| 28 মার্চ 2024
Categories
ব্রহ্মপুত্র ও বরাকের গল্প

ব্রহ্মপুত্র ও বরাকের গল্প: জল ঈশ্বর । শর্মিলা দত্ত

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

পরাশর, সনাতন দিগেনদের  মতো কিছু জল-মানুষেরা ক’দিন থেকেই বেশ খুশি খুশি। জলের অঢেল ঢল এই নামল বলে বরাক নদীতে। আকাশের রং ঢং দেখে তাদের অনুমান করে নিতে কষ্ট হয় না যে পাহাড়ে ভারী বর্ষার হৈ চৈ শুরু হয়ে গেছে। মাটি ক্ষেত নদী জল মেঘ আকাশ এসব নিয়ে সনাতন পরাশররা এতোই ওয়াকিবহাল যে তাদেরকে রীতিমতো গবেষক বললেও অত্যুক্তি হবে না। মাঝি মাল্লারের জাত তারা। জল তাদের কাছে ঈশ্বর। এই জল-ঈশ্বরকে নিয়েই প্রতিনিয়ত খেলা তাদের। 

পাহাড়ে বর্ষা শুরু হলেই সনাতনরা যেন জলমাতাল হয়ে ওঠে। তাদের বৌ-রা তখন বেশ ভয়ে ভয়ে থাকে। কি জানি কী ভীষণ খাড়া নেমে আসে তাদের সবার জীবনে! ছেলে মেয়েগুলোও হয়েছে তেমনি, তখন তাদের বাবাদের সঙ্গেই বেশি খাতির। আসলে এভাবেই বোধ হয় পরম্পরা চলতে থাকে। দেখে দেখে জলের আয়নায় নবীন প্রজন্ম বড় হয়, পাকাপোক্ত হয়, জীবিকায় মন দেয় আবার কখনো কখনো কেউ কেউ নতুন জীবন জীবিকার টানে বহুদূর ছিটকেও যায়। জল ছেড়ে খরা মাটির টানে অন্য মানুষ হয়ে বেঁচে থাকে কিংবা মানুষের মানচিত্রে হারিয়ে যায়।

এভাবেই হয়ত হারিয়ে যেতে যেতে আরো কোনো জাত-মানুষের জন্ম হয়, আরেক যাপন, অন্য পরম্পরা সভ্যতার হাত ধরে এগিয়ে আসে পরিবর্তন বা অগ্রগতির নাম নিয়েকিছুদিন থেকেই এত কালো ঘোর অন্ধকার বর্ষামুখর দিনরাত জীবনে আর দেখেছে বলে মঙ্গলার মনে পড়ে না।

নদীতে কি প্রচণ্ড ঢল নেমেছে জলের। ধীরে ধীরে বরাকের বুকে জল বেড়েই চলেছে। রাত নামতেই বুকের ভেতরটা কেমন যেন হুম্ হুম্ করে সেই স্রোতের প্রচণ্ড শব্দে। চরের মানুষেরা রাত জাগে অজানা আশঙ্কায়। সনাতনও জানে স্রোতের এই আওয়াজটা ঠিক নয়। যে কোনো সময় যে কোনোকিছুই হতে পারে। কিন্তু চরের কিছু কিছু হত  দরিদ্র সনাতনরা করবে কি, যাবেই বা কোথায়? পাহাড়ের অবিশ্রান্ত বৃষ্টি বরাকের পূর্ণ গর্ভের সময়কে যেন আহ্বান করছে মহাপ্রলয়কাল!

বরাকের বুকের এই জলস্রোত আগামীর কোনো অশণি সংকেত দিচ্ছে কি? কিন্তু সনাতন, পরাশরদের তো এই স্রোতের সঙ্গে বোঝাপড়া করতেই হবে। চরের অনেকেই সনাতনদের এই জীবিকার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছে। সরকারের উজালা যোজনায় অনেকেরই ঘরে এখন চুলাচৌকি ঢুকে গেছে। কেবল তাদের মতোই হতভাগ্য কিছুজন রয়ে গেল। ঘোর বর্ষায় ফুটো আকাশের মতো তাদের কপালও ফুটো হয়ে রয়েছে। কবে উজালার চুলা জুটবে সনাতনদের ঘরের মঙ্গলাদের জন্য কে জানে? আরো অনেক শহুরে ধনবান বাবুবিবিরা তাদের ভর্তুকী নেওয়া ছাড়লেই নাকি আরো অনেক গরীবরা চুলাচৌকি পাবে! সেটা কোন জন্মে পাওয়া যাবে কে জানে?

তবে পরাশর, সনাতনদের এ নিয়ে তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই। লড়াকু দুই হাত ও শরীর নিয়ে জলের সঙ্গেই তাঁদের অগাধ খেলা। গাছ কুড়ানো আর কাঠ কুড়ানো নিয়ে জল, দড়ি, নৌকা আর স্রোতের সঙ্গে খেলায় জল-ঈশ্বরকেই তারা প্রত্যাহ্বান জানায়। আর তাদের ঈশ্বরও তেমনি, জলের বিক্রমে খেলিয়ে খেলিয়ে তাদের জীবনকে লড়াইয়ের জন্য পাকাপোক্ত করে তোলেন। সনাতনরা জানে এ তাদের অলৌকিক আশীর্বাদ। কিন্তু সরকার, তার স্কিম, তার নিয়মনীতি আর কিছু মানুষ নামের অমানুষদের সাথে প্রতিনিয়তই তাদের বিদ্বেষের একমুখী লড়াই। বার বার হারতে হয় বা হেরে যেতে বাধ্য করা হয়। আর এমন ধারা বজায় থাকে কিছু মানুষমুখী রাক্ষসদের জন্যে। সনাতনদের মতো কিছু তথাকথিত অশিক্ষিত, রুখাসুখা মানুষদের মধ্যে এইসব রাক্ষসদের উপস্থিতি যেমন বিশাল, ঠিক তেমনি ভয়ংকর শিক্ষিতদের মধ্যে এদের অটল জটিল অবস্থান। আর মাঝখানে নেপোর সংখ্যা তো অগুন্তি। নেপোরা চিরকালই একেবারে হাওয়ায় ভেসে ভেসে বড় ভালোভাবে বেঁচে বর্তে থাকে।

বড় ঘনঘোর ত্রিসন্ধ্যা আজ। সময়ের হিসেব করে সনাতন পরাশর জনার্দনদের মতো এক ঝাঁক জল-মানুষেরা আজ নৌকা তৈরি রেখেছে। সবাই প্রস্তুত যাবার জন্যে।

গত কয়েকদিন থেকেই আকাশে জমে থাকা কালো মেঘ ও বৃষ্টির প্রতি তারা তীব্র নজর রাখছে। সনাতনরা আসলে জন্ম-জ্যোতিষী হয়। আকাশ মেঘ জল বৃষ্টি দেখে গোত্র বিচার করে বুঝে নেয় সহজেই জল-ঈশ্বরের সাথে তাদের জীবিকা খেলার কেমনতরো যোটক হবে। কখনো কখনো রাজযোটক হয়ে যায় আবার কখনো কখনো যোটকের মানুষগুলোই অতলান্তিক হয়ে পড়ে। 

বিচার মতো মেঘবতীর গর্ভসময় পেরোয় না। তীব্র ঘনগর্জনে অজস্র ধারায় নদীতে নেমে আসে নবজন্মের কলতান যা হয়তোবা বসতি ভাসানেরও আগাম সংকেত। এসবের মধ্যে ভয়ে কাঁপে কেবল মঙ্গলাদের মতো মাঝি বৌগুলি। হাত পা পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে যেতে থাকে। যদি কিছু অঘটন ঘটে যায়! পোলাপান নিয়ে দাঁড়াবে কোথায়? রাষ্ট্রের অবাঞ্ছিত গণজন তারা। ক্রয় বিক্রয় যোগ্য ভোটার কেবল। তাদের ভাতের গন্ধে কোনো দেশেই ম ম শব্দ প্রয়োগ হয় না, তাদের স্বাধীনতায় কোথাও কোনো পতাকা ওড়ে না। তাই ঘন ঘোর চরবর্ষায় তাদের বুকের ভেতর প্রতিনিয়তই সব হারানোর ভয়ের বৃষ্টি ঝরে।

উঠোনে ঢের হয়ে আছে কোনো পাহাড়ের, কোনো জঙ্গলের গাছ, ঝার, বাঁশের বুঙ্গা। মিলের লোকেদেরও ঘোরাঘুরি শুরু হয়ে গেছে নীরবে নিভৃতে। তারা খুব কলা-কুশলী লোক। সনাতনরা প্রতিবারই দর কষাকষিতে হেরে যায় মিলবাবুদের কাছে। বাবুদের কাছে পরাশর সনাতনদের পরিশ্রমটা দরযোগ্য নয় কখনোই। মালিক বিহীন গাছ বলে কণ্ঠস্বরও উচ্চগ্রামে চড়ে না। তারমধ্যে যদি দু’একজন দালাল বা বাঁশের বুঙ্গার নেপোরা উপস্থিত হন তবে তো আর কথাই নেই। এভাবেই চলে তাদের যাপন কথা। তবে তাদের মধ্যে কিছু মানুষ অনায়াসে বহু মোহরানা, বহু যোজনাকে আত্মসাৎ করে খুব ভালো থেকে যায়। যা সুবিধা যার প্রাপ্য ছিল তা চলে যায় অযোগ্যদের হাতে অনিয়মের টেবিলের তলা দিয়ে। আর আজীবন লড়াই করে সনাতনরা।

সনাতন পরাশরদের নৌকা তাদের ঘাট ছাড়ে যোটক বিচার করে। ঘাটে ঘাটে মঙ্গলারা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। বৃষ্টি একটু ধরেছে বটে কিন্তু নদীতে কি তীব্র জলস্রোত! সনাতন দক্ষ মাঝি। জলের পৃথিবীতে সে দ্বিতীয় ঈশ্বর আর এইটুকুতেই মঙ্গলার যা অল্পবিস্তর ভরসা! নদী, স্রোত, জল, নৌকা আর মাঝিদের সম্মিলিত আওয়াজে নৌকা ছাড়ে ওপারের দত্তবাবুদের ঘাটের সোজাসুজি। নৌকার ওপর থেকে ধীরে ধীরে দড়ি ছাড়তে থাকে পরাশর। এ সময়টা বড় বিপজ্জনক। তীব্র স্রোত আর মানুষের হাতে ধরা দড়ির মধ্যে সে কি বিশাল লড়াই! পরাশর দড়িটা স্রোতের মুখে খেলিয়ে খেলিয়ে অল্প অল্প করে আগল ছাড়ছে। নিজেদের ঘাটের কাছে দড়ির একটা মুখ হিজলের শেকড়ে বাঁধা। জনার্দন সেখানে বাবুল, চাকুর আর মোহনকে নিয়ে দড়ির খোঁটের কাছে অতন্দ্র চাউনীতে, যেন চোখ ফসকে না চলে যায়!

মঙ্গলারাও দাঁড়িয়ে থাকবে আর কিছুক্ষণ। পোলাপানগুলো উত্তেজনায় হৈ হৈ হৈয়া চিৎকার করছে। যেন মোচ্ছব লেগেছে – মনে মনে গজরায় মাঝি বৌগুলো। আসলে এভাবেই তারা মনের ভয়কে তাঁড়ায়। সবার একই কামনা সনাতনরা যেন ভালোভাবে ফিরে আসে।

বিভূতি, পশুপতি ও সীতানাথ আগেই দত্তবাবুদের ঘাটে ঘাঁটি মেরে বসা। মাঝে মাঝে বিকট সুরে হৈ হৈ হৈয়া বলে হাঁক পাড়ছে। সনাতন, দিগেনরা নৌকাটাকে যেন পাঁজকোলা করে নিয়ে যেতে চাইছে দত্তবাবুদের ঘাট বরাবর। এতই সোজা নাকি? জল-ঈশ্বরও আঙুলের ডগায় স্রোতের বিক্রমকে উথাল পাথাল করে দিতে চাইছেন। কিন্তু সনাতন তো তারই সন্তান। হার মানার পাত্র নয় আর জল তো তার শিরায় শিরায়, মগজে। পাহাড়স্নাত জলের ঢল আশেপাশের প্রকৃতি সম্পদকে নিয়ে কি এক আসুরিক তাড়নায় ছুটছে যেন। নদীতে আছড়ে আছড়ে পড়ে ঘূর্ণিও তার চিলচক্র দেখায়। এই কঠিন পরিস্থিতিতেও সনাতনের হঠাৎ মনে হলো একেই কি তবে কবিকর্তা ‘ডহরের ঘোর’ বলেছিলেন?

অল্পসময়ের অন্যমনস্কতায় নৌকা তীব্র মোচড় মারে। রে রে করে ওঠে দিগেন। সম্বিত ফিরে পায় সনাতন। মনের আফালের খবর কাউকে সে দিতে চায় না। কবিকর্তার সাথে মাঝে মধ্যে মাছ-বৈঠকে তার দুঃখসুখের কিছু আলাপ হতো। দু’জনেই বিবিয়ানার সন্তান কি না! নৌকার প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে সনাতন টালমাটাল হতে হতে টের পায়, মহারাজ পাত পেড়েছেন এবার। হেঁচকা টান লাগে পরাশরের দড়িতেও। নৌকা ঘুরতে শুরু করে। প্রাণপন চেষ্টায় নৌকাকে ঘুর্ণন থেকে ছাড়াতে চেষ্টা করে সনাতন। দুইপার থেকে শুরু হয়েছে চিৎকার। পরাশর নৌকার ঘূর্ণিকে হিসাব করে দড়িকেও ঘুরিয়ে খেলাতে থাকে যাতে আটকানো কিছুতে ফাঁস লেগে যায় কিন্তু…।

শেষমেষ পরাশর বিপদ বুঝে দড়ি হাতে নদীতে ঝাঁপ মারে। মুহূর্তে মনে হলো আজ আর বোধ হয় শেষরক্ষা হলো না! পরাশর ঝাঁপ দিতেই সনাতন নৌকাকে ‘ডহরের ঘোর’ থেকে ঝাঁকুনি দিয়ে সরে আসতে সক্ষম হয়। দু’ইপার থেকেই জনার্দন, বাবুল, চাকুররা আর পশুপতি সীতানাথ প্রবল বিক্রমে হৈয়া হৈয়া চিৎকারে তাদের মনোবল ঠিক রাখতে চেষ্টা করে। অন্ধকার আর বৃষ্টি যেন পাল্লা দিয়ে নামতে থাকে।

অমানুষিক শক্তিতে পরাশর আর দিগেন দড়িটাকে জলের স্রোতের তাড়নায় খেলিয়ে খেলিয়ে সাঁতরাতে থাকে। সনাতনের নৌকা খেই পেতেই পশুপতি আর বিভূতি সীতানাথকে নিয়ে দত্তবাবুদের ঘাট থেকে নৌকা ছাড়ে। পরাশর আর দিগেনের দিকে নৌকাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। দড়ির হাত বদল হয়। সীতানাথ ও বিভূতি দড়িকে খেলিয়ে নিয়ে যেতে থাকে তাদের চরের ঘাটের দিকে। পরাশর ও দিগেনকে নিয়ে পশুপতি নৌকা সামলায়। সনাতনও ফিরতে থাকে।

ওপারে দত্তবাবুদের ঘাটে বাড়ির নারী পুরুষ সবাই বেরিয়ে পড়েছেন। ঘাটের কাছের উঠোনে তখনও আলো জ্বলছে। বর্ষায় এসব তাদের বহু দেখা ব্যাপার তবুও প্রতিবারই তাঁরা এই সনাতন দিগেন সীতানাথদের সঙ্গ দেন। তাঁদের কণ্ঠেও হৈয়া হৈয়া চিৎকারে আশে পাশের মানুষও সামিল হয়। জল-ঈশ্বর আর মাঝিমাল্লারের এই তীব্র খেলায় এভাবে সকলেই একযোগ হয় বর্ষা-আকাশের নিচে। আসলে সত্য মানুষেরা এভাবে হয়ত একে অন্যের হয়ে বাঁচে আর প্রকৃতি জানে এই এক হওয়ার মন্ত্র।

ক্রমশ পশুপতি বিভূতিরা পেশির ক্ষ্রিপ্ততায় এবং কৌশল দক্ষতায় গাছ আর দড়িকে স্রোত বিরুদ্ধে খেলিয়ে খেলিয়ে নিজেদের ঘাট-মুখো হতে থাকে। দড়ি তখনো ক্রমাগত ঝাঁকুনি দিচ্ছে। জল, ঢেউ, দড়ি আর মানুষের অসমান্তরাল লড়াইয়ে তখনো লেগে থাকে ‘ডহরের ঘোর’। পাহাড়ের বৃষ্টির খামখেয়ালি ঢলে নেমে আসা গাছকে জড়িয়ে থাকে সনাতনদের জীবিকামঙ্গল। আর মঙ্গলাদের শ্রাবণী মনসামঙ্গল চলে তাদের চুলার আঁচে। রের ঘাটে তখন সমবেত হৈ হৈ হৈয়া…।

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত