| 25 এপ্রিল 2024
Categories
ব্রহ্মপুত্র ও বরাকের গল্প

ব্রহ্মপুত্র ও বরাকের গল্প: বদলা । মাসকুরা বেগম

আনুমানিক পঠনকাল: 13 মিনিট

   

পেশায় আইনজীবী মিস নায়লার চেম্বার। তিন দিকের দেয়ালে রয়েছে রাশি রাশি বইয়ের তাক। বেশিরভাগই বিভিন্ন আইন সংক্রান্ত বই। আর রয়েছে বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যের কিছু বই। মাঝখানে রয়েছে একটি বড় টেবিল ও একটি রিভলভিং চেয়ার। সামনে গুছানো রয়েছে আরও  কয়েকটি চেয়ার। বিস্তৃত চেম্বারের প্রবেশ দ্বারের সম্মুখের কোনায় রয়েছে সাদামাটা ডিজাইনের সোফা সেট। সোফার কোনায় ফুলদানিতে কিছু ফুলের তোড়া সাজিয়ে রাখা। ঘরটিতে ঐ একটি মাত্র ফুলদানি। বাকি ঘরটি সাজানো রয়েছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন জিনিসপত্র দিয়ে। একটি দেয়াল জুড়ে রয়েছে তিনটি মানচিত্র,ইতিহাস বিখ্যাত কিছু স্মৃতি স্তম্ভের চিত্র আর ফ্রেমে বন্দি বেশ কয়েকটি মানপত্র, যেগুলো বিভিন্ন সামাজিক কাজকর্মে জড়িত থাকার জন্য নায়লার প্রাপ্ত সম্মান। ওর কিছু বিশেষ কর্ম হচ্ছে  শিশু, কন্যা তথা মহিলা সুরক্ষা প্রদান সংক্রান্ত। শিশু ও মহিলা নির্যাতনের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া ব্যক্তির নাম নায়লা। খুব কম সময়ের মধ্যেই নায়লার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে চতুর্দিকে। কলেজ জীবন থেকেই শিশু ও মহিলা সুরক্ষা বিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সাথে জড়িত রয়েছে নায়লা। ওর কর্ম নিষ্ঠা ও দক্ষতার জন্য  অনেক দূর এগিয়ে গেছে। আইন পাশ করে যোগ দিয়েছে ডিসট্রিক্ট বার এসোসিয়েশনে। ইচ্ছে করলে হাইকোর্ট কিংবা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে যোগ দিতে পারত। কিন্তু না। ওর লক্ষ্য শুধু উপরে উঠা নয়। ও সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে থাকতে চায়। তাদের জন্য কাজ করতে চায়। লড়তে চায় । 

নিজের চেম্বারে ঢুকে চেয়ারে বসে একটি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল উনত্রিশ বছরের নায়লা। আজ বারো বছর পর আরেকটি ন্যায় বিচার পেয়ে মনটা একটু হালকা ঝরঝরে লাগছে। মামলাটা নিয়ে এতদিন কী চাপের মধ্যেই না ছিল নায়লা! বাচ্চাটির নিষ্পাপ মিষ্টি চেহারাটা মনে পড়তে দুচোখের পাতা অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল। নায়লাকে অতীতের সাথে আবার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। নিজের অতীতের কালো দিনটিকে দুমড়ে মুচড়ে দলা পাকিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু অতীতকে মানুষ যতই ভুলাতে চায়, পারে কি ভুলাতে? না, পারে না। অতীত কালো ছায়ার মত পিছু পিছু থেকে যায়। যেকোনো সময় যে কোনো পরিস্থিতি কিংবা ঘটনা জিইয়ে দেয় ভুলতে চাওয়া অতীতকে। যারা শক্তিশালী তারা ভেঙে পড়ে না। শিক্ষা নেয় অতীতের কালো অধ্যায় থেকে। নতুন করে জেগে উঠে। অগ্নি স্ফূলিঙ্গ হয়ে জ্বালিয়ে দেয় বর্তমানের অশুভ শক্তিকে। 

চেয়ার থেকে উঠে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল নায়লা। এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসল বুকের ভিতর থেকে আপনাপনি। গড়িয়ে পড়ল চোখ থেকে অশ্রু বিন্দু। আজ খুব মনে পড়ছে গ্রামের কথা। ও জন্ম গ্রহণ করেছিল খুব সুন্দর সবুজে শ্যামলে ভরা একটি গ্রামে। কিন্তু সেই কবে যে গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছে।বড় ভালোবাসত গ্রাম,গ্রামের মাঠ – ঘাট,কাঁচা রাস্তা,লোকজন! ভাবতেই ওর কানে বাজতে থাকে গ্রামের লোকজনের ফিসফিস – কানাকানি – হাসাহাসি!মুহূর্তের মধ্যে নায়লা হারিয়ে গেছে সেই অতীতে !

– “আরে এক হাতে তালি বাজে না ! বুঝলে !…. নায়লার পাশের বাড়ির বৌদি বললেন।

– “একদম ঠিক বলেছ। নিজে যেন ধোয়া তুলসি পাতা। শুধু ছেলেটার দোষ !…. তার সঙ্গে আজিজের মা যোগ করলেন।

– ” ছিঃ ছিঃ! তোবা তোবা! কী বেহায়া  মেয়ে রে বাবা।’ ও বাড়ির পল্টুর আইবুড়ো পিসি বললেন।

– “যতসব নেকামি দেখ না!কচি মেয়ে! বুঝতে পারে নি কিছুই! এত বড় চেংড়া মেয়ে আবার কী বুঝে না এসব!ছিঃ ছিঃ!’ – আরেক জন নিকটাত্মীয় বললেন।

– “গলায় কলসি বেঁধে মরতে পারল না। লোকের সামনে মুখ দেখাচ্ছে কেমন করে। ছিঃ ছিঃ ছিঃ! নায়লার নিজের পিসি তিরস্কার করলেন ।

– ” ছিঃ দিদি, ছিঃ! তোমার মেয়ের জন্য শ্বশুর বাড়িতে মুখ দেখাতে পারছি না। তোমরা এত বোকা কেন রে? মান সম্মান বাঁচানোর কত রাস্তা আছে। তোমরা সামাল দিতে পারলে না। অতটুকু জল গড়াল কীভাবে! বড় মাসি মাকে ফোন করে যা তা অপমান করলেন।

সত্যিই তো! সেদিন নায়লা কে কী  বলছেকিচ্ছুটি শুনতে পায় নি! আসলে শুনতে চায়ও নি। লোক দেখানো লজ্জা শরমের ঊর্ধ্বে চলে গিয়েছে ও। সব গঞ্জনা আর বঞ্চনা শুনতে শুনতে কত শত প্রশ্ন ভিড় করেছিল ওর মনে – কেন  মুখ লুকব?’ ‘কী দোষ করেছি?’ ‘কেন নিজের হাতে মরে ইহ-পরকাল ধ্বংস করব?’ ‘যে পাপ করেছে সে শাস্তি পাবে না কেন?’ ‘কেন ছেড়ে দেব?’ ‘আমি কি পাপী?’ 

না! আমি তো পাপী নই‘… এই একটি উত্তর ওর মনে সাহস যুগিয়েছিল।লড়তে হবে।প্রচুর লড়াই করতে হবে। আজীবনের জন্য লড়াই করার খড় কুটো যোগাড় করতে হবে। বাঁচতে হবে। মাথা উঁচু করে।পড়াশোনায় অধিকতর মনোযোগী হতে হবে। অনেক ভালো রেজাল্ট করতে হবে। বেঁচে থাকার লড়াইয়ে অস্ত্র হিসেবে কাজ করবে বিদ্যা শিক্ষা। সব অপবাদ-অপমানের জবাব দেবে কর্ম, জিভ নয় ।

মনে পড়ছে এক এক করে সবকিছু!সবে মাত্র মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়েছিল ওর। পড়াশোনায় যথেষ্ট ভালো ও মনোযোগী ছিল। রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে। মায়ের কাছ থেকে নামাজ-রোজা পালন করা, কোরআন পড়া,শালীনতা বজায় রেখে চলাফেরা করা ইত্যাদি সবকিছু শিখে ফেলেছে। যথেষ্ট ভদ্র, অমায়িক, সহজ-সরল মেয়ে। কণ্ঠ স্বর খুব মিষ্টি। চটপটে স্বভাবের। একটু বাকপটু। কথা বলতে খুব ভালোবাসে। চোখ দুটো কাজল কালো উজ্জ্বল। পাতলা মুখের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ পাতলা নাক আর পাতলা দুটো ঠোঁট। ঝকঝকে সাদা দাঁত। মেয়েটির গায়ের রঙ কালো হলেও চেহারাটা দেখতে বেশ ভালোই। পাতলা-খাটো শারীরিক গঠন। ষোলো বছরের নায়লা যেন দেখতে  তখনও বারো/তেরো বছরের মেয়ে !

নায়লার পরিবারের লোকজন বলতে তার মা, বাবা ও একজন বড় ভাই। একজন বড় বোন আছে কিন্তু তার বিয়ে হয়ে এখন শ্বশুর বাড়িতে। তেরাস্তার মোড়ে বাবার একটি মুদির দোকান। কিছু চাষের জমি আছে। তাই চাষাবাদ ও করেন। বড় ভাই নাসির দ্বাদশ শ্রেণী পাশ করে ডিগ্রি কলেজে দুবছর যাওয়া-আসা করে পাশ করতে না পেরে মাঝ পথে পড়াশোনায় ইতি টেনে দিয়েছে তাই এখন দোকানে বাবাকে সহায়তা করছে ।

নায়লার বড়দি লায়লা সন্তান সম্ভবা ছিল। তার সন্তান প্রসবের সময় ঘনিয়ে এসেছিল। প্রথম সন্তানের জন্ম দেবে। সে ভয় পাচ্ছে। মাকে খবর দিয়েছে যাওয়ার জন্য। তখন যদি মা নায়লাকে একা না রেখে দিদিকে দেখাশুনা করতে না যেতেন হয়তো ওর জীবনে এত বড় তছনছ করে দেওয়া ঘূর্ণিঝড় আসত না। কিন্তু দিদি কী স্বার্থপরের মত দূরে সরে গেল লজ্জা শরমের দোহাই দিয়ে! কত কথা শোনাল নায়লাকে, কত ছিঃ ছিঃ করল! মাকে ফোনে যা ঝাড়ল- “চরিত্রহীন নায়লাকে বোন বলতে আমার লজ্জা করছে। ছিঃ ছিঃ! এ কী করল নায়লা! আমিও তো ঐ বাড়িতেই বড় হলাম, কোনদিন কোন ছেলে চোখ তুলে তাকাবার সাহসই পায় নি। মেয়ে হলে একটু সাবধানে থাকতে হয়। তাও শিখল না ওই বোকা মেয়েটি। আর মা, তোমরাও কী বলতো! এসব নিয়ে কোনো ভদ্র পরিবার থানা-পুলিশ করে? ডাক্তার, ঔষধ পাতি কিছুই চেন না নাকি? লজ্জা শরমের ও মাথা খেয়েছ । ছিঃ ছিঃ ….!

সেই অন্ধকার দিনটিতে ভাই মাকে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন দিদির বাড়িতে। বাবা ও খেয়ে দেয়ে দোকানে চলে গিয়েছিলেন। নায়লা একা ছিল বাড়িতে। দুপুর বেলা ঘরের দরজা বন্ধ করে মনের আনন্দে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “গল্প গুচ্ছ পড়ছিল ও। খুব ভালো লাগছিল এক একটা গল্প। গল্পউপন্যাস পড়তে খুব ভালোবাসে ও। রোজ ওর সংবাদ পত্র চাই। সংবাদ পত্র পড়া ওর নেশা। দোকান থেকে আসার সময় বাবা  সংবাদ পত্র নিয়ে আসতেন ওর জন্য। কোথায়, কী ঘটেছে গড়গড় করে বাবা মা-কে শোনাত। রাজনীতি থেকে খেলাধুলা-সব খবর।গর্বে বাবা-মায়ের বুক ফুলে উঠে নায়লার জন্য। নাসির আর লায়লা উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে আর এগুতে পারেনি। এই মেয়েটি পারবে। বরাবর স্কুলে প্রথম হয়। তাই নায়লাকে তাঁরা  উচ্চ শিক্ষায় উচ্চশিক্ষিত করে তুলতে খুব আগ্রহী । 

 সুভাগল্পটি সবে মাত্র পড়া শুরু করেছিল হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে উঠে দাঁড়িয়েছিল। আন্দাজ করতে চেষ্টা করছিল, এ অসময়ে কে আসতে পারে! কড়া নড়ছে ধীরে ধীরে। ভাবছিল, সকালে যাওয়ার সময় মা, ছোটমাকে বলে গিয়েছিলেন একটু খেয়াল রাখতে, তাই ছোটমা এসেছেন বোধহয়। নায়লার কাকা-কাকিমারা পাশাপাশি আরেকটি বাড়িতে আলাদা থাকেন। দরজা খুলতে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল –কে?’

-“আমি।তোর বাদশা ভাই। হা হা হা।হায়রে নায়লা! তুই তো বড্ড ভিতু মেয়ে। এত ভিতু ভিতু গলায় জিজ্ঞেস করছিস কে।’

– “ওহ্! বাদশা ভাই! নিশ্চিন্তে দরজা খুলে দিয়েছিল নায়লা। তোমার আজ স্কুল নেই নাকি ভাই?’ 

– “না রে আজ শরীরটা ভালো লাগছে না। তাই যাই নি স্কুলে। ঐ প্রাইভেট স্কুলে মাইনেই বা কী দেয় যে মরে মরে যাব। আচ্ছা বলত এভাবে বাইরে দাঁড়িয়ে রাখবি? ভিতরে আসতে বলবি না! যদি এক কাপ চা করে খাওয়াতি, তবে একটু তরতাজা লাগত। তোর হাতের চা টা কিন্তু দারুণ হয়। বোনদের হাতের চা বোধহয় এমনি হয়। আমার যে কোনো বোন নেই তাই বুঝবই বা কেমন করে !

– “ইস্ কী যে বল ভাই তুমি! আমি কি তোমার বোন নই।’ দরজা থেকে সরে গিয়ে ভিতরে এসে বাদশাকে বসতে বলে নায়লা চলে গিয়েছিল রান্নাঘরে চুলায় চা বসাতে। 

গ্যাস লাইটটা হাতে নিয়ে আগুন ধরাতে যাবে, পিছন থেকে এসে তাকে জড়িয়ে ধরেছিল বাদশা! নায়লা হতবাক হয়ে গিয়েছিল! ও কী কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছে! বাদশা ভাই তো এরকম না- এটাই তো ওর বিশ্বাস! কত মিষ্টি, ভদ্র- অমায়িক ব্যবহার বাদশা ভাইয়ের। কত ভরসা করে ও বাদশা ভাইকে! তাই তো মজবুত করে খিল দেওয়া দরজাটা খুলে দিয়েছিল তাকে! কী করবে এখন! কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না নায়লা। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে প্রায় জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়েছে। প্রায় অবশ দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে বাদশার হাত থেকে রক্ষা পেতে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হতেই দেখে এ কী ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে যে বাদশা। ক্ষীণকায় মেয়ে নায়লা পেরে উঠছিল না এই হাট্টাখাট্টা জোয়ান পুরুষ বাদশার সাথে লড়াই করে। হাঁপিয়ে উঠেছিল। প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিল !

যখন জ্ঞান ফিরেছিল নায়লা নিজেকে আবিষ্কার করেছিল বিছানায় বিবস্ত্র-বিধ্বস্ত অবস্থায়! বুঝতে পেরেছিল তার অমূল্য সম্পদ হরণ হয়ে গেছে! অঝোরে কাঁদতে থাকে অসহায় নায়লা !

একই গ্রামেরই বাদশা নায়লার বড় ভাইয়ের খুব কাছের বন্ধু। তাদের বাড়িতে বাদশার অবাধ আসা- যাওয়া ছিল। নায়লা ভাইয়ের বন্ধু বাদশাকে নিজের বড় ভাইয়ের মত শ্রদ্ধা করত। সে বাদশাকে ভরসা করত বড় ভাইয়ের মত। নায়লা বলত, ‘আমার দুই ভাই নাসির ভাই আর বাদশা ভাই।’ সে বিশ্বাস করত একজন ভাই একজন বোনের সবচাইতে বড় রক্ষক। ওর সেই পাতানো ভাইই আজ ভক্ষক! কিন্তু কোমলমতি নায়লা কী জানত যে ওর সব বিশ্বাস- ভরসা একদিন চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে! এক মহা প্রলয় আসবে আর ওর জীবনকে তছনছ করে দিয়ে যাবে !  

চুপ হয়ে গিয়েছিল চটপটে নায়লা। কাকে বলবে? কীভাবে বলবে? কত লজ্জার ব্যাপার! কে বিশ্বাস করবে ওর কথা। উল্টো যদি ওকেই দোষারোপ করা হয়! কে কী ভাববে? প্রচণ্ড লজ্জা আর জড়তা পেয়ে বসেছিল ওকে। কাউকে কিছু বলতে পারল না। পরদিন বাবা ও ভাই ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চলে গিয়েছিল কাকার ঘরে। অনবরত বকবক করতে থাকা নায়লাকে চুপচাপ দেখে কাকিমা জিজ্ঞেস করেছিলেন, কী রে নায়লা তোর শরীর খারাপ নাকি? এত চুপচাপ কেন ?’ 

-‘না ছোটমা। এমনি।কিছু ভালো লাগছে না। মা যে কোনদিন ফিরে আসবে?’

– ‘ঘরে একা ভালো লাগে না তো এখানে চলে আসবি। সিমি আর মিনির সাথে খেলবি। আমি যে ওদের নিয়ে ঘরের কাজ কর্ম করে সময় পাই না তোদের ওদিকে যাওয়ার।’ 

নায়লা মাঝে মাঝে জানলা দিয়ে ওদের বাড়ির দিকে উঁকি মারছিল। একবার দেখল বাদশা ওদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে! ঘরে তালা ঝুলছে দেখে বোধহয় চলে যাচ্ছে! যদি না আজ ঘর ছেড়ে চলে না আসত – ভাবতেই ভয়ে গা শিউরে উঠেছিল! আরও সাবধানে চলতে হবে। না হলে যেকোনো সময় শিকারির ফাঁদে পড়তে পারে। ওর অন্তর কেঁদে উঠে অসহ্য যন্ত্রণায়। নিজেকে সামলে নেয় কোনো মতে ।

নাসিরের সঙ্গে বাদশা ওদের বাড়িতে আসে-যাওয়া করত আগের মতই। নায়লা কিছু বলতে পারত না। বাদশা ওর সাথে কথা বলতে চাইত। ও চায়ের ট্রেটা ভাইয়ের পাশে রেখে তাড়াতাড়ি পালাত। বাদশাকে দেখলেই খুব ভয় করত। একদিন বিস্কুটের প্লেটের নীচে পেয়েছিল এক টুকরো চিরকুট কিন্তু হাতের লেখা নয়!প্রিন্ট করা বেনামী পত্র। বাদশার কম্পিউটার সেন্টারবলে একটি ডিজিটাল শপ আছে। পত্রে লেখা ছিল অনেক মন ভোলানো কথা, মিথ্যে ক্ষমা ভিক্ষা, মিথ্যে প্রতিশ্রুতি – মিথ্যে, মিথ্যে, সব মিথ্যে! সব শিকারের টোপ!বলে ও ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিল চিরকুটটি। বুদ্ধিমতী নায়লার মনে প্রশ্ন জেগেছিলতবে কেন হাতে লেখা পত্র না দিয়ে প্রিন্টেড দিয়েছে, শালা হারামি! ধরা পড়ে যাবে বলে!নিজের কোটার দরজা বন্ধ করে খুব কেঁদে ছিল। পনেরো দিন পরে মা ফিরে এসেছিলেন। নায়লার শুকনো চেহারা দেখে ভেবেছিলেন, তিনি বাড়িতে ছিলেন না তাই বোধহয় মেয়েটির অবস্থা এরকম হয়েছে।

দুমাস পার হয়ে গেছে নায়লার প্রাকৃতিক মাসিক চক্র বন্ধ।ও টের পেয়ে গিয়েছিল কিছু তো উল্টো পাল্টা ঘটেছে। কী করবে! সন্দেহ যদি সত্যি হয়! আঁতকে উঠেছিল! কাকে বলবে? মায়ের সাথে তো কোনোদিনই খোলামেলা সম্পর্ক নেই! তো মাকে বলবে কী করে!

উপায়ান্তর ভেবে না পেয়ে ছুটে গিয়েছিল বাদশার কম্পিউটার সেন্টারে। একা পেয়ে যায় তাকে। বাদশাকে দেখতেই ঘৃণা করছে। তবু ও নিজের ইজ্জত তো রক্ষা করতে হবে। উত্তেজিত নায়লা মাটির দিকে তাকিয়ে ঝটপট বলে ফেলে অনেক কথা ।

অসভ্যের মত হেসে উঠেছিল বাদশা, ‘প্রথমে টেস্ট করে নেয় তারপর খালাস! সব ব্যবস্থা আছে। তুই মুক্ত হয়ে যাবি!বলে তার টেবিলের ড্রয়ার থেকে টেস্ট কিট বের করে দিয়ে বলেছিল, “পজিটিভ হলে গর্ভপাতের বড়ি ও আছে আমার কাছে। তোর মত কত মেয়েকে সহায়তা করি। তাই এসব মজুত রাখি সব। হা হা হা !”

নায়লার মাথাটা ঘুরছে ঘূর্ণিঝড়ের মত। চিন্তায় মাথা খারাপ। বলে উঠেছিল, ‘সত্যিই যদি হয়ে থাকে। তবে তোমাকেই এর দায় নিতে হবে। আমার এ অবস্থার জন্য তো তুমি দায়ী। তাই বিয়ে ও তোমাকেই করতে হবে।’  শুনেছিল ওর দিদির এক মামাতো ননদ ধর্ষণের শিকার হয়ে গর্ভবতী হয়েছিল। তাই নাকি তাড়াতাড়ি ওই ধর্ষকের সাথে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় আর কেউ কিছুই বুঝতে পারে নি! মান- সম্মান ও রক্ষা হয়ে যায়। নায়লার এই মুহূর্তে নিজের সম্মান বাঁচাতে ঐ ধারণাটাই মাথায় কাজ করছে ! 

হাহাহাহা! কী প্রমাণ আছে? কোথাকার কার দায় আমার উপর চাপাবি! হে টুনটুনি পাখি, নিজের চেহারাটা একবার আয়নায় দেখিস! হাহাহাহা ।

অপমানিত নায়লা বিড় বিড় করে বলেছিল, ‘দেখে নেব!চিনিস না আমায়! আগুন জ্বালিয়ে দেব! তছনছ করে দেব! এ অপমানের বদলা আমি নেব।

আর নয়! এবার মাকে বলতে হবে। কিন্তু মা ও যদি বলে মুক্তির ব্যবস্থা আছে. কিছুতেই মানবে না নায়লাএত বড় পাপ করতে পারবে না। যে পাপ করেছে, সে হয় বোঝা কাঁধে নেবে, নাহয় জেলে যাবে! নায়লার মন তো জেলে দিতেই বেশি সায় দিচ্ছে। কিন্তু পরিবার বা সমাজ যে ওর দিকেই আঙুল তুলবে। তাই নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে কবর দিয়ে ঐ পশুর সাথেই ঘর বাঁধতে রাজি। রক্ষা করতে হবে মান সম্মান। সে সময়ে এখনকার মত এত সাহসী ছিল না নায়লা। অতীতে ঘটে যাওয়া কোনো দুর্ঘটনাই দুঃসাহসী করে তুলে দুর্বল মানুষটিকেও। বসে বসে নায়লা অন্য মনস্ক হয়ে ভাবছিল কত কথা!একান্ত নিজের কথা! ঘূর্ণিঝড়ের এক ঝটকায় সব দুমড়ে মুচড়ে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে ওর! এখন কী করা যায়!

আরে নায়লা কী হয়েছে তোর? এভাবে বসে থাকলে হবে! কিছু বই পত্র আছে তো। বের করে পড়।না পড়ে বসে থাকলে বাবার স্বপ্ন পূরণ হবে কীভাবে! তোর বাবা বলে বেড়ায় যে, মেয়েকে অফিসার বানাব!হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছিল নায়লা। মা অবাক হয়ে বলেছিলেন, ‘তোর ভালোর জন্যই তো একটু বকলাম …! 

না মা, না ….কথা আটকে যায়, বাঁধ ভাঙা কান্না থামতে চায় না। মাকে, পরিবারকে যে কত  বড় সমস্যায় পড়তে হবে! সব কিছু আন্দাজ করতে পারছিল। মা বুকে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরে ওকে আদর করে জিজ্ঞেস করলেন, “তোর কী হয়েছে রে মা? কেমন যেন হয়ে গেছিস! ভালো করে খাওয়া-দাওয়া করিস না! আগের মত বকবক ও করিস না! হাসি ফুর্তি ও করিস না! আগে ভেবেছি যে পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের চিন্তায় আছিস  তাই এমন হচ্ছে। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি অন্য কোনো কারণ হতে পারে! বল মা বল! কী হয়েছে তোর?”

সব শুনে মায়ের জ্ঞান হারানোর মত অবস্থা! সামনে শুধু অন্ধকার দেখছেন! মাথাটা ঘুরছে! বুকের মধ্যে শক্ত করে ধরে রাখলেন মেয়েকে! প্রচণ্ড রাগ হল নিজের ছেলে নাসিরের ওপর! এমন অসভ্য জানোয়ারের সাথে বন্ধুত্ব! বাড়িতে নিয়ে আসে! এমনকি রান্নাঘর পর্যন্ত অবাধ যাতায়াত! আজ আসুক! আগে নিজের ছেলেকে শিক্ষা দিতে হবে।

নাসির ও তাদের মা কথা বলেছিলেন বাদশার সঙ্গে। কোনো ধরনের উচ্চ-বাচ্য না করে নায়লাকে বিয়ে করার জন্য অনুরোধ করেছিল। গ্রামের মানুষ জানতে পারলে মুখ দেখাবে কেমন করে। ভবিষ্যতে যা হওয়ার হবে! এখন বিয়েটা হয়ে গেলে মন সম্মানটা বাঁচে। বাদশার সততা দেখার সময় নয় এটা। তাই বিবেকের কোনো প্রশ্নেরই ভ্রুক্ষেপ না করে মা ছেলে বাদশার হাতে পায়ে ধরে অনুনয় বিনয় করেছিলেন। কিন্তু কোনো ভ্রুক্ষেপই করল না সে। এড়িয়ে গেল নিজের দোষ। বদনাম দিল নায়লাকে নষ্ট মেয়েবলে ! বন্ধ করে দিল বন্ধু নাসিরের ঘরে আসা-যাওয়া। শেষ হয়ে গেল বন্ধুত্ব!

নাসির ও মা ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে চাইলেন নায়লাকে। কিন্তু বেঁকে বসল ও নিজে। নায়লার চোখের দিকে তাকিয়ে মা-ছেলে কেমন যেন কুঁকড়ে গিয়েছিলেন! এ কী দেখছেন নায়লার চোখে-মুখে! এ কোন নায়লা! এ কেমন রূপ ওর! চোখ দেখে মনে হচ্ছে আগ্নেয়গিরি থেকে যেন অগ্নুৎপাত/লাভা বেরুচ্ছে! নায়লার এই ভয়ঙ্কর রূপ দেখে সাংঘাতিক ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন মা ছেলে ! 

নায়লা সব বলল বাবাকে। আইনি ব্যবস্থা নিতে বলল বাবাকে। বাবা নিজেকে কোনোমতে সামলে নিয়ে মেয়ের সাথে একমত হয়ে চলে গেলেন থানায়। বাদশার বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা দায়ের করলেন !

গর্ভবতী নায়লা বৃষ্টির মধ্যে ছাতা মাথায় দিয়ে পুলিশ বাহিনী সঙ্গে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাদশার কম্পিউটার সেন্টারের সামনে।বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিল কিন্তু নায়লা যেন আগুনের মত দাউ দাউ করে জ্বলছিল। চতুর্দিকে কত লোকজন তামাশাদেখছিল। ফিসফিস করছিল। হাসছিল। বার বার নায়লার দিকে তাকাচ্ছিল। চতুর্দিকে ফিসফিস, কানাকানি, হাসাহাসি চলছিল। নায়লা জানে এসব চলবে। তাই ও পাত্তাই দিল না । 

পুলিশ নিজের কাজ করেছিল। তল্লাশি চালিয়ে বাদশার কম্পিউটার সেন্টারে কিছু প্রেগন্যানসি টেস্ট কিট‘, ‘এবরশন পিলইত্যাদি আপত্তিকর কিছু জিনিস পাওয়া গিয়েছিল।এসব দেখে কোনো বিবেকবানের বুঝতে বাকি রইল না যে বাদশা কত মেয়েকে নষ্ট করেছে। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। মামলা-মোকদ্দমা চলতে থাকে। বাদশা-ই যে অপরাধী তা আইনিভাবে প্রমাণিত করার জন্য ও তার দীর্ঘমেয়াদি শাস্তির ব্যবস্থা করার জন্য বাচ্চার জন্ম গ্রহণ করা অব্দি অপেক্ষা করতে হয়েছিল নায়লাকে ।

যথাসময়ে ডিএনএ টেস্ট হয়েছে। বাচ্চার ডিএনএ ও বাদশার ডিএনএ মিলে গেছে। বাচ্চাটির গায়ের রং, মুখের গঠন দেখতে ও অবিকল বাদশার মত হয়েছে। জরিমানা সহ দশ বছরের জেল হয়েছে তার। সাজা থেকে বাঁচতে সে বিয়ে করতে চেয়েছিল। কোর্ট ও প্রস্তাব রেখেছিল নায়লার কাছে মীমাংসার জন্য। কিন্তু না,নায়লা এ প্রস্তাবে থুথুফেলেছিল। নায়লার বাবাও বলেছিলেন,  ‘না হয় সারা জীবন মেয়েকে রেখে দেব নিজের কাছে। কিন্তু এই লম্পটের কাছে …. কিছুতেই না !উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিলেন। আর বলতে পারেননি। মহল্লার মানুষ হৈচৈ করেছিল ওদের একঘরেকরা হউক বলে। বাবা বলেছিলেন, – ‘আপনাদের যা খুশি করতে পারেন। ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন মসজিদের ইমাম। মহল্লার লোকজনকে বলেছিলেন, ‘আমি একঘরে করার পক্ষে নই। পরে যদি আমাকে কোন ঝামেলায় পড়তে হয়।এটা পুলিশ কেস।গাঁও পঞ্চায়েত সভাপতি গ্রামবাসীদের বলেছিলেন, ‘পরে জেলের ভাত খেতে যদি ইচ্ছা থাকে তাহলে হৈচৈ কর গে। যাও।আমি এসবের মধ্যে নেই ।

নায়লার অগ্নি রূপ গ্রামের সবাইকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। নায়লার সামনে কেউ কিছু বলা তো দূরের কথা, ওকে দেখলেই নেতিয়ে পড়ে! নায়লা মাধ্যমিকে খুব ভালো ফলাফল করল। কিন্তু উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হতে পারেনি ঐ বছর। একটা বছর ওর নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ও ধরে নেয়, ‘থাক্ এই এক বছর জীবন কাহিনির দুর্ভাগ্যজনক এক অধ্যায় হয়েএই অধ্যায়কে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে নতুন করে পথ চলতে হবে। আমাকে প্রচুর পড়াশোনা করতে হবে। জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে।’ 

নায়লার পরিবার বাচ্চাটির দায়িত্ব নিয়ে ওকে পাঠিয়ে দিল শহরে পড়াশোনা করার জন্য। ওর  নিঃসন্তান জ্যাঠামশাই ও জ্যঠিমায়ের কাছে ।

নায়লা দৃঢ় সংকল্প নিয়ে শুরু করেছে নতুন করে পথচলা। প্রতিজ্ঞা করেছিল, ‘একদিন একজন যোগ্য আইনজীবী হয়ে উঠব, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াব, নির্যাতিতাকে ন্যায় পাইয়ে দেওয়ার জন্য কঠিন লড়াই লড়ে যাব। মেয়েদের মধ্যে সজাগতা গড়ে তোলা ও আত্মরক্ষার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য একটি সেচ্ছাসেবী সংগঠন গড়ে তুলবো। ’ওর লক্ষ্যে পৌঁছাতে কোনো বাধা বিপত্তি ওকে আটকাতে পারে নি। পিছনে ফিরে তাকানোর ফুরসৎই মেলেনি । 

সমস্ত পরিকল্পনা করে ফেলেছিল যে বাচ্চাটিকে ও মা-বাবাকে নিজের কাছে নিয়ে আসবে। এখন ও  স্বাবলম্বী।প্রতিষ্ঠিত। তাদের দায়িত্ব বহন করতে পারবে। বাচ্চাটির স্কুলে নাম ভর্তির সময়টার অপেক্ষা ছিল। বছরের মাঝখানে নিয়ে আসলে ভালো স্কুলে নাম ভর্তির সুযোগ পাবে না। তাই আরও পাঁচটি মাস অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু কোথা থেকে যে  কী ঘটে গেল! কোনো মানুষ অতটা নিষ্ঠুর হতে পারে! ভাবতেই পারেনি।কীভাবে পারলে এত বড় কাণ্ড করতে ! 

সেদিন মা ফোন করে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘নায়লা! কয়েক দিন ধরে আমাদের গ্রামে একজন নতুন আইসক্রিমওয়ালা এসেছে। ভালো ভালো ব্র্যান্ডের আইসক্রিম এনেছে। মারুফ খুব জেদ করছে খাবে বলে। দেব কী রে?’ ‘ভালো আইসক্রিম হলে দিয়ে দাও না,মা।বাচ্চা ছেলে খেতে ইচ্ছে করবে তো! 

কে জানত এই শেষ আইসক্রিম খাওয়া মারুফের!নায়লা কত দেখে শুনে নাম রেখেছিল মারুফ। সততার শিক্ষা দিয়ে বড় করে তুলবে ওর ছেলেকে। তাকে ঘিরে কত যে স্বপ্ন দেখেছিল ও। আইসক্রিম খাওয়ার পর পরই মারুফের শরীর খারাপ হতে থাকে। মুখ দিয়ে ফেনা বেরুতে শুরু করেছিল, সারা শরীর গাঢ় নীল রঙের হয়ে গিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে  হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে রক্ষা করা যায়নি মারুফের জীবন। ডাক্তার বললেন যে আইসক্রিমে সাংঘাতিক বিষ ছিল। চুল দাড়িওয়ালা মাথায় গামছা বাঁধা  আইসক্রিম ওয়ালাকে আর গ্রামের তেসীমানায় দেখা গেল না। পুলিশ তন্ন তন্ন করে খুঁজে বের করল আইসক্রিমওয়ালাকে। সত্যতা সামনে আসল। আসলে আইসক্রিমওয়ালা ছিল বাদশার ছদ্ম রূপ ! 

-‘কেন তুই নিষ্পাপ বাচ্চাটিকে খুন করলি ?’ 

পুলিশ এই প্রশ্নের জবাবে বাদশা বলেছিল যে সে দশ বছর পর জেল থেকে বেরিয়ে আসার পর গ্রামের সবাই বলে, ‘বাচ্চাটা দেখতে একদম তোর মত হয়েছে! তার মা ও একদিন বললেন, ‘ওই বাচ্চাটিকে দেখলে মনে হয় আমার ছোট্ট বাদশা !প্রচণ্ড রাগ উঠেছিল তার। সে সহ্য করতে পারছিল না এত অপমান, এত শাস্তি। সব ওই বাচ্চাটির জন্য। ওই বাচ্চাটিকে বড় হতে দিলে আরও কত কী খারাপ দিন হয়তো তাকে দেখতে হবে। তাই তার মাথায় কু-চিন্তা আসে কীভাবে ওই কালো ছায়া থেকে মুক্তি পেতে পারে। নকল চুল দাড়ি লাগিয়ে আইসক্রিমওয়ালা সেজে গ্রামের কিছু বাচ্চাদের বিনামূল্যে দামি দামি আইসক্রিম খাওয়াতে শুরু করে। তাই তারা তার পিছনে ঘুরতে থাকে। তার আইসক্রিমের বিজ্ঞাপন হয়ে যায় এভাবেই। একটি আইসক্রিমে বিষ মিশিয়ে রেখে দেয় আলাদা করে আর নিয়মিত ঘুরতে থাকে নায়লাদের বাড়ির সামনে। একদিন ধরা দিয়ে দিল তার শিকার মারুফ ! 

কোনো অনুশোচনার লেশ মাত্র নেই যেন তার চোখে মুখে! উচ্চতম আদালত তার ফাঁসির আদেশ বহাল রাখছিল। মুক্তির জন্য আবেদন করেছিল রাষ্ট্রপতির কাছে। আজ রাষ্ট্রপতিও তার আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন। তার বাঁচার আর কোনো উপায় নেই। নায়লা আবার ও বিজয়ী হয়েছে । 

নায়লার সম্বিৎ ফিরল পিছন থেকে কাঁধের উপর একটি স্নেহ ভরা হাতের চাপে। ঘুরে দেখল জ্যাঠিমা। দুচোখের জল মুছে দিলেন জ্যাঠিমা। হাতটা ধরে ওকে নিয়ে গিয়ে বসলেন সোফায়। পরম স্নেহে হাত বুলিয়ে দিলেন নায়লার মাথায় পিঠে  নায়লা মাথাটা এলিয়ে দিল জ্যঠিমায়ের কোলে। তিনি স্নেহ ভরা হাতে  বিলি কাটতে থাকেন ওর চুলে ।

– ‘বড়মা, বড় ক্লান্ত লাগছে।বাচ্চাটিকে শেষ পর্যন্ত বাঁচাতে পারলাম না ! চলে গেল…! 

– ‘মা রে সবই আল্লাহর ইচ্ছে। সে হয়তো এতটুকু আয়ু নিয়েই পৃথিবীতে এসেছিল। হারিয়ে ফেলেছিস! এটা ভাবিস না। তাকে বেহেস্তে নিশ্চয়ই পাবে। তুই তো তার প্রতি সুবিচার করতে কম করিস নি। অপরাধী দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও পাচ্ছে। খুনির মৃত্যু-দণ্ডাদেশ জারি হয়েছে। তোকে একটা কথা বলার ছিল রে মা।

-‘বল বড়মা, বল! তোমার  কথাগুলো শুনে ভালো লাগছে। তোমার কোলে মাথা রেখে খুব শান্তি পাচ্ছি ।

– ‘বললি যে,বড় ক্লান্ত লাগছে তোর। মানুষ মাত্রই ক্লান্তি অনুভব করে মাঝে মাঝে – তা সে যতই শক্তিশালী হউক না কেন। আর নারী তো নারীই। সে যতই শক্তিশালী হউক, স্বাবলম্বী হউক, ইতিবাচক হউক না কেন! তার চাই ভালোবাসা, যত্ন, সহানুভূতি ও উৎসাহ – উদ্দীপনা। আজ আমার কোলে মাথা রেখে শান্তি পাচ্ছিস। আমরা ও তোকে পেয়ে নিঃসন্তান হওয়ার জ্বালা ভুলেছি। কিন্তু আমরা তো বুড়ো হয়ে গেছি আর কদিন বাঁচব? একজন নারীর জন্য একজন সৎ পুরুষের দরকার, যে তার সুখে- দুঃখে পাশে থাকবে, যার কাঁধে নারী তার ক্লান্ত-অবসন্ন মাথা এলিয়ে দিয়ে একটু শান্তি পাবে ।

– ‘কী সব আজেবাজে বকছেন বড়মা !

– ‘চুপ থাক্ একটু। আজ আমি বলব,তুই শুনবি। সবসময় তো তুই বলিস আমরা শুনি। ওই আহমদ উকিল সাহেব তোর জন্য কী না করলেন! বারো বছর আগে যে ন্যায় পেয়েছিলে, সব তাঁর জন্যই সম্ভব হয়েছিল। আজ যে ন্যায় বিচার পেলে তাও তাঁর ছেলে সুপ্রিম কোর্টের উকিল আবিদের জন্য।ব রাবরই তাঁরা তোর পাশে ছিল, আছে আর থাকবেও। আবিদ আর তুই তো একসাথে একই কলেজ থেকে আইন পাশ করেছিস। ছেলেটির মধ্যে কোনো দোষ দেখেছিস কি? দেখে থাকলে বল !

– ‘না ! দেখিনি !

– “বেচারা তোকে বলার সাহস পায় না যে তোকে ভালোবাসে! তোর আত্মসম্মানবোধ ও আত্মবিশ্বাস র খুব পছন্দ। সে নিজে আমাকে বলেছে। সে কিংবা তার পরিবারের সবাই তোর সম্পর্কে সবকিছুই জানে। তারপরও তাদের ঘরের বউ করতে চায়। তুই নিশ্চয়ই বুঝতে পারিস। আজ সকালেও আহমেদ সাহেব ফোন করে বলেছেন, -‘এখন তো বাচ্চাটিও চলে গেছে। আগে না হয় তার জন্য নায়লা রাজি হত না। এখনও আমাদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেবে নাকি !বাকিটুকু তুই বল! পাঁচ বছর ধরে তাঁরা বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছে এখন আমরা তাঁদের কী জবাব দেব? আজ তোকেহ্যাঁকিংবা নাবলতেই হবে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আজ তাঁদের একটা কিছু জানাব। তুই বলে দে,কী বলব তাদের?”

হ্যাঁবলে দাও বড়মা ! নায়লার ছোট্ট জবাব ।

       

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত