| 20 এপ্রিল 2024
Categories
ব্রহ্মপুত্র ও বরাকের গল্প

ব্রহ্মপুত্র ও বরাকের গল্প: পরিক্রমণ । পরিতোষ তালুকদার 

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

পরিক্রমণ

ফাল্গুনি পূর্ণিমার রাত। মঘা নক্ষত্র, সুকর্মাযোগ শেষ রাত্রি। চারিদিকে জ্যোৎস্নায় ভাসছে। বাড়ির পাশেই বাঁকা নদী। তারপর মস্ত বড়ো একটা লাল মাটির রাস্তা। আমাদের পরিবারের সকলেই রাস্তায় হাঁটছে। কবে থেকে হাঁটছে, কে কে হাঁটছে তাও জানি না। আমিও দৌড় শুরু করলাম। কারণ ওদের ধরতে হবে। রাস্তা বড়ো মসৃণ। এবড়ো-খেবড়ো। কোথাও কাদা, কোথাও জল। তবুও আমি সন্তর্পণে রাস্তা দিয়ে ছুটছিলাম। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছি। আমার মা-বাবা, দিদিমা, বাসুমামা, দাদা-দিদিভাই সবাই রাস্তায় আছে। তবে তারা কেউ থেমে নেই। কেউ ধীরে, কেউ অল্প গতিতে সামনের দিকে ছুটে চলেছে। ওরা হাঁটছিল তবে একসঙ্গে নয়, ছাড়াছাড়া। কেউ আগে, কেউ পিছনে। আমার দেরি হয়ে গেছে। আমি ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে ওদেরকে ধরে ফেললাম। রাস্তাটা কম নয়। আমি হাঁপাচ্ছিলাম। মায়ের হাসি-মুখ।বললেন, এসেছিস, আয়। এখন ছুটতে থাক। থামবি না।

কেন মা? থামব না কেন?

মা পরম যত্নে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, থামা মানেই থমকে যাওয়া। পিছিয়ে পড়তে হয় আর কখনও সামনে এগিয়ে যেতে পারবি না।

আমি ওদের কাছে পৌঁছতেই সবার মুখে হাসি-ফুটে উঠতে দেখলাম। মা ধান-দূর্বা মাথায় ঠেকিয়ে আশীর্বাদ করলেন।

বাবা বললেন, বেঁচে থাক। দিদিমা আদর করে চুমু খেল।

বাবা বললেন, সিংহ রাশি ক্ষত্রিয়বর্ণ রাক্ষসগণ অষ্টোত্তরি মঙ্গলের ও বিংশোত্তরি কেতুর দশা।

মা বললেন, যা হয়েছে হোক। আমি তাতেই খুশি।

আমি অবাক হয়ে ছুটতে থাকলাম।ছুটতে ছুটতে এক সময় মনে হয় আমি সবাইকে পিছনে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছি।কিছু সময় পর মনে হল আমার সামনে কেউ আগে আগে আগে ছুটে চলেছে।পিছন ফিরে তাকালাম।সবার মুখেই হাসি।আকাশের জ্যোৎস্না যেন ঝরে পড়েছে মুখগুলোতে।মাকে বললাম আমার সামনে কে ও?মা বললেন,ও তোমার ভাই।ওকে আগলে রেখ।মা ছোটো ভাইয়ের মাথায় ধান-দূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করলেন।দিদিমা উলু দিলেন।বাবা বললেন,বেঁচে থাক।দাদা-দিদা ভাইকে মাথায় হাত দিয়ে আদর করল।

বাবা বললেন,কালরাত্রি।

ভাই ছোটো।তিড়িং-বিড়িং লাফাতে লাফাতে ছুটে চলেছে।আমার থেকে ওর গতি বেশি।

রাস্তা আর শেষ হয় না।আমি প্রশ্ন করি কোথায় চলেছি আমরা?

বাবা বললেন, সামনে শ্রীধাম, শ্রী গোবিন্দজিউর মন্দির।

মা বললেন, থামবি না, এগিয়ে চল।

আমি প্রশ্ন করলাম, মা আমরা কেন হাঁটছি? কোথায় যাব?

মা বললেন, হাঁটাই আমাদের উদ্দেশ্য। এগিয়ে চলার নামই জীবন। যত এগুবে ততই সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে।

মা আমাদের বাড়ি নেই?

এটাই আমাদের বাড়ি। পৃথিবীর উপরিভাগ।

আমাদের দেশ কোথায়?

পূর্ব পাকিস্তান।

আমরা কোথায় চলেছি?

জীবনের পথে।

বাড়ি ফিরে চল।

না বাবা, অমন কথা বলতে নেই। এগিয়ে চল। এখনও অনেক পথ বাকি।

আমার পিছনে দাদা-দিদি।ঠিক তার পিছনে মা-বাবা।তারও পিছনে বাসুমামা। হঠাৎ খেয়াল হল দিদিমা কোথায় গেল?

পিছন দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম,দিদিমা কোথায় গেল?

একটু চুপ করে থেকে মা বললেন, পিছনে ভীষণ অন্ধকার। কিছু দেখতে পাচ্ছি না।

দিদিমাকে ছুটতে বল, তাড়াতাড়ি আসতে বল।

মায়ের গম্ভীর মুখে হাসির মৃদু স্ফুরণ। বললেন, এই বয়সে জীবনের গতি কমে আসে। এখন তো ছুটতে পারবে না। আস্তে আস্তে হেঁটে আসবে। যতদূর পারে।

দিদিমার শবদেহ সাদা কাপড়ে ঢাকা। মুখে সাদা চন্দনের ফুলস্টপ। শরীরে সাপের মতো পেঁচানো রজনীগন্ধার মালা।

কয়েকটা ধুপ নিঃশব্দে পুড়ছে। আশপাশে মানুষের ভিড়। কারা যেন বলল, এবার নিয়ে যাক। মরা বাসি হচ্ছে।

বাবা বললেন, দিদিমা অন্ধকারে হারিয়ে গেছে। আর আসবে না। তুমি থেমো না, সামনে এগিয়ে চল। এখনও অনেক পথ বাকি।

বাবা বললেন, যাত্রা শুভ পূর্বে।মধ্যম অগ্নিকোণে ও ঈশানে নিষেধ।

আমি, ভাই, দাদা-দিদিভাই গান গাইতে গাইতে চলেছি। জীবনের জয়গান। আমাদের মুখে হাসি। ভাই হুটোপুটি করছে। আমার পায়ে ঘোড়ার জিন লাগান আছে। পিছনে মা-বাবা ও বাসুমামা। ওদের মুখ বিষণ্ণ। ভাবলাম এতটা পথ পার হয়ে এসেছেন। ক্লান্ত শরীর। আকাশে চাঁদ ভাসছে। পাশেই একটা মন্দির। সেখানে গাঢ়। জ্যোৎস্নার আলো অন্ধকারকে বিনির্মাণ করে চিনিয়ে দিচ্ছে ওটা মন্দির।

দাদা প্রশ্ন করল, মা আমাদের দেশ কী পূর্ব পাকিস্তান?

মা বললেন,হ্যাঁ।

কতদূর?

অনেক দূর।

আমরা কেন চলে এলাম?

সে অনেক কথা।দেশ ভাগ হল। ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হল পূর্ব পাকিস্তান।অমানুষিক অত্যাচার নেমে এল বাঙালির জীবনে।অথচ স্বাধীনতা যুদ্ধে বাঙালিদের অবদান ছিল সব থেকে বেশি। দেশ ভাগের বলি হল তারা। সব থেকে বেশি অত্যাচারিত, নির্যাতিত, অবহেলিত জাতি। আর কোনো ভাষাভাষীকে এই তীব্র যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়নি। দেশ ভাগ ছিল আমাদের জীবনে অভিশাপ।

দাদা হাঁটতে হাঁটতে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। এক ঝলক আগুন ছিটকে এল নাকের দুটো ফুটো দিয়ে। যেন দু-নলা বন্দুক। আগুনের পিণ্ডটা দুলতে দুলতে মাথার ওপরের আকাশটাতেও আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। ফেলে আসা পূর্ব পাকিস্তানের ছবি, তার ইতিহাস মা-বাবা-বাসুমামার হৃদয় খুঁড়ে রক্তনদী বইয়ে দিয়েছে। দাদার বুকের মাঝখান থেকে ওঠা এক টুকরো আগুন যেন সেই রক্তের রঙকে চিনিয়ে দিল। টকটকে লাল নয়, কেমন যেন কালচে বর্ণের বাসি রক্ত। মাথার ওপরে থাকা আকাশের বুকে ভেসে বেড়ান মেয়েদের মতো। দাদা নিঃশব্দে পথ হেঁটে চলে।

হঠাৎ দেখি বাসুমামা নেই। পিছনে ঘাড় ঘুরিয়ে বললাম, মামা কোথায়, তাকে তো দেখতে পাচ্ছি না।

বাবা বললেন, পিছনে ভীষণ অন্ধকার। কিছু দেখা যাচ্ছে না। তুমি সামনে তাকাও। এগিয়ে চল।

রাস্তার দু-পাশে মাঝেমধ্যেই নজরে পড়ল আগুন জ্বলছে। আগুনের কুণ্ডলী দেখতে পাচ্ছি আবার মুহূর্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। মাকে জিজ্ঞেস করলাম, মা আগুন জ্বলছে কেন? ওগুলো কীসের আগুন?

মা বললেন, ওগুলো চিতা জ্বলছে।

কেন?

আত্মার শুদ্ধিকরণ হচ্ছে। তুমি এগিয়ে চল। থামবে না।

দূরে জঙ্গলের মাথায় পূর্ণিমার হলুদ আলো দাউ দাউ করে জ্বলছে। মনে হচ্ছে বনে আগুন ধরে গেছে। মাকে বললাম, মা জঙ্গলে আগুন কেন?

মা বললেন, ও আগুন নয়, আলোর ঝরনা।

দাদা-দিদিভাই গল্প করতে করতে পথ হাঁটছে। আমিও চলেছি অনাগত ভবিষ্যতের দিকে। আমার সামনে ভাই তিড়িং-বিড়িং করে লাফাতে লাফাতে চলেছে। হঠাৎ শনশন বাতাস।ঝোড়ো হাওয়া। সঙ্গে বিদ্যুতের চমক। গুমগুম শব্দ।ঝমঝম করে বৃষ্টি আরম্ভ হল। হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, মা জল পড়ছে। হাওয়া দিচ্ছে।

কিচ্ছু হবে না।

আমার ভয় করছে।

ভয় পেলে চলবে না। সব সহ্য করতে হবে। এ-ভাবেই পথ হেঁটে যেতে হবে।

জলে আমার শরীর ভিজে গেল যে।

আচ্ছা, আমি তোমার মাথা আঁচল দিয়ে ঢেকে দিচ্ছি।

আমি আকাশের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকলাম। পত পত করে উড়ছে মায়ের আঁচল। বাতাসের তীব্র গতি।আশ্চর্য। আমি ভাই, দাদা- দিদিভাই কেউ আর বৃষ্টিতে ভিজছি না। এখন আর কোনো কষ্ট নেই।

চাঁদের আলো মেখে বৃষ্টিরা ঝরে পড়েছে। রূপোলি বৃষ্টির সোহাগে আশপাশের গাছ-গাছালিতে আলোড়ন। দু-চারটে পাখিও ডেকে উঠছে। গ্রামের পর গ্রাম পার হয়ে চলেছি। ভাই গান গাইতে গাইতে চলেছে।আমি দাদা-দিদিভাই গল্প করতে করতে চলেছি। পিছনে মা-বাবা। তারা নির্বাক। ধীরে ধীরে পথ হাঁটছে। হঠাৎ পাথরে হোঁচট লেগে ভাই ছিটকে পড়ল। তার গলা থেকে যন্ত্রণামাখা শব্দ ছিটকে এল। পিছনে মাও যেন আর্তনাদ করে উঠল। আমরা তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে এগিয়ে চললাম। ভাই নিথর-নিস্তব্ধ হয়ে শুয়ে আছে। পিছন ফিরে বললাম, মা ভাই থেমে গেছে আর চলছে না।

বাবা বললেন, তুমি সামনে এগিয়ে চল। এখনও অনেক পথ বাকি।

আমি চলতে শুরু করলাম। পিছনে দাদা-দিদিভাই। আমার মনে হল মা ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। কান্নাটা ভারি অদ্ভুত। মনে হচ্ছে দূরে বিস্তীর্ণ মাঠের মধ্যে গাছের নিচে বসে কেউ বেহালার ছর টেনে চলেছে।বড়ো করুণ সে সুর। সে সুরে মায়া আছে। সহজেই চোখ জলময় হয়ে ওঠে।

দাদা বলল,হাজার হাজার মানুষের জনস্রোত।এক দেশ থেকে আর এক দেশে যাত্রা।মাঝে খাল-বিল-নদী। কত মানুষের মৃত্যু হল। কেউ কেউ পঙ্গু, আবার কেউ বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেল সব হারানোর শোকে। বাবা আমাকে বলেছিল সব হারানোর ঘাটে। আমি পূর্ব পাকিস্তান দেখিনি। কেবল নীল আকাশে রামধনুর রঙ দিয়ে ছবি এঁকেছি আকাশ জুড়ে। হঠাৎ দেখি কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে গেল। দগদগে ক্ষত নিয়ে কথা-বলা ছবিগুলো বীভৎস কালো থাবার আক্রমণে আর্তনাদ করে মিলিয়ে গেল। কোথাও যেন বাজ পড়ল। মাটিতে সোঁদা গন্ধ।

মা-বাবা কী একটু বেশি পিছিয়ে পড়েছে। ওদের চলার গতি যেন ধীরে ধীরে কমে আসছে। দিদিভাইকে বললাম। ও আমাকে বলল, রাস্তার ক্লান্তি। ধুলো-ঝড়, বৃষ্টি। শোক-তাপ চৈত্রের পাতাঝরা। এখন তো স্তিমিত হবেই।

আমার সামনে কেউ নেই। যারা আছে সব পিছনে। হঠাৎ দেখি একটা মেয়ে শাড়ি পড়ে ছুটতে ছুটতে উত্তরের রাস্তা থেকে আমাদের রাস্তায় উঠে এল। তারপর ঠিক আমার পিছনে দাদার পাশে গিয়ে হাঁটতে থাকল। আমি তো অবাক। এ-আবার কে! জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কে?

সে বলল, আমি স্বাতী।

তুমি এখানে কেন? এ-রাস্তা তো তোমার নয়। এটা তো আমাদের রাস্তা।

হ্যাঁ ঠিক তাই। আমি উত্তরের। ঐ দেখ চাঁদ। চাঁদের জমিতে তোমাদের ছায়া দেখে আমি রাস্তা বদল করেছি।

কী দরকার ছিল বদলের?

ফাল্গুনি পূর্ণিমার চাঁদ বলে দিল রাস্তা বদলের ডাক এসেছে। চাঁদের গায়ে তোমাদের ছায়া দেখে এলাম।

তুমি ভুল করে এ পথে ঢুকে পড়েছ।

নাহ্,তা নয়। দেখ তোমার দাদার চলার ছন্দে আমার পা মেলানো-কেমন মিলে গেছে?

সত্যি অবাক কাণ্ড! দাদা ডান পা বাড়ালে ওই মেয়েটাও ডান পা ফেলছে। বাম পা দিলে তাই। ভয়ে দিদিভাই তার জায়গা করে নিল। সে ঠিক আমার পিছনে চলে এল। মা বললেন, কী হয়েছে, এত হইচই কেন?

মাকে ইশারা করে বুঝিয়ে দিলাম পূর্ণিমার চাঁদে ছায়া পড়েছে।

মা বললেন, ও-সব কিছু নয়। আকাশ পথে মেয়েদের ছোটাছুটি। স্বাতীকে দেখে মাথায় ধান-দূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করে বললেন, বেঁচে থাক মা। আয়ুষ্মতী ভব:। পুত্রবতী ভব:।

বাবা বললেন, সুস্থ থাক। এগিয়ে চল।

দিদিভাই একটু মনমরা। সে এখন নিশ্চুপ হয়ে গেছে। মাথার ওপরে চাঁদটাও বিষণ্ণ। কথা বলছে না।

আবার হাওয়া উঠেছে। মন ভালো করা বাতাস। বৃষ্টি নেই। তবে ঠাণ্ডা আমেজ। দিদিভাই হঠাৎ গান ধরল, “আজি দখিন দুয়ার খোলা…”।

আমরা সবাই শ্রোতা। চুপ করে শুনছি। দিদিভাই ভাবে  বিভোর। দাদা বউদিতে ফিসফিস করে বলল, প্রেম জেগেছে।

মা বললেন, তোর ঠাকুরদার মুখে গল্প শুনেছিলাম দেশভাগের পর তারাও পূর্ব পাকিস্তান থেকে মাইলের পর মাইল হেঁটে ছিল। মনের মধ্যে আতঙ্ক এই বুঝি ধরে ফেলল। কচু-কাটা করে দিল। চলার কোনো নির্দিষ্ট পথ ছিল না। বন-জঙ্গল, আলপথ, জলা-জমি,নদী। সে এক ভয়ঙ্কর পথ হাঁটা। হাজার হাজার মানুষের পথ চলা। খাবার নেই,জল নেই, ক্লান্তিহীন ভাবে ছুটে চলা। থমকে যাওয়া মানেই মৃত্যু।

আমি শুনতে শুনতে চলেছি। হঠাৎ দেখি আমার পিছন থেকে দিদিভাই উবে গেল। হাঁটতে হাঁটতে সসে একটা অন্য রাস্তা ধরল। আমি চেঁচিয়ে বললাম, মা দিদিভাই বিপথে চলে গেল। ধর। ওকে আটকাও।

মা নিরুত্তর। পীড়াপীড়ি করাতে বলল, ও বাঁশীর ডাক শুনতে পেয়েছে। ওকে যেতে দেওয়াই ভালো। মা আরও বললেন, চারিদিকে ভয়ানক অবস্থা। মেয়েদের মান-ইজ্জত আর রক্ষা হচ্ছে না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ-ব্যবস্থার যাঁতার নিচে ওষ্ঠাগত ওষ্ঠাগত প্রাণ। ওকে ওর অভিভাবকের কাছে যেতে দিলাম। নিরাপদ থাকবে।

আমি খানিক তাকিয়ে থাকলাম দিদিভাই এর চলে যাওয়ার পথের দিকে। কিন্তু পথটা যে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল বুঝলাম না। এখন বউদি আমার পিছনে পিছনে হেঁটে চলেছে। রাস্তাটা খানাখন্দে ভরা। খুব কষ্ট হচ্ছে। চেঁচিয়ে মাকে বললাম, মা তুমি সাবধানে পা ফেলে এসো। পড়ে যাবার ভয় আছে। বাবার হাত ধরে হাঁটতে থাক।

মা খানিক সময় নিরুত্তর থাকার পর বললেন, এর থেকেও খারাপ রাস্তা দিয়ে ডাউকি হয়ে তোর দাদু-ঠাকুমারা যখন মেঘালয়ে এসে ঢুকল তখন তারা কপর্দক শূন্য। হাতে একটা টাকাও নেই। সরকারি লঙ্গরখানায় লাইন দিয়ে খিচুরির অপেক্ষায় থাকতে হত। বেলা পড়ে আসলে অনেক হাতাহাতি-মারামারির পর সামান্য খিচুরি জুটত। তাও একবেলা। পচা চালের খিচুরি খেয়ে কলেরা আরম্ভ হল। অথচ কোনো ওষুধ নেই।ধীরে ধীরে মহামারি। মানুষ প্রাণ ভয়ে পালাতে লাগল ক্যাম্প ছেড়ে। কোথায় যাবে, কী খাবে, কী করবে দিশেহারা। তারপর যেখানেই যায় সেখানেই ভূমিপুত্রদের অত্যাচার। তারা কাউকে থাকতে দেবে না। এ-দেশ তাদের একার। তারাই ভোগ করবে। বাইরের কাউকে ঢুকতে দেবে না।

আমি হঠাৎ চেঁচিয়ে বললাম, মা বাবা নেই। বাবা কোথায় গেল?

মা মুহূর্তের জন্য হকচকিয়ে পিছনে তাকাল। তারপর শ্বাস বন্ধ করে কী যেন বলতে চেষ্টা করতে লাগল। মায়ের মুখ দিয়ে কোন শব্দ ছিটকে এল না। কেবল তার মাথাটা পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকল। মনে হল এক টুকরো ঘূর্ণির দাপটে মাথাটা এমন ভাবে আন্দোলিত হয়ে চলেছে। আমি অস্থির হয়ে উঠলাম। বললাম, মা বাবাকে দেখা যাচ্ছে না কেন?

দাদা উত্তর দিল পিছনে ভয়ানক অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তুই সামনে এগিয়ে চল আমরা আসছি।

আমার বুকটা হু হু করে উঠল। কী হয়েছে ঠিক বলে বোঝাতে পারব না। তবে এ-মুহূর্তে বাবার কথা ভীষণ ভাবে মনে পড়ছে। ছোটবেলায় বাবার কাছে নামতা শিখেছি। বাংলা শিখেছি।আরও কত কী। বাবার কাছে এই পৃথিবীর সব সমস্যার সমাধান ছিল। ছিল সব প্রশ্নের উত্তরও। বাবারা অনেক কিছু জানে। দেখতে দেখতে, শুনতে শুনতে বাবাদের জ্ঞান-ভাণ্ডার সাগরের মতো বিশাল হয়ে ওঠে। সময়ে সময়ে উত্তাল হয়ে ওঠে। বাবারা জানে কখন ভাসতে হয়, কখন ডুবতে হয়। কখন পাড়ে উঠে জীবন রক্ষা করতে হয়।আমি যখন ছোট্ট ছিলাম, ছোট্ট চারাগাছ। বাবা ছিল চারপাশে গোল হয়ে ঘিরে থাকা বাঁশের বেড়া। আমার কোনো কষ্ট ছিল না। আমার কোনো দুঃখ ছিল না বাবা কি ম্যাজিক জানত?

আবার ঝড় উঠল। শনশন হাওয়া বইছে। বৃষ্টি নামবে কি? দাদাকে জিজ্ঞেস করলাম। দাদা বলল, এগিয়ে চল, বৃষ্টি নামলে ভয় নেই, আমাদের মা আছে।

অনেকটা ভয়-মুক্ত হয়ে পথ হাঁটি। মনে হল ‘হাজার বছর ধরে আমি পৃথিবীর পথ হাঁটিতেছি।’ বউদি আমার পিছনে পিছনে হেঁটে আসছে। দাদাকে কেন্দ্র করে বৃত্তের মতো তার প্রদক্ষিণ। আমি ও মা সেই বৃত্তের বাইরে দুটো বিন্দুর মতো। আমি ভালো করেই জানি মা ছুটে এসে আমার কাছে কোনদিনও পৌঁছতে পারবে না।

মাথার ওপরের আকাশে চাঁদের রূপোলি বৃষ্টি। তারারা জানালা খুলে উঁকি দিয়ে পৃথিবী দেখছে। গাছেরা এখন শান্ত।

রাস্তাগুলো মরা নদী। কেবল আমরা কজন ডিঙি নৌকার মতো আপ্রাণ বইঠা চালিয়ে গন্তব্যে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে চলেছি। স্রোতের বিরুদ্ধে সে এক অভিনব সংগ্রাম।যত কষ্টই হোক না কেন থামা চলবে না। থমকে যাওয়া মানেই স্থবিরতা। মৃত্যু।

দাদা পিছন থেকে আর্তনাদ করে উঠল, মা মা তুমি কোথায়? মা মা…।

বউদির জলদ-গম্ভীর কণ্ঠ এগিয়ে চল। পিছনে ভীষণ অন্ধকার। তাকিও না। ভয় পেতে পার।

আমি নির্বাক। কথা বলতে পারছি না। আমার কী শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে? শ্বাসকষ্ট তো হওয়া উচিত। আমি কেন জানি না ভয়েই হয়তো হবে পিছন ফিরে তাকাতে পারিনি। সে মুহূর্তে ভয় আমাকে গ্রাস করেছিল আপাদ-মস্তক। মনে হচ্ছিল পৃথিবীটা যেন দড়ি ছিঁড়ে মহাশূন্যে ছিটকে পড়ে গেল। আকাশে চাঁদটা কিন্তু ঠিক ছিল। ওর আলোও এসে পড়েছিল আমার গায়ে। আর ছিল বাতাস। ঠাণ্ডা বাতাস। যা ছিল অনুভববেদ্য। জোনাকিরা ঠিকই জ্বলছিল ঝোপঝাড় জঙ্গলের মাথায় তারাদের সঙ্গে ওদের সখ্যতা হয়েছিল নিবিড়। আমার বাকপটুতা এখন নিস্তেজ। মানুষ যখন আঘাতপ্রাপ্ত হয় তখন সে হয় নির্বাক। নির্বিকল্প সমাধির আগের পর্যায়।

হয়ত মহাশূন্যে ভেসে যাওয়ার বাসনা হয়। তখন বোধ কাজ করে না। প্রাত্যহিক জীবন থেকে চ্যুতি ঘটে। তখন কেবলই পথ চলা উদ্দেশ্যহীন ভাবে।

আমার পিছনে দাদা আর বউদি। আর কেউ নেই। দাদার বার্ধক্য তাকে শ্লথ করে তুলছে। বউদিও কিছুটা পা টেনে হাঁটছে। কিছু দূর হেঁটে যাবার পর বুঝলাম দাদা অন্ধকারের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বউদি বেহালার ছড় টেনে করুন রাগিণীতে দুঃখ প্রকাশ করছে। বউদিকে বললাম তোমার ভয় করছে নাকি? আমি কি একটু পিছিয়ে পড়ব?

না তার দরকার নেই। তুমি সামনে এগিয়ে চল। এটাই তোমার পথ।

আশপাশের সবকিছু দূরে সরে সরে যাচ্ছে। বুঝতে পারছি একটুও না থেমে আমি এগিয়ে চলেছি। পায়ের নিচের পৃথিবীর মাটি লাল। লাল ধুলোয় পা- দুটো রঙিন।

নিস্তব্ধতাকে ভেঙে কিছু বলতে চাই। কিন্তু গলা দিয়ে শব্দ আসে না। হাতদুটো কেমন চঞ্চল হয়ে উঠছে। ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। আমি পথ কেটে এগিয়ে চলেছি। পিছনে বউদি একা। মেয়ে-বউরা এ-পথে আজ আর নিরাপদ নয়। আমার ভাবনার আকাশে খণ্ড খণ্ড মেঘ। মায়ের ভবিষ্যৎ বাণী মনে পড়ে যাচ্ছে।

আমার দু’হাত ক্রমশ প্রসারিত চলার পথের দিকে। হঠাৎ করেই দু-হাত আবার পিছনে চলে আসে। পিঠে সামান্য ব্যথা অনুভব করি। হাতদুটো ক্রমাগত সামনে-পিছনে আসা যাওয়া করতে শুরু করে। একটু কি ভয় পেয়ে গেলাম। শরীরে অন্য এক অনুভূতি। দু-হাতের শিরায় শিরায় অসংখ্য পালক কিলবিল কিলবিল করছে,রোমশ হাতের মতো। শীর্ণ হাতদুটো স্ফীত হয়। পাখি ডানার মতো যত আন্দোলিত করি শরীরটা হালকা হয়ে ওঠে। তারপর মনে হয় মাটি ছেড়ে পা দুটো যেন পিছনের দিকে চলে গেছে। আমি উড়তে আরম্ভ করেছি। পায়ের নিচে থাকা পৃথিবীটা ক্রমশ মহাশূন্যের পথে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। এক অনাবিল আনন্দ,প্রশান্তি আমার চোখ-মুখে। হঠাৎ বউদির কথা মনে পড়ে যায়। মেয়ে-বউরা রাস্তায় আজ আর নিরাপদ নয়। আমার দ্রুতগতি। উড়ে চলার মধ্যে বারবার ভেসে ওঠে সীতাহরণের ছবি। ঘরে,ঘরে রাস্তায়-রাস্তায়,স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে হেঁটে চলা সীতারা আজ নিরাপদ নয়। ভাবনা আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে চলে। শত-সহস্র বছর আগের জটায়ুর মতো আমার দুটো ডানাকে প্রসারিত করে আলোমাখা আকাশে উড়তে থাকি।আমার তীক্ষ্ণ চোখ খুঁজে বেড়ায় গ্রামের সীতা, শহরের সীতা, রামের সীতা, রহিমের মাতা, ছোটো সীতা, বড়ো সীতা, অপাপবিদ্ধ সীতা, নির্বাক সীতা, বস্তির সীতা, গঞ্জের সীতাদের। অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে শয়তানের বাচ্চারা যদি ওদের ক্ষতি করে? আমার গতি আরও ক্ষিপ্র হয়ে ওঠে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত