| 20 এপ্রিল 2024
Categories
এই দিনে কবিতা সাহিত্য

ব্রত রায়ের ছড়া

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

আজ ২১ জানুয়ারি ছড়াকার ব্রত রায়ের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।


 

যাচ্ছেতাই

দিদি বলেন, “লেখা পাঠাও
হোক না সেটা যাচ্ছেতাই”
অমন লেখা লিখব আমি?
প্রচণ্ড ভয় পাচ্ছে তাই!
একটুখানি বেচাল হব –
নেই তো মোটেই তাহার যো
সবুজরঙা বিশুদ্ধ ঘাস
আমার প্রধান আহার্য!

খাই সেটা রোজ তিনবেলা ভাই
গব্য খাঁটি ঘিসুদ্ধ
সবাই বলে, আমার লেখা
শাস্ত্রমতে বিশুদ্ধ!

লেখার যত নিয়ম আছে
মানব সবই অক্ষরে
দেই না সুযোগ একটা ফোঁটাও
আমার প্রতিপক্ষরে!

এই কথাটাও ভাবছি সাথে
এ ভাবনাটাও যথার্থ
এর ভেতরে একটা ছোট
ফাঁক রয়েছে কথার তো!

দিদির কথায় লিখব? ভেবে –
পুড়ছি মনের অঙ্গারে
অমন হলে বদলে যাবে
যাচ্ছেতাই-এর সংজ্ঞা রে!
যা ইচ্ছে তাই – ইচ্ছেটা তো
লিখছে যে তার একান্ত

পরের কথায় লিখলে সেটা
হয় কী করে দেখান তো?
দিদির, ভাইয়ের ইচ্ছেনদী
এক মোহনায় মিললে কি –
ভয় থাকে আর? সমস্যাটার –

যায় না হয়ে হিল্লে কি?

 

পানিপথ

মর্তুজা স্যার পড়াচ্ছিলেন

এই তো সেদিন ক্লাসে
পানিপথের যুদ্ধ কেন
অমর ইতিহাসে।

করতে পরখ ছাত্রগণের
ইতিহাসের জ্ঞান
প্রশ্ন করেন, ‘পানিপথের
যুদ্ধ হল ক্যান –

কেউ কি জানিস?’ কারোর মুখে
আর সরে না বাত
অবাক হলাম যখন দেখি
আবুল তোলে হাত।

‘ডাঙায় যখন যুদ্ধ করায়
থাকবে অসুবিধা
পানি পথেই যুদ্ধ হবে –
ব্যাপার সাদাসিধা!’

স্যার হেসে কন, ‘ডোবাস নে আর
স্কুলের মানইজ্জত
এবার তোরা বল দেখি কেউ
কোথায় পানিপথ?’

আবুল মিয়া হাত তুলে ফের
স্যারের দিকে তাকায়,
‘এইটা হল’, আবুল বলে,
‘চাটগাঁতে বা ঢাকায়!

বাড়ি ডুবে যায়

বাড়িটি বোধ হয় তৈরি হয়েছে
গৌরী সেনের টাকায়
লোকালয় থেকে একটু দূরেই —
নদীর কিনারে, ফাঁকায়!

দুর্গতদের আশ্রয় হবে,
ইস্কুলও হবে এতে
মানুষ আসবে বিপদের দিনে
বাঁচার সুবিধা পেতে।

ক‘দিন বাদেই চালু হয়ে যাবে
সকলেরই ছিল আশা
আড়াই কোটির বাড়িটিতে হবে
অনেক আশার বাসা।

দুর্গতদের আশ্রয় আজ

দুর্গত হলো নিজে
বাড়িটি গিয়েছে নদীর গর্ভে
চক্ষু গিয়েছে ভিজে।

 

আত্মীয়রা

আত্মীয় আর স্বজন যত
সবাই থাকেন ঢাকাতে
হয় দেখা কই? কী লাভ তবে
এক শহরে থাকাতে?

লালমাটিয়ায় দাদুর বাসা
নানির বাসা বনানী
ফোন করে কন, ‘আসবি কি কাল?’
মুখেই বলি, ‘হ, নানি!’

বাস্তবে আর হয় না যাওয়া
ট্র্যাফিক জ্যামের কারণে
ত্রিশ মিনিটের রাস্তা যেতে
ঘণ্টা দেড়েক আরো নেয়!

ভাইয়া থাকেন সূত্রাপুরে
আজমপুরে শ্যালিকা
যাই না কেন বললে বলি,
‘অত্ত দূরে গেলি ক্যা?’

রূপনগরে বড়পা’ থাকেন
ভাগ্নি থাকে পলাশী
আমার বাসা বসুন্ধরায়
‘কেমন করে বল আসি?’

মগবাজারে চাচার বাসা
শ্বশুরবাড়ি গোড়ানে
জ্যামের কথায় দুইটি চোখে
একটা কেমন ঘোর আনে!

খালার বাসা ইন্দিরা রোড
ফুপুর নিবাস বাসাবো
কোন্ ভরসায় জ্যামসাগরে
নৌকা আমার ভাসাবো?

খিলজি রোডে ফ্ল্যাট কিনেছেন
ভায়রা আমার সেদিনই
নতুন ফ্ল্যাটে নেবেন বলে
করেন বড়োই জেদ ইনি!

কাজিনরা কেউ উত্তরা, কেউ
কাঁঠালবাগান, ওয়ারী
যাই না কোথাও যতই ভাবুক
আনসোশ্যাল আর গোঁয়ারই!

 

শয়তানের আড্ডাখানা

এই যে নারীরা ‘শপিং শপিং‘ করিয়া পাগলপারা
বাঁচিতে পারে না একটা দিবসও যাহারা শপিং ছাড়া
এই মার্কেট, ওই মার্কেট ছুটিয়া ছুটিয়া মরে
ফিরিয়া বাসায় অনলাইনেও আবার শপিং করে

মূর্খ নারীরা, তোমরা কি জানো, মার্কেট আর মলে —
শয়তান থাকে? কোরআন–কেতাব এমন কথাই বলে।
মার্কেটে গিয়ে ভুলে যাও তুমি আল্লাহ্–খোদার নাম
মিথ্যা এবং প্রবঞ্চনায় ভুলে থাকো অবিরাম!

বাঁচিতে কি চাও জাহান্নামের লেলিহান শিখা হতে?
ভাসিয়া যেও না শপিংয়ের নামে গড্ডালিকার স্রোতে।
বসুন্ধরায়, ফিউচার পার্ক, গাউছিয়া, মৌচাকে —
যেখানেই যাও আল্লাহর নাম যেন অন্তরে থাকে!

শাড়ি, লেহেঙ্গা, চুড়িদার কেনো, কেনো পায়জামা, লেগিং
ডিজাইন দেখো, দরদাম করো — ইবাদত–বন্দেগি —
চলুক সঙ্গে। শয়তান যেন নাহি ভুলাইতে পারে
মার্কেট হলো আড্ডা তাহার — উঠিয়া পড়িলে ঘাড়ে

কী উপায় হবে? পুরুষ, তুমিও দিও না নারীরে টাকা
তোমারই উচিত তাহারে ঘরের ভেতরে আটকে রাখা।
জাহান্নামের আগুন হইতে তবেই বাঁচিবে জানি
পকেটের টাকা পকেটে থাকিবে, হইবে না টানাটানি।

 

একজন সাধারণ পাঠকের জবানবন্দি

আমি একজন ‘নর্মাল’ লোক
ফেসবুকে রোজ আসি
কান্নার কিছু দেখলে কান্দি,
হাসির পোস্টে হাসি।

রাগের–ক্ষোভের পোস্টে আবার
দিচ্ছি রাগের ইমো
আর সবটায় লাইক মেরে যাই—
পিক বা ভিডিও। মিমও!

আমার লিস্টে হাজারখানেক
আছে ছড়াকার–কবি
এছাড়াও আছে মানুষ যাদের
ছন্দ মেলানো হবি।

একদিনে পাই নিদেনপক্ষে
হাজার দু’য়েক ল্যাখা
পড়তে পড়তে চোখ ব্যথা করে,
কোমর হচ্ছে ব্যাঁকা!

মাথার ভেতর টনটন করে,
লক হয়ে যায় ঘাড়ে
কিন্তু এতেও লাভবান হই—
ধৈর্য–সহ্য বাড়ে!

কেউ বা আছেন (ব্রত রায়) যিনি
দিনে দেন চারখানা
আমার ধারণা তার আছে ছড়া
বানানোর কারখানা!

এতকিছু করি তারপরও দেখি
কবিরা করেন রাগ
লাইক দেই নাই তার কবিতায়?
রেগে কন, ‘তুই ভাগ!’

তাহার লিস্টে নিজেরে তো আমি
খুঁজিয়া পাই না আর
মনে মনে করি আল্লার কাছে
শুকরিয়া বারবার।

 

বলিউড যদি না থাকত

বলিউড যদি না থাকত তবে
কী রকম হত বলো?
লক্ষ বাঙালি মুষড়ে পড়ত
আঁখি হত ছলোছলো।

আনন্‌দবাজার পত্রিকা তবে
বন্ধই হত বুঝি
প্রথম আলোরও স্বাস্থ্য কমত —
বলছি তা সোজাসুজি।

কালের কণ্ঠ ছাপা হত কিনা
সন্দেহ রয়ে গেছে
দেখতাম কত ফালতু চ্যানেল
বাজারে পটল বেচে।

দাদাগিরি আর সারেগামাপা–র
জন্মই হত না তো
ড্যান্স বাংলা বা রচনাদিদির
জুটত না পেটে ভাতও!

‘ইত্যাদি‘তেও শোনা যাইত না
তুতুতু তুতুতু তারা
নকল মুভিও তৈরি হত না
দেশি নির্মাতা দ্বারা।

আর কিছু হোক কিংবা না হোক
বাঙালির ঘরে কোনও
জন্ম হত না প্রের্‌ণা, দীক্‌ষা,
লক্‌ষমী নামের বোনও!

বাঙালি তাহার নিজের ভাষাটি
বলিতে পারিত ভালো
এই ছড়া লিখে ব্রত রায় তার
মুখ করিত না কালো।

 

কিংকর্তব্যবিমূঢ়

বোর্ডে লিখেই শব্দটা স্যার
বললেন, ‘মানে কী জানো?’
পুরো ক্লাস চুপ। আমিও নীরব।
চুপ ফার্স্টবয় মিজানও।

পড়তে গিয়েই দাঁত ভেঙে যায়
কিং..কর..কর..বিমুঢ়
আমার মতোই নাজেহাল দশা
মেধাবী ছাত্রী শিমুরও!

স্যার আমাকেই দাঁড় করালেন
পড়লাম কী যে ফাঁপরে
স্যার বদরাগী। ধরলেই জানি
দাগ লেগে যাবে কাপড়ে!

‘কী বলব আর কী করব, স্যার,
পাচ্ছি না ভেবে কিনারা‘,
যেই বললাম হাসল সবাই —
বিলু, মোখলেস, মিনারা।

স্যার বললেন, ‘সঠিক জবাব!
হলাম ভীষণ খুশি তো!’
সেদিন থেকেই আমিও হলাম
‘মেধাবী‘ খেতাবে ভূষিত!

 

গামছা

বৃষ্টি পড়ছে টাপুর টুপুর। লুঙ্গি পরেছি আমি
যাচ্ছি পুকুরে ডুব দিতে? না না৷ আমি তো অফিসগামী।
ভাগ্যিস কোন ছোট্টোবেলায় সাঁতার নিয়েছি শিখে
সুইমিং যারা পারে তাহাদের চাহিদা তো চারিদিকে।

চাকরি করবে কুরিয়ারে? পিজা–বার্গার ডেলিভারি?
এইসব জবে সুইমিং জানা দাদা কম্পালসারি!
শুক্রাবাদের খাল থেকে শুরু, ধানমন্ডির নদী
কী করে পেরোই—সাঁতার কাটিতে নাই শিখি আমি যদি?

একডুবে যাই শান্তিনগরে, একডুবে তোপখানা
ডুবেছে মাথার কেশরাশি আর ডুবে যায় গোঁফখানা।
এক ডুবে যাই তেজগাঁও আমি, আবার আগারগাঁও
হঠাৎ শুনছি কে বলে আমায়, ‘এদিকে কোথায় যাও?’

তাকিয়ে দেখছি, পরিচিত লোক। তাকসিম স্যার তিনি।
জুসের সুবাদে ঢাকাবাসী আজ তাহার নিকট ঋণী।
সাঁতারে ব্যস্ত তিনিও আজকে। সাঁতার কাটা তো ভালো
‘কী ব্যাপার স্যার? বিস্তারে কন মুখখানা কেন কালো?’

স্যার বললেন, ‘গামছা আনিনি, করেছি বিরাট ভুল‘
‘আমারও লাগবে‘ — পশ্চাৎ থেকে বললেন আতিকুল।
গামছা দিলাম। লুঙ্গির রঙ আছিল আমার সাদা
কালো হলো কেন? মুরুব্বিগণ, মেলাবে কে এই ধাঁধা?

 

আমাদের ছোট গলি
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমাদের ছোট নদী অবলম্বনে)

আমাদের ছোট গলি চলে আঁকে বাঁকে
বৃষ্টির দিনে তার হাঁটুজল থাকে।
কোনোমতে পার হয়ে যায় নরনারী
কপাল খারাপ হলে ফেঁসে যায় গাড়ি!

সুয়ারেজ থেকে আসা দ্রব্যাদি ভাসে
মেরামতি শুরু হয় বর্ষার মাসে।
মেরামত হয়ে গেছে। এইবার গুরু–
ফের নয়া উদ্যমে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু!

এই বসে পানি, এই সুয়ারেজ পাইপ
তিনমাসে শেষ হয় রাস্তার লাইফ!
আমাদের ছোট গলি বড় বড় ঘর
আমাদের পেরেশানি সারা বৎসর!

 

মুড খারাপ করে দিল

সকাল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে
উদাস হচ্ছে মনটা
আবুল ভাবছে শুনবে সে গান —
পারফেক্ট হবে কোনটা?

নজরুল, নাকি রবীন্দ্রনাথ?
‘ছায়াবীথি তলে’ চলছে
কদমের বনে নবধারা জলে
স্নান করি এসো—বলছে!

আবুলের হাতে ধূমায়িত কফি
বৃষ্টি লাগে না মন্দ
আজ সারাদিন বৃষ্টিবিলাস
অফিস–টফিস বন্ধ!

ফ্রিজে রাখা আছে গোরুর মাংস,
রয়েছে ইলিশ আস্ত
খিচুড়িই হোক—ডায়েট বাতিল,
বাড়ুক না হয় স্বাস্থ্য!

‘কোক নিয়ে এসো’ পুত্র বলেছে,
‘স্প্রাইট’ বলেছে কন্যা
টিভিতে নাটক—নাটকের নিচে
ছোট্ট খবর ‘বন্যা’!

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত