তুরস্ক সরকার সম্প্রতি বৃক্ষরোপণের দিনকে জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করেছেন। এই ঘোষণার একটা পটভূমি আছে। এনেস শাহিন নামে এক তুর্কি নাগরিক টুইটারের মাধ্যমে প্রথমে এই প্রশ্ন তুলেছিলেন। তাঁর দাবি ছিল আগামী প্রজন্মের জন্য চাই সবুজ তুরস্ক। সেজন্য সরকার বৃক্ষরোপণের দিনটিকে জাতীয় ছুটি হিসেবে ঘোষণা করুন । ছুটি মানে হেসে-ফেলে দিন কাটানো নয়, নয় নিছক অবসর বিনোদন। ওই দিন তুরস্কের ৮২ মিলিয়ন নাগরিক অংশগ্রহণ করবেন বৃক্ষরোপণে। শাহিনের এই আবেদনে বিপুল সাড়া পাওয়া যায়। সেখানকার প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়েপ এরদোগান এই সঙ্গত দাবি মেনে নেন এবং বৃক্ষরোপণকে জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
মানুষের অবিবেচনায়, মূঢ়তায় বসুন্ধরা আজ মুমূর্ষু । সবুজ পৃথিবীর নাভিশ্বাস উঠছে। শিল্পবিপ্লব ও নগরায়ণের তাগিদে যখন নির্বিচারে বৃক্ষ ও অরণ্য ছেদন শুরু হয়েছিল তখন ইংরেজ রোমান্টিক কবিরা প্রতিবাদ করেছিলেন। কেউ গুরুত্ব দেয় নি তাকে। উড়িয়ে দিয়েছিল কল্পনাবিলাসী কবিদের খেয়াল বলে। বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে প্রকৃতির প্রতিশোধে আতঙ্কিত হয়ে উঠল মানুষ। বিশ্ব উষ্ণায়ন, জলবায়ুর পরিবর্তন, খরা-বন্যার প্রকোপ বিভীষিকা বিস্তার করতে লাগল চারদিকে।
আমাদের, ভারতবাসীদের চেতনায় এ সত্য ধরা পড়া উচিত ছিল। আমাদের প্রাচীন শাস্ত্রে, মহাকাব্যগুলিতে বৃক্ষ ও অরণ্যের গুরুত্ব পর্যালোচনা করা উচিত ছিল আমাদের। বৃক্ষশোভিত অরণ্য প্রাচীন ভারতীয়দের বিশেষ শক্তি দান করেছিল। এর থেকেই নিঃসৃত হয় সভ্যতার এক বিশেষ ধারা। তপোবনে মানুষ, বৃক্ষ ও বন্যপ্রাণী পরম সৌহার্দ্যে বসবাস করত। ভারতবর্ষে বৈদিক ও বৌদ্ধ উভয় যুগে অরণ্য ছিল মানুষের ধাত্রী।
রামায়ণে দেখি বৃক্ষ ও অরণ্যের সঙ্গে মানুষের সেই সৌহার্দ্য। দণ্ডকারণ্য, চিত্রকূট, পঞ্ববটী-যখন যে অরণ্যে বাস করেছেন রাম-সীতা তখন সেখাকার বন ও বন্যপ্রাণীদের সঙ্গে মিত্রতাবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। গাছের প্রাণময় সত্তা সম্পর্কে তখনকার মানুষ যে সচেতন ছিলেন তার প্রমাণ পাই সীতার একটি উক্তিতে। অপহৃতা হবার সময় তিনি পঞ্চবটীর গাছপালার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেছেন। মহাভারতের অনুশাসন পর্বের ৫৮তম অধ্যায়ে ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বৃক্ষরোপণের সুফলের কথা বলেছেন—‘বৃক্ষরোপণ করা মানবগণের অবশ্য কর্তব্য। তাহারা ধর্মানুসারে রোপণকর্তার পুত্রস্বরূপ।’ বরাহপুরাণে বৃক্ষরোপণের সুফলের কথা বলা হয়েছে, বলা হয়েছে উদ্ভিদাদি রোপণ ও পরিচর্যা করলে ভূমিদান ও গোদানের সমতুল্য পুণ্য অর্জিত হয়। ব্রহ্মনারদীয় পুরাণে বলা হয়েছে যদি কোন দরিদ্র মানুষ একটি মাত্র গাছ লাগান, তবে তিনি ব্রহ্মসদনে যাবার অধিকার অর্জন করবেন।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে অরণ্যের আধিকারিককে কূপাধ্যক্ষ বলা হয়েছে। তাঁর উপর অরণ্য ও অরণ্যসম্পদ রক্ষার দায়িত্ব। কেউ অরণ্য সম্পদ ক্ষতি করলে শাস্তিবিধান করা হত। মনুস্মৃতিতেও এরকম বিধানের উল্লেখ আছে। ফলবতী বৃক্ষছেদনে শাস্তির কথা মনুস্মৃতিতেও উল্লিখিত। কালিদাসের রচনা্য বিশেষ করে অভিজ্ঞানশকুন্তলমে গাছপালার সঙ্গে মানুষের নিবিড় সৌহার্দ্যের ছবি ফুটে উঠেছে। সম্রাট অশোকের অনুশাসনেও প্রাকৃতিক সম্পদের সুরক্ষার কথা আছে।
আমাদের ঐতিহ্যে আছেন অমৃতাদেবী। চিপকো আন্দোলনের বহু আগে নিরক্ষর এই নারী গাছের জন্য আত্মবিসর্জন দিয়েছিলেন। যোধপুরের মহারাজার নির্দেশে যখন তাঁর কর্মচারীরা গাছ কাটতে এসেছিলেন, তখন দুই কন্যাকে নিয়ে গাছ আঁকড়ে অটল হয়েছিলেন তিনি। কুঠার তাঁদের দ্বিখণ্ডিত করে। এরই অনুপ্রেরণায় ১৯৭০ সালের চিপকো আন্দোলন। সুন্দরলাল বহুগুনার নেতৃত্বে। চিপকো কথাটার অর্থ আলিঙ্গন । এই আন্দোলনে ছিলেন সুবেদার দেবী, বাচ্চিনী দেবী, চণ্ডীপ্রসাদ ভট্টাচার্য, গোবিন্দ সিং বাওয়াত, ধূম সিং নেজি প্রভৃতি।
আমাদের ঐতিহ্য রবীন্দ্রনাথও। ১৯২৫ সালে শান্তিনিকেতনের পূর্বাঞ্চলে পঞ্চবটীতে তাঁর জন্মোৎসব উপলক্ষে প্রথম বৃক্ষরোপণ হয়। তারপর ১৯২৮ সাল। বাংলা ১৩৩৫ সালের ৩০শে আষাঢ়। শান্তিনিকেতনে বিধিবদ্ধভাবে বৃক্ষরোপণের সূচনা। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভাষণে বললেন, “ সৃষ্টির প্রথম পর্বে পৃথিবী ছিল পাষাণী, বন্ধ্যা। জীবনের প্রতি তার করুণার কোন লক্ষণ সে দিন প্রকাশ পায় নি। চারদিকে অগ্ন্যুদগীরণ চলছিল, পৃথিবী ছিল ভূমিকম্পে প্রকম্পিত। এমন সময়ে কোন সুযোগে বনলক্ষ্মী তাঁর দূতগুলিকে প্রেরণ করলেন পৃথিবীর এই অঙ্গনে। চারিদিকে তার তৃণশষ্পের অঞ্ভল বিস্তৃত হল, নগ্ন পৃথিবীর লজ্জা রক্ষা হল। ক্রমে ক্রমে এল তরুলতা প্রাণের আতিথ্য গ্রহণ করে। তখনও জীবের আগমন হয় নি, তরুলতা জীবের আতিথ্যের প্রয়োজনে প্রবৃত্ত হয়ে তার ক্ষুধার জন্য এনেছিল অন্ন, বাসের জন্য দিয়েছিল ছায়া।”
যে পঞ্চভূত থেকে গাছ খাদ্য গ্রহণ করে সেই ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম সম্পর্কে ৫টি খণ্ড কবিতা লিখলেন রবীন্দ্রনাথ। আরও পরে প্রকাশিত হল তাঁর ‘বনবাণী’ । কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় লিখলেন, “ আমার ঘরের আশপাশে আমার যেসব বোবাবন্ধু আলোর প্রেমে মত্ত হয়ে আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে আছে, তাদের ডাক আমার মনের মধ্যে পৌঁছাল। তাদের ভাষা, তার ইশারা গিয়ে পৌঁছায় প্রাণের প্রথমতম স্তরে; হাজার বছরের ভুলে যাওয়া ইতিহাসকে নাড়া দেয়। মনের মধ্যে যে সাড়া ওঠে সেও ওই গাছের ভাষায়—তার কোন স্পষ্ট মানে নেই, অথচ তার মধ্যে যুগযুগান্তর গুনগুনিয়ে ওঠে ।” ‘বৃক্ষবন্দনা’ কবিতায় তিনি গাছকে বললেন ‘আদিপ্রাণ’। তাঁর কবিদৃষ্টি জগদীশচন্দ্রের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টির সঙ্গে মিলে গেল।
আজ আবার পরম দুর্ষোগের পট্ভূমিকায় সেই ঐতিহ্যের স্মরণ-বরণ প্রয়োজন। তুরস্কের মতো আমাদের দেশেও বছরের একদিন বৃক্ষরোপণের জন্য ছুটি ঘোষণা করা দরকার। সে ছুটি অবিমিশ্র ছুটি হবে না। সেই দিন নারী-পুরুষ সমস্ত নাগরিক গুরুত্বের সঙ্গে বৃক্ষরোপণে অংশগ্রহণ করবেন। ইট-কাঠ-পাথরের শহরগুলিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হয়। এখানে ইটের পরে ইট মাঝেতে মানুষ কীট বসবাস করে। এখানে সবুজের মায়া চোখ ও মন জুড়োয় না। বিশাল বিশাল ফ্ল্যাটবাড়িগুলির চারপাশে, ছাদে গাছ লাগানো হবে বাধ্যতামূলক । রাস্তার দুধারে থাকবে গাছের সারি। তবে বৃক্ষরোপণ যেন নিছক আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত না হয়। প্রযুক্তি ও পরিকল্পনানির্ভর পথে অগ্রসর হতে হবে আমাদের। যে সব গাছ লাগানো হবে তাদের তথ্য রাখতে হবে। মোট কথা বৃক্ষরোপণকে একটি সামাজিক আন্দোলনে রূপান্তরির করতে হবে।
[লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক ]
গবেষক