| 10 ডিসেম্বর 2024
Categories
ব্রহ্মপুত্র ও বরাকের গল্প

ব্রহ্মপুত্র ও বরাকের গল্প: এনার্সির পর । সমর দেব

আনুমানিক পঠনকাল: 13 মিনিট

আজ সাতই আষাঢ়। আকাশ মেঘলা। সকাল থেকেই টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল। একটু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছিল। সকালে ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরিই হয়ে গেছে। ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেলেও বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করছিল না। আজ কলেজে যাব না, সেটা আগে থেকেই ঠিক করেছিলাম। মাকেও বলেছিলাম সেকথা। ফলে,মা-ও ঘুম থেকে তাড়াতাড়ি ওঠার জন্য তাড়া দেয়নি। এমনিতে রোজই একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঘুম থেকে না উঠলে মা চেঁচামেচি করে। এমন চেঁচামেচি করে যে, বাধ্যত বিছানা ছাড়তেই হয়। আজ যা হোক মায়ের উৎপাত থেকে বাঁচা গেছে। ফলে, বেশ আরামে বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছিলাম। আমাদের ক্লাসের অনেকে বলে, ওরা নাকি বিছানায় বসেই সকালের চা খায়। ওরা বলে ‘বেড টি’। তো আমাদের বাড়িতে এসব নেই। বাবাও খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠে না। তাঁর অন্তত সাতটা। তার আগে বাবাকে কোনোদিনই বিছানা ছাড়তে দেখিনি। বাবা সাতটার দিকে উঠে একবার চা খায়। শুধু চা,সঙ্গে বিস্কুট টিস্কুট খায় না। আমার অবশ্য দুটো বিস্কুট লাগে। নইলে চা খাওয়াটা জমে না। মা কিন্তু অনেক ভোরে ওঠে। ভোরে উঠেই মায়ের প্রথম কাজ ফুল তোলা। সাড়ে ছটা, সাতটার মধ্যে মা স্নান করে। একেবারে ঠাণ্ডা জলে। আমি তো ভাবতেই পারি না। মা বলে, ওর নাকি ঠাণ্ডা লাগে না। মায়ের কোনোদিন সর্দিটর্দি লাগতেও দেখিনি। সত্যিই বোধহয় মায়ের ঠাণ্ডা লাগে না। তো, স্নানের পরই মা ঠাকুর ঘরে ঢুকে যায়। কিছুক্ষণ পুজোয় ব্যস্ত থাকে। তারপর রান্নায় হাত লাগায়। বাবা নটার মধ্যে খেয়ে বেরিয়ে যায়। লালগণেশ এলাকায় আমাদের একটা মুদিখানা আছে। খুব বড় না হলেও বিক্রিবাটা ভালো। বাবাই দোকানটা চালায়। সকালে বেরিয়ে যায়। ফিরতে সেই রাত নটা অন্তত। আমি কলেজে রওয়ানা হবার পর সারা দুপুর জুড়ে মা একাই থাকে ঘরে। মায়ের হাজারো কাজ। সারাদিনই এটাসেটা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কলেজে না গেলে বা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মজে না গেলে আমি বাড়িতেই থাকি। তখন দেখি মায়ের কাজের বহর। কাজ আর শেষই হয় না। আসলে,কাজের চেয়েও মায়ের একাকীত্ব কাটানোর উপায় বোধহয় ঘর-গেরস্থালির ব্যস্ততা। আশপাশের বাড়ি থেকে কেউ কেউ হঠাৎ এসে গল্প জুড়ে দেয় মায়ের সঙ্গে। তখন কিন্তু মা দিব্যই গল্পে সোৎসাহে যোগ দেয়।তখন আর কাজের তেমন তাড়া থাকে না। কিন্তু রোজ তো মানুষ আসে না। একা থাকলে নানা কাজ জুটিয়ে নেয় মা এবং এভাবে একলা থাকার সমস্যার মোকাবিলা করে। এসব নিয়ে মায়ের সঙ্গে কোনেদিনই কথা হয়নি অবশ্য। এসবই আমার অনুমান মাত্র।

আমাদের বাড়ির পাশেই ছোটকাকার পরিবার। আমাদের সঙ্গে কার্যত কোনো সম্পর্ক নেই। তার কারণও আছে। আমার শৈশবে বাবার দোকানে কিন্তু কাকাও বসত। সে অনেক আগের কথা। মায়ের কাছে শুনেছি, কাকা মাত্র সেভেন অবধি স্কুলে গিয়েছে। বদ সঙ্গে পড়েছিল। স্কুল ফাঁকি দিয়ে বিড়ি সিগারেট টানত,বস্তির সমবয়সীদের সঙ্গে এখানে সেখানে আড্ডা মারত। তখন মা বা বাবার সঙ্গে তেমন কথাও হতো না কাকার। শুধু দরকারি কিছু কথা বলতো বাবার সঙ্গে। শুনেছি,দোকান থেকে যখন তখন টাকা সরাত। বাবা তাঁর ভাইকে অনেক বুঝিয়েছে লাভ হয়নি। এ কদিন ফ্যান্সিবাজারে মারও খেয়েছে কাকা। ছোটখাটো চুরি চামারিতেও হাত পাকিয়েছিল। গাঁজা খাওয়া শিখেছিল। তখন কাকার চোখগুলো ভাটার মতো জ্বলত।এসব কিছু কিছু মনে আছে আমার। দিনের পর দিন এসব চলছিল। তারপর একদিন বাড়িতে পুলিশ এল। কোথাও একটি চুরির কেসে কাকার নাম উঠেছিল। পুলিশ এসে কাকার জামার কলার ধরে টেনে কালো গাড়িতে তুলল মা তখন ভয়ে ঘরের কোনে লুকিয়েছিল। বাবা একজন কনস্টেবলের সঙ্গে কথা বলছিল। পুলিশের কনস্টেবল লোকটা কাকার উদ্দেশে নোংরা খিস্তি করছিল। বাবাকেও দুষছিল, ‘আপোনার ভাইটি চুর হৈ গ’ল! আপুনি একো নাজানে’! তারপর লোকটা কাকার জামার কলার আঁকড়ে বলেছিল, ‘বাল কেলা, বোল আজি, তোর কোটি ফালি দিম’! কথাগুলো খুব অশ্লীল।শুনেই কানে আঙুল দিয়েছিলাম। কাকা একটি কথাও বলছিল না। নীরবে গালাগালি, খিস্তিগুলো হজম করে বাধ্য ছেলের মতো গাড়িতে গিয়ে উঠেছিল। বাবা তখন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিল। তারপর, গাড়িটা চলে গেলে বাবা ঘরে ঢুকে বিছানায় শুয়ে পড়েছিল।

এ ঘটনার পর কোনও একদিন জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিল কাকা। কিন্তু আর বাড়িতে তার জায়গা হয়নি। এখন কোথায় যায়, কী করে বাবা-মা জানে না। আমিও জানি না। জানতেও চাই না। তবে, ছোটো থাকতে কোলেকাঁখে করেছে তো, কেমন একটা মায়া হয়।খুব খারাপ লাগে কাকাকে দেখে। আমাদের পারিবারিক জমিটার একপাশে কাকা একদিন তরজার বেড়া দিয়ে একটা ঘর তুলেছিল। বাবা কিছুই বলেনি। মাও কিছু উচ্চবাচ্য করেনি। শুধু, বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল, নিজেদের বাড়িতেই হয়তো এখন চুরি করবে!

মা চুপ করে বাবার দিকে তাকিয়ে ছিল। বাবা ফের বলেছিল, ‘আশিসটা বংশের কুলাঙ্গার। ভগবানের কাছে কামনা করি, শত্রুরও যেন এমন ভাই না জন্মায়’!

ব্যস, আর কিছুই হয়নি। বাবা-মা কেউই কাকার সঙ্গে কথা বলে না। কাকাও আমাদের বাড়িতে আসে না। তারপর একদিন বোঝা গেলো, কাকা বিয়ে করেছে। একেবারে পাশেই ঘর বলে স্বামী-স্ত্রীর কথাবার্তা কানে আসে। কখনও ঝগড়াঝাঁটিও হয়। তো, এভাবেই চলছে বছরের পর বছর ধরে। কিছুদিন আগে বোঝা গিয়েছিলো কাকাদের নাম এনার্সিতে আসেনি। কেন আসেনি জানি না। কাকা কিন্তু এখানে সেখানে খুব দৌড়োদৌড়ি করেছে। বোধহয় লাভ হয়নি। বাবা বিরক্ত হয়ে মন্তব্য করেছিল, বাবার নাম তো একান্নর এনার্সিতে আছে। সেজন্যই তো আমাদের নাম আছে। একই বাপের আরেক ছেলের নাম কেন থাকবে না?’ কিন্তু কাকা মোটেই ধৈর্য হারায়নি। সে নিজেও অবাক হয়েছে, কেন নাম উঠল না! এজন্য কাকা তার ভাগ্যকেই দোষ দেয়। একদিন রাস্তায় আমাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছিল কাকা। আমি একটু ইতস্তত করে এগিয়ে গিয়েছিলাম। কাকার ঠোঁট কাঁপছিল। তার মুখে কথা আসছিল না। আমিই বললাম, ‘কেমন আছো তুমি?’

কাকা আমার হাত দুটো চেপে ধরেছিল। তার হাত দুটো দিয়ে আমার দুহাত জড়িয়ে নিয়েছিল। হাত দুটো কাঁপছিল প্রবল উত্তেজনায়। সে অবস্থায় থেমে থেমে কাকা বলেছিল, ‘আমার আর থাকা! তুই ভালো আছিস? কোন কেলাসে পড়িস?’

আমি বলেছিলাম, ‘ভালই আছি। টুয়েলভে’।

-‘তোর মা-বাবা ভালো আছে’?

-‘হ্যাঁ’।

-‘কই গেছিলি’?

-‘কলেজে’।

– ‘আচ্ছা। ভালো কইরা পড়িস। দ্যাখচস তো আমার অবস্থা। পড়াশুনা না করলে কপালে বড় দুঃখ রে’! তার গলা যেন কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছিল। আমারও গলার কাছে একটি কী যেন দলা পাকিয়ে উঠতে শুরু করেছিল। চোখ ফেটে কান্না আসছিল। আমি অনেক কষ্টে নিজেকে ধরে রাখার চেষ্টা করছিলাম। দাঁড়িয়ে থাকা অসহ্য মনে হলে বলেছিলাম, ‘আমি যাই কাকু’।

কাকা একটু খানি চুপ করে থেকে বলেছিল, ‘আচ্ছা। ঘরে যা’।

ওই ঘটনার পর থেকে কাকার বাড়িতে একটা লালশালু পরা লোককে মাঝে মাঝেই আসতে দেখেছি। লোকটা এলে তার সঙ্গে কাকা আর কাকিমা যেন ফিসফিস করে কথা বলে। কাকার ঘরের একেবারে পাশে, আমাদের সীমানার মধ্যে একটা জামগাছ আছে। সেই জামগাছের নীচে ঘন ছায়া। ঘরে থাকলে দিনের বেলা গরম লাগলে আমি প্রায়ই সেই গাছের নীচে গিয়ে বসি একটা মোড়া নিয়ে। তখন কাকার ঘরের থেকে আমার দূরত্ব দাঁড়ায় মাত্র কয়েক ফুট। ফলে,কাকার ঘরের কথাবার্তা প্রায় স্পষ্ট কানে আসে। আমি বুঝে যাই, লোকটা কেন আসে কাকার কাছে। লোকটা কাকাকে কথা দিয়েছে, এনার্সিতে নাম তোলার ব্যবস্থা করে দেবে। সেজন্য কাকাকে কিছু খরচ করতে হবে। কাকা এমন মরিয়া হয়ে উঠেছে যে, লোকটার খরচের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়।

একদিন লোকটা এলে আমি স্রেফ কৌতূহল বশেই জামগাছের নীচে এসে দাঁড়াই। তখনই জানতে পারি এরিমধ্যে লোকটা কিছু কাজ করেছে এবং সেজন্য সে টাকা চাইছে। লোকটার কথায় কাকা বোধহয় কিছু টাকা তার হাতে তুলেও দিয়েছে। সপ্তাহ খানেক পরে আরেকদিন এলো লোকটা। কাকা তাকে রূঢ়ভাবে বলল, ‘কাম তো হইলো না। অহন কী করুম? কাম না হইলে আর টাকা দিমু না। আমি গরিব মানুষ, কাম না হইলে টাকা দিবার মানে কী? আপনে কন, কী করলে কাম হইব’।

লোকটা খানিক চুপ করে থাকল। তারপর বলতে শুরু করল, ‘কাম তো হইবই। খরচ করবার চাও না, কেমনে হইব! গরিব কইলে হইব নাকি! কাম করলে খরচ করবার লাগবই। একটা কথা কই’, বলে লোকটা গলা নামিয়ে আনে। তার কথা এত মৃদু যে, কিছুই বোঝা যায়নি। তবে,কিছু একটা গোপন ব্যাপার যে আছে তা স্পষ্ট মনে হয়েছিল।

তারপর অনেকদিন লোকটাকে আর দেখা যায়নি। এরমধ্যে একদিন বাবাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। তখন রাস্তায় কাকাকে দেখেছিলাম। আপন মনে যেন হেঁটে যাচ্ছে তার হাঁটায় একটা ঢিলেঢালা ভাব। কে জানে কখন, কোথায় গিয়েছিল। এখন শেষবেলায় ঘরে ফিরছে। স্নান খাওয়া হয়েছে কিনা কে জানে! সত্যিই তার জন্য খুব দুঃখ হয়। কিন্তু আমার কীই বা করার আছে! বড় অসহায় লাগে। কোনোভাবে কাকাকে যদি স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা যেত! মনে আছে,রাস্তায় কাকাকে উদ্দেশ্যহীন ভঙ্গিতে হেঁটে যেতে দেখে বাবা মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল। সেটা হতেই পারে, তাতে অস্বাভাবিকতা কিছু নেই। বাবা তাঁর ভাইয়ের জন্য অনেক করেছে। কিন্তু সে ভাই মাঝপথে পড়াশুনো ছেড়ে দিয়ে জীবন ধ্বংস করেছে। বাবা আর কীই বা করতে পারে। এখনও মনে আছে, আমি তখন খুব ছোট, কাকাকে বাবা কত বকাবকি করেছে। তবে, কাকার একটা ভালো গুণ ছিলো, তার দাদার মুখে মুখে কোনোদিন তর্ক করতে দেখিনি। নিজের দাদা সম্পর্কে তার শ্রদ্ধা কখনও টাল খেতে দেখিনি। বাবাকেও আড়ালে ওর জন্য দুঃখ করতে দেখেছি। শেষবার বাবা ওকে বলেছিল, ‘আশিস, তোকে কিছু টাকা দেই। তুই একটা দোকান কর’। বাবা চেয়েছিল, তাঁর ভাইও কিছু একটা দোকান দিয়ে ব্যবসা চালাক। তাতে জীবনের মোড় ঘুরে যাবে। কিন্তু কাকাকে সে প্রস্তাবে রাজি করাতে পারেনি বাবা। একদিন মা-ও কাকাকে বলেছিল, ‘আশিস, তুমি কিছু একটা করো। তোমার দাদা যখন দোকান দিতে বলছে, তুমি সেটাই করো না’।

কাকা তাতেও নিরুত্তর ছিল। পরে,সেই পুলিশি হুজ্জোতি। গ্রেপ্তার। জেলখাটার ঘটনা। ফলে, বাবা-মা হাল ছেড়ে দিয়েছিল। বাবার পক্ষে পাড়ায় মুখ দেখানোও অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছিল। পরিচিত লোকজন রাস্তায় দেখা হলেই কাকার প্রসঙ্গ তুলে এটা সেটা বলত। বাবার খারাপ লাগত। অথচ,ভাইয়ের জন্য বাবা আপ্রাণ করেছে। তেমন কটু কথাও বলেনি কখনও। মানুষের কী ভাগ্য বলে কিছু থাকে? কী জানি। নইলে এমন হবে কেন? বাবারও সামান্য লেখাপড়া। কিন্তু,পাড়ায়, সমাজে বাবার একটা সম্মান আছে।বাবা নিজের চেষ্টায় একটু একটু করে ব্যবসায় সফল হয়েছে। ঘরবাড়ি করেছে। সংসারে মন দিয়েছে। কোনো নেশা-ভাঙের সঙ্গে সম্পর্ক নেই। বাবা পান বা বিড়ি-সিগারেটও খায় না। তাস পেটানোর কোনো আড্ডায় বাবাকে কেউ কখনও দেখেনি। কারও সঙ্গে রূঢ়ভাবে কথা বলার অভ্যাস নেই বাবার। সকলের সঙ্গেই হেসে কথা বলে বাবা। মা-ও বড় নিরীহ টাইপের মানুষ। গলা উঁচু করে কথা বলার অভ্যাস নেই। নিজের দেওরের সঙ্গে কোনোদিন কঠিন কোনও কথা বলেনি, আমি অন্তত শুনিনি। মায়ের ব্যবহারে এমন একটা স্নেহশীল ভাব থাকে যে সকলেই মা-কে পছন্দ করে। কাকারও কোনও অভিযোগ নেই তার বউদি সম্পর্কে। মা কিছু বললে কাকা মাথা নিচু করে সেকথা শোনে। মৃদুস্বরে হয়তো কিছু জবাব দেয়। ব্যস, এর বেশি কিছু নয়। এটাই এ বাড়ির দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই ছোটবেলা থেকেই আমি এসব দেখে দেখে অভ্যস্ত।

কাকা ঠিক আমার বাবা-মায়েরই মতো কিনা জানি না। নিশ্চয়ই না। আমার মনে আছে, কাকাকে একদিন দেখেছিলাম, একজোড়া পায়রাকে বালতির জলে চুবিয়ে ধরতে! আমাদের বাড়িতে পায়রার মাংস চলে। মা খায় না, তবে, আমরা পছন্দ করি। পায়রার মাংস খেতে হলে বাবা বাজার থেকেই মেরে নিয়ে আসে। ঘরে এসে নিজেই পালক ছাড়িয়ে পরিষ্কার করে নেয়। মা এসব থেকে দূরেই থাকে। তবে, রান্না করে দেয়।

গত পৌষের ঘটনা। জব্বর ঠাণ্ডা পড়েছিলো। সকালে নিজের দোকানের উদ্দেশে ঘর থেকে বেরনোর মুখে বাবা বলেছিল, ‘সুনন্দা শুনছো’?

মায়ের নাম সুনন্দা। সেটা আমার জানা আছে, বাবার সূত্রেই। বাবা মাকে সুনন্দা বলেই ডাকে সবসময়। বাবার বোধহয় এই নামে মাকে ডাকতে ভালো লাগে। আমিও অনেক সময় মজা করতে মাকে সুনন্দা বলে ডাকি। মা তখন কপট রাগ দেখিয়ে চপেটাঘাতের ভঙ্গি করে। তবে, মুখের হাসিটা কিন্তু ঠিকই থাকে। ফলে,আমারও খুব ভালো লাগে। আমার মা খুবই সুন্দরী। টকটকে ফর্সা রং। মুখের আদলে একটা দেবী দেবী ভাব। চোখ দুটো যেন কৌতুক মিশ্রিত। মায়ের কথা ভেবেই এখন আমার কান্না পাচ্ছে। বাবার মুখটা মনে পড়ছে। কিন্তু আমি এখন কীই বা করতে পারি। আমার দুটো হাত জুড়ে বাঁধা। দুটো পা-ও শক্ত করে দড়ি বাঁধা। বলতে চাইছি, কাকা আমার ব্যথা লাগছে। একটু আস্তে বাঁধো। কিন্তু বলতে পারছি না। মুখে একটা কাপড় গুঁজে দেওয়া। ফলে, মুখ নাড়তেও পারছি না। কথা বলার প্রশ্নই নেই। তবে, চোখ দুটো খোলা বলেই সব দেখতে পারছি। আমি এখন মৃতদেহের মতো পড়ে আছি মাটিতে।পিঠে শক্ত কী একটা বস্তুর খোঁচা লাগছে। বোধহয় পাথরের টুকরো। নীলাচল পাহাড়ের ওপরে কামাখ্যা মন্দিরের কাছেই এই জায়গাটা। সামনে একটা বিরাট পাথরের চাঁইয়ে মন্দিরের আলো, হইচই ঢাকা পড়েছে। মন্দিরের ওদিক থেকে আলোর একটা উজ্জ্বল আভা চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। সেই আলোয় খানিকটা দেখা যাচ্ছে চারপাশ। ঘাড় কাত করে আমি এদিক ওদিক দেখার চেষ্টা করছি। যেখানে আমাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে তারই খানিকটা দূরে জ্বলছে একটা অগ্নিকুণ্ড। তার চারপাশ ঘিরে বসে রয়েছে কয়েকজন। সেই দলে কাকা ছাড়াও সেই লোকটাকে দেখেছি আমি। এখন একটু আড়াল পড়ে যাওয়ায় ওই লোকটা এবং কাকার মুখটাও দেখা যাচ্ছে না। কেউ মন্ত্র পড়ছে, তবে, সেটা কী মন্ত্র ঠিক বুঝতে পারছি না। খানিক বিরতিতে শুধু শোনা যাচ্ছে উচ্চকিত ঔং শব্দ।পরের কথাগুলো ঠিকঠাক শোনা যাচ্ছে না। একটা জটাজুট ভীষণ দর্শন লোককে এক আধবার দেখা যাচ্ছে। লোকটার গায়ে ঝালুর ঝুলুর পোশাক। মনে হচ্ছে টকটকে লাল রঙের। তবে, জায়গাটা তত আলোকিত নয় বলে আমি নিশ্চিত হতে পারছি না তার ঝালুর ঝুলুর পোশাকের রং সত্যিই রক্তবর্ণ কিনা। তবে, আমি ভাবছি, তান্ত্রিক তো, পোশাক তার রক্তবর্ণই হবে। লোকটা মাঝে মধ্যেই মনে হচ্ছে অগ্নিকুণ্ডে ঘি ঢেলে দিচ্ছে। আর, যতবার সে ঘি ঢেলে দিচ্ছে ততবারই লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে আগুনের শিখা।সেই সময় তার মন্ত্রের আওয়াজও তীব্র হয়ে উঠছে। দুয়েকবার তার চোখও আমার নজরে পড়েছে। সেই চোখ ভাটার মতো জ্বলছে। একটু আগে গাঁজার গন্ধ পেয়েছি। এরা সকলে মিলে মুহূর্মুহূ গাঁজায় টান দিচ্ছে। হাতে হাতে ঘুরছে মেটে কলকে। কলকের আগুন থেকেই বোঝা যাচ্ছে সেটা হাতবদল হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। কাকার মুখটা দেখার চেষ্টা করছিলাম অনেকক্ষণ ধরে। কিন্তু একবারও দেখতে পাইনি। চারপাশ ঘন ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। কেউ কেউ দুয়েকবার খুক খুক করে কাশল। সেটা কে বা কারা বুঝতে পারিনি। কাকাই কাশছে কিনা ভাবছি। কাকার তো কফের ধাত আছে। শীতের দিনগুলোতে তার কাশির আওয়াজ বহুবার শুনেছি। তবু সে গাঁজা খায়। অথচ, গাঁজার ধোঁয়ায় নিশ্চয়ই কাশি বেড়ে যায়। না বুঝলে তার আর কী। এখন কাশির আওয়াজ শুনে কাকার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে ভেবে কষ্ট পাচ্ছি। কিন্তু আমি তো কিছু বলতে পারছি না। আমার মুখে কাপড় গুঁজে তারপর বেঁধে দেওয়া হয়েছে। বলতে পারলে এখনই কাকাকে বলতাম, ‘অত গাঁজা টেনো না, তোমার কষ্ট আরও বাড়বে’।

মনে পড়ছে, সেদিন বাবার কী একটা ব্যস্ততা ছিলো। ফলে,বাবা কাকাকে বলেছিল, ‘আশিস, আজ ঠাণ্ডা পড়েছে। রাতে পায়রার মাংস হবে। আমি তো সময় পাব না। তুই নিয়ে আসিস। বউদির কাছে টাকা রেখে গেলাম। চেয়ে নিস’। বলেই বাবা বেরিয়ে গিয়েছিল। সকাল এগারোটার দিকে কাকা বাজার থেকে একজোড়া পায়রা নিয়ে এসেছিল। উঠোনে দেখি কাকার হাতে ডানাবাঁধা পায়রা দুটো। কী সুন্দর পায়রা দুটো। দেখে মায়া হয়। খাওয়ার কথা ভাবলেই গা গুলিয়ে ওঠে। আগে অনেকদিনই খেয়েছি, সেভাবে ভাবিনি। মনেই আসেনি। সেদিন কেন জানি মনটা খুব ভেজা ভেজা হয়ে উঠেছিল। আমি মুগ্ধ চোখে দেখছিলাম পায়রা দুটোকে। ঘর থেকে একমুঠো চাল এনে তাদের সামনে ছড়িয়ে দিতেই তারা খুঁটে খুঁটে খেতে শুরু করলো। তেমন বড় হয়নি এখনও, বাচ্চাই। কাকা পায়রা দুটোকে সেখানে রেখেই ঘরে ঢুকে গেল। একটু পড়ে খালি গায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে পায়রা দুটোর কাছে বসল। আমি বললাম, ‘কী সুন্দর’! কাকা একটু হাসল। তারপর উঠে গেল উঠোনের প্রান্তে কলপাড়ে। সেখানেই পড়ে থাকা প্লাস্টিকের বালতিতে কল থেকে জল ভরল।তারপর বালতিটা নিয়ে এগিয়ে এল।আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম পায়রা দুটোকে। কাকা এসে বালতিটা রেখে পায়রা দুটোকে একহাতে উঠিয়ে নিল. তারপর দুটোকেই বালতির জলে চুবিয়ে ধরল। আমি চিৎকার করে উঠলাম—‘করো কী, করো কী’!কাকা তখনও হাসছিল। হাসতে হাসতেই বালতি থেকে পায়রা দুটোকে তুলে আনল।তারা নড়াচড়া করছে। তবে, ডানাগুলো কাকার হাতে বাঁধা পড়ে আছে বলে তেমন জুত করতে পারছিল না।কাকা হাসতে হাসতেই ফের তাদের মাথা দুটো বালতির জলে চেপে ধরল। দেহের বাকি অংশে তখন প্রবল আলোড়ন।পাখি দুটো ছটফট করছে।কাকা ফের তাদের তুলে আনল। নিজের মুখের কাছে এনে মুখ দিয়ে একটা চুক চুক শব্দ করল।বাঁহাত দিয়ে একটু আদর করল। তারপর ফের…আমি ক্রুদ্ধ চিৎকারে ফেটে পড়লাম—‘তুমি মানুষ, না জানোয়ার’?

কাকা তখনও নির্বিকার। হাসতে হাসতেই হাতের আঙুলের দক্ষ প্যাঁচে দুটোর গলা চেপে ধরল আর এক টানে, বিচিত্র হিংস্রতায় ধর-মুণ্ড আলাদা করে ফেলল! দুটো অসহায় জীবের ছিন্ন গলা থেকে রক্তের ধারা বইছে। দুটো শরীর তখনও ছটফট করছে অসহায়ভাবে।আমি আর সেখানে দাঁড়াতে পারছিলাম না।একছুটে ঘরে দৌড়ে এলাম।বুকের ভেতরে কেমন গুমরে উঠছে। গলার ভেতরে কী একটা দলা পাকিয়ে উঠছে যেন। পেটের ভেতরে কিছু একটা যেন পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে। আমার ঘাম হচ্ছে সেই শীতের দুপুরে। এখনও স্পষ্ট মনে আছে। আমি সেদিন আর মাংস খাইনি। সেদিনের পর থেকে একবারের জন্যও কোনও মাংসই খাইনি। এই মুহূর্তে তন্ত্রক্রিয়ার এই আবহে আমার সেদিনের দৃশ্যটা মনে ভেসে এল। আমার মাথায় আলোড়ন উঠেছে। এরই মধ্যে মুখে গামছা বা কোনও কাপড় জড়িয়ে কেউ একটা আমার দিকে এগিয়ে আসছে।তার ডানহাতে কিছু একটা ধরা।অগ্নিকুণ্ডের উজ্জ্বল শিখায় আমার নজরে পড়ল সেটা একটা হাতল লাগানো ধারালো অস্ত্র। লোকটা এসে আমার দিকে নিচু হয়ে ঝুঁকে দাঁড়াল। তারপর আমার বাঁহাতের কনিষ্ঠা আঙুলটা চেপে ধরল। অনুভবেই সেটা বুঝতে পারছি। তারপর কিছু একটা করল.আমি তীব্র যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলাম। ভয়ানক এক অসহ্য যন্ত্রণায় আমার শরীর থরথর করে কাঁপছে। আমি চিৎকার করছি, কিন্তু সেই চিৎকার গলার বাইরে আসছে না। আমার মুখ বাঁধা। উহ্,কী ভয়ানক যন্ত্রণা। আমি আর সইতে পারছি না। পেটের ভেতর থেকে বমি উঠে আসছে। মুখ বন্ধ, ফলে বমি করতে পারছি না। আমার বোধহয় প্যান্ট ভিজে গেছে। আমি আর পেরে উঠছি না। লোকটা আমাকে ফেলে উঠে গেল ফের আগুনের কাছে। অস্পষ্ট দেখলাম,লোকটা তার হাত থেকে কিছু একটা ছুঁড়ে দিলো আগুনের মধ্যে। তারমানে আমার বাঁহাত থেকে কেটে নেওয়া কনিষ্ঠা! আমার এক হাতে এখন চারটে মাত্র আঙুল!ওদিকে তান্ত্রিক উচ্চস্বরে মন্ত্র আউড়ে চলেছে। আমি শুধু শুনতে পাচ্ছি ঔং। বাকি কোনও শব্দই আমার কানে আসছে না। লোকটা অনেকটা ঘি ঢেলে দিল আগুনে দাউদাউ করে জ্বলে উঠেছে আগুনের শিখা। বুঝতে পারছি, আগুনে পুড়ছে আমার কাটা আঙুল। আমার মুখ বাঁধা। বলতে পারছি না. ‘কাকা, স্বজনের রক্তের বিনিময়েও তোমার এনার্সি হবে না। কোথাও কিছু গণ্ডগোল হয়েছে বলেই এনার্সিতে বাদ পড়েছ তুমি। তার সঙ্গে আমার বা আমাদের কোনও সম্পর্ক নেই’।

এখন স্পষ্ট মনে পড়ছে, পরশুর আগের দিন কলেজ থেকে ফেরার পথে রাস্তায় কাকার সঙ্গে দেখা। কাকা এদিন বেশ আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে এসে বলেছিল, ‘কলেজ থেইকা ফিরলি’?

আমি আগে খেয়াল করিনি কাকাকে। ফলে হঠাৎ প্রশ্নে হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। তারপর বলেছিলাম-‘হ্যাঁ। তুমি কোথায় গেছিলা’?

কাকা, ‘ওই, একটা কাম আছিল’। তারপর একটু থেমে কাকা বলে—‘অম্বুবাচী মেলা সামনেই। আমার লগে যাবি’?

অম্বুবাচী উপলক্ষে প্রচুর লোকসমাগম হয় কামাখ্যা মন্দিরে। বহু আগে একবার গিয়েছিলাম। তারপর আর যাওয়া হয়নি। আসলে,সঙ্গীর অভাবে যাওয়া হয়নি। তেমন গরজও হয়নি অবশ্য। ফলে,কাকার প্রস্তাবে সানন্দে সম্মতি দিয়েছিলাম। কাকার সঙ্গে মেলামেশায় বাবা-মা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে ভেবেই বোধহয় কাকা বলেছিল, ‘তুই বিকাল পাঁচটায় লালগণেশে আসিস। তারপর দুজনে একসঙ্গে যাব’। আমার মনে কোনও প্রশ্ন আসেনি। কারণ, বাবা-মা যদি জানতে পারে আমি কাকার সঙ্গে যাচ্ছি তাহলে নিশ্চয়ই বাধা দেবে। সেজন্যই গল্প ফেঁদেছিলাম যে,বন্ধুদের সঙ্গে যাচ্ছি। সাধারণত সন্ধ্যার পর ঘরের বাইরে থাকার অনুমতি থাকে না আমার। বাবা এব্যাপারে খুবই কড়া।সন্ধ্যার মধ্যেই ঘরে ফেরা চাই। কিন্তু আজ কী হলো কে জানে!কেউ বাধা দেয়নি, মা-ও না, বাবা-ও না। মা শুধু বলেছিল,‘বেশি রাইত করিস না। বাবা ঘরে আইয়া যদি দেখে তুই ঘরে নাই,তাইলে রাগ করব’। আমি বললাম—‘বাবা ঘরে ফেরার আগেই আমি চলে আসব’। হায় ঈশ্বর! এখন কত রাত কে জানে। আমার হাত-পা বেঁধে এরা কতক্ষণ ধরে এখানে ফেলে রেখেছে বুঝতে পারছি না। হয়ত রাত দশটা বেজে গেছে, অথবা তারও বেশি। বাবা নিশ্চয়ই ঘরে ফিরেছে। আর, আমি ঘরে নেই জেনে কী দুশ্চিন্তাই না করছে! হয়তো মাকে বকে-ঝকে আর রক্ষা রাখেনি। বেচারা মা আমার! তারও কত অসহায় অবস্থা। আমার দুচোখ বেয়ে নেমে এল জলের ধারা। কিন্তু আমার তো কিছুই করার নেই। অগত্যা পাথুরে বিছানায় পড়েই থাকলাম লাশের মতো। এখনও আমার কাছে পরিষ্কার নয়, আরও কী কী হবে। আমাকে কি এরা মেরেই ফেলবে? সে নয় মেরেই ফেলুক। কিন্তু যেভাবে আঙুল কেটে নিল তাতে আমি আর সইতে পারছি না। কতটা সময় ধরে এদের এসব চলবে বুঝতে পারছি না। এরা কেউই আমাকে কিছু বলছে না। যেন আমাকে কিছু বলার প্রয়োজনই নেই! কাকাকেও কাছেপিঠে দেখছি না।

যজ্ঞ ও তাতে ঘিয়ের আহুতি প্রদান চলছে ক্রমাগত। চলছে অবিরল মন্ত্রোচ্চারণ। ওদিকে কামাখ্যা মন্দিরের চারপাশে অসংখ্য মানুষের কোলাহল। প্রচুর আলো। অথচ, এদিকে ঘোর অন্ধকার। শুধু আকাশের দিকে তাকালে নজরে পড়ছে উজ্জ্বল আলোর আভা। নীচে,মাটির কাছে প্রায় নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। যে অন্ধকারে মাটিতে পাথুরে বিছানায় শায়িত আমার মৃতবৎ দেহ। হাত-পা বাঁধা। মুখ বাঁধা। ফলে,আমি চিৎকার করলে একটা গোঁ গোঁ আওয়াজ হচ্ছে, কিন্তু সে আওয়াজ একটু দূরেও পৌঁছচ্ছে না। আমার কী হবে! ভেবে কোনও কূলকিনারা পাচ্ছি না। আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে এভাবে শুইয়ে রাখার ফলে আমার সারা শরীরে জমাট ব্যথা, সারা শরীরে অবশ অবশ ভাব।

আবারও এগিয়ে এল, মনে হচ্ছে সেই আগের লোকটাই। দ্রুত ঘাড় ঘুরিয়ে আমি তার হাতের দিকে দেখার চেষ্টা করতেই সারা শরীরে হিমেল স্রোত বয়ে গেল। এবারে সে আমার শরীর থেকে আরেকটা অঙ্গ কেটে নেবে এবং তারপর ছুঁড়ে দেবে যজ্ঞের আগুনে। তান্ত্রিক উচ্চস্বরে মন্ত্রোচ্চারণ করবে আর আগুনে ঘৃতাহুতি দেবে। আমি কী করবো? আমার হাত-পা বাঁধা, মুখ বাঁধা। লোকটা এগিয়ে এসে ফের ডানহাতের কনিষ্ঠ আঙুল…। উহ্, কী অসহ্য ব্যথা।আমি বোধহয় অজ্ঞান হয়ে যাব। সেটাও ভালো হবে আমার পক্ষে, কারণ আমি আর সইতে পারছি না। অথচ, এখনও আমার টনটনে জ্ঞান আছে। প্রতিটি দৃশ্য আমি, যতটা দেখা সম্ভব দেখছি। প্রায় সবটুকু আওয়াজ শুনছি।নিজের মৃত্যু দেখার কী দুর্লভ অভিজ্ঞতা!একটু কী অহংকারও হচ্ছে আমার? কী জানি! এভাবে কেটে যাচ্ছে যেন অনন্ত সময়। এখন কতটা রাত কে জানে। কখন ভোর হবে কে জানে। আজ কি আর ভোর হবে না? ভোর না হলে যে আমারও মুক্তি নেই। এরা আমাকে আদৌ মুক্তি দেবে কি? কিছুই বুঝতে পারছি না।পাহাড়ে, কামাখ্যা মন্দিরের ওদিকে কোলাহল স্তিমিত হয়ে আসছে।তারমানে রাত এখন অনেক।কত রাত? নিজেকেই প্রশ্ন করি। আমি চাইছি দ্রুত ভোর হোক, সূর্য উঠুক। এই নীলাচল পাহাড়ে কত সহস্র মানুষের ভিড়। সেই ভিড়ের মধ্য থেকে কেউ একজন যদি এগিয়ে আসে তাহলেই আর চিন্তা নেই। কিন্তু তার কোনও সম্ভাবনাই এখনও দেখতে পাচ্ছি না। খোলা আকাশের দিকে মুখ করে আমি রাতের অনন্ত প্রহর গুনতে থাকি। দূরে কোথাও একটা শেয়াল ডেকে উঠল। শেয়ালেরা প্রহরে প্রহরে ডাকে বলে শুনেছি। তাহলে এখন রাতের কত প্রহর? জানি না। জানা সম্ভব নয়। সেই কোন বিকেলে ঘর থেকে বেরনোর সময় দুধ-রুটি খেয়েছি।এখন পেটে ছুঁচের ডন।ভয়ানক খিদে পেয়েছে। আমার তো মুখ বাঁধা, কিছু খেতেও পারব না। এর মধ্যে দু’বার আমার পেচ্ছাপ আর পায়খানা হয়ে গেছে। নোংরা প্যান্টেই চিৎপাত শুয়ে আছি। পিঠে তীব্র ব্যথা অনুভব করছি। লোকগুলোর মাথায় একটু বুদ্ধিশুদ্ধিও নেই? আমাকে শোয়ানোর আগে একটা চাদর অন্তত পেতে দিতে পারতো না? বলিহারি বুদ্ধি! কাকাটাই বা কেমন,তারও মনে হয়নি এই শক্ত পাথুরে মাটিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চিৎপাত হয়ে শুয়ে থাকতে ভাইপোর কষ্ট হবে? আমার খুব অভিমান হয় কাকার ওপরে।

এখানে মল-মূত্রের ঝাঁঝালো গন্ধ আসছে। এত তীব্র সেই গন্ধ যে, টেকা দায় হয়ে উঠেছে। কিন্তু আমি নিরুপায়। কে বুঝবে আমার কষ্ট! আর তাই, একটা একটা করে আমার আঙুল কাটছে ওরা। আরে,একবারে গলাটা কেটে দে না। তারপর না হয় কুড়িটা আঙুল একে একে কেটে নিস! কে আপত্তি করেছে।এসব ভাবতে ভাবতেই বুঝি আমার শরীরে আর তেমন যন্ত্রণার বোধ হচ্ছে না। কোন এক অলৌকিক প্রক্রিয়ায় আমার সমস্ত ব্যথা,বেদনা,লাঞ্ছনা, খিদে সব উধাও।আমি ভাবি, এও কি তন্ত্রের অলৌকিক শক্তির পরিণাম? কী জানি। দীর্ঘ তন্ত্র প্রক্রিয়ার একটা পর্বে সেই লোকটা ফের এগিয়ে এলো। আমি আর তাকে গুরুত্ব দিচ্ছি না। ওকে গুরুত্ব দিয়ে লাভ নেই। ওর কাজ ও-ই করুক। বাধা দেবার যখন উপায় নেই, তখন নিষ্ক্রিয় পড়ে থাকাই ভালো। আমি নিষ্ক্রিয় পড়ে রইলাম। তার দিকে তাকাবার ইচ্ছেও নেই আমার। ফালতু লোক একটা, নির্বোধ। সে এগিয়ে এসে তার হাতের ধারালো অস্ত্রটা এবারে আমার মুখের খুব কাছে এনে ফেলেছে। আমি মুহূর্ত গুনে যাচ্ছি। ভাবছি এবারে সে কী করবে,কী করতে পারে? তার বাঁহাত আমার কণ্ঠা স্পর্শ করল। খুব ঠাণ্ডা কিছু একটা আমার গলার ত্বকের ওপরে এসে পড়ল। আমি জেনে গেছি এরপর কী হতে পারে। ফলে, আর কিছু ভেবে কীই বা হবে! আমি একবার কাকাকে দেখতে চাইলাম, কিন্তু গলায় ঠাণ্ডা ধাতব বস্তুটা স্পর্শ করে থাকায় সেভাবে ঘাড় ঘোরাতে পারছিলাম না। আমার ওপরে উপুড় হয়ে পড়া লোকটার গরম নিঃশ্বাস আমার মুখের ওপরে এসে লাগছিল। তার নিঃশ্বাসের দুর্গন্ধ এসে ধাক্কা মারছে আমার নাকে। আমার গা গুলিয়ে উঠছে। সেই অবস্থায় লোকটা জুতো শুদ্ধ একটা পা তুলে দিল আমার বুকের ওপরে। উহ্, কী ভারী পা লোকটার! তার পায়ের চাপে আমার প্রবল শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। কী মনে করে লোকটা বাঁহাতে আমার চুল খামচে ধরল, যাতে আমি মাথাটা তুলতে না পারি। আমি তো মড়ার মতো নিশ্চেষ্ট হয়েই পড়ে আছি। আমি তো তাকে কোনও রকম বাধাই দিইনি। বাধা দেবার মতো অবস্থায় আমি নেই। আমার হাত-পা বাঁধা, সেই কত ঘণ্টা ধরে ওরা আমাকে কঠিন এই পাথুরে জমিতে চিৎ করে শুইয়ে রেখেছে। লোকটা ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলছে আমার মুখের ওপর। সে বোধহয় হাঁপাচ্ছে। হাত-পা বাঁধা না থাকলে আমার এই পেশল শরীর তাকে এতদূর এগোতেই দিত না। সেরকম হলে অনেক আগেই এক লাথিতে তাকে বহুদূরে ছিটকে ফেলতাম। ওই তো প্যাকাটে শরীর, আমার একটা ঘুষিও লোকটা হজম করতে পারত না। এটা সে বোঝে বলেই হয়তো ভেবেছে আমি তাকে বাধা দিতে পারি। তাই সে আমার চুলগুলো খামচে ধরেছে। এত জোরে সে চুলগুলো খামচে ধরেছে যে, মনে হচ্ছে সমস্ত চুল মাথার চাঁদি থেকে উপড়ে আসবে। ভীষণ ব্যথা লাগছে আমার।  তারপর তার সেই দুর্গন্ধ নিঃশ্বাস! কী কুৎসিত এই জল্লাদটা। ঘেন্নায় আমি কুঁকড়ে যাই। এরিমধ্যে তার ডানহাতটা নড়ে উঠল, কণ্ঠায় ধাতব স্পর্শেই সেটা আমি বুঝে গেলাম। ‘কাকু’ বলে চিৎকার করে উঠলাম। গলায় খচ করে একটা শব্দ যেন…আমি চোখ বুজে ফেললাম।

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত