| 25 এপ্রিল 2024
Categories
ব্রহ্মপুত্র ও বরাকের গল্প

ব্রহ্মপুত্র ও বরাকের গল্প: অন্তর্গত রক্তের ভিতর । মেঘমালা দে মহন্ত

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

এদিক ওদিক তাকিয়ে ব্লাউজের ভেতর থেকে হাড়টাকে বের করে আনে সরসতীয়া। তেল সিঁদুর কাজলের চটচটে হয়ে আছে বুকের বাঁ দিকটা। কাঠফাটা রোদে দুই মাইল হেঁটে টিলার পাড়ের ভাগাড় থেকে হাড়টা তুলে এনেছে সরসতীয়া। বারবার উল্টেপাল্টে দেখে নিশ্চিত হয়ে নিয়েছে  হাড়টা গরুর-ই। সন্ধ্যার পর গা ধুয়ে, কাচা কাপড় পড়ে, সিঁদুর তেল কাজল লেপ্টে হাড়টায়  জড়িয়ে দিয়েছে কুঁড়ির ব্যবহৃত রক্তমাখা ন্যাকড়ার টুকরো। অন্ধকারে সবার চোখের আড়ালে নিয়ে এসেছে বটতলার তেমাথায়।  কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে প্রণাম করে সরসতীয়া সেই  মৃত পশুর হাড়খণ্ডটিকে, 

– হামার কুঁড়িকে  সুখাই দেও…  খুন বন্ধ করে দেও…

তারপর রাতের অন্ধকারে চুপিসারে বটতলার তেমাথায় হাড়টা পুঁতে  দিয়ে সোজা চলে এসেছে ঘরে। পেছন ফিরে তাকায়নি একবারও।  এছাড়া সরসতীয়া বাকতি  জানে না কী করতে হয়,  কিভাবে বন্ধ করতে হয় রক্তপাত। এভাবে কোনো শত্রু ও শত্রুতা করে না।  শত্রু না, ইস্কুল করেছে শত্রুতা।  দিদিমনিরা কেন এমন ডাইনি কাম করছে! মাত্র দু-মাস আগে শরীর খুলেছে কুঁড়ির, কী করে টের পেল ওরা!  কুঁড়িটাই  বলেছে নিশ্চয়ই। সাধসিধা মেয়েটা কী করে জানবে ওদের মতলব?  সরসতীয়াও কি বুঝেছিল কিছু?  কিছুদিন আগে স্কুল থেকে ফিরে খুশিতে উপচে পড়া কুঁড়ি প্যাকেটটা তার হাতে দিয়ে বলেছিল,

–  ন্যাপকিন।  দিদিমণিরা দিল।  মাগনা… 

তারপর প্রায় এক নিঃশ্বাসে মাকে দিদিমণিদের বলা কথাগুলো দাড়ি কমা সহ বুঝিয়ে দিল কেন ‘বাইরে’ হলে কাপড় ব্যবহার না করে ন্যাপকিন লাগানো উচিত, কী করে লাগাতে হবে সব। অস্থির হয়ে উঠেছিল কুঁড়ি মনে মনে তার পরবর্তী ‘বাইরে’ হবার প্রতীক্ষায়।  ন্যাপকিন লাগাবে সে। সরসতীয়া হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখেছিল প্যাকেটটা। কোথায় যেন একটা ইচ্ছে তার মনেও উঁকি দিচ্ছিল। বহু ব্যবহৃত মাসে মাসে ধুয়ে শুকিয়ে রাখা বিবর্ণ মড়া চামড়ার মত শক্ত কাপড়ের টুকরোগুলোর পরিবর্তে এই নরম শুভ্রতার স্পর্শ পরখ করে দেখবে সে নিজেও। 

কিন্তু তিন মাস হলো সরসতীয়ার শরীর জবাব দিয়েছে। 

পেট লাগেনি ঠিক সে জানে।  কারণ  হারামি কুঁড়ির বাপ্টা পালিয়ে যাবার পরও তিনমাস শরীর খুলেছে তার। বুঝতে পারছে না এই শুখা সাময়িক একটা নিয়মের হেরফের না কি চিরতরেই বন্ধ হল।  এই নিয়ে এক অদ্ভুত দোলাচল তার মনে।  নিজেও জানে না ঠিক কী চায় সে।  প্রতিমাসে কয়েকটাদিন অসহ্য-অস্বস্তি থেকে মুক্তির আনন্দ নিয়েও যেন সে অধীর অপেক্ষায় আছে হোক, আবার হোক। সরসতীয়ে আরও কিছুকাল ‘রসবতী’ থাকতে চায়। তাকে আড়ালে ওই নামেই ডাকে সবাই সে জানে।

কুঁড়িকে কিছু বুঝতে না দিয়ে সরসতীয়া জিজ্ঞেস করেছিল, 

– বছরভর দিবে ন্যাপকিন তোর দিদিমণিগুলান? দমে গেছিল একটুখানি মেয়েটা।

সেই প্যাকেটটা এখন ফেলতেও ভয় পাচ্ছে সরসতীয়া।  ছেঁড়া প্যাকেটের খোলা মুখের ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে সাদা সাদা রক্তচোষা দাঁতের মতো  নরম ফোলা ফোলা ন্যাপকিনগুলো। এই মাসে শরীর খোলার পর এই ন্যাপকিন লাগানোর পর থেকেই বন্ধ হচ্ছে না কুঁড়ির অস্বাভাবিক রক্তপাত।  দু মাস আগে যখন প্রথম কুঁড়ির নাইরে হয় রক্ত দেখে ঘাবড়ে গিয়ে মেয়ের কী কান্না!  অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে মেয়েকে শান্ত করেছিল। ভালো করে পাখিপড়া করে বুঝিয়ে দিয়েছিল বড়ো হওয়ার নিয়মকানুনের পাঠ। ঠিক যেমন সরসতীয়াকে বুঝিয়েছিল তার মাই, ঠিক তেমনি কুঁড়িকে বুকে জড়িয়ে বলেছে, 

– ডরাচ্ছিস কেনে মাই, এখনলে মাস মাস এমন হবেক। ঝটপট বড়ো বিটি হয়ে যাবি। শরীর খিলা থাকলে যখন তখন ঘরের বাইরে নাই যাবি। মাস মাস যত বেশিদিন হবেক, শরীল তাজা থাকবেক। বন্ধ হলেই, শুখা পড়লেই বুডঢি।

মেয়ের হাত ধরে কাটিয়ে দিয়েছিল ঘরের আড়াইটা বাঁধন দা এর এক এক কোপে। মেয়ের হাত ধরে দায়ের কোপগুলো  দিতে দিতে দপ করে মাথায় আগুন জ্বলে উঠেছিল হটাৎ। মেয়ের শরীর খোলার নিয়মে ঘরে আড়াই বাঁধন কাটছে সরসতীয়া কিন্তু লুচ্চাটা বউ বাচ্চার সব বাঁধন কেটে পালাল কোথায়! কীসের টানে! হাত নিশপিশ করে সরসতীয়ার দায়ের এক এক কোপে ঘরের সবগুলো বাঁধন কেটে দেবার জন্য।

ভয় পেয়েছিল কুঁড়ি সেদিন মায়ের ওই চেহারা দেখে। বাবা হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে মা-টাও বদলাচ্ছে দিনকে দিন। অমন সুন্দর মায়ের শরীরটা এই ক মাসে নদীর ধারে পড়ে থাকা বাসি মূর্তিগুলোর মতো হয়ে গেল! মায়ের মধ্যেও যে এত রাগ আর গালিগালাজ ভরা ছিল কুঁড়ি কি তা জানত বাবা হারিয়ে যাবার আগে! মায়ের এই অবস্থা করেছে বাবা, কুঁড়ি বোঝে। প্রচন্ড অভিমানে হাজারবার মনেমনে প্রতিজ্ঞা করেছে বাবা ফিরে এলেও কিছুতেই আর সামনে যাবে না সে। প্রথম শরীর খোলার জন্য মায়ের হাত ধরে ঘরের বাঁধন কাটতে কাটতে  মনে মনে স্বস্তি পাচ্ছিল, ভাগ্যিস বাবাটা নেই, না হলে কী লজ্জা হত! ঠিক তখনই মায়ের ওই নীরব ভয়ংকর চেহারায় কুঁড়ি কেঁপে ওঠে আপাদমস্তক। একটা লোমশ কালো বুকের অভাবে কান্না পায় হু হু করে। চিৎকার করে বাবাকে ডেকে, জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হয় ভয়ংকরী মা কে। কান্না গিলতে গিলতে কুঁকড়ে যায় কুঁড়ি। নিজেকে অপরাধী লাগে। এই রক্তপাত… 

কুঁড়ি টের পায় দু’পা বেয়ে নামছে গরম লাভাস্রোত। মাটিতে মায়ের পেতে দেওয়া বিছানায় দু’পা মুড়ে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে পড়ে।  অসহায় কুঁড়ি লজ্জা ঘেন্না ভয়ে কেঁপে ওঠে ঠান্ডায়। পায়ের পাতা থেকে চুলের গোড়া অবধি একটা শিরশিরে কাঁপুনি লাগে গোটা শরীরে। সাহস হয় না হাত বাড়িয়ে কাঁথাটা গায়ে জড়াতে। ঠান্ডায় জমে যেতে যেতে  দু’হাঁটুর অন্ধকারে মুখ গুঁজে কুঁড়ি পা রাখে তপ্ত লাভাস্রোতে।  কী করে এই স্রোত পেরিয়ে পৌঁছবে সে ওই পারে যেখানে সারিসারি সব সবুজ গাছের নীচে রাখা আছে পুজোর দিনের মতো চিকন সুন্দর সব হাসিমুখ মূর্তি। কুঁড়ি ওই মূর্তিগুলোতে মাকে খোঁজে বাবা হারিয়ে যাওয়ার আগের মা। 

– হামার ডর লাগছে মাই… খুব ডর… শীত লাগছে…ঘিস্টা লাগছে মাই… 

হাতের দা টা ছুঁড়ে ফেলে সরসতীয়া দেখে কুঁড়ির বিছানা ভিজে লাল। থরথর করে কাঁপছে মেয়ে। পাশের কাঁথাটা গায়ে জড়িয়ে দিয়ে  সরসতীয়া মেয়েকে বের করে দেয় নিজের ব্যবহার করে ধুয়ে রাখা পুরোনো ন্যাকড়ার টুকরো-

– পুছে লে। ডরাছিস কেনে? সব লড়কির হয় ইরকম।

– তোরও হয়েছিল মাই?

– হঁ তো।

গতমাসে শরীর খোলেনি সরসতীয়ার। শুখা গেছে। এই মাসেও তাই। আর বোধহয় হবেই না। কিন্তু এত জলদি কেন? দু’ কুড়ি বয়সও তো হয়নি এখনও।  ক’ দিন আগে গেছিল সরসতীয়া শীতলা বুড়ির কাছে।  ভয়ংকর চেহারা শীতলার।  মুখে বয়সের ভাঁজ অজস্র, তার মধ্যে তাড়ির নেশায় টকটজে লাল ঢুলুঢুলু দুটো চোখ। প্রায় টাক মাতগায় কয়েকটা খাড়া খাড়া চুল, তামাক টেনে চলেছে দিনভর। অব্যর্থ এই বুড়ির ‘তুক’।  শরীর খোলা, বন্ধ করা, পেট খসানো, বাণ মারা, বশকরা, বেটাবাচ্চা পেটে ধরা, সবকিছুতেই সরসতীয়াদের বুড়িই ভরসা।  তবে মরণকালে এসেও বুড়ির মুখটা খুব কাঁচা।  তাই খুব বিপদে না পড়লে শীতলার আশপাশ মাড়ায় না কেউ। সব শুনে চোখ পিটপিট করে বলেছিল বুড়ি, 

– প্যাট লাগাইছিস নাকি? মরদটা যেন কবে পলাইছিল?

– না রে মাই, উ সব কিছু নাই। কুঁড়ির বাপ যাবার বাদেও তো দুইবার হয়েছিল। বুড়ি হাসে, 

– ক্যানে, হিঁয়া কি দুসরা মরদের কুছু অকাল পড়েছে? সচ্চা কথা  বল রে কসবি, তুয়াকে সব কী ডাকে হামি নাই জানি ভাবেছিস?

দপ করে মাথায় খুন চেপে যায় সরসতীয়ার।  ইচ্ছে করছিল ওই খাড়া খাড়া চুল গুলো মুঠো করে ধরে আচ্ছাসে নাড়িয়ে দেয় কিন্তু সামলে নেয় নিজেকে। গলা চড়িয়ে বলে, 

– তা কেনে নাই জানবি, তোর ব্যাটাগুনাও তো হামাকে রসবতী বলে। ডাকবে নাই কেনে? আছি আমি রসবতী। ধুপধাপ করে পা ফেলে বেরিয়ে আসে সরসতীয়া। শুনতে পায় বুড়ি তারস্বরে গালিগালাজ করছে,

– শাল, খুব তোর গুমোর তোর… খুব রস…  তোর ওই গুমরের চোটেই তো পালাইছে সাধাসিধা মরদটা। এইবার সব শুখাবে। শুখায় শুখায়  মরবি তুই।  

থমকে গেছিল সরসতীয়া। হারামিটা পেট লাগিয়ে পালায়নি ঠিক, ওইটার জন্যই শুখাচ্ছে সে। বাপছাড়া মেয়ে নিয়ে দিশেহারা সরসতীয়া দুশ্চিন্তা আর অপমানের গ্লানিতে ছাই হচ্ছে।  পুড়েছে সে আগেও।    তার শরীরের আগুনে ঝলসে পুড়ে যখন ঢ্যামনা হারামিটা পালাতো তখন অশ্রাব্য গালিগালাজ করত তাকে। গায়ে হাত ও তুলতো। আশ্চর্য, মার খেয়ে একটা দিনও কাঁদেনি সরসতীয়া শুধু চোখদুটো জ্বলে উঠত অন্ধকারে বাঘিনীর মতো। ঢোড়া হারামিটা ভেতর ভেতর বিধ্বস্ত হতো ওই চোখের আগুনে। দিনের প দিন এই একই দৃশ্য ঘটে গেছে জাটিঙ্গার স্যাঁতস্যাঁতে নির্জন পারে অন্ধকার ঝুপড়িতে।জানোয়ারটা সব শোধ নিল এভাবে পালিয়ে গিয়ে।  

একটু আগে ন্যাকড়া দিয়ে মোছা রক্তের আবছা লাল আভা কুড়ির দু’ পায়ে স্পষ্ট। সরসতীয়া একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে সেদিকে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। পায়ের লালিমা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে সরসতীয়ার চোখে। রসবতী লোভাতুর বাঘিনি! যেন  চোখ বন্ধ করলেই বুডঢি। হবেক… হবেক… ফির হবেক। 

জাটিঙ্গা নদীর পাড়ে পাহাড়ের নীচে  জঙ্গল ছুঁইছুঁই ঘর কুঁড়িদের।  ঘর মানে চারিদিকে নুইয়ে পড়া বাঁশঝাড় আর জংলিবেত গাছের আড়ালে ছোট্ট ঝুপড়ি। সারাদিন প্রায় রাতের মতোই অন্ধকার। এখানে বিকেলের কোনো অস্তিত্ব নেই। দুপুর বেলাতেই হটাৎ ঝপ করে অন্ধকার  নামে। বাঁশঝাড়ে আড়াল করে রাখা ছোট্ট ছোট্ট ঝুপড়ির টিমটিম আলো আর দূরে টিলার উপর পঞ্চায়েতের বাড়ির হুকের বড়ো আলো, ঝিঁঝিঁ র ডাক, পাহাড়ি নদীর ছপছপ শব্দ আর মাঝরাতে গুমগুম করে চলা মালগাড়ির আওয়াজ…  পাহাড়ের বুক চিরে  সব দিক কাঁপিয়ে দিয়ে যখন চলে যায় রেলগাড়িটা,  কুঁড়িদের  ঝুপড়ির সঙ্গে তিরতির কাঁপে ক্যঁড়ির ছোট্ট বুকটাও। নদীর ওই পারে চা বাগান, যেখানে কয়েকমাস আগেও কাজ করত তার বাবা। ধুর! বাবার কথা মনে পড়লেই চোখ ঝাপসা, বুক ব্যথা। রেলগাড়িটা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে হয় লাইন থেকে। 

রাতের জলভেজা ভাত এক সানকিতে ভাগ করে খায় মা মেয়ে। বাপের একটা আলাদা সানকি ছিল। কয়েকদিন আগে কুঁড়ি উপুড় করে রাখা সানকিটা  তুলে দেখেছে নীচে উইপোকা মাটি তুলেছে। যেমন ছিল তেমনি রেখে দিয়েছে আবার। সকালে ওই ভেজা ভাত খাওয়া শেষে কুড়িয়ে হাঁটে স্কুলের পথে। সরসতীয়া দুচোখ ভরে দেখে মেয়ের স্কুল পোশাক পরে সরকারি ব্যাগ পিঠে ঝুলিয়ে হেঁটে যাওয়া। তারপর নিজে হারিয়ে যায় জংলি কলা থোড় শাক রেমার সন্ধানে গভীর জঙ্গলের অন্ধকারে।  

আজ সাতদিন ওরা দুজন কেউ কোথাও যায় নি।  কুঁড়ির খুন বন্ধ হচ্ছে না কিছুতেই। 

শরীর খোলার ভয়টা বেশ কেটে গেছিল কুড়ির গত দু মাসে। স্কুল থেকে ন্যাপকিনের প্যাকেটটা পাওয়ার পর তো অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিল কবে আবার ‘বাইরে’ হবে। কুঁড়িদের স্যাঁতস্যাঁতে অন্ধকার ছোট্ট ঝুপড়িতে চকচকে ন্যাপকিনের প্যাকেটটা যেন এক টুকরো অন্যজীবনের আলো। যে আলোর স্পর্শে কটা দিনের ভয়াবহ লাল অস্বস্তিকে পরাজিত করতে চায় কুঁড়ি। কুঁড়ির মা সরসতীয়ার মনেও গোপনে লালিত  সেই একই সাধ।  কিন্তু গত দু মাস সরসতীয়া বুডঢি হবার পথ ধরেছে। আশা ছাড়েনি অবশ্য সে।  সরকারি হাসপাতালের নার্স দিদি সব শুনে বলেছে চিন্তা আর পরিশ্রমে শুখাচ্ছে সরসতীয়া। চিন্তা ছেড়ে খানাপিনা ঠিক করলে আবার হবে। ক’ টা বড়ি দিয়েছ, রক্ত বাড়বে শরীরে। নিয়ম করে বড়িগুলো খায় সরসতীয়া। তেজ বাড়বে, খুন বাড়বে দেহে। সরসতীয়া আবার রসবতী হবে।

কুঁড়ির মা যখন প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে শরীর খোলার, তখনই রক্ত ঝরে ঝরে শুকিয়ে যাচ্ছে কুঁড়ি। এবারে কুঁড়ির তিন নম্বর ‘বাইরে’ ছিল।  সাতদিন পার হতে চলল থামার কোনো ইশারা নেই। অসহায় একটা রাগে দিনরাত জ্বলছে সরসতীয়া।  দুনিয়াটাই স্বার্থপর। দুঃখের দিনে সব হাওয়া। কুঁড়ির বাপ পলায়ছে, কুঁড়ির খুন ঝরা থামছে না। শীতলা বুড়ির বদনাম, নিজে শুখা পড়ছে, কোনটা সামলাবে! ভেবে ভেবে কূল পায় না। ঝাড়ফুঁক টোটকা সবই তো করেছে সাধ্যমতো। আজও কিছুক্ষণ আগে পুঁতে দিয়ে এসেছে ভাগাড়ের গরুর হাড়টা। কিন্তু এসবেও যেন আজকাল আর ঠিক আস্থা রাখতে পারে  না সরসতীয়া। ‘রসবতী শুখা পড়েনি’ প্রাণপণে এই বিশ্বাস আঁকড়ে ধরে সবই ত করছে। কিন্তু লাভ হয়নি। বুঝেছে সরসতীয়া কোনো টোটকা তাবিজই পারে না শরীর খুলতে বা বন্ধ করতে৷ সরসতীয়া নিজের পারল, না কুঁড়ির পারল? 

সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে অনেক্ষণ। ঘরে কুপি জ্বলছে টিমটিম করে। কুঁড়ি দেখে মায়ের ক্লান্ত চোখে টানা কজল ধেবড়ে আছে, ঘাম চিকচিক করছে সারা মুখে। বিকেলের টানটান করে বাঁধা চুল বিশৃঙখল লেপটে আছে কপালে। ইদানিং মা খুব যত্ন করে সাজে, কুঁড়ি লক্ষ করেছে।  ভাঙা আয়নায় কতবার মুখ দেখে, শাড়ি পরে টানটান করে। মা টা তার কত সুন্দর ছিল! শুধু বাবা চলে যাওয়ার পর কখন যে এমন হয়ে গেল। মায়ের জন্য খুব কষ্ট হয় কুঁড়ির। মা জানে না, কুঁড়ি শোনেনি মায়ের কথা। মা যতই বলুক স্কুলের দিদিমণিদের ন্যাপকিন লাগিয়েই বন্ধ হচ্ছে না কুঁড়ির খুন। সে কিছুতেই মানতে পারে না এসব কথা।  কুঁড়ি এখনও পরে আছে সাদা নরম শুভ্রতা। যেন লাল সাদার এক অসহ্য লড়াইয়ে সাদাকে জেতাতে মরিয়া কুঁড়ি। 

সরসতীয়া জানে কুঁড়ি এখনও বিশ্বাস করে না এটা দিদিমণিদের কাম। দিমাগ চাটে খায়েছে লড়কিটার। তার উপর নয়া উৎপাত পঞ্চায়েতের বাড়ির টিভি। ওইখনেই কীসব ছেন্দা কথা দেখে দেখে আরও মাথাটা বিগড়ায়ছে। সরসতীয়া যিত বোঝানোর চেষ্টা করেছে, 

– উ সব গলত বাত টিভির লোকগিলানের। উয়াদের মতলব খালি কচি মেয়েগিলানকে মেমসাহেব বানিয়ে জিনিস বেচবে। ন্যাপকিন বেচার ধান্দা। কিচ্ছু বোঝেনি কুঁড়ি। মা কে জোর করে নিয়ে গেছিল পঞ্চায়েতের বাড়ি টিভি দেখাতে। যে ন্যাপকিন কুঁড়ির আছে সেই ন্যাপকিন টিভিতেও দেখায়। কী আশ্চর্যের ঘটনা কুঁড়ির কাছে। কী শরমের বাত! কাকা কাকির সামনে বসে টিভিতে ওইসব দেখবে! ইস! জোয়ান কসবি মেয়েগুলান…  কেমন হাসি হাসি মুখে ন্যাপকিনে কালি ঢেলে শুখা থাকার আরাম বোঝায়! ছিঃ! 

কুঁড়ি মা কে চিমটি কেটে ইসারা করেছিল। লজ্জায় ঘেমে যাচ্ছিল সরসতীয়া। কাকাও জোরে জোরে হুঁকা টেনে কাশি মারছিল। এই টিভি দেখে দেখেই বদলাচ্ছে কুঁড়িটা, বাবুয়ানা বাড়ছে। মাঝেমাঝেই মাকে চোখ পাকিয়ে শাসনও করে। সেদিন কেমন আঙুল তুলে বলিছিল, 

– মাই,  কথায় কথায় কসবি নাই বলবি।দিদিমণিরা বলেছে উটা ভালো বাত নাই লাগে। গালি কেনে দিবি বিনা কারণ লে? অবাক হয়ে গেছিল সরসতীয়া। কসবি গালি! ই তো বুলি লাগে!  আজ কসবি গালি বলছিস, কাল বিটি  বললে গালি বলবি। তবু মনে নিয়েছে মেয়ের কথা,।  চেষ্টা করেছে সরসতীয়া  তারপর থেকে  ওই শব্দ উচ্চারণ  না করতে। 

– মাই….

– হুঁ

– চিন্তা করিস না, শুখা পড়ে যাব আমি।  কমে যাবে। 

– কেমনে বলছিস? 

— মন ডাকছে। ভাগাড়ের হাড় পুঁতে আইলি না? 

-হুঁ, দিয়ে তো আসেছি। ন্যাপকিন লাগাছিস নাই তো? উ ন্যাপকিনই শুখাতে নাই দিচ্ছে তোকে। ন্যাপকিন দিচ্ছে না শুখাতে! ন্যাপকিন! নিজের বুচ্চারণে নিজেই চমকে ওঠে সিরসতীয়া। ন্যাপকিন! শরীর খুলা রাখে ন্যাপকিন!

ধ্যাবড়ানো কাজল চোখে লাগে হাজার তারার চমক। শরীর থেকে লাল রজত চুষে খায় ওই সাদা সাদা নরম ফালিগুলো। কুঁড়িটাকে চুষে চুষে এই ক’দিনে সাদা করে দিয়েছে। রক্ত বন্ধ হলেই হাসপাতালের ওই বড়িগুলো খাওয়াতে হবে কুড়িকেও। আরও বহুদিন শরীরে খুন রাখতে হবে মা বিটি দুজনকেই। কিন্তু আপাতত ওই রক্তচোষা ন্যাপকিনের শুভ্র স্পর্শ  চাই সরসতীয়ার। কুঁড়ি ঘুমিয়ে গেছে অনেক্ষন হল।মেয়ের হাতটা বুকের উপর থেকে নামিয়ে আস্তে আস্তে উঠে আসে সরসতীয়া। হালকা হয়ে যাওয়া বাঁশের বেড়ার ফাঁক গলে ঠান্ডা হাওয়া আসছে। শীত শীত লাগছে কুঁড়ির। মেঘ ডাকছে জোর।  হাত বাড়িয়ে মা কে জড়িয়ে ধরতে যায় কুঁড়ি – মা নেই বিছানায়। আধোঘুম পুরোপুরি ছুটে যাওয়ার আগে বিদ্যুৎ চমকে মাকে এক ঝলক দেখে কুঁড়ি। ঘরের কোনে ন্যাপকিনের প্যাকেট হাতে মা- ন্যাপকিন পরছে। ডাকতে গিয়েও নিজেকে সামলে নেয় কুঁড়ি। চোখ বন্ধ করে পাশ ফিরে শোয়। 

ভোরবেলা অসময়ে রেলগাড়ির শব্দে ঘুম ভেঙ্এ যায় কুঁড়ির। বৃষ্টি নেমেছে জোর। ঘরময় একটা ঠান্ডা সোঁদা গন্ধ।  কুঁড়ি ভয়ে ভয়ে হাত দিয়ে বোঝার চেষ্টা করে ঠিক কতটুকু রক্তে ভিজে আছে তার উরু, দুই পা। গতকাল রাতের পরা ন্যাপকিনটা থেকে একটা অসম্ভব ভালোলাগার স্বস্তি ছড়িয়ে পড়ে কুঁড়ির দু’হাত বেয়ে সমস্ত শরীরে। দু’হাতে মায়ের গলা জড়িয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে করে বলে, 

-মাই 

– উঁ

– মাই আমি রাতভর শুখা পড়েছি… 

হালকা হাসি ফোটে সরসতীয়ার মুখে। মা কে খুব সুন্দর লাগে কুঁড়ির। সেই বাবা চলে যাওয়ার আগের মতো সুন্দর। আধোঘুমে সরসতীয়া টের পায় ভাঙা বেড়ার ফাঁক গলে  আসছে বৃষ্টির ছাট। হাত বাড়িয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে মেয়েকে। শুকনো আছে কুঁড়ি।  কিন্তু ভিজে যাচ্ছে সরসতীয়া। বহুদিন পর সরসতীয়া ভিজছে…

সরসতীয়া আবার রসবতী হবে।

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত