৩০৪ নং কেবিন (পর্ব- ২)

Reading Time: 3 minutes

গত পর্বের পরে…

মেঘ অদিতির কেবিনটা তিনতলায়রাস্তার দিকে সেদিকে কেবিনের গা ঘেঁষে  একটা রাধাচূড়া গাছহলুদ ফুলে ঢেকে আছে কাঁচের জানলায় তার প্রতিবিম্ব পরেকতগুলো পায়রা সেখানে, কখনো বা জানলাটায় বসে দিন রাত বকবকম বকবকম করেওরা এত কী কথা বলে! তার আরোগ্য প্রার্থনা করে কী?

মেঘ তো রোজ বলে ওদের, ওই, দোহাই তোদের একটুকু চুপ কর, ভালবাসার দে মোরে এতটুকু অবসরতারপর নিজের মনেই হাসে ভালবাসার অবসর! হায় রে! 

তার এখন অনন্ত অবসর সারাদিন কেবল শুয়ে, মাঝেমধ্যে উঠে বসে, জানলা দিয়ে দেখে , দূরে পুকুরটা পুরো কচুরি পানায় ভরতিবালি সিমেন্ট মাটি দিয়ে ভরাটের চেষ্টা হয়েছিল, ব্যর্থ যদিওতার পিছনে খেলার মাঠ

ভোর পাঁচটায় যখন মাসি তাগাদা দেয়, দিদি ওঠেন, মুখ ধুয়ে নেন, ডাক্তার বাবু আসবে, ওষুধ খেতি হবে, মেঘ বিরক্তি  নিয়ে চোখ খুলে উঠে বসলেই জানলা দিয়ে প্রথমে ওদিকেই চোখ চলে যায়

ভোরে ছেলে পুলের দল ফুটবল খেলছেভীষণ ইচ্ছে করে দৌড়ে ওদের কাছে চলে যেতে

কিন্তু তখনি যন্ত্রের মত সিস্টার এসে স্যালাইন বোতলটা পালটে দেয়, বলেন, ডাক্তার এসে গেছেন

খুব রাগ হয়, ডাক্তারবাবুর কী কোনো কাজ নেই!  এত সকালে কেন আসেন! নাকি রাতে ঘুমোন না! ভোর হতেই বেরিয়ে পরেন! তারপরেই মনে পরে যায়, আরে উনি তো এখানে রোগী দেখে চলে যাবেন বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ সেখানে আমারই মতো শত শত রোগী ওনার অপেক্ষায় মাফ করে দেয় ওনাকে

তাড়াতাড়ি ফ্রেস হয়ে পারিষদবর্গ (আর এম ও, সিস্টার -এদের মধ্যে আবার আর এম ও এর দেখা শুধুমাত্র ডাক্তার এলেই পাওয়া যায় অবশ্য ২ দিন একজন আর এম ও এসেছিলেন, সব দিক থেকেই ব্যতিক্রম, যেমন দেখতে তেমনি ব্যবহার। এমন ডাক্তার এলে শরীর এমনিই সুস্থ হয়ে যায় যদিও ২ দিনই ওনার টার্ন ছিল) নিয়ে আসা ওনাকে হাসিমুখে বলি সুপ্রভাত

কিছু সাধারণ প্রশ্ন -জ্বর এসেছিল? ইউরিন, পটি, হেডেক, ভমিটিং. . .।

মেঘঅদিতি বাধ্য মেয়ে হয়ে সব উত্তর দেয়, তারপর বলে, কবে আমার ছুটি হবে?

উনি বলেন, এই তো এ্যান্টিবায়োটিকটা শুরু হল। মিনিমাম পাঁচদিন লাগবে এডজাস্ট হতে। এটা শেষ হোক, তারপর কদিন দেখি. . .। 

দুজনেই আর কথা বাড়ায় না

উনি চলে যাবার পর মাসি তাগাদা দেয়, বিছানা পাল্টাতে হবে, স্নান করতে হবে. .

মেঘের তখন দুচোখে ঘুমভালো বাচ্চার ভূমিকায় অভিনয় করা ছাড়া কিচ্ছু করার নেইউঠে সামনে পাতা সোফায় বসে, বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে মাসির বিছানা পালটানো শেষ হয়, এক রংচটা নীল চাদর থেকে আরেক রংচটা চাদরে উঠে বসে মেঘ।

এবার ১৫ মিনিট অক্সিজেন নেওয়ার পালা. . কী যেন বলে তাকে-নেবুলাইজেসন!! কখনো কখনো স্যালাইন চ্যানেলে রক্ত এসে যায় মাসি মৃদু ধমক দেয়

সিস্টার এসে সিরিঞ্জ দিয়ে ওয়াশ করে আবার নর্মাল করে চ্যানেল বলে , এত ছটফট করলে রোজ চ্যানেল বদলাতে হবে

মেঘ হাসে এই সাতদিনে সাতবার চ্যানেল বদলেছেমনে মনে বলে, যা খুশি কর তোরা হাত নিয়ে , আমার কী! 

ঘড়িতে এখন সবে  ছটা আমার শহর আড়মোড়া ভাঙছে, ধোঁয়া উঠছে রাস্তার উনুনে, কেটলির জল ফুটছে, প্রথম ট্রাম ডিপো ছেড়ে ঘড়াং ঘড়াং শব্দে এগিয়ে চলেছে. . 

শুরু হচ্ছে আরো একটা দিন

মেঘের ভীষণ চা খেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু ঘড়ির কাঁটা মাপা এখানে। ঠিক সাড়ে সাতটাতেই চা আসবে। দুটো মেরি বিস্কুট দিয়ে। চা না সরবত বোঝার আগেই শেষ হয়ে যাবে ঠান্ডা জলের মতো কালো চা বা লিকার। আর আটটা বাজতেই আসবে চারপিস শক্ত হয়ে যাওয়া পাউরুটি,এক বাটি থকথকে ঘিয়ে রঙের স্বাদহীণ স্যু্প।একটা আধপচা কলা।

মেঘের ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে এমন শক্ত পাউরুটি আর স্যু্পের রেসিপিটা। কিন্তু এ বিষয়ে ক্যান্টিনের দিদি আর ভাইটার মুখে কুলুপ আটা থাকে। তা স্বত্তেও এ্যপ্রণ পরা দিদি যখন একগাল হেসে সুপ্রভাত বলে ব্রেকফাস্টের প্লেটটা এগিয়ে দেয়, মেঘের মন হঠাৎ করেই ভালো হয়ে যায়। সে উপলব্ধি করে পেটের খিদের থেকেও বড় খিদে মনের। মানুষের মুখের হাসি সেটা নিবারণ করতে পারে।

বাবার কথা মনে হয় মেঘের। বাবা বলত, মানুষের ক্ষিদে, যন্ত্রণা, শোক, দুঃখ সব অনুভূতি মুছে যেতে পারে যদি সে পরিপূর্ণভাবে কারোর ভালোবাসা পায়।

মেঘের কান্না পেল।এই প্রথম সে হাসপাতালে ভরতি অথচ একদিনও বাবা এলো না। অথচ বাবা মাথার সামনে এসে দাঁড়ালেই তার সব রোগ পালাই পালাই করে দূরে পালাতো। এ বিষয়ে সে একশোভাগ নিশ্চিত।

মেঘ চশমা খুলে চোখ মুছলো।   

ক্রমশ…

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>