বৃষ্টি দিনের আগুন সন্ধ্যা

Reading Time: 5 minutes

হুড়মুড়িয়ে এসে পড়া বৃষ্টিতে একেবারে ভিজে সপসপহয়ে বিদিশা বাড়ি ফিরতেই জবা বলল,

-দিদি একটা খুব জরুরী দরকারে বাড়িতে ফোন করব, আমার ফোনে টাকা শেষ হয়ে গেছে।

ইচ্ছা করলে জবা বাড়ির ফোনটা ব্যবহার করতে পারত। কিন্তু ওর এই স্বভাব প্রথম থেকেই। না জিজ্ঞেস করে কিছুতেই হাত দেয় না। বিদিশার অবশ্য এসব ভাবার ফুরসৎ নেই একেবারেই। একে ভিজে একসা তারওপর এক্ষুণি কপি লিখে ছাড়তে হবে। রোববার বলে অফিসে যেতে হয় নি। সভা শেষে একেবারে বাড়ি চলে এসেছে।

-হ্যাঁ করো।আর আমাকেও এককাপ চা দিও। এখুনি কাজে বসতেহবে।

দ্রুত পোশাক বদলে শুকনো তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে পাপানকে ল্যাপটপ অন করতে বলে। খুব মন দিয়ে ডোরেমন আঁকতে আঁকতে সে মা’কে বলে,

-মা, ল্যাপটপ ইস নট ওয়ার্কিং

কথাটা শুনেই বিদিশার মাথায় বাজ পড়ার মতোই দশা হয়।

-তুমি কি আবার ল্যাপটপ খুলেছ? গেম খেলেছ?

-না, মা। কাল রাতে তুমিই তো বললে “ল্যাপটপ অন হচ্ছে না।“

-উফ, সে তো চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছিল। দাঁড়াও আমি দেখছি।

হাতের তোয়ালেটা সোফার ওপরেই রেখে বিদিশা তড়িঘড়ি ল্যাপটপ অন করে। কী আশ্চর্য! লাল আলোটাই জ্বলছে না। চার্জারের সকেটটাও দেখে নেয়। সব ঠিক আছে। অথচ ল্যাপটপ অন হচ্ছে না। এদিকে কলকাতা থেকে মিহিরদার ফোন আসছে।

-কী রে? আর কতক্ষণ? তোর কপিটার জন্যই বসে আছি। একটু তাড়াতাড়ি কর প্লিজ? এখানেও প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে।

ঘড়ির কাঁটা আটটা ছুঁয়েছে। মিহিরদার তাড়া দেওয়া সংগত। মোবাইলে আবার মিহিরদাকেই ব্যাক করল।

-খুব বিশ্রি একটা সমস্যায় পড়লাম। ল্যাপটপটা অন হচ্ছে না কিছুতেই। বাড়ি চলে এসেছি। আর দিল্লি তো জানোই এখন ভাসছে। বন্যার খবরও যাবে কাল। কিন্তু এখন উপায় একটাই। আমি বলছি তুমি যদি একটু টাইপ করে নাও?

বিদিশা আরও কিছু বলত হয়ত। ওকে থামিয়ে উল্টোদিক থেকে সিনিয়ার কপি এডিটর মিহির ব্যানার্জী বললেন,

-এছাড়া আর কোনো উপায়ও নেই। তুই বলে যা। আমি রেডি।

বিদিশা আজ সন্ধ্যার সভার বিবরণী পুরোটাই বলে গেল।

জবা চা নিয়ে এসেছে। হাতের ইশারায় ওকে চায়েরকাপ টেবিলে নামিয়ে রাখতে বলে বিদিশা বাকিটুকু বলে যায়,

-মালয়েশিয়া সহ ১৯ টা ইসলামিক রাষ্ট্রে ১৯৬৩তে তিন তালাক বে আইনি ঘোষিত হয়েছিল। ভারতের এই কাজ করতে ৫৬ বছর লেগে গেল।

কথা শেষ হলে ফোন রেখে দিয়ে বিদাশা দেখল জবা দাঁড়িয়ে রয়েছে তখনও।

-কি হল? কিছু বলবে?

জবা কোনও উত্তর দিল না। চুপ করেই দাঁড়িয়ে আছে।

-এখন আর কিছু খাবো না। রাতের খাবার গরম কর।

জবা কোনও উত্তর দিচ্ছে না। নিষ্পলক তাকিয়ে রয়েছে বিদিশার দিকে। ওর কেমন অস্বস্তি হতে লাগল। বলল,

-বাড়িতে ফোন করেছো? সব ঠিক আছে তো?

এইবার জবা কথা বলল।

-দিদি ক’দিনের ছুটি চাই। বাড়ি যেতে হবে। খুব জরুরী প্রয়োজন।

বিদিশার মনে হল, আজ দিনটাই এরকম। একদিকে বৃষ্টিতে ভিজতে হল, ল্যাপটপ খারাপ। আবার জবা ছুটি চাইছে। কী যে সমস্যায় পড়ে ও, জবা বাড়ি গেলে!

-এই তো দুর্গাপুজোর ছুটিতে এতদিন বাড়ি থেকে ঘুরে এলে। এরমধ্যেই আবার যেতে হবে? কারো অসুখবিসুখ করেনি তো?

-না দিদি, অসুখ নয়। কিন্তু খুব জরুরী প্রয়োজন। যেতে আমাকে হবেই। আমি সাতদিনের মধ্যেই ফিরে আসব। কালই ট্রেনে চাপব দিদি।

জোর করে তো কাউকে আটকে রাখা যায় না? অগত্যা বিদিশাকে জবার যাওয়াটা মেনে নিতেই হয়। পাপানকে দেখার জন্য কলকাতা থেকে ওর সকল অগতির গতি ওরবাবা এসে কয়েকদিন থাকল ওর সাথে।

একদিন অফিস থেকে ফিরে দেখল, জবা ফিরে এসেছে। ওকে দেখেই বেশ নিশ্চিন্ত লাগে বিদিশার। একা হাতে সবটা সামলায়। জবা থাকলে বিদিশাকে ঘরকন্নার দিকে তাকাতেই হয় না কখনও।

চায়ের কাপ নিয়ে সোফায় বসে টিভিটা চালিয়েছে ও। বাবা ওঘর থেকে এসে পাশে বসল। দুজনের চোখই টিভির দিকে। জবা আজ বেসনের চিল্লা বানিয়েছে। গরম চিল্লার প্লেটটা হাতে নিয়ে এসে বাবাকেই বলল,

-মেসোমশাই আপনি বলবেন? না আমিই দিদিকে বলব?

বিদিশা বেশ অবাক। কী আবার বলবে? যার জন্য বাবার অনুমতি চাইছে?

বাবা বলল,

-বিষয়টা এমনকিছুই নয় আমাদের কাছে। কিন্তু সত্যিটা চেপে যাওয়া অনেক বড় জবা। জীবনে সত্যের পথে চলা খুবই কঠিন কিন্তু একদিন মিথ্যে ভেঙে পড়লে যারা বিশ্বাস করেছিল তারা কষ্ট পায়।

বাবার কথায় জবার চোখে জল দেখে বিদিশা অত্যন্ত হতভম্ব হয়ে পড়ল।

-কী আশ্চর্য! সত্যি মিথ্যে কী বলছ তোমরা? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না? খুলে বলবে আমায়?

-দিদি আমি মুসলমান। আমার নাম বানুবেগম। খুব অভাবে পড়ে কাজে এসেছি, টাকার প্রয়োজন এতটাই যে সেন্টার থেকে জবা নামটা দিল। শাঁখা পলা পরিয়ে বলল, “এই নামই থাক তোর। এই নামেই কাজ করবি।” আমি রাজি হয়ে গেলাম।

-আশ্চর্য! তোমার ভোটার কার্ডেও তো জবাই লেখা।

-হ্যাঁ, দিদি। সব আয়াসেন্টারের আলোদিদিই ব্যবস্থা করে দিয়েছে।

বিদিশার মনে হল, ইশ! আধার কার্ড চাওয়া উচিত ছিল ওর। আঁধার কার্ডেও কি ভুল নাম দিতে পারবে? এত ভাল কাজ করে জবা যে বিদিশা একেবারে ওর ওপর অসম্ভব নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে এই ক’দিনেই। মাত্র তো দুমাস হল এসেছে ও। জাতপাত কোনও সমস্যা নয় কিন্তু মিথ্যে? আরও দুচার কথা ওকে শোনাবে ভাবল কিন্তু বাবা বলল,

-যাও আরও কয়েকটা চিল্লা ভেজে আনো।

ও রান্নাঘরে চলে গেলে বাবা বলল,

-কত মানুষ কত পরিস্থিতিতে এরকম মিথ্যে বলে। তুই আর ঘাঁটাস না। বিশ্বাস করতে পারলে রাখ না পারলে চলে যেতে বল।

বাবার কথায় বিদিশা খুব রেগে যায়।

-একটা লোক মিথ্যে বলল এতদিন ধরে। ভুয়ো ভোটার কার্ড দেখাল আর তাকে ছেড়ে দেবো? আমার পাপানকে ওর ভরসায় রেখে যেতাম?

-কিন্তু ওর অভাবটাও তো দেখবি? ও জানে হিন্দু পরিচয়ে কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।

-তোমাকে এসব গল্প ও আজ বলল?

-না রে। আমাকে বলেনি। কিন্তু আমি জানলাম কী করে শোন। আমার কলকাতায় ফেরা জরুরী এদিকে জবা আসছে না। তুই ওর যে নম্বরটা দিয়েছিস সেই নম্বরে একদিন ফোন করে জবাকে ডেকে দিতে বললাম। মনে হল যেন কেউ ডাকল, ‘আর্জিনা..তোর মায়ের ফোন।”

জবা ফোন ধরতেই বললাম, “তোর কাজ শেষ হল? কবে ফিরছিস?”

ও যে সময় বলেছে সেই সময়ই ফিরে এসেছে। আজ সকালে তুই বেরানোর পরই জবা এল।

-জবা নয় বানু বল বাবা।

-আচ্ছা, সে যাক। তারপর শোন। দুপুরে খাওয়ার পর ওর বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করতে করতে আচমকাই বললাম, “আর্জিনা তোমার মেয়ে?”

আচমকা মেয়ের নাম শুনে ওর মুখ থেকে “হ্যাঁ” বেরিয়ে এল।

ব্যাস! আমিও বললাম, তাহলে তোমার নামও জবা নয়। তোমার সত্যিকারের নাম বলো।

-আর ও বাড়ি কী কাজে গিয়েছিল?

-দিদি, মেয়েটাকে বাঁচাতে বাড়ি গিয়েছিলাম।

চিল্লা হাতে জবা এসে দাঁড়িয়েছে বিদিশার প্রশ্নের উত্তর দিতে।

-আবার একটা গল্প?

-গল্প নয় দিদি। সত্যি কথা। গ্রামে আমার পাশের বাড়ির ফোন নম্বর তো আছেই আপনার কাছে। আমি ঠিকানা বলে দিচ্ছি। আপনি খোঁজ নিয়ে দেখুন?

টেবিলের ওপর প্লেট দুটো নামিয়ে ও বলল,

-সেদিন আপনি বৃষ্টি ভিজে বাড়ি ফিরে ফোনে খবরের কাগজে লেখার জন্য বলছিলেন। আমি শুনলাম সবকথা। তিন তালাক আইন করে বন্ধ হয়ে গেছে এমাস থেকেই।আমরা এমনিতেই মরে ছিলাম দিদি। জানিনা, এরপরও কি মানুষের মতো বাঁচতে পারব?ভয়ে ভয়ে কি সত্যিই আর থাকতে হবে না? পেট ভাত নেই, অথচ বরের মার খাওয়া মেয়েদের কি সত্যিই জাত বলে কিছু আছে? যেটা আছে, তা হল ভয়। যদি লোক বসায়, যদি তালাক দেয়? এতগুলো বাচ্চা নিয়ে কোথায় মরব?

জবার গলায় কিন্তু কান্না নেই। বরং একটুকরো আগুন ঝলসে উঠছে।

-আমার আর্জিনার আজ বছর পাঁচ বিয়ে হয়েছে। বিয়ে হওয়া ইস্তক আমার কাছেই থাকে। জামাই মাঝেমাঝে আসে। আর জামাই এলে প্রতিবারই মেয়টা পোয়াতি হয়। এইভাবে চারটে বাচ্চা হল ওদের। পয়সাকড়ি যা দেয় তা দিয়ে চারচারটে বাচ্চার খরচ চলে না। তাই আমি কাজে এসেছি ভিনদেশে। এইবারও আবার মেয়েটার পেটে বাচ্চা। গেলবার ছোটোমেয়ে হওয়ার সময় মেয়েটা আমার মরেইযাচ্ছিল। সরকারি হাসপাতালে ডাক্তার দিদিমণি বারবার বলল, “তুই অপারেশন করিয়ে নে। এরপর বাচ্চা হলে কিন্তু আর বাঁচবি না।”

দিদি, রক্তে কী যেন একটা কম আছে আমার মেয়ের। জামাই কোনও কথা শুনতে রাজি নয়। শাদি করেছে আমার মেয়েকে তাই মেয়ে আমার ওর বাচ্চাপয়দার যনতোর আছে। বাচ্চা নিতেই হবে। এবার বাচ্চাটা পেটে এসেই ওর শরীর খুব খারাপ। বাড়ি থেকে ফোন এলেই শুনতাম, হাসপাতালে দিদিমণি বলেছে আর বাঁচাতে পারবে না মেয়েটাকে। আমি তালাকের পরোয়া না করেই বলেছিলাম,“পরিস্কার করিয়ে নে। তুই বাঁচ মা।”

কিন্তু সে তো তালাকের ভয়েই অস্থির। ঠিক যেন ওই বয়সের আমি। এত ভীতু মেয়েটা।

এরপর হাউহাউ করে কেঁদে ফেলে জবা। কাঁদতে কাঁদতেই বলে,

-এ খুশীর কান্না দিদি। আর কোনও মরদ ভয় দেখাতে পারবে না আওরতকে। তালাকের ভয়ে বানু আর্জিনা কাউকে সিঁটিয়ে থাকতে হবে না। পয়দা করিয়েছ যখন মরদ তুমি, বাচ্চার দায়িত্বও তোমাকেই নিতে হবে। তালাকের অজুহাতে দায়িত্ব ছাড়িয়ে পালাবে কোথায়? গ্রামশুদ্ধ সবাইকে, আমার মেয়ে আর্জিনাকে একথা জানাতে দেশে গিয়েছিলাম। সেদিন বৃষ্টির সন্ধ্যায় আপনি আসলে আমাদের জন্য আগুন নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন দিদি।

বিদিশার চোখেও জল। ও বলল,

-আগুন সেদিন বৃষ্টির সন্ধ্যায় সত্যিই জ্বলেছিল তাহলে! সেই আগুনেই আহুতি দিল একটা প্রথা অথবা ভয়,তালাক তালাক তালাক…

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>