| 19 এপ্রিল 2024
Categories
এই দিনে প্রবন্ধ সাহিত্য

ফ্যাসিবাদ ও বুদ্ধদেব বসু

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

রাজীব সরকার

অস্ট্রীয় ঔপন্যাসিক ও নাট্যকার পিটার হান্ডকে এ বছর নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পাওয়ার পর একটি বিতর্কের পুনর্জন্ম হল। যুদ্ধাপরাধী মিলোসেভিচের সমর্থক পিটার হান্ডকে। এ অপরাধে ২০০৬ সালে হাইনেরিখ হাইনে পুরস্কার থেকে তিনি বঞ্চিত হয়েছিলেন। ফ্যাসিবাদ কিংবা যুদ্ধাপরাধের পক্ষাবলম্বনকারী পিটার সাহিত্যে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পেতে পারেন কিনা এ নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত সাহিত্যদুনিয়া। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন মানবতাবিরোধী অপরাধের ক্ষেত্রে একজন সাহিত্যিকের ভূমিকা কী হওয়া উচিত। বাংলা সাহিত্যে এ প্রশ্নে সবচেয়ে যৌক্তিক ও প্রাঞ্জল আলোচনা করেছেন বুদ্ধদেব বসু।

রবীন্দ্রনাথের পর বুদ্ধদেব বসুই বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে সব্যসাচী লেখক। রবীন্দ্রোত্তর আধুনিক বাংলা সাহিত্যের তিনিই প্রধান নির্মাতা। তিনি ও সমকালীন সাহিত্যিক-শিল্পীর পাশ্চাত্য সাহিত্য নিংড়ে গ্রহণ করেছিলেন প্রেরণার উৎস। ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ তথা কলাকৈবল্যবাদ দর্শন মূর্ত হয়ে উঠেছিল তাদের সাহিত্যকর্মে। সাহিত্যের প্রায়োগিক মূল্য কখনও উন্নত সাহিত্যের মানদ-হতে পারে না- এ ছিল বুদ্ধদেব বসুর আজন্ম লালিত বিশ্বাস।

বুদ্ধদেব জোরের সঙ্গে বলেছেন, শিল্প-সাহিত্যের কোনো সামাজিক উপযোগিতা বা লক্ষ্য থাকতে পারে না। একালের শিল্পী সমাজ বিচ্ছিন্ন। মহৎ শিল্পী মাত্রই স্বাধীন ও মুক্ত চিত্তের অধিকারী। শার্ল বোদলেয়ার : তার কবিতা’র ভূমিকায় তিনি বলেছেন-

‘যে মধ্য-উনিশ শতকে ইংল্যান্ডে উপযোগবাদের অভ্যুদয় হল, সে সময়ে বোদলেয়ার ঘোষণা করেন যে কবি কোনো ‘কাজে লাগেন না’ যে বায়রনি বিদ্রোহের দিন গত হয়েছে, পূর্ণ হয়েছে সমাজের সঙ্গে কবির বিচ্ছেদ; প্রতিবাদ করলেও প্রতিবাদের পাত্রকে স্বীকার করে নিতে হয়, অতএব, একমাত্র যা সহনীয় ও সম্ভব তা উপেক্ষা ও স্বেচ্ছাবৃত নির্বাসন।’

এ বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি শোনা যায় রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠেও। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে ২৪ মে ১৯৪১ সালে বুদ্ধদেবকে প্রেরিত একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন-

‘আমরা যে ইতিহাসের দ্বারাই একান্ত চালিত এ কথা বারবার শুনেছি এবং বারবার ভেতরে ভেতরে খুব জোরের সঙ্গে মাথা নেড়েছি। এ তর্কের মীমাংসা আমার নিজের অন্তরেই আছে, যেখানে আমি আর কিছু নেই- কেবলমাত্র কবি। সেখানে আমি সৃষ্টিকর্তা, সেখানে আমি একক, আমি মুক্ত। বাহিরের ঘটনাপুঞ্জের দ্বারা জালবদ্ধ নই।’

অথচ কলাকৈবল্যবাদের অনুসারী হিসেবে বুদ্ধদেবকেই সবচেয়ে বেশি সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছে। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত লিখিত ‘সহে না সহে না এ জনতার জঘন্য মিতালি’ এবং বুদ্ধদেব উচ্চারিত ‘প্রান্তরে কিছুই নেই; জানালায় পর্দা টেনে দে’-এর মতো কিছু পঙ্ক্তি বিচ্ছিন্নভাবে উদ্ধৃত করে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছে বুদ্ধদেব এবং তার সহযাত্রী কবিবৃন্দ কতটা ‘জীবনবিমুখ’ ছিলেন। উপযোগিতামূলক সাহিত্য রচনার বিরোধী ছিলেন বলে বুদ্ধদেব এবং তার সঙ্গীরা অভিহিত হয়েছিলেন ‘পলায়নবাদী’ হিসেবে। এ অভিযোগ অসামান্য যুক্তিনিষ্ঠায় তিনি খণ্ডন করেছিলেন ‘পলায়ন’ প্রবন্ধে –

‘আমি যদি কবি হই তাহলে কবি হিসেবে আমার কর্তব্য ভালো কবিতা লেখা, তা ছাড়া কিছু নয়, জীবনের সঙ্গে সেই আমার যোগসূত্র। আমি যদি বাণিজ্য কি রাজনীতি সম্বন্ধে মূঢ় হই, ফুটবল কি ঘোড়দৌড়ের খবর না রাখি তাহলে ক্ষতি কী? আমি বরং বলব, ভালো কবিতা লেখার জন্য যে রকম জীবন আমার নিজের পক্ষে সবচেয়ে অনুকূল বলে জানি আমি চাইব আমার জীবনকে সেভাবেই গড়তে, সেটি এস্কেপিজম নয়, সেটা শুভবুদ্ধি। এখানেও কবিতে-কবিতে প্রভেদ হবে; কেউ চাইবেন নির্জন আত্মনিমগ্ন জীবন, কেউ বা সামাজিক জীবনের জটিলতা, অন্য কেউ হয়তো ‘ছাত্র আর মজুরের উজ্জ্বল মিছিল’ থেকে প্রেরণা পাবেন- বেশিরভাগই কখনও এদিকে কখনও ওদিকে ঝুঁকবেন; সম্পূর্ণ আত্মসংহত কি সম্পূর্ণ বহির্ব্যাপ্ত কোনো কবিই বোধহয় নন, তবে বিশেষ এক দিকে পক্ষপাত সবারই ধরা পড়ে- সাহিত্যের অভ্যন্তরীণ তাগিদ হিসেবে ও সবেরই সমান মূল্য, এর মধ্যে বিশেষ কোনো একটিকে গ্রহণ না করাটাই ‘পলায়নী’ মনোবৃত্তি এ কথা বললে আর যা-ই হোক সাহিত্য সম্বন্ধে কিছু বলা হয় না।’

সাহিত্যকে প্রত্যক্ষভাবে সামাজিক লক্ষ্য সাধনের অস্ত্র করে তোলার তীব্র বিরোধী বুদ্ধদেবকে ভিন্নরূপে দেখা যায় ১৯৪২ সালে। সেই সময় ঢাকায় কমিউনিস্ট কর্মী ও তরুণ সাহিত্যিক সোমেন চন্দ দাঙ্গাবাজদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন। এই নারকীয় ঘটনার প্রতি তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করে বুদ্ধদেব ‘প্রতিবাদ’ নামে একটি তাৎপর্যমণ্ডিত কবিতা লিখেছিলেন-

‘ক্ষমা? এরও ক্ষমা আছে? এ উন্মত্ত হননবৃত্তিরে

নীরবে সহিতে পারে এত বড়ো মানবমহিমা

জানি না সম্ভব কিনা।’

কবিতাটি শেষ করেছিলেন এ সংকল্প ঘোষণা করে- ‘পশুত্বের প্রতিবাদে নিখাদে রেখাবে আজ থেকে উদ্দীপতা। আমার কবিতা।’ নজরুল লিখিত ‘প্রার্থনা কর যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস/যেন লেখা হয় আমার রক্তলেখায় তাদের সর্বনাশ’-এর সঙ্গে বুদ্ধদেবের সংকল্পের সাদৃশ্য লক্ষণীয়।

শুধু এ কবিতা লিখেই ক্ষান্ত হননি তিনি। ১৯৪২ সালে ‘ফ্যাসিস্টবিরোধী লেখক ও শিল্পীসংঘ’ গঠিত হওয়ার পর তিনি সেই সংঘে যোগ দেন। রচনা করেন ‘সভ্যতা ও ফ্যাশিজম’ নামে একটি বলিষ্ঠ প্রবন্ধ। প্রবন্ধের শুরুতেই বুদ্ধদেব স্বীকার করেছেন রাজনীতি তার জীবনে ‘কখনও আলোচনার বিষয় ছিল না’। সাহিত্যসাধনাই তার ‘জীবনের মূল প্রেরণাশক্তি’। ‘নিরিবিলি ঘরের কোণে বসে পড়াশোনো করতে’ ও ‘মাঝে মাঝে এক-আধটা কবিতা লিখতে’ চান তিনি। এ জন্য যে শান্তির প্রয়োজন সেই শান্তি বিপণ্ণ হয়েছে ‘সংস্কৃতির প্রতিশ্রুত শত্রু’ ফ্যাসিবাদের তাণ্ডবে। তাই ফ্যাসিবাদের মতো একটি রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে তাকে লিখতে হচ্ছে। ফ্যাসিবাদ ‘মনুষ্যত্বের অবমাননা ও সভ্যতার বিনাশ’ এরই অপর নাম। ‘কমিউনিস্টবিরোধী’ বলে পরিচিত বুদ্ধদেব বসু এ প্রবন্ধে রাশিয়াতে মনুষ্যত্বের পূর্ণ মর্যাদা দান ও সভ্যতার পূর্ণ বিকাশের প্রশস্তি গেয়েছেন। রাজনীতিবিমুখ বুদ্ধদেব অকপটে বলেছেন-

‘শান্তির সময়, সুখের সময় নির্লিপ্ত থাকা সম্ভব, হয়তো সে অবস্থাই স্বাস্থ্যের পক্ষে অনুকূল, কিন্তু চারদিকে যখন অশান্তির আগুন লেলিহান হয়ে জ্বলে ওঠে তখন কবি বল শিল্পী বল ভাবুক বল কারও পক্ষেই মনের মধুর প্রশান্তি অক্ষুণ্ণ রাখা আর সম্ভব হয় না, যার প্রাণ আছে তার প্রাণেই ঘা লাগে।… তাই আজ পৃথিবী ভরে লোভ যখন তার বীভৎসতম মূর্তিতে প্রকট তখন আমরা কবিরা, শিল্পীরা স্বভাবতই, নিজের প্রকৃতির অদম্য টানেই, ওই বীভৎসতার বিরুদ্ধে দাঁড়াব- এর মধ্যে রাজনীতির কোনো গূঢ়তত্ত্ব নেই, আমাদের মনুষ্যত্বের, কবি চরিত্রের এটা ন্যূনতম দাবি।’

উপরোক্ত বক্তব্যে বুদ্ধদেব স্পষ্ট করে বলেছেন, প্রতিবাদ করার জন্য রাজনৈতিক স্লোগান বা হাতিয়ার অপরিহার্য নয়। মানবধর্মের স্বভাববৈশিষ্ট্যই হচ্ছে বর্বরতার বিরুদ্ধাচরণ। অসুন্দরের বিরুদ্ধে সুন্দর, অসত্যের বিরুদ্ধে সত্য, অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলো লড়বে এটিই স্বাভাবিক। এ দ্বন্দ্বের মধ্যে রাজনীতি আবিষ্কার করা পণ্ডশ্রমের নামান্তর। শুভ শক্তি তার অস্তিত্বের স্বার্থেই এ যুদ্ধে লড়বে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্য নয়।

সংস্কৃতিতে, বিশ্বমানবের ঐতিহাসিক প্রগতিতে যারা আস্থাবান তারা প্রকৃতির নিয়মেই ফ্যাসিবাদ তথা বর্বরতার বিরোধিতা করবে। ফ্যাসিবাদ ‘উন্নয়ন’-এর মোড়কে বর্বরতা ছড়িয়ে দিয়েছিল। হিটলারের আমলে জার্মানি আশ্চর্য উন্নতি করেছে- এমতাবলম্বীদের বিরোধিতা করেছেন বুদ্ধদেব বসু। আইনস্টাইনকে তাড়িয়ে দিয়ে যদি কোনো উন্নতি হয়, তবে তা যে উন্নতি নয়, ঘোর অবনতি এ কথা নিশ্চিতভাবেই তিনি জানেন এবং মানেন। যদি স্বদেশি হিটলার রবীন্দ্রনাথকে তাড়িয়ে উন্নতি দেখাতে চান, সেই উন্নতিরও ঘোরবিরোধী তিনি। তিনি জানেন রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে উন্নতি সম্ভব নয়।

ফ্যাসিবাদবিরোধী ও সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির সমর্থক বুদ্ধদেব বসুর রাজনৈতিক সচেতনতার পরিচয় পাওয়া যায় ‘ফ্যাসিবাদ, শিল্প ও বিশ্বমানব’ প্রবন্ধেও-

‘শিল্পীর যেটা সত্য পরিচয় সেটা কখনই নঞর্থক হতে পারে না; তিনি যে শুধু অন্যায়ের বিরুদ্ধে এ কথা বললে তাকে অনেকটা ছোট করে দেখা হয়; তিনি যে প্রেমিক, তিনি যে বিশ্বমানবিক, তিনি যে দেশকালের সব সংস্কারের ঊর্ধ্বে, তিনি যে মনুষ্যধর্মের পুরোহিত এটাই তার সম্বন্ধে আসল কথা। … রোমা রোঁলার বিখ্যাত বাণী আজ আমরা নিজেদের বাণী বলে গ্রহণ করব : সব উৎপীড়কের বিরুদ্ধে, সব উৎপীড়িতের সঙ্গে।’

এরপরও কি কোনো সন্দেহ থাকে বুদ্ধদেবের জীবনবাদী দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে? প্রতিবাদের বিবেকি কণ্ঠ হিসেবে নজরুল, সুকান্ত, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের রচনা যেমন পরিচিত, বুদ্ধদেবের তেমন নয়। এর কারণ বুদ্ধদেব সম্পর্কে আমাদের খণ্ডিত মূল্যায়ন। সামগ্রিকতার অবয়বে তার সাহিত্যকর্ম প্রত্যক্ষ করলে বুদ্ধদেব বসুকে ‘কলাকৈবল্যবাদী বা ‘পলায়নবাদী’র বৃত্তে আবদ্ধ করার আগে আমাদের বারবার ভাবতে হবে।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত