| 20 এপ্রিল 2024
Categories
ব্রহ্মপুত্র ও বরাকের গল্প

ব্রহ্মপুত্র ও বরাকের গল্প: ভালো মানুষ । বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

 

বাইরে গরমের পারদ চড়ছে তরতরিয়ে। ক’দিন থেকেই এমন হচ্ছে। সকাল থেকেই কাঠফাটা রোদে যেন ঝলসে যায় পৃথিবী। আবার বিকেলে একপ্রস্থ ঝড় তুফান। ঘরের ভেতরেও অ-সুখের মাত্রা যেন বেড়েই চলেছে মানসের। অথচ এমনটা হওয়ার তো কোনও কথা ছিল না। কিন্তু হলো তো। হতাশায় নিজের মাথার অবশিষ্ট চুলগোছাকেও টেনে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে মানসের। কিন্তু আপাতত সেই শক্তিটুকুও যেন নেই মনে হচ্ছে। তার মধ্যে আবার এই মুহূর্তে অনেকগুলো কাজ তাকে করতেই হবে নিজের হাতে। ঘরে সব মিলিয়ে চারটে প্রাণী থাকলেও এই মুহূর্তে, আজ প্রথম বারের মতো মানসের মনে হচ্ছে সে ভীষণ একা। আগেও বারকয়েক এমন চিন্তাধারা যে আসেনি তার মনে এমনটা নয়। তবে খুব সহজেই এড়িয়ে গেছে এসব। দানা বাঁধতে দেয়নি অন্তরে। আজ যেন হঠাৎ করে জীবনের সার সত্যটা বড্ড নিদারুণ ভাবে প্রকট হয়ে ভেসে উঠেছে চোখের সামনে। 

শেষ কবে অসুস্থ হয়েছিল তা মনেই করতে পারে না মানস। রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা অধিক থাকায় রোগ শোক সহজে এসে কাবু করতে পারেনি। এবার কিন্তু পরিস্থিতি একটু অন্য রকম। কাল বিকেল থেকেই টের পাচ্ছিল অসুস্থতা। প্রথম দিকে গায়ের জোরে পাত্তাই দিতে চাইছিল না এতটুকু। কিন্তু ধীরে ধীরে হাতের নাগাল থেকে বেরিয়ে যে গেছে তা এখন দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট। আজ আর অফিসে যাওয়ারও ক্ষমতা হয়নি। ইতিমধ্যে বার আটেক টয়লেটে যেতে হয়েছে। এই মুহূর্তে দুপুরের সব খাবারটুকু বমি হয়ে বেরিয়ে এলো হড়হড় করে। সামলে নেওয়ার কোনও সুযোগই পেল না মানস। সারাটি মেঝে নোংরা হয়ে আছে। মানস এদিক ওদিক তাকিয়ে একটা পরিত্যক্ত ছেঁড়া কাপড়ের সন্ধান করতে লাগলো, যা দিয়ে মেঝেটা মুছে ফেলা যায়। ঝিমলি বা ছেলে মেয়ে দুটো এসব দেখে ফেলার আগেই যে করে হোক মুছে ফেলতে হবে। ওরা এসব দেখলে ভয় পেয়ে যাবে হয়তো ভীষণ। তাছাড়া এসব সাফসুতরো করার অভ্যেসও তো নেই ওদের। বস্তুত ওদের এসব ঝামেলায় কোনোদিন পড়তে দেয়নি মানস নিজেই। সব কিছু এতদিন সামলে নিয়েছে নিজে। 

বিয়ের পর থেকেই ঝিমলিকে লাগামছাড়া ভালোবেসে এসেছে মানস। ঘরের প্রায় সব কাজই নিজের হাতে করার চেষ্টা করেছে বরাবর। ঝিমলি হাত লাগাতে চাইলেও বাধা দিয়েছে। একান্ত অসুবিধে হলে যদিও কিছু করতে দিয়েছে ঝিমলিকে কিন্তু তার নিজের কাজটুকু কখনো করতে দেয়নি। নিজের কাপড় নিজেই ধুয়েছে, নিজের বাসন নিজেই ধুয়েছে। নিজে কখনো অসুস্থ হয়নি কিন্তু ঝিমলির শরীর সামান্য খারাপ হলেই সারা ঘরের যাবতীয় কাজ নিজের জিম্মায় এনে নিয়েছে মানস। ছেলে মেয়ে দুটির জন্মের পরও বজায় থেকেছে একই ধারা। 

সকালে উঠে ছেলে মেয়েদের টিফিন তৈরি করে, ওদের স্কুলে পাঠিয়ে, ঘরদোর সাফাই করে, বাসনপত্র ধুয়ে, রান্নার যাবতীয় প্রস্তুতি সেরে, স্নান করে, চা বানিয়ে ঝিমলিকে ডেকে নিজে অফিসে বেরিয়ে পড়েছে সকাল ন’টার মধ্যেই। বিয়ের পর ঝিমলিকে নিয়ে নতুন কর্মস্থলে নতুন সংসার পাতার পর থেকেই এ তার নিত্য রুটিন। অফুরান জীবনীশক্তি যেন মানসের। ঝিমলি সারা দিনে শুধু রান্নাটুকুর বাইরে কিছুই করার খুঁজে পেত না। সন্ধের পর ঘরে ফিরে আবার গা ধুয়ে দুপুরের এঁটো বাসন ধুয়ে, সন্ধ্যারতি দেখিয়ে, চা বানিয়ে সবাইকে খাইয়ে তারপর একটু যেন দম ফেলার ফুরসত পেত মানস। তবে এই অফুরন্ত কাজের মধ্য দিয়ে যা মানসিক তৃপ্তি পেত মানস তা বলে বোঝানোর নয়। 

মানসের এই অভ্যাসের ফলে তার নিজেরই অলক্ষ্যে সংসারের অবশিষ্ট তিনটে প্রাণী যে দিন দিন নিষ্কর্মার হাঁড়ি হয়ে উঠেছে সে খেয়াল কারোরই ছিল না। ঝিমলিও হাল ছেড়ে এখন উপভোগ করছে কর্মহীন জীবন। গায়ে গতরে দুই সন্তান সহ ঝিমলিও বেড়ে উঠেছে দিন দিন। ওদের শরীরে দানা বাঁধছে পরিশ্রমহীনতাজনিত রোগ। আলস্যের খপ্পরে পড়ে ঘরকন্না কাজে কোথাও ত্রুটি হলে উলটে মানসকেই ওরা দু’কথা শুনিয়ে দিত। মানস এসব দেখেও দেখেনি কোনোদিন। ‘পষ্ট কথার দাবড়ি’ সহ সংসারের ষোলো আনা কাজের দায়িত্ব মাথা পেতে নিয়ে সবাইকে সুখী দেখার মধ্যেই ছিল মানসের যাবতীয় সুখ। এক অদ্ভুত সহনশীলতার প্রতিমূর্তি যেন। ঝিমলিকে নিয়ে তার আদিখ্যেতা চোখে পড়ার মতোই ঘটনা বটে। একা ঝিমলিকে কোথাও বেরোতে দিত না মানস। বিপরীতে এমন হলো যে মানস নিজেও শুধুমাত্র অফিস ছাড়া কোথাও একা বেরোতেই পারতো না। যেখানেই বেরিয়েছে দু’জন নয়তো চারজন। পকেটে টান পড়েছে এর জন্য । কিন্তু নিয়মের উল্টোটি হয়নি। 

মানসের এ স্ত্রৈণ স্বভাব নিয়ে বাইরেও যে কানাঘুষো চলবে সেটাই স্বাভাবিক। মানসের এই স্বভাবটি মহিলা মহলে কারোও কাছে অনুকরণীয় হলেও অনেকেই মুখ টিপে হাসাহাসি করে। কিছু পরিশ্রমবিমুখ মহিলাদের কাছে মানস ছিল আদর্শ স্বামী আবার বন্ধু মহল বা অফিসের সহকর্মীদের চোখে মানস হয়ে উঠেছিল এক হাস্যরসের উপাদান। তবে শুধু প্রশংসাটুকুই ঘুরপথে কানে এসে পৌঁছায় মানসের। নিন্দাটুকু নয়। স্তুতিবাদের প্রভাবে এক পরম আত্মতৃপ্তিতে মগ্ন হয়ে থাকে মানস। 

এভাবেই চলছিল দিনতামামি। কাল থেকে এই ঘোর অসুস্থতার ফলে সবকিছু যেন হঠাৎ করে কেমন অগোছালো হয়ে পড়লো সংসারে। নিত্য কাজের খেই খুঁজে পায়না কেউই। এসব নিয়ে কারোও কোনও মাথাব্যথা ছিল না কোনও দিনই। স্ত্রী, পুত্র, কন্যাকে দেখে ভীষণ কষ্ট অনুভব করে মানস। হাত পা নিশপিষ করতে থাকে তার। কিন্তু সব দেখেও বাধ্য হয়ে চুপ থাকে অপারগ মানস। 

এদিক ওদিক তাকিয়েও এক টুকরো ছেঁড়া কাপড় খুঁজে পায়না মানস। মেয়েকে ডাকে। স্পষ্ট অনুভব করে গলার আওয়াজটিও যে আর ঠিকঠাক বেরোচ্ছে না তার। বার কয়েক ডাকাডাকির পর অবশেষে কানে গিয়ে পৌঁছায় মেয়ের। কিন্তু তৎক্ষণাত ছুটে আসার মতো পরিস্থিতি ছিল না তখন। মা-মেয়ে মিলে রোজকার বাংলা সিরিয়ালে পুরোপুরি ডুবে রয়েছিল। সিরিয়ালের ক্লাইম্যাক্স ছেড়ে কী আর সঙ্গে সঙ্গে ছুটে আসা যায়? তাই – ‘আসি’ বলেও বেশ খানিকক্ষণ বাদেই আসে। এসেই সব দেখে থ হয়ে যায়।  আর পরক্ষণেই নাকে মুখে হাতচাপা দিয়ে বলে, ‘তুমি বমি করেছ না বাবা? ইস, কী গন্ধ। আমি পারবো না থাকতে’  বলেই বেরিয়ে যায় এ ঘর থেকে। মুচকি হাসে মানস। পাগলী মেয়ে, এসব দেখেনি কোনও দিন, তাই। ওকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। এবার ঝিমলিকে ডাকে মানস। ইতিমধ্যে মেয়ে গিয়ে রিপোর্ট করে দিয়েছে মা’কে। ঝিমলি দূর থেকে বলে শুনেছি, কাণ্ড যে বাঁধিয়েছ। সানা বলেছে। ন্যাকড়া দিচ্ছি, মুছে নাও। আমি বমির গন্ধ একদম সহ্য করতে পারি না জানোই তো। বলে দরজার বাইরে থেকে এক টুকরো ছেঁড়া কাপড় ফেলে দেয় ভেতরে। 

ইতিমধ্যে আবার তলপেটের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে মানসের। আবার টয়লেটে যেতে হয়। এবার একেবারে পাতলা জলের মতো দাস্ত হয়। না এবার আর ঔষধ না খেলেই নয়। কিন্তু ঔষধ তো নেই ঘরে। এবার চিন্তায় পড়ে যায় মানস। ঔষধ আসবে কী করে ? ছেলে তো একা একা বেরোয়নি কখনো। শুধু ওই ফ্ল্যাটের নিচের রাস্তায় গিয়ে স্কুলের বাসে উঠে পড়া আর বিকেলে আবার একই ঠিকানায় বাসে করেই পৌঁছে যাওয়া। এর বাইরে তো মানস কোনওদিনই যেতে দেয়নি ছেলেকে। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই কোনওক্রমে টয়লেট সেরে ফিরে এসে কাপড় দিয়ে মুছতে থাকে ঘর। এতটা ধকল সইতে পারে না মানস। জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে মেঝেতেই।

খানিক বাদে জ্ঞান ফিরলে আবিষ্কার করে নোংরামাখা নিজেকে। আবারও বলতে গেলে হামাগুড়ি দিয়ে দিয়েই বাথরুমে গিয়ে কোনওক্রমে হাত পা শরীর ধুয়ে মুছে বিছানায় উঠে বসে। শুনতে পায় পাশের রুম থেকে ভেসে আসা হাসির আওয়াজ। ঘড়ির দিকে তাকায় মানস। রাত প্রায় এগারোটা। অর্থাৎ টিভিতে এখন শুরু হয়ে গেছে হাসির সিরিয়াল। খানিক বাদে ছেলেটা রুমের বাইরে এসে দাঁড়ায়। নাকে মুখে রুমাল চাপা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলে, ‘বাবা, মা বলছিল আজ রান্নার সব্জিগুলো কেটে দেবে না? রান্না কখন হবে বাবা ? কখন খাবো?’ মানস ক্ষীণকণ্ঠে ডাকে ছেলেকে। ছেলে বলে, ‘না বাবা তুমি বমি করেছ না? আমি এখন আসবো না। পরে আসবো।‘ অসহায় মানস প্রাণপণে সবাইকে কাছে পেতে চাইছে কিন্তু কাউকে দেখতে পায় না কাছে।

এক অসহায় ক্ষণে মানসের চোখের সামনে ভেসে ওঠে সংসারের টুকরো স্মৃতির কোলাজ। মানসের মন্ত্র ছিল- যাকে তুমি ভালোবাসবে তার সবকিছু ভালোবাসবে। সংসারের তিনটি প্রাণীর জন্য করেনি এমন কোনও কিছু নেই। সাময়িক অসুস্থতায় দৈহিক ও মানসিক ভাবে যা করার সব করে এসেছে সারা জীবন। নিজের কোনও কিছুতে কখনো জড়ায়নি ওদের কষ্ট হবে বলে। জীবনভর শুধু আদর্শ আদর্শ করে, যুগ যুগ ধরে চলে আসা পারিবারিক কাজকর্মের সমবণ্টনের যে ঐতিহ্য তা ভেঙে দিয়ে আজ এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে মস্ত ভুল করে ফেলেছে সে। ভালোবাসার আতিশয্যে কিংবা সামাজিক মাধ্যমের অপরিণামদর্শী পরিবর্তনের আহ্বানে বোকার মতো বেশি ভালো হতে গিয়ে বঞ্চিত হয়ে গেছে নিজেরই কৃতকর্মে। ভালোবাসা বিলিয়ে গেছে একতরফা ভাবেই শুধু। বিনিময়ে ভালোবাসতে শেখায়নি কাউকে। তারই প্রতিদানে আজ এই ঘোর দুর্দিনে কেউ তার কাছে আসছে না। এতদিন ধরে নিজেকে নিজেই সে ব্রাত্য করে রেখেছিল। তার প্রতি অন্যের ভালোবাসার উদ্রেকই সে হতে দেয়নি। পরিবর্তে সবার অন্তরে সবারই অজান্তে সৃষ্টি হয়ে গেছে এক দূরত্ব, এক ঘেন্নার ভাব। নিজের প্রাপ্য অধিকারটুকু নিজেই এভাবে খুইয়ে আজ নিঃস্ব হয়ে গেছে মানস। পরিবারের কাছে, সমাজের কাছে আদর্শ হতে গিয়ে, সংসারে পুরুষ প্রাধান্যের অপবাদ থেকে নিজেকে দূরে রেখে বাহবা কুড়োনোর লক্ষ্যে, ‘পরিবার’ শব্দটির মূল আদর্শ অর্থাৎ পারস্পরিক বন্ধনকেই অবজ্ঞা করে এবার ভুলের খেসারত দিতে উঠে দাঁড়াতে চায় মানস। কিন্তু পারে না। বড্ড দেরি হয়ে গেছে। ঘুরে দাঁড়ানোর পথ এবার রুদ্ধ হয়ে গেছে চিরতরে। শেষ বয়সে আর নতুন অনুভূতির সৃষ্টি হয় না – বুঝতে পারে। আজ সংসারে থেকেও বড় একা হয়ে গেল মানস। 

বাইরে ঝড়ের দাপটে ভেঙে পড়লো একটি নড়বড়ে গাছ।

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত