি হঠাৎ করে মোড় নিল। একেবারে ইউ টার্ন।  বদলে গেল চোখের সামনের ছবিটাও। সামনে পাহাড়ের পর পাহাড়ের সারি। পাহাড়ের একদিক কেটে কেটে তৈরি হয়েছে রাস্তা। বাসে বসেই দেখলাম অনেক দুরের পাহাড়ের গা বেয়ে পিলপিল করে এগিয়ে চলছে সার সার গাড়ি। বেশিরভাগ মালবাহী ট্রাক। পিঠে বিশাল মালের বহর নিয়ে হেলেদুলে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে ত্রিপুরা, মিজোরাম, মণিপুর অথবা বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে।

আরেকটু এগিয়ে লাইদ্রেম্বাই। ক্লেরিয়াত। কয়লাখনি এলাকা। একটু খেয়াল করলেই দেখা যায় পাহাড়গুলোর গায়ে গায়ে অসংখ্য গর্ত। এগুলো আসলে পাহাড়ের ভেতর থেকে কয়লা বের করে নিয়ে আসার পথ।এখন পরিত্যক্ত। এই পাহাড়ে আর কয়লা নেই। মুখগহ্বর গুলো পড়ে আছে স্মৃতি হয়ে। আসার আগে মা বলেছিলেন, নতুন জায়গায় যাচ্ছিস, বিজয়কে সঙ্গে নিয়ে যা। আমি রাজি হই নি। বিজয়! যার নিজেরই চালচুলোর কোন ঠিকানা নেই। একাত্তরের বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় ওপার থেকে তার বাবার সঙ্গে এদেশে এসেছিল বিজয়। রিফিউজি। আমাদের পাড়ার পাঠশালায় আশ্রয় নিয়েছিল। বিজয় তখন খুব ছোট। আমাদের বাড়িতে আসত। ছোটো খাটো কাজ করে দিত। মা আমাদের সঙ্গে বিজয়কেও খেতে দিতেন। কয়েকদিন পরেই স্কুলের ক্যাম্পে হঠাৎ করে মৃত্যু হয় বিজয়ের বাবার। যুদ্ধ থেমে গেলে ক্যাম্প উঠে যায়। বিজয়ের কেউ নেই, কোথায় যাবে। বাবা বিজয়কে বরাবরের জন্যে আমাদের বাড়িতেই রেখে দেন। সেই থেকে বিজয় আমাদের পরিবারের একজন সদস্য হয়ে রয়ে গেছে। বাবা তাকে একবার স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু এক সপ্তাহ পরেই বিজয় স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। পড়াশুনার বদলে আজগুবি যত ডানপিঠে কাজেই ছিল তাঁর বেশি আগ্রহ। শেষে বাবাও হাল ছেড়ে দেন। বাড়ির সব ধকলের কাজ করা আর সারাদিন ধরে বনবাদাড়ে ঘোরাই ছিল বিজয়ের প্রাত্যহিক রুটিন। প্রায় সমবয়সী হওয়ায় আমার সঙ্গেই ছিল বেশি ভাব। ছোটবেলায় আমরা একই ঘরে ঘুমোতাম আর গল্প করতাম। কিন্তু পড়াশুনার কথা তুললেই বিজয় পাশ ফিরে নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়তো। বিজয় আমাকে খুব ভালোবাসতো। বলত, তুমি চাকরি পেয়ে যেখানে যাবে আমাকে নিয়ে যাবে। আমি সবসময় তোমার সঙ্গে থাকবো। আমি হাসতাম। নিজেরই কোন ঠিকানা নেই। এ যে গোদের উপর বিষফোঁড়া। আমি পাত্তা দিতাম না। মা যখন বিজয়কে সঙ্গে নিয়ে যেতে বললেন আমি কথাটা কানেও তুলিনি। যেদিন শিলং গেলাম, বেরোবার সময় বিজয়ের সঙ্গে দেখাও হল না। বিজয় যেন কোথাও বেরিয়ে গিয়েছিল।

ছাই রঙের একটি ছয় সিটের মারুতি ভ্যান আমাদের নিয়ে রওয়ানা হল। ঐ রাস্তায় বাস যায় না। ভ্যানে সওয়ারি কতজন আমিও জানি না। গাড়ির আষ্টেপৃষ্ঠে মানুষ। গাড়ির দুদিকের দরজা, এমনকি ডিঁকি ও হাট করে খোলা। উপরেও মানুষ। গাড়ি চলতে শুরু করলে হঠাৎ এক উৎকট গন্ধ নাকে এসে আছড়ে পড়ল। হয়তো কোন সহযাত্রীর শরীর থেকে বেরিয়েছে। চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম। বোঝা গেল না। কিন্তু গন্ধটা সহ্য করতে পারছিলাম না। মনটা অন্যদিকে ঘোরাবার জন্যে অন্য চিন্তা করতে লাগলাম। গন্ধটা আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই চলতে লাগল। ঐ ফাঁড়িপথে ঘণ্টা তিনেক চলার পর গাড়ি থামল এক পাহাড়ি জনপদে। পাহাড়ের গায়ে গায়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা একটি গ্রাম। রাস্তার আশেপাশে কয়েকটি দোকানপাট, বাজার। চারদিকে শুধু খাড়াই উতরাইয়ের পাহাড়ের সারি। আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। কোথায় থাকবো, কি খাবো ভেবে কুল কিনারা পেলাম না। শিলং অফিস থেকে একজনের নাম দেওয়া হয়েছিল। একটি দোকানে গিয়ে লোকটির সন্ধান করলাম। দোকানি মহিলা। দুর্বোধ্য ভাষায় পাশের একজনের সঙ্গে কথা বললেন। একজন পাশের ঘর থেকে একগ্লাস চা এনে দিল আমাকে। ঠাণ্ডায় আমি প্রায় জমে গেছিলাম। চা পেয়ে দুইহাতে গ্লাসটিকে জড়িয়ে ধরলাম। যার খোঁজ করেছিলাম তিনি এলেন আরেকটু পরে। গাঁওবুড়ো। এলাকার প্রধান। বয়স বেশ হবে। দশাশই। গায়ে একটি গন্ধমাদন জ্যাকেট । ভুসভুসে দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে। যেন জ্যাকেটটি কেনার পর থেকে একদিনও ধোওয়া হয়নি। লোকটির মুখ ভর্তি পান। মদের উগ্র গন্ধ।

গাঁওবুড়ো সঙ্গে করে যাকে নিয়ে এলেন, তাকে দেখে আমি শুধু অবাকই না স্তব্ধ হয়ে গেলাম। বিজয়। ঘটনার আকস্মিকতায় আমার মুখ দিয়ে কোন কথা বেরোল না। বিজয় বলল,  নতুন জায়গায় তুমি একা থাকবে, মা আমাকে তোমার সঙ্গে যেতে বলেছিল। তুমি তো সেদিন আমাকে না নিয়েই চলে এলে। গাঁওবুড়ো জানালেন বিজয় তিনদিন আগেই এখানে এসে গেছে। আমি যে আসছি, খবরটা তারা আগাম বিজয়ের কাছে পেয়ে গেছেন। আমি আর কথা বাড়ালাম না। বিজয় আগেভাগেই আমার জন্যে ঘর প্রস্তুত করে রেখেছিল। ঘরটি তুলনায় বেশ ভালই। মাটি থেকে বেশ উপরে কাঠের পাটাতনের উপর তৈরি। শীত আর ভুমিকম্পের প্রকোপ বেশি বলে এখানকার সবাই এরকম ঘরেই থাকে। একটি মাত্র কামরা। সঙ্গে টয়লেট। একপাশে রান্নার জায়গা। সরল কাঠের তৈরি একটি ছোট্ট খাটে বিজয় আগেভাগেই আমার জন্যে পাটপাট বিছানা তৈরি করে রেখেছে । পরিস্কার পরিছন্ন। একটি কয়লার উনোন ও আছে। বিজয়কে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার বিছানা কোথায়? হাসল বিজয়। জানালো সে তিনদিন ধরেই পাশের একটি ঘরে আছে। বিজয় চা বানাতে গেল। বিজয় সরে যেতেই আগের সেই উৎকট, উগ্র গন্ধটি আবার যেন আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এতক্ষণ ভুলেই গেছিলাম। আসার সময় ভ্যানে ঠিক ঐ গন্ধ আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। চা নিয়ে আসার পর আমি বিজয়কে গন্ধটি সম্পর্কে প্রশ্ন করলাম। বিজয় তাঁর নিজের মাথাটি আমার দিকে এগিয়ে দিল। গন্ধ আসছে তাঁর মাথা থেকে। অবাক হয়ে গেলাম। বিজয়কে আগে কখনও মাথায় তেল মাখতে  দেখিনি। বিজয় বলল, এটা ওষুধ তেল। শিলচর থেকে আসার পথে তাদের গাড়িটা দুর্ঘটনায় পড়েছিল। পাহাড়ের অনেক উঁচু দিয়ে অপরিসর এই রাস্তায় প্রায়ই এরকম দুর্ঘটনার খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বিজয়ের গাড়ি প্রায় হাজার ফুট নিচে গড়িয়ে পড়েছিল। বিজয়ের কিছুই মনে নেই। মাথায় অসহ্য ব্যথা। কোনরকমে এখানে এসে পৌঁছার পর এখানকার একজন বুড়িমা নাকি এই তেলটি তাকে লাগাতে দিয়েছিলেন। নানারকম লতাপাতা দিয়ে তৈরি এটা তাদের নিজস্ব আবিস্কার। এটি লাগানোর পর থেকে তাঁর মাথাব্যথা সম্পূর্ণ উবে গেছে।

একটানা এগারদিন এলাকা চষে বেড়ালাম। নানারকম তথ্য সংগ্রহের কাজ। এলাকা উন্নয়নের জন্যে সরকারি প্রকল্প বানাতে এসব তথ্য খুব দরকার। আমার চাকরি ছিল এই সংগ্রহের। গাঁওবুড়ো সব ব্যবস্থা করে দিলেন। বাড়ি থেকে এত দূরে এসেও বিজয়ের চরিত্রের কোন পরিবর্তন হল না। এক সপ্তাহ পরে একদিন বিকেলে ঘরে এসে দেখি সকালে যেমন ফেলে গেছিলাম, ঘর সেরকম পড়ে রয়েছে। বুঝলাম, পাখি উড়ে গেছে। ঠিক এই কারণেই আমি বিজয়কে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে চাইনি। জানি বলে রাগও করলাম না। গাঁওবুড়ো একজন মহিলা ঠিক করে দিলেন। নেপালি। ওরা বলে কাঞ্চি।

কাজ শেষ করে শিলং ফিরলাম। অফিসে রিপোর্ট জমা দিয়ে ভাবলাম একবার শিলচরে বাড়িতে যাব। কিন্তু শিলঙে আমার জন্যে আরও কাজ আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল। এবার আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হল চেরাপুঞ্জিতে। প্রমাদ গুনলাম। আরও কত অজ গ্রাম হবে কে জানে? মনকে বোঝালাম, এসব ভেবে কি লাভ। চাকরি তো করতে হবে। এরকম হুটহাট যেতেও হবে। শিলঙে কিটিং রোডে ছিল আমাদের অফিসের গেস্ট হাউস। শিলং থাকলে আমি ওতেই থাকি। সন্ধ্যের সময় গেস্ট হাউসে ফিরলাম। কাল কাকভোরে চেরাপুঞ্জির গাড়ি। পলো থেকে ছাড়বে । তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে হবে। বাইরে বেশ ঠাণ্ডা। বিকেল থেকে আবার ঝিরঝির বৃষ্টিও শুরু হয়েছে। কেমন একটা মনমরা পরিবেশ। রিসেপসন থেকে রুমের চাবিটা নিয়ে ঘর খুললাম। দরজা খুলতেই গন্ধটা আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তীব্র । আরও বেশি ঝাঁঝালো। বিজয়ের কথা মনে পড়ে গেল। ধুর, এখানে বিজয় আসবে কোথা থেকে? হয়তো অন্য কেউ ওরকম তেল লাগিয়েছে। কিন্তু আশেপাশে তো কেউ নেই। কামরার ভেতর খালি। সাদা ধবধবে টানটান বিছানা পাতা রয়েছে। সারাদিনের ছোটাছুটিতে ক্লান্ত ছিলাম । ভাত খেয়ে বিছানায় যেতেই চোখ দুটো বুজে এল।

চেরাপুঞ্জির গ্রামটি একেবারে বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে। তুলনায় অনেক উন্নত। কয়েকটি সরকারি অফিসও রয়েছে। একটা দুই কামরার গেস্ট হাউসে আরেকজনের সঙ্গে একটি  বিছানা পেয়ে গেলাম। দুজন থাকব। বেশ ভালই হল। একা আর বোকা সমান। আমার সঙ্গে যিনি ছিলেন তিনি শিলঙের। খাসি সাহিত্যের একজন বড়মাপের লেখক। খুবই সদাশয় ভদ্রলোক। অনেক সময় দুজনে গল্প করলাম। রাতের খাওয়ার পর বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট সবে ধরিয়েছি ঠিক তখনই নাকে এসে লাগল সেই তীব্র গন্ধটি। বাইরের পাহাড়ি হু হু বাতাসেও গন্ধটা নাক থেকে সরছে না। কেন জানি না, একটা ভয়ের শিহরণ মাথা থেকে নেমে বারান্দার কাঠের মেঝেতে পলকে যেন মিলিয়ে গেল। সিগারেট ফেলে দিয়ে তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে গেলাম। ততক্ষণে ঘরও গন্ধময়। ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম তিনি এরকম কোন গন্ধ অনুভব করতে পারছেন কিনা। তিনি নাক দিয়ে কয়েকবার বাতাস টেনে জানালেন, গন্ধ তো পাচ্ছি না। আমি জানি গন্ধ মানে বিজয়। রাতে ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখলাম বিজয় ও আমার সঙ্গে সঙ্গে চলছে। এই মুহূর্তে আমাদের এই ঘরের একমাত্র চেয়ারে বসে মিটিমিটি হাসছে। ঘুম ভেঙ্গে গেল। তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নেমে ঘরের আলো জ্বালিয়ে দিলাম। কেউ নেই। চেয়ারটা খালি পড়ে আছে।

আবার শিলং। অফিসে কাগজ জমা দিয়ে বাড়ির পথে শিলচর রওয়ানা হলাম। পাঁচ দিনের ছুটি মঞ্জুর হয়েছে। বাসের টিকেট পেলাম না। সুমোয় ওঠে বসলাম। পাহাড়ের দুর্গম পথে এধরনের ছোটো গাড়িতে যাতায়াত করাটা খুবই ক্লেশকর। ভীষণ ভয়েরও। আমি সাধারণত যাই না। গাড়িগুলো চালায় ভীষণ জোরে ।কিন্তু এযাত্রা উপায় নেই। আমার ছুটি মাত্র পাঁচদিনের।

লাইদ্রেম্ভাইয়ে হোটেলে ভাত খাওয়ার সময় আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামল। একটু পরেই ছাড়ল গাড়ি। সর্পিল পথে বৃষ্টির তোড়ে সামনের রাস্তা ভাল করে দেখাই যাচ্ছিল না। গাড়ির হেড লাইট, ফগ লাইট সব জ্বালিয়েও সামনের পরিবেশ অনেকটাই আবছা। রাত কত হবে মনে নেই। হঠাৎ দেখলাম গাড়ি রাস্তা ভুল করে খাদের দিকে নেমে যাচ্ছে। এবড়োখেবড়ো। প্রচণ্ড ঝাঁকুনি।  মনে হল যেন মাথাটা নিচের দিকে নেমে পা দুটো ওপরের দিকে ওঠে গেল। সহযাত্রীরা চেঁচিয়ে ওঠলেন। আমার চোখের সামনে ঘনিয়ে এলো কালো ঘুটঘুটে অন্ধকার। আর কারো কথা শোনা যাচ্ছে না। আমি এক অলীক নিস্তব্দতার মধ্যে যেন ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছি। চেতনা লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে আমার। এই শেষ মুহূর্তে আচমকা নাকে এসে লাগল সেই গন্ধটি। বিজয়ের মুখটা মনের আয়নায় ভেসে ওঠেই  মিলিয়ে গেল। আমি ধীরে ধীরে হারিয়ে গেলাম। কিন্তু বেশ বুঝতে পারলাম গন্ধটি লেপটে রয়ে গেছে আমার নাকে, সর্বাঙ্গে ।

চোখ মেললাম দুদিন পর শিলচরের এক নার্সিং হোমে। মা, বাবা সহ সবাইকে পেলাম। শুনলাম, চালক সহ বারো জনের মধ্যে একমাত্র আমিই কি করে যেন বেঁচে গেছি। এগারোজন ঘটনাস্থলেই শেষ। আমার তেমন আঘাতও লাগেনি। পরদিনই ঘরে চলে এলাম। বাড়িতে গিয়ে দেখি আরেক আয়োজন। চাকরি পেয়ে আমি যেদিন শিলং যাই পরদিন স্থানীয় থানা থেকে খবর আসে যে শিলঙের রাস্তায় কয়লার ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখি কলিশনে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে একজন ছিল আমাদের বিজয়। আমি সঙ্গে নিয়ে যাইনি বলে বাড়িতে কাউকে কিছু না বলে সে নিজেই শিলং রওয়ানা হয়েছিল। পথে দুর্ঘটনায় মৃত্যু। পাঁচদিন পরে তার দেহ শিলচরে নিয়ে আসার পর বাবা মর্গে গিয়ে বিজয়কে শনাক্ত করেন। বিজয়ের শরীর এতটাই পচে গিয়েছিল যে দেহে একটা তীব্র গন্ধ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। দুদিন পর বিজয়ের পারলৌকিক কাজ। মা যখন আমাকে বিজয়ের কথা বলছিলেন কোথা থেকে ছুটে এসে মুহূর্তে গন্ধটি আমাকে দখল করে নিল। মাথাটা ভো করে উঠল। শুয়েছিলাম বলে নিজেকে সামলে নিলাম। আমার চোখের সামনে থেকে এক এক করে রহস্যের পর্দা সরে যেতে লাগল। জোয়াইর ভেতরে কোন পাণ্ডববর্জিত গ্রামে যাচ্ছি আমি নিজেই জানতাম না। কিন্তু বিজয় সব জেনে আমার আগেই সেখানে পৌঁছে গিয়েছিল। আমার থাকার সুবন্দোবস্ত করে রেখেছিল। তারপরেও শিলঙের, চেরাপুঞ্জির গেস্ট হাউসে বিজয় আমার সঙ্গেই ছিল।

বিছানায় শুয়ে শুয়ে ঘরের চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম। গন্ধটা এখনও নাকে লেগে রয়েছে। তার মানে বিজয় ঘরেই আছে। এত বড় দুর্ঘটনায় একমাত্র আমি কি করে বেঁচে গেলাম সেই রহস্যও পরিস্কার বুঝে গেলাম। চেতনা হারানোর মুহূর্তে গন্ধটা আমার নাকে লেগেছিল। তার মানে শুধু বিজয় আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।

বিজয় নেই। বাড়ির সবার কাছে সেটাই বাস্তব। বিজয় আছে, আমাদের মধ্যেই আছে, এই পরম সত্য শুধু আমার। এটা আমি কাউকে বোঝাতে পারব না। তারচেয়ে বরং না বলাই ভাল। বললে কেউ বিশ্বাস করবে না। বরং দুর্ঘটনায় মাথায় আঘাত পেয়ে আমার মানসিক সমস্যা হয়ে গেছে বলে ধরে নেবে। কিন্তু কোনমতেই বিজয়ের অস্তিত্ব মেনে নেবে না।

সেই থেকে বিজয় সবসময় আমার সঙ্গেই থাকে। গন্ধটা মাঝে মাঝে আমাকে তার অস্তিত্ব জানান দেয়। আমি কাউকে কোনোদিন কিছু বলিনি। জানি, বলেও লাভ নেই। উল্টো আমার মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে প্রশ্ন তুলবে। কে বিশ্বাস করল আর কে করল না, আমার এতে কিছু যায় আসে না।

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত