| 20 এপ্রিল 2024
Categories
সিনেমা

চলচ্চিত্র যেন কাব্যিক-বাস্তবতার মায়াবী নকশা

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

রূপসা দাস

বরাবরই সামগ্রিক অর্থে, চলচ্চিত্রের ভাষাকে (Language of Film)আমরা আন্তর্জাতিক আখ্যা দিয়েছি।যে ভাষা কোন মানচিত্র মানে না, মানে না দেশ-কাল সময়ের জাগতিক গন্ডি,যা সময়ে-অসময়ে ন্যারেটিভের গা বরাবর লতিয়ে চলা গাছের মতো বেড়ে উঠেছে, আলোর সম্মুখে,সেই ভাষার একটা নিজস্বতা আছে, আছে বৃহৎ পরিসরে আসমান-জমিন ছেয়ে ফেলার মতো ভাবনার অবকাশ,যার গায়ে ফুটিয়ে তোলা যায় শিল্পের কাঁথাস্টিচ,সেই ভাষা আর কবিতার ভাষা ,তারা কী আরশিনগরের দুজন পরশী নাকি তাদের মধ্যেও রয়েছে লক্ষ যোজন দূরত্ব? দূরত্ব কোথায় নেই, এক ছাদের তলায় থাকা দুজন মানুষের মধ্যেও কী হিম শীতল পাহাড় প্রমাণ দূরত্ব থাকে, আর দুর্দিনে দাঁড়িয়ে দুই পৃথক শিল্পমাধ্যমের দুটো আলাদা ফর্মের ভিতর কত কত দূরত্ব থাকে, তার হিসেব-নিকেষ করবো ? সত্যিই কী প্রয়োজন আছে?

নয়া উদারবাদী মুক্ত অর্থনীতির খোলা বাজারে দাঁড়িয়ে শিল্পে প্রগতিশীলতার নামে যেভাবে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী উত্তর আধুনিকতা গ্রাস করতে শুরু করেছে,সমাজ-রাজনীতি চরম হতাশাব্যঞ্জক একটা পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে হাঁটছে,লঘু ভোগবাদী বিনোদনের সু্রে ঘুরতে ঘুরতে প্রতিভাবান ছেলেটা কিংবা মেয়েটা সস্তার খেউড়ে গা ভাসিয়ে প্রাতিষ্ঠানিকতার পাদপ্রদীপের আলো খুঁজছে, সেই সময়ে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের মতো পরিচালকদের চলচ্চিত্রে কাব্যিক বাস্তবতার সূত্র খোঁজা নেহাতই ব্যাকডেটেড।তবুও আমি খুঁজবো। বাজার নির্ধারিত কন্টেন্টের কাউন্টার ডিসকোর্সের গল্প বলার জন্য।কালচারাল ইন্ডাস্ট্রীর ক্লিশে গতানুগতিক চলনের বাইরে প্রান্তিক মানুষজন, প্রান্তিক লোকশিল্প,আর পুঁজিবাদী সমাজের ইঁদুরদৌড়ে হারিয়ে ফেলা স্বপ্নগুলোকে আবারো খুঁজে দেখার জন্য এই ছবিগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম।

যেখানে চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে রিয়্যালিটি থেকে আনুষ্ঠানিক পলায়নবাদ। সমাজ-বাস্তবতার সম্যক পরিস্থিতি থেকে দূরে কোন স্বপ্ন বাস্তবতার কাব্যিক দিকশূণ্যপুরে যাত্রার মতো।ক্লাসিকাল পোয়েটিক রিয়্যালিজমের সূচনালগ্নে হতাশাকে কাব্যময়তা দিয়ে ঢেকে দেবার যে রীতি থেকে চলচ্চিত্রের ভাষায় কবিতার ভাষা জায়গা করে নেয়, বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ছবির ক্ষেত্রেও অবধারিতভাবে সেই “রিক্রিয়েটিভ বাস্তবতা” ধরা দিতে থাকে, যার ভিত টা বাস্তবের কাছাকাছি কিন্তু তা যদিও বাস্তব নয়।

খুব অদ্ভুতভাবে সত্যজিতের পরবর্তী জামানায় বুদ্ধদেববাবুর ছবির মধ্যে থেকে নিটোল গল্পের ন্যারেটিভ সরে যেতে থাকে, তার পরিবর্তে ইমেজভিত্তিক সিম্বলিক দৃশ্যকল্প প্রাধান্য পেতে শুরু করে, তার সাথে যুক্ত হয় একবারে সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির বেসিক চাহিদাগুলো, বেসিক অধিকার ছিনিয়ে নেবার আন্দোলনের ভাষাগুলো, ফলত সুখী মধ্যবিত্ত পরিবারের বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটের সুদৃশ্য ড্রইংরুম হারিয়ে যেতে থাকে, তার পরিবর্তে বড্ড বেশী করে প্রকৃতি জায়গা করে নিতে থাকে,নির্দিষ্ট কোন অবজেক্ট জায়গা করে নিতে থাকে আর লং শটে তৈরী হয়ে যায় পর্দায় কবিতা বলার উপযুক্ত প্রেক্ষাপট। নান্দনিক বিচারে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ছবি, বাংলা চলচ্চিত্রকে আন্তর্জাতিক স্তরে নিয়ে গেছে তার বলার অপেক্ষা রাখেনা, তবে এই নান্দনিকতার সংজ্ঞা কিন্তু নন্দন-রবীন্দ্র সদন কর্তৃক প্রাতিষ্ঠানিক নান্দনিকতা নয়, এর মধ্যে অনেক বেশী মাত্রায় সাব-অল্টার্ণ ভয়েস মিশে আছে,আর রয়েছে বাজার নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত শিল্প চাহিদার বাইরে প্রান্তিক লোক সংস্কৃতিকে চলচ্চিত্রে তুলে নিয়ে আসার প্রয়াস, যদিও তখনো লোকসংস্কৃতি পপ-কালচারের অন্তর্ভুক্ত হয়ে কোক স্টুডিও তে আত্মপ্রকাশ করেনি।বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ছবিগুলোর মধ্যে থেকে আমরা কটা প্রাণহীন জড়বস্তু আর কিছু সাধারণ প্রবণতা নিয়ে কথা বলবো, যা প্রায় সবকটি ছবির ক্ষেত্রেই কোন না কোন সময় দেখা গেছে।

একটি হুট খোলা জিপগাড়ি সিনেমার মাঝবরাবর পরাবাস্তবতার দিকে ছুটে যায়

হালের “টোপ” সিনেমাটা দিয়েই যদি শুরু করি,এরপর একে একে “স্বপ্নের দিন” “মন্দ মেয়ের উপাখ্যান” “কালপুরুষ” এ সেই হুট খোলা জিপগাড়ি, আর “লাল দরজা”, “আমি ইয়াসিন আর আমার মধুবালা” র ক্ষেত্রে ট্যাক্সি বা মারুতি গোছের একটা গাড়ি সারা ছবি জুড়ে একাধিকবার ছুটে চলে, চলচ্চিত্রের নিজস্ব গতির সাথে তাল মিলিয়ে। “স্বপ্নের দিন” এর কথাই যদি ধরি ওই হুট খোলা জিপগাড়িতেই তিনটে আপাত সম্পর্কবিহীন মানুষ, পরিস্থিতির ফেরে আটকে পরে, তাদের মধ্যে সাধারণ যোগসূত্র হিসাবে শুধু তিনটে আলাদা আলাদা স্বপ্নের রেশ মায়াজাল বুনে চলে, “কালপুরুষ” এর ক্ষেত্রেও সুমন্ত’র বাবা অশ্বিনী যখন তার জিপগাড়িটি নিয়ে নিরুদ্দেশের পথে যাত্রা শুরু করেন, সেটা তো খানিক চরাচরের যাবতীয় জাগতিক রুক্ষ বাস্তবতার দুনিয়া ছেড়ে কাব্যিক মায়াবাস্তবতার দিকে যাত্রার মতো, কিংবা টোপ সিনেমার কথাই যদি বলি নারায়ন গঙ্গোপাধ্যায়র গল্পকে সম্পূর্ণ ভিন্ন উপস্থাপনায় বুদ্ধদেববাবু যেভাবে পর্দায় হাজির করেছিলেন, সেখানেও খামখেয়ালি জমিদারের হারানো বংশ গৌরব স্বরূপ জিপ গাড়িটি জঙ্গলের মাঝবরাবর ছুটে যায়। এখানে জিপগাড়িটি কোন স্বপ্নলোকের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেনি বরং সমাজের উঁচুতলার মানুষের আদিমতম প্রবৃত্তিকে উন্মোচন করে গল্পকে একটা ফ্যাটালিস্টিক ভিউ পয়েন্টে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়েছে। মন্দ মেয়ের উপাখ্যানে আবার সেই জিপ গাড়িটিই মেয়েটিকে পৌঁছে তার স্বপ্নের কাছাকাছি। এটাই বোধহয় বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ছবির ম্যাজিক, মনে হয় সমস্ত ছবি জুড়ে উনি কেবল একটাই গল্প বলতে চেয়েছেন, যার যোগসূত্র হিসাবে জিপগাড়িটি পৌঁছে দেয় এক স্টেশন থেকে পরবর্তী স্টেশনে, সেখান থেকে আবার তৈরী হয় নতুন ছবির প্লট।

খুব অদ্ভুতভাবে সত্যজিতের পরবর্তী জামানায় বুদ্ধদেববাবুর ছবির মধ্যে থেকে নিটোল গল্পের ন্যারেটিভ সরে যেতে থাকে, তার পরিবর্তে ইমেজভিত্তিক সিম্বলিক দৃশ্যকল্প প্রাধান্য পেতে শুরু করে, তার সাথে যুক্ত হয় একবারে সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির বেসিক চাহিদাগুলো, বেসিক অধিকার ছিনিয়ে নেবার আন্দোলনের ভাষাগুলো, ফলত সুখী মধ্যবিত্ত পরিবারের বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটের সুদৃশ্য ড্রইংরুম হারিয়ে যেতে থাকে, তার পরিবর্তে বড্ড বেশী করে প্রকৃতি জায়গা করে নিতে থাকে,নির্দিষ্ট কোন অবজেক্ট জায়গা করে নিতে থাকে আর  লং শটে তৈরী হয়ে যায় পর্দায় কবিতা বলার উপযুক্ত প্রেক্ষাপট। নান্দনিক বিচারে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ছবি, বাংলা চলচ্চিত্রকে আন্তর্জাতিক স্তরে নিয়ে গেছে তার বলার অপেক্ষা রাখেনা, তবে এই নান্দনিকতার সংজ্ঞা কিন্তু নন্দন-রবীন্দ্র সদন কর্তৃক প্রাতিষ্ঠানিক নান্দনিকতা নয়, এর মধ্যে অনেক বেশী মাত্রায় সাব-অল্টার্ণ ভয়েস মিশে আছে,আর রয়েছে বাজার নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত শিল্প চাহিদার বাইরে প্রান্তিক লোক সংস্কৃতিকে চলচ্চিত্রে তুলে নিয়ে আসার প্রয়াস, যদিও তখনো লোকসংস্কৃতি পপ-কালচারের অন্তর্ভুক্ত হয়ে কোক স্টুডিও তে আত্মপ্রকাশ করেনি।বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ছবিগুলোর মধ্যে থেকে আমরা কটা প্রাণহীন জড়বস্তু আর কিছু সাধারণ প্রবণতা নিয়ে কথা বলবো, যা প্রায় সবকটি ছবির ক্ষেত্রেই কোন না কোন সময় দেখা গেছে।

কিছু বোকা মানুষের গল্প

এখনকার দর্শকরা-পাঠকরা কেউই বোকা নয়,সমাজ- আর পরিবারের নিদারুণ চাপে তারা ছোট থেকেই মোটা টাকার অঙ্কের বিনিময়ে জীবনের সাফল্য নির্ধারণের চেনা সূত্রটি চিনে যায়, তাই ছোট থেকেই শুরু হয় দৌড় ,দৌড় আর দৌড়, আজন্ম শুধু ছুটে চলা, বুদ্ধদেববাবু ছবি কিছু বোকা মানুষদের গল্প বলে, আমরা যারা কোনদিন দৌড়ে সামিল হইনি, তাদের খুব অন্তরের কাছাকাছি এই চরিত্রগুলো।টোপ ছবির গজার কথাই যদি বলি, তবে সেই মানুষটি নিঃসন্দেহে বোকা,পোস্ট অফিসের সরকারী চাকরী ছেড়ে সে কিনা গাছে উঠে বসে থাকে, বাঁদরদের সাথে কথা বলে, গাছেদের সাথে কথা বলে, যে বাস্তবের চেয়েও বড়ো বেশি করে নিজস্ব কল্পনার দুনিয়ায় বাস করে, যার মধ্যে থেকে এখনো অনুভূতির কোমল চাদর সরে যায়নি, তাই তাকে বাস্তবের দুনিয়ায় বড্ড বেশী করে বেমানান লাগে,তেমনিই কালপুরুষের সুমন্ত , যে তার বৌ এর মতো জীবনে উন্নতির সেই চেনা ছকে হাঁটেনি, উচ্চাকাঙ্খার পারদের মাঝেও যে প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে পারে,সাফল্য ব্যর্থতার এসব জাগতিক হিসাবনিকাশ সুমন্তকে বিচলিত করে না। সে বিশ্বাস করে, জীবন নানা রকমের হয়। তার জীবন তার মতন।কিংবা জানলার বিমলের কথাই যদি ধরি, যে এক বৃদ্ধাশ্রমে সামান্য এক কেয়ারটেকারেরে চাকরী করে (মাইনের ভিত্তিতে সামান্য) তারপরেও সে তার ছোটবেলার ভেঙে পরা স্কুলটাকে একটা জানলা উপহার দিতে চায়, যেই জানলা দিয়ে ওর ছোটবেলায় কল্পনা ডানা মেলতে শিখেছিল, সেই জানলার আর স্বপ্নের উত্তরাধিকারটা ও ওর পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও ছড়িয়ে দিতে চেয়েছে জানলার মাধ্যমে, এ আমাদের চোখে, বোকামি নয় তো আবার কী! যখন নিজের ট্যাঁকেরই জোর নেই। তাহাদের কথা সিনেমায় জেল ফেরত বিপ্লবী শিবদাসের কথাই যদি বলি, তবে তার কমরেডকে সে তাবেদারি করে ইলেকশনের টিকিট হাতিয়ে নিতে দেখেও ভুলেও নিজে এই মধ্যপন্থার চাটুকারিতায় পা ডোবায় না, নিজের পরিবারের কথা ভেবেও কারুর কাছে নিজের মতাদর্শ , রাজনৈতিক বোধ বিকিয়ে দেয়না। সর্বহারার শৃঙ্খল ছাড়া সত্যিই হারাবার কিচ্ছু থাকেনা। তাই সমাজ-পরিজন তাদের পাগল বলে কিংবা বোকা।

অন্ত্যমিলের মতো কিছু মানুষ হারমোনিকা বয়ে বেড়ায়

কালপুরুষ ছবিটা দিয়েই শুরু করবো,যেখানে সুমন্ত ওর ছোটবেলায় গ্রামে এক বাঁশিবাদক আর তার ছেলেকে একটা মিষ্টি সুর তুলে পথ দিয়ে চলে যেতে দেখতো, পরবর্তী সময়ে বহু বছর বাদে বিবাহিত জীবনে নিঃসঙ্গ সুমন্ত যতবার স্মৃতিতে ফিরে যেতে চেয়েছে, ততবার অবচেতনে কলকাতার শহরের রাস্তাতেও সেই বাঁশিবাদক আর তার ছেলেকে দেখতে পেয়েছে। কিংবা ও যেমন ওর ছোটবেলায় একটি যাত্রার দলকে দেখতে পেতো, সেইরকম একটি যাত্রার দলকে ওর ছেলেও দেখতে পায়, এই মানুষগুলো, এই চেনা সুরগুলো বোধকরি প্রজন্মের পর প্রজন্মকে নস্টালজিয়ার অন্ত্যমিলের মতো বেঁধে রাখতে চায়। বা আমি ইয়াসিন আর আমার মধুবালার ক্ষেত্রে যদি আসি, দেখতে পাবো, কয়েকজন মুটে বিশাল বিশাল রাজসিংহাসনের মতো আসবাব মাথায় করে নিয়ে শহরের রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলছে, কোথায় যাবে , কীভাবে যাবে তার কোন হদিশ নেই, শুধু তারা হেঁটে চলেছে, ছবির শেষে হয়তো সমাপ্ত চিহ্নের মতো একটা উত্তর মেলে কিন্তু সারা ছবি জুড়ে এই হেঁটে চলাটা প্রতীকী।উত্তরার মতো ছবির কথা বললে বলতে হয়, মুখা নাচ বা গমীরা ডান্স ফর্মের কথা, মুখে মুখোশ পরে কিছু লোকজন প্রত্যন্ত ওই রেলস্টেশনের ছোট্ট জনবসতিতে হেঁটে চলেছে, সিনেমার প্রতি বাঁকে বাঁকে তাদের দেখা মিলছে, আর ছবির শেষে এক গভীর সংযোগসূত্র রেখে তারা বিদায় নিচ্ছে। ঠিক এরকমভাবেই ছবিতে উঠে এসেছে, সার্কাসে খেলা দেখানো , মাদারির খেলা দেখানো, শিল্পীদের কথা যথাক্রমে জানালা ও টোপ ছবিতে। আর স্বভাবতই ছবিতে জাদুবাস্তবতার মায়াবী দুনিয়া ফুটিয়ে জাদুকরের আগমন খুব স্বাভাবিক নিয়মেই ঘটতো।যারা ছবির মাঝেমাঝে পরজন্মের স্মৃতির মতো উঠে আসতো হারমোনিকার মিঠে সুর নিয়ে, আর আমাদের নিয়ে গিয়ে ফেলতো মাটির কাছাকাছি, শিকড়ের কাছাকাছি।

ধর্মবিদ্বেষ-খুন- সমসাময়িক সামাজিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি

বুদ্ধদেববাবুর সব ছবিই যে বাস্তব থেকে পলায়নবাদ, এমনটা কিন্তু নয়, এমন বাস্তববাদী আঙ্গিকে এই ইস্যুগুলোকে নিয়ে কাজ করা করা খুব সহজ নয়,উত্তরা সিনেমায় গীর্জার পাদ্রীকে ধর্মান্তরের অভিযোগে যেভাবে গোঁড়া হিন্দুত্ববাদীদের লুম্ফেন দল পুড়িয়ে মারে, তা উপলব্ধি করার জন্য আমাদের খুব বেশী পিছনে ফিরতে হবে না, ধর্মের নামে যে বিভেদের রাজনীতিতে আমরা বাস করছি, তাতে হিন্দুত্ববাদীদের এই রামরাজত্ব খুব বেশী দূরেও নেই। গ্রামীণ মানুষদের নিয়ে কাজ করার মহৎ প্রয়াস ধূলিসাৎ হতে বেশী সময় লাগবে না। কিংবা আমি ইয়াসিন আর আমার মধুবালা ছবিতে যেমন দেখি মুসলিম হবার অপরাধে ইয়াসিন কে উগ্রপন্থী সন্দেহে রাষ্ট্রের লেঠেলবাহিনী গুলি করে মেরে ফেলে তাও দেখতে দেখতে আর অদ্ভুদ লাগেনা। মুসলিম মানেই জঙ্গি, উগ্রপন্থী এই প্রোপাগান্ডা তো এখন হিন্দুরাষ্ট্রের প্রধান মোটো। এই ছবিতেই আমরা শুরুর দৃশ্যে এমন এক হাসপাতাল দেখতে পাই, যেখানে ইঁদুর , এক রোগীর নাক কামড়ে দেয়, স্বাস্থ্যপরিকাঠামোর বেহাল অবস্থাকে নিয়ে ব্যাঙ্গাত্মক স্বরে বিদ্রুপ করে ছবিতে তুলে ধরতে উনিই পারেন। ঠিক একইরকমভাবে স্বপ্নের দিন চলচ্চিত্রে গুজরাট দাঙ্গায় স্বামী হারানো সন্তান সম্ভবা এক মেয়ের গল্প উঠে এসেছে রেফারেন্স ন্যারেটিভ হয়ে। তবে যে বিষয়টা উল্লেখ করতেই হয়,তা হল পুঁজিবাদী আমেরিকা সম্বন্ধে তৃতীয় বিশ্বের এই আপাত উন্নয়নশীল মানুষের ধারণার খতিয়ান বেশ অনেক সিনেমায় উঠে এসেছে। উত্তরা ছবিতে দারিদ্র্যকৃষ্ট বৃদ্ধরা যখন দুপুরে খাবারের জন্য গীর্জায় আসতো আর তাদের কথোকথনে উঠে আসতো আমেরিকায় চলে গেলে আর কোন কষ্ট থাকবেনা তাদের, ছবির শেষাংশে তারা ঠিক করে হাঁটতে হাঁটতেই আমেরিকায় পারি দেবে, একইরকমভাবে কালপুরুষ সিনেমায় সুমন্ত’র স্ত্রী আমেরিকা যাবার আগে থেকে য্রভাবে উত্তেজনায় ফুটতে থাকে,তাতে আমেরিকা যে আদতেই একটা আইডিয়া , একটা কনসেপ্ট তারা বারে বারে ফুটে ওঠে।

সম্পর্কের জটিলতা, ম্যারাইটাল রেপ, বাইসেক্সুয়াল সম্পর্ক,পলিগ্যামাস সম্পর্কের মতো একাধিক জটিলতার মধ্যে তিনি সম্পর্ককে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়েছেন, আর তার অন্তরনিহিত বিষ্ফোরণে ফুটে বেরিয়েছে বুনো ফুলের মাতাল গন্ধ।

শেষ পর্বে এসে এটুকুই বলা যায়, সিনেমাকেও যে পড়া যায়, কবিতার মতো তার শরীরেও যে ছন্দ, অন্ত্যমিল, লিমেরিকের কারুকার্য থাকে, সিনেমাটোগ্রাফি টা যদি উলের বল হয়, তবে তা দিয়ে যেকোন উলের জিনিস বুনে ফেলা যায় নির্দ্বিধায়, তা বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের সিনেমা আমাদের শিখিয়ে দেয়, আমরা যারা সিনেমাকে মায়ের মতোই ভালোবাসি তাদের জন্য থাকুক কালপুরুষ ছবির এই ছড়াটি…

“নাক কামড়াই, কান কামড়াই, কামড়ে দিলাম মন,
তুমি আমার আঙুর লতা, আমার ত্রিভুবন।”

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত