৩০৪ নং কেবিন (পর্ব-৮)
আজকের আকাশটা কেমন যেন।পুরো রৌদ্রজ্বল যেমন নয়, তেমনি মেঘলাও বলা যায় না। একটা মাঝামাঝি সহবস্থান রোদ আর মেঘের।অনেকটা জীবনের মতো।কখনো উপচে পড়ছে সুখ তো পরমুহূর্তেই বিষাদ ঢেকে দিচ্ছে মনের অলিগলি।
আজও ছটায় ডাক্তারবাবু এসেছিলেন ।
সব ঠিক আছে -জানতে চাওয়ার আগেই মেঘ বলে উঠি, আপনার অপেক্ষাতেই ছিলাম।আজ আমি বাড়ি যাবই।
শুনে উনি বললেন, পুরো সুস্থ লাগছে?
মেঘ বলে, পুরো সুস্থ বলে কিছু হয় না।সবই আংশিক ।
ডাক্তারবাবু মেঘের মুখের দিকে চেয়ে কিছু ভাবলেন।তারপর বললেন, যান তাহলে বাড়ি।যদিও ভালো নেই আপনি।ওষুধ খেয়ে যেতে হবে।
মেঘ তাড়াতাড়ি বলে, আপনার নিয়ন্ত্রণেই তো থাকব।যেমন যেমন বলবেন দেখিয়ে আসব।
এবার ড: চক্রবর্তী হেসে ফেলেন।বুঝে যান, এ আজ নাছোড়বান্দা।
বলেন, বেশ, ডিসচার্জ লিখে দিচ্ছি । দুপুরের এন্টিবায়োটিক নিয়ে চলে যাবেন।
ডাক্তার চলে যাবার পর মেঘের ইচ্ছে হল চিৎকার করে সবাইকে ডাকতে।বলতে, আজ আমার ছুটি, আজ আমার ছুটি।কিন্তু দমন করল সে ইচ্ছে ।
পিয়ালি বলল, দিদি বাড়ি যেতে যেতে সেই দুপুর ২টো। তুমি বাড়ির লোককে বলে দিও খাবার পাঠাতে ।
২ টো হয়ে যাবে শুনেই মনটা ভারী হয়ে গেল।তবু তো ছুটি হবে, এই আশাতেই জানলার সামনে গিয়ে বসল সে।
গাছগুলো বৃষ্টির জলে স্নান করে কেমন নবপরিণীতা কনের মত লজ্জা নিয়ে দাঁড়িয়ে ।পাতাগুলো তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে , আর যেন সেই স্পর্শে সে শিহরিত হচ্ছে , চোখ বুজে আদর খাচ্ছে লাজুক মুখ নিয়ে।
মেঘ সেদিকে তাকিয়ে ভাবে, এই স্পর্শ ভীষণ দরকার ।নইলে কোনো সম্পর্কই বেঁচে থাকতে পারে না।ভিতরে ভিতরে ঘুন ধরে যায় ।শুধু বাইরের শুষ্ক আবরণ পরে থাকে ।
কত সম্পর্কই তো এভাবেই টিকে আছে ভালোবাসা হীন, অনুভূতিহীণ হয়ে, কেবল কর্তব্যের খাতিরে। সে বুকের ভিতর থেকে কেমন একটা কষ্ট অনুভব করে সহসা ।
এই কদিন তনয় নিয়ম করে সাড়ে চারটের মধ্যে হাসপাতালে এসে চুপ করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে ।সেভাবে কথাও বলে না।তাকে দেখে মনে হয়, মেঘ নয়, সেই অসুস্থ ।
খালি বলে, এত বড় রোগটা কিভাবে বাঁধালে! কেন যে এত ঘোরাঘুরি করো! পায়ে পড়ি তোমার, এবার লাগাম দাও, তোমার এই শুকনো মুখ, এত কষ্ট আমি . . .
তনয়ের চোখ জলে ভরে ওঠে। মেঘ হাসে। বলে- কি হত! বড়জোড় মরে যেতাম।তোমার তো ভালোই হত। কেউ জ্বালাবার থাকতো না। খেতে, স্নান করতে বলত না।
সে এবার বলে, ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল কোরো না মেঘ। তুমি জানো , তুমি ছাড়া আমি কিছুই পারি না।
মেঘের অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করে।কিন্তু ভেঙে পড়া এই করুণ মুখটা দেখে বড় মায়া হয় ।বলি, দূর! দেখো, আমি দিব্যি বেঁচে আছি ।এত সহজে ছাড় পাচ্ছ না।
কিছু খাবে? তনয় শুকনো মুখ করে জিজ্ঞেস করে।
মিষ্টি আনাবে? বলেই অবাক হয় মেঘ ।সে আদৌ মিষ্টি ভালোবাসে না।তবু বলল ।
আর কিছু?
মেঘ বলে, কাবাব ।
সে বলে, না সোনা, এমন করে না।বাড়ি গিয়ে দুদিন ঠিক হয়ে নাও, তারপরে খেও।তোমার ওষুধ চলছে।
অভিমান করে ঠোঁট ফোলায় মেঘ।
সে বলে, কথা দিচ্ছি সাতদিন বাদেই খাওয়াবো।এমন কোরো না।দোহাই তোমার সুস্থ হয়ে বাড়ি চলো আগে।
মেঘ চুপ করে থাকে। ভাবে, খেতে চাইলাম বটে, কিন্তু সত্যি তো খেতে পারব না।ডাক্তার এখন নর্ম্যাল ডায়েট বললেও, লিখে দিয়েছেন, তেল, ঝাল, মশলা, কিচ্ছু চলবে না।খালি সেদ্ধ ।
তনয় আবার বলে, আচ্ছা বেশ আনাচ্ছি। তারপর ড্রাইভারকে ডেকে টাকা দেয়।
মেঘ বলে, শুধু নলেন গুড়ের মিষ্টি আনবে, একটাই আনবে।আর ২ টাকার গাঠিয়া।
২ টাকার ? ড্রাইভার অবাক হয়।
তনয় বলে, মেঘ, ২ টাকায় কিছু হয় না।বাপন তুমি ১০ টাকার এনো।যেটুকু খাবার খাবে।বাকিটা থাকবে ।
মেঘ বলে, আমি তো একটাই খাব। মিষ্টি খাবার পর।
বাপন আর অপেক্ষা করে না।চলে যায় ।
তনয় উঠে আসে বেডের সামনে। তুমি অবুঝ হয়ে যেও না।তুমি এমন করলে আমি . . .
মেঘ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। বলে, বাড়িটা পরিস্কার করে রেখো। নিশ্চয়ই ডাস্টবিন বানিয়ে ফেলেছ এই কদিনে।
এবার সে হেসে ফেলে।পুরো ডাস্টবিন।তুমি যাবার আগে চিন্তা কোরো না, বাবান ঠিক গুছিয়ে নেবে।
হুম।
আচ্ছা ভূতগুলো আর জ্বালাচ্ছে নাতো তোমায়?
ভূত? কোন ভূত? তনয়ের প্রশ্নে মেঘ অবাক হয়।
কেন যেদিন এখানে এলে তার আগেরদিন রাতে।
রাতে আবার কী হয়েছিল?
মনে নেই তোমার? তুমি তো চিৎকার করে বলছিলে, কারা তোমাকে জোর করে বড় একটা আগুনের পাতের উপর শুইয়ে দিয়ে হাত পা বেঁধে দিয়েছে। তুমি এত করে বলছ, ছেরে দাও ছেড়ে দাও, আমি পুড়ে যাচ্ছি, তবু তোমাকে ছাড়ছে না।
কী ভুলভাল বলছ? এসব মজা আমার ভালো লাগে না। মেঘ বিরক্ত হয়।
আরে আমি কোথায় ভুল বলছি! তুমিই তো বলছিলে, তোমার চারপাশে সাদা সাদা পোশাক আর মুখোশ পরা লোকজন। তুমি বাবা বাবা বলে কত ডাকছিলে, তবু বাবা এল না। তারপর তো আমি এলাম। তুমি বললে, যেই তুমি এলে সব পালালো। আমাকে ছেড়ে যেও না। তারপর আবার জিয়া আর সুমাকে ডাকছিলে। বলছিলে, ওরা এলো, অথচ পাশের ঘরে চলে গেল আমার সঙ্গে কথা না বলেই। তুমি কাদঁছিলে- তনয় আমাকে ছেড়ে যেও না বলে।
সব বানিয়ে বলছ। এসব আমি বলিইনি। আমি বললে আমার মনে থাকতো ঠিক।
আচ্ছা বেশ। ভোরাই আসুক ওকে জিজ্ঞেস করি।মেঘ বলল।
করো। তুমি তো বলছিলে, এগারোটা বেজে গেল, আমাকে নিয়ে চলে যাচ্ছে, আর মেয়েটা এখনো বাড়ি ফিরল না।একবারও মায়ের কথা তার মনে পড়ে না। অথচ মেয়ে তোমার সামনে তোমাকে জড়িয়েই বসেছিল।মাথায় জলপট্টি দিচ্ছিল।
মেঘের এসব কিছুই মনে পড়ছিল না। সে এবার বলল, বুঝেছি, যেহেতু আমার জ্ব্রর বেড়ে গেছিল, এখন কিছু মনে আসছে না, তাই তোমরা এসব আজগুবি গল্প বানাচ্ছ। তা ভূত গেল কী করে শুনি?
সে কী আর এমনি যায়! কত মন্ত্র পাঠ করতে হল, তবে গেল।
ভালোতো! এমনিতে তো মন্ত্র পড়া হয় না, ভূত ছাড়াতেই না হয় পড়লে। মেঘ হাসল।
তনয় মাথায় হাত রেখে বলল, যা জোর ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে মেঘ।মনে হচ্ছিল এবার বুঝি আমার সব শেষ হয়ে গেল।
মেঘ হাসল। আশ্চর্য, এত কিছু ঘটেছে, তার একটুও মনে নেই! সে কী তবে সত্যি না ফেরার দেশের দিকেই যাত্রা শুরু করে দিয়েছিল! কে ফেরালো তাকে?
পরশু রাত অবধি জ্বরে সে কাতর চিল। রাত হলেই কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছিল। বাবা তো সেদিনই এসেছিল।সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরে সামনের সোফায় বসে তার দিকে তাকিয়েছিল।ইশারায় কিছু একটা বলছিল। তবে কী বাবাই যাত্রাপথ বদলে দিল!
মেঘ তনয়ের হাতটা নিজের হাতে টেনে নিয়ে বলে, কাল তাড়াতাড়ি এসো। দেরি কোরো না। আর আমার পরে যাবার জন্য একটা জামা এনো।
তনয় মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে চুমু খেয়ে চলে যায়।
আচ্ছা সাতসকালে বসে এসব ভাবছি কেন! আজ তো আমার ছুটি।নিজের ঘর, বিছানা, মেয়ে, মা, সব মুখগুলো আবার. . .।
সিস্টার দিদিদের সঙ্গে গল্প করতে ইচ্ছে করে।এরা সকলে সাড়ে সাতটার মধ্যে ডিউটি হ্যান্ডওভার করবে আটটার সিস্টারদের।সাতটা থেকেই সেই পর্ব চলে।এখনি কথা বলতে হবে।নইলে ব্যস্ততার সময় বিরক্ত করা।
উঠে পড়ে মেঘ।মনে মনে বলে, ছুটি ছুটি , আজ আমার ছুটি। গরম গরম রুটি । বলেই হেসে ফেলল! খুব ছোটবেলায় ছুটির দিন বন্ধুরা হাতে তালি দিয়ে একটা গান গাইত-ছুটি ছুটি গরম গরম রুটি। ছুটির দিনের সঙ্গে গরম রুটির কী সম্পর্ক জানা ছিল না। বাড়িতে ছুটির দিন রুটিও হতো না। মা নয় লুচি, পরোটা, চাউমিং কিংবা চিড়ের পোলাও বানাতো। ম্যাগি আসার পর শুরু হলো সব রকম সবজি সহযোগে তার অগাধ বিচরণ ।কাঁটা চামচ দিয়ে লম্বা লম্বা ম্যাগি আর তার ঝোল তখন খাবার জগতে বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছে।বিশেষ করে ঘরে বাইরে মায়ের মতো যেসব মা’রা দুহাতে সব সামলাচ্ছেন তাদের কাছে ম্যাগি হঠাৎ করেই দুমিনিটে রান্না ঘরের ঝন্ঝাট থেকে মুক্তির স্বাদ এনে দিয়েছিল।তখন সে ভাবত ছুটি মানে সারাদিন কোনো কাজ না করে আনন্দে কাটানো। মাকে দেখত রবিবার ঘর ঝাড়ছে, আলমারি গোছাচ্ছে, তার ফাঁকেই চলছে রান্না।
রবিবার বাবাও বাড়িতে। সকাল থেকে লোকজনের ভিড়,তারসঙ্গে সারা সপ্তাহ যে আইসক্রিম কাকু, ঘটি গরম কাকু সারা পাড়ার বাচ্চাদের সরবরাহ করেছেন তাদের মুখরোচক সেঁও ভাজা আর জিভে জল করা দুধ সাদা , গোলাপি, লাল, হলুদ, সবুজ আইসক্রিম তারাও হাজির বাবুর দর্শন পেতে।কারণ বাবু তখন কল্পতরু।আর তাদের চা জলখাবার দুপুরের ভাত দিতে গিয়ে মা ঘেমে একসা।
মা কেন ছুটি নিয়ে শুয়ে বসে ঘুরে কাটায় না এটা ভেবে মেঘ মাকে ভাবত খুব বোকা।আয়েশ করতে জানে না।আমি যখন বড় হব ১২ টায় উঠব, রান্নার লোক রান্না করে দিয়ে যাবে, বসে বসে খাব আর টিভিতে সিনেমা দেখব -এমনি সব ভাবত সে।
হায় রে মুর্খ আমি! তখন বুঝি নি বিবাহিত মেয়েদের ডিকসিনারিতে ছুটি শব্দটাই নেই। যত ছুটি মার কাছে পেয়ে এসেছে তারা।সংসার তাকে ছুটি দেয় না।
ছুটি মানেই দোকান বাজার, ঘর গৃহস্থালি, সারা সপ্তাহের সব ফেলে রাখা কাজ, কাজের লোকেদের রবিবার মানেই -বৌদি সারা সপ্তাহ কাজ করেছি, তুমি ছুটি পাচ্ছ, আমি পাব না! অগত্যা রান্নার পাশাপাশি বাসন মাজা, ঘর মোছা, কাপড় কাচা।
তারপরেও –করোটা কী! সারা সপ্তাহ তো ঘুরে বেড়াচ্ছ গায়ে হাওয়া লাগিয়ে, আর আমি উদয়স্ত পরিশ্রম করছি! বাড়ির কর্তা, কত পরিশ্রম করে মাটি কাটছে অফিসে ! আর আহা সত্যি তো অফিসে মেয়েটি যাওয়া মাত্র বলা হয়- ম্যাডাম, আপনি চুপ করে বসে থাকুন, আমরা সব করে নিচ্ছি!
ছুটি ছুটি গরম গরম রুটি এখন আর মনে আনন্দ আনে না।বরং মনে হয় রবিবারও অফিসটা থাকলে ভালো হতো, গৃহস্থালির ঝামেলা থেকে মুক্তি পাওয়া যেত। কীই বা হতো মাসে চার দিন তিনবেলা হোটেল থেকে বা হোমডেলিভারিতে খেলে! সুইগি তো আছে নাকী! কিন্তু তাতো হয় না।
এই যে ছুটি বলে এত আনন্দ পাচ্ছি, সেই তো বাড়ি গেলেই আবার সব দায়িত্ব, কি রান্না, কি বাজার, কি নেই, কি আনতে হবে. . এর থেকে বেশ আছি। নির্দিষ্ট সময়ে জিয়া খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছে , কোনো চিন্তা না করে আমি খাচ্ছি , এটাও তো সুখ।অসুস্থতার মাঝখানে পরম প্রাপ্তি ।
তখনি মনের মধ্যে কে জানো বলে ওঠে – নাই কিরে সুখ? নাই কিরে সুখ?— এ ধরা কি শুধু বিষাদময়?
যতনে জ্বলিয়া কাঁদিয়া মরিতে/কেবলি কি নর জনম লয়?—. . . . “সুখ” “সুখ” করি কেঁদ না আর,/যতই কাঁদিবে ততই ভাবিবে,/ ততই বাড়িবে হৃদয়-ভার।
.

কবি,কথাসাহিত্যিক,সম্পাদক ও প্রকাশক