ব্রহ্মপুত্র ও বরাকের গল্প: প্রত্যাহ্বান । মেঘদূত সেন
গত ২১ জুলাই ছিলো গল্পকার মেঘদূত সেনের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার গল্পকার মেঘদূত সেনকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।
প্রণব পাল গম্ভীর গলায় ইনক্লুসিভ এডুকেশন নিয়ে বিস্তর আলোচনা করে চলছেন।ক্লাসে শতাধিক পড়ুয়া।খুব স্বাভাবিকভাবেই শেষের দু‘তিন বেঞ্চ আগে বসা পলাশকে দেখা স্যারের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়।তবুও কেন জানি ভয়। স্যার যদি দেখে ফেলেন কিছু জিগ্যেস করেন তখন কী হবে? ক্লাস শেষ হলেই নিজের কোঠায় পালিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় পলাশ। কমার্স-আর্টস পড়ুয়াদের ইডুকেশন ক্লাস একসাথে হয়। প্রাইভেট কলেজ।নিয়ম মানা বাধ্যতামূলক।অনিচ্ছা সত্ত্বেও কমার্সের পড়ুয়াদের সাথে পলাশরা বসে।আর্টসের পড়ুয়াদের জন্য বরাদ্দ থাকে পেছন সারির দুতিন বেঞ্চ। এমনিতেই আর্টসের ছাত্র বলে স্যার খুব একটা পাত্তা দেন না। আর এদিকে পেছনের বেঞ্চিতে বসা বন্ধুরা বারবার শার্টে দাগ দেয় কখনো গুঁজে রাখা শার্ট টেনে বের করে দেয়। মুখ লুকিয়ে চলে হাসাহাসি। রীতিমত অত্যাচার ।মুখে বলার সাহস পায় না। ইচ্ছে হয় মারবে। যেমন মেরেছিল বছর দুই আগে ক্লাস নাইনে সুজনকে একই অপরাধে ।
‘ওই কালিয়া বাট্টিমোল্লা… দেখ তোর পিঠও সাপ উঠছে।‘
‘কিতা রে ওতো মন দিয়া কুন পুড়িরে দেখরে..‘
‘কইতাম নি গিয়া টিনা রে। তাইরে তুই ভালা পাস…‘
রোজকার একই কাহিনি। নিজের ব্যাচমেটরাই পলাশকে নিয়ে মজা করে। ডাক নাম দেয় কয়লা। ইচ্ছে হয় প্রতিবাদ করবে। সাহস পায় না। চারিদিকে অপরিচিত মুখ।গ্রামের পরিবেশ এমন ছিল না। কালো ও খাটো হওয়ায় স্যাররা মাঝে মাঝে হাসি ঠাট্টা করলেও গায়ে মাখত না। কিন্তু শহরে বড়ো একা লাগে। বাবা লোন নিয়ে প্রাইভেট কলেজে ভর্তি করিয়েছেন। বোনের বিয়ের জন্যেও টাকা রাখতে হবে। চিন্তার জগৎ বিস্তৃত।শেষ কোথায় জানে না সে। প্রতি সপ্তাহে বাবার দেওয়া দেড়শ টাকা কীভাবে বাঁচিয়ে খরচ করবে এই চিন্তায় বয়সের ছাপ পেরিয়ে এগিয়ে গেছে কয়েক কদম। এক পোয়া মাছে যাতে ছয় বেলা খাওয়া যায় সেই হিসেবে মাছ কুটে আনে। ডালের সাথে ভাজা চাই।কেরোসিন তেল দুটোই বেশি লাগে। তাই ডাল খায় না । অভ্যস্ত হয় ধীরে ধীরে ।
শহুরে যাপন একেবারেই ভিন্ন।গোলাপি রঙের শার্টেও তফাৎ ধরা দেয়। অবিরল ইংরেজিতে আলোচনা চলে। দশম শ্রেণিতে নিজেও বেশ ভালো ছিল পলাশ। রঞ্জন স্যার বলতেন ‘তুমি ইংলিশে ভালা রে বা বড়ো অইয়া ইংলিশ লইয়া পড়িও…‘ শহরে এসে সব যেন উড়ে গেছে। কলেজে ঠাসা রুটিন। একের পর এক ক্লাস চলে অবিরত । এদিকে শার্টে দাগ দেওয়া,বইয়ের পাতা ওল্টাতে পলাশের মাথায় হাত দিয়ে আঙুলের ডগায় তেল মাখানো এমন কাণ্ডকারখানা চলতেই থাকে। মা বলতেন চুলে তেল দিতে হয় রোজ। কিন্তু কলেজে তার মাথায় তেল দেওয়া নিয়েও হাসাহাসি চলে। প্রিন্সিপাল স্যার বলে রেখেছেন ‘রেগিং মোটেও চলবে না…‘
পলাশ সাহস পায় না তাকে গিয়ে বলার। স্যারের তরতরিয়ে বলা ইংরেজির সামনে নিজের কথা কীভাবে উপস্থাপন করবে। পলাশ একা না। তার মতো আরো দুচার জন আছে যাদের সাথে এমন ব্যবহার হয়। সবাই তার মতো গুটিয়ে থাকেন। তারাও এ কলেজের, কিন্তু এ কলেজ যেন তাদের না। ক্লাসের স্যার ম্যাডামরা এসব কাণ্ড দেখেও যেন অদেখা করেন। শরীরের রঙ ও উচ্চতা নিয়ে বড্ডো রাগ হয় তার। আরেকটু ফর্সা ও লম্বা করে দিলে ঠাকুরের কী যে হতো… গ্রাম থেকে শহর; পড়াশুনার সাথে বেশ কিছু স্বপ্ন লালিত করেছিল সে। ভালো রেজাল্ট করবে মা-বাবার মুখে হাসি ফোটাবে ।বোনের বিয়ের আগে চাকরি জুটাবে। সব কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে যায় ।
মাসে দেড় মাসে বাড়ি ফিরলে শহরের গল্প করবে রতন, রাজেশ, নির্মলদের সাথে।বাড়ি ফেরা ঠিকই হয় কিন্তু গল্প বলা হয় দায়। সাজিয়ে গুছিয়ে মিথ্যে ছাড়া বলার কিছু নেই। নিজের গল্প বলতে পারে না।
বই পড়ার তার শখ ভীষণ। গল্পের বই।শরৎ, রবীন্দ্র, শঙ্কর আরো কতো লেখকের নাম,বইয়ের নাম স্কুলের গোপাল স্যারের কাছ থেকে নিয়ে এসেছিল। কলেজে এসে লাইব্রেরিতে দেখে বিশাল বিশাল হাতে গোনা ইংরাজি বই ছাড়া আর কিছুই নেই। স্যারকে জিগ্যেস করেছিল বাংলা বই আছে কি। স্যার বলেছেন আর্টসের ছাত্র এতো বই পড়ে কী হবে।
ভাড়া ঘরে ছোটো বিছানা ও টেবিল রাখার পর জায়গা খুব একটা নেই। ছোটো স্টোবে রান্না করে বিছানার পাশেই খেতে হয়। বাবা বলেছিলেন চেয়ার কিনে দেবেন।পলাশ নিজেই না করে। এই ঘরে চেয়ার রেখে দিলে বসে খাবার জায়গাও থাকবে না। বাঁশের বেড়ার ঘরে দৈনিক পত্রিকার কাগজ লাগানো। কিছু জায়গা ছিঁড়ে গেছে।ওই ফাঁক দিয়ে পাশের বাড়ির দালানের কাজ একটু একটু দেখা যায়। পড়ন্ত বেলার রোদ মাঝে মাঝে অতিথি হয়ে এই ফাঁক দিয়ে আসে। চলেও যায় খুব তাড়াতাড়ি। সকালে হয় কাকের ডাকে ।
ঘর মালিকের ছেলে তার স্কুলেই পড়ে এক ক্লাস আগে। ভাড়াটে সহ সবাইকে বন্ধুদের দেওয়া তার নাম কয়লা জানিয়ে দেয়। সন্ধ্যার লোডশেডিঙে ঘর মালিক উঠোনে বসে পলাশের কলেজের কথা ছেলের মুখে শোনেন। হাসেন প্রাণ খোলে।পলাশকে ডেকে আনেন। রাগ হয় তার। কিন্তু অন্ধকারে রাগ কারো চোখে পড়ে না। মিলিয়ে যায় অন্ধকারেই। দিনে দিনে গা সওয়া হয় সব। স্টোব নেভানোর অদ্ভুত গন্ধ ছাড়া এই শহরে পলাশের ভালো লাগার মতো কিছু খুঁজে পায় না। তবে মাঝে মাঝে শ্রীকর্ণারের মোড়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে মোমো বিক্রি করা পাপলুর দোকানে যায়। দুজনেই প্রায় সমবয়সী। পাপলুর বাবা হঠাৎ মারা যাওয়ায় শ্রীকর্ণারের মোড়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে মোমো বিক্রি করে পরিবার চালায়। মাঝে মাঝে মোমো থেকে গেলে পলাশের ফোন আসে। সেই রাতে মোমো খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ে।
গুঁজে রাখা শার্ট টেনে বের করা থেকে কয়লা নাম; সবটাই মানিয়ে নেয় হয়ে পলাশ। ইনক্লুসিভ এক্সক্লুসিভ শিক্ষার সাথে শহুরে বাতাসের তীব্রতায় মিশে যায় মান অভিমানের পালা।গড়িয়ে চলা সময়ে রাগ ক্ষোভের পরত ভুলতে শুরু করে। স্যার ম্যাডামদের তাচ্ছিল্যের সাথে ভালোবাসাও খুঁজে পায়। কেটে যায় দুবছর।উচ্চতর মাধ্যমিক চূড়ান্ত বর্ষের পরীক্ষা। পলাশের রান্না থেকে বিরতি মেলে।মা আসেন এই পরীক্ষার কদিন থাকবেন বলে।পাঁচ পেপারের পরীক্ষা পনেরো দিন গড়িয়ে হবে শোনে মা এক সপ্তাহ থেকে বাড়ি চলে যান। বাবা অসুস্থ, বোনও একা। উপায় ছিল না।
পলাশ জানে এই পরীক্ষা ভালোভাবে উতরে গেলেই শহরে আসা ছোটো বড়ো কষ্ট সফল হবে। চাকরি জীবনের ভীত এই উচ্চতর মাধ্যমিক। ক্লাস নাইনে নীলিমা ম্যাডাম বলেছিলেন। প্রায় তিনমাস পর ঝড় তুফানের সকালে পরীক্ষার ফল বেরোয়। পলাশ গলির সাইবার ক্যাফেতে জেনে নেয় তার রেজাল্ট।ফার্স্ট ডিভিশন উইথ ত্রি লেটার্স।ততদিনে দু চারজন বন্ধুও জুটে গেছে। সবাই ফোন করে। কলেজে আয়। কমার্সের কোনো ছাত্র রাজ্যের মেধা তালিকাভুক্ত হয়েছে।হৈ হট্টগোল। আতশ বাজি প্রদর্শন। মাইক ক্যামেরা হাতে কয়েকজন ঘোরাফেরা করছেন।গলায় লাল রঙে মিডিয়া লেখা কার্ড ঝুলছে।যে ছাত্র মেধা তালিকায় এসেছে তাকে ঘিরে তুমুল আনন্দ। পলাশের ইচ্ছে হয় সেও যাবে। কিন্তু নিজেকে আটকায়। একই কলেজের হলেও সে তাকে চিনবে না। কলেজ ক্যাম্পাসে ঢুকে একে একে স্যার ম্যাডামদের প্রণাম করে পলাশ। সব শেষে নিজের পরিচয় দিয়ে প্রিন্সিপাল স্যারের রুমে যায়। স্যারের চির পরিচিত আন্দাজ। চোখের সোনালী ফ্রেমের চশমা। কিছু লিখছেন । পায়ে মাথা ঠেকে প্রণাম করে ।
“আরে তুমি তো আর্টসের আমাদের কলেজে তৃতীয় হয়েছ । ক্যনগ্রেজুলেশনস । ‘
পাশে প্রণব স্যার দাঁড়িয়ে। তিনি নিজেই বলছেন, ‘স্যার আমরা ওকে খুব ভালো গাইড দিয়েছি ।আলাদা করে ক্লাসে ওর খোঁজ রাখতাম। আপনি জানেন না ওকে তো বন্ধুরা কয়লা বলে ডাকে…‘
হেসেই চলেছেন প্রণব পাল। প্রিন্সিপালের মুখ দেখে কোনো উত্তেজনা বোঝা যায় না। মুখ তুলে তাকায় পলাশ। স্যারের ঠোঁটে এখনো হাসি লেগে আছে।এক দলা থু থু প্রিন্সিপালের টাইলস বিছানো মেজেতে ফেলে সে। কেঁপে ওঠেন প্রণব পাল ।
দু’ তিন ফোঁটা হয়তো তার পায়ে গিয়েও পড়ে। অপ্রত্যাশিত। চোখ মুখ বিশ্বাস করতে পারছে না। যে ছেলে দুই বছর মুখ লুকিয়ে কাটিয়েছে তার এমন ব্যবহার।
নিস্তব্ধ নীরবতা। বাইরের আতশ বাজির শব্দ যেন মুহূর্তে হারিয়ে গেছে। বহু বছরের জমে থাকা রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা, এক নিমিষে ঝেড়ে ফেলে পলাশ। দলা পাকানো থু থু পড়ে আছে টাইলসে ।
হাসি উড়ে যায়। এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে বুঝতেই পারেন নি প্রণব পাল ।নীরবে রুম ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে পলাশ।বাইরে হাজার মানুষের ভিড়।পলাশ হেঁটে চলেছে একা।সবার মাঝে উজ্জ্বল। পেরেছে সে তীব্র প্রত্যাহ্বান জাগিয়ে তুলতে।মিশে যায় জনসমুদ্রে। প্রণব পাল তখনো দাঁড়িয়ে আছেন একা।
