চেয়ারম্যান মাও-এর মৃত্যুদিবসে শ্রদ্ধার্ঘ

Reading Time: 3 minutes

 

মাও সে তুঙ এর ৪৩তম মৃত্যু দিবসে গভীর শ্রদ্ধা। মাও সেতুঙ কীভাবে নেতৃত্ব দিয়ে চীনে বিপ্লব সম্পন্ন করেছিলেন তা কম-বেশী আমরা জ্ঞাত। তাই আমরা একটু ভিন্ন আঙ্গিকে মাও -এর মৃত্যু বার্ষিকী স্মরণ করব।

মাও এবং চীন সম্পর্কে এদেশে যে তিন ধরণের মাও অনুসারী রয়েছেন তাদের ভ্রান্তি উল্লেখের জন্য পর্যাপ্ত পরিসর এবং নির্দিষ্ট জায়গা নয় এটি। খুব সংক্ষেপে বলা যায় মাও এবং মাওয়ের চীন সম্পর্কে এখানে যারাই নিজেদের ‘পণ্ডিত’ পর্যায়ে ভেবে বিভিন্ন বক্তব্য, রচনা, মন্তব্য করে এসেছেন তার অধিকাংশই হয় ভুল-ভ্রান্তিতে ভরা, নয়ত অতিরঞ্জিত। কেউ না বুঝে যান্ত্রিকভাবে অনুসরণ করতে চেয়েছেন, কেউ বা জাতীয়তাবাদী বিচ্যুতিসমেত মাও চিন্তাকে আত্মস্থ করতে গিয়ে জতীয়তাবাদী ঘেরাটোপে বন্দী হয়েছেন।

এদের মধ্যে এমনও মাও চিন্তানুসারী নেতা রয়েছেন যারা ৩০-৪০ বছর ধরে মাও চিন্তা অনুশীলনের পর মাওকে ‘উন্মাদ’ বলেছেন! আবার কেউ মাও চিন্তাকে অথোরিটি মেনে নিয়েও এক পর্যায়ে নিজেকেই মাও চিন্তার উপরে তুলে ধরে অথোরিটি ঘোষণা করেছেন। আগেই বলেছি; এই ক্ষুদ্র পরিসরে মাওকে বা মাওচিন্তা কিংবা মাওবাদকে মূল্যায়ন করা যায় না। আবার কথিত মাওবাদীদের ইতিবাচক-নেতিবাচক বিশ্লেষেণে যাওয়া যাবে না।
অনেকে মনে করেন চীনা বিপ্লব সম্পন্ন হওয়ার পর সেখানে কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়া আর কোনো পার্টির অস্তিত্ব ছিল না। এই ভ্রান্তির কারণে এখানে বিপ্লবীরা নয়া গণতন্ত্রিক বিপ্লববের পরিবর্তে এক লাফে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের স্বপ্ন দেখে বসেন এবং যথারিীতি সেই স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পর্যবশিত হয়।

বিপ্লব সম্পর্কে মাওয়ের মহান উক্তিঃ আমাদের মত কৃষিপ্রধান দেশে সর্বহারা বিপ্লব করতে (যে বিপ্লব কার্যত নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব, এবং আজকের দিনে এই নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবও আর বুর্জোয়া পথে আসতে পারেনা) তিনটি জিনিস দরকারঃ এক. শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে একটি কমিউনিস্ট পার্টি। দুই. সেই পার্টির নেতৃত্বে একটি যুক্তফ্রন্ট এবং তিন. জনগণের বাহিনী।

১৯৪৯ সালে চীন বিপ্লব সম্পন্ন হওয়ার পর ১৯৫১ সালের খতিয়ানে দেখা যায় চীনা কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়াও আরো ৯টি পার্টি শাসন ব্যবস্থার অন্যতম শরিক ছিল।
এ ছাড়াও ছিল আরো ১০ টি গণসংগঠন বা শ্রমিক ইউনিয়ন।

মার্কসবাদ-লেনিনবাদ মতাদর্শকে সফল প্রয়োগ করে মাও সে তুঙ চীনের মত পশ্চাদপদ কৃষি নির্ভর দেশে বিপ্লব সম্পন্ন করেছিলেন। সেই সাথে যে তিনটি বিশেষ সংযোজন তিনি লেনিনবাদে সংযোজিত করেছিলেন সেগুলোই মাওকে বিশ্বের সকল নেতা থেকে আলাদা করে। মাওয়ের সেই তিনটি অবদানের কারণেই মাও চিন্তা (পরবর্তীতে মাওবাদ) লেনিনবাদের মৌলিক সংযোজন হিসেবে বিবেচিত।

যার প্রথমটি হচ্ছে মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লব। মহামতি লেনিন এই সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবরে প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিলেন ১৯১৯ সালেই। তিনি বলেছিলেন৬ “যদি সমগ্র জনসংখ্যা সরকারের কাজে অংশগ্রহণ করে কেবল তাহলেই আমরা একেবারে শেষ পর্যন্ত, রুড়ন্ত বিজয় পর্যন্ত আমলাত্রন্তের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারি। বুর্জোয় প্রজাতন্ত্রগুলোতে এটা কেবল অসম্ভবই নয়, পরন্তু খোন আইনই এটাকে নিবৃত্ত করে!আমলাতন্ত্রকে পরার্ভত করা হয়েছে। শোষকদের নির্মূল করা হয়েছে। কিন্তু সাংস্কৃতিকবান উন্নয়ন করা হয়নি বলে আমলারা এখনও তাদের পুরোনো স্থান দখল করে রয়েছে” [৪]

লেনিন যেটা শেষ করতে পারেননি সেটাই মাও শুরু এবং শেষ করেছিলেন। যে মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবকে সহ্য করতে না পেরে আজও বুর্জোয়ারা একে ‘মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি’ বলে আসছে।

 

দুই.

মার্কসবাদী দর্শন অনুসারে দ্বন্দ্বের নিয়মে বিপরীতসমূহের ঐক্যের নিয়ম-বিধি আবিষ্কার করা। বিপরীতসমূহের ঐক্যের নিয়ম-বিধি হচ্ছে নিখিল সৃষ্টির একটি মৌল নিয়ম-বিধি। এই নিয়ম ব্যতিক্রমহীনভাবে কাজ করে, হোক সে প্রাকৃতিক জগতে, মানব সমাজে বা মানুষের চিন্তায়। একটা দ্বন্দ্বের ভেতরে বিপরীতগুলোর মধ্যে একই সাথে রয়েছে ঐক্য এবং সংগ্রাম, এবং এর ফলেই সব কিছু চলছে এবং সব কিছু পরিবর্তী হচ্ছে। [৫]

 

তিন.

সমাজতান্ত্রিক সমাজে পুঁজিবাদের পুনরাবির্ভাবের বিপদ সম্পর্কে নির্দিষ্ট ধারণা দেয়া। মাও বলেছিলেনঃ যতদিন শ্রেণিসমহের অস্তিত্ব রয়েছে, কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে শুদ্ধ বেং ভুল চিন্তার মধ্যকার দ্বন্দ্বসমূহ হচ্ছে পার্টির অভ্যন্তরে শ্রেণি দ্বন্দ্বের প্রতিফলন।এটা উপলব্ধি করা অত্যাবশ্যক যে, সমাজতান্ত্রিক সমাজে শ্রেণি দ্বন্দ্ব ও শ্রেণি সংগ্রাম এবং তার সাথে পুঁজিবাদে প্রত্যাবর্তনের সম্ভবনা বিদ্যমান থেকে যায়। সর্বহারা শ্রেণি এবং বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যকার শ্রেণি সংগ্রাম, বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তিসমূহের মধ্যকার শ্রেণি সংগ্রাম, এবং মতাদর্শের ক্ষেত্রে সর্বহারা শেণি বেং বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যকার সংগ্রাম দীর্ঘ ও আঁকাবাকা হতে থাকবে এবং কখনো কখনো তা এমনকি অত্যন্ত তীব্র হয়ে উঠবে। সর্বহারা শ্রেণি তার নিজের বিশ্ব দুষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী বিশ্বকে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করে এবং বুর্জোয়া শ্রেণিও তাই করে। এদিন দিয়ে কোনটা জয়ী হবে, সমাজতন্ত্র না পুঁজিবাদ, এখনও তার প্রকৃত মীমাংসা হয়নি। [৬]

এই তিনটি ঐতিহাসিক সংযোজনের পর ঐতিহাসিকভাবেই মাও চিন্তাধারা মার্কসবাদ-লেনিনবাদের এক সম্পূরক ধারা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। আজকের দিনে কোনো দেশের পক্ষেই আর আগেকার ঢঙে বিপ্লব করা সম্ভব হবেনা। কৃষি ভিত্তিক শিল্পবিকাশ না হওয়া দেশগুলোতে মাও এর লাইন ছাড়া আর কোনোভাবে নয়া গণতান্তিক বিপ্লব করা সম্ভব নয়। চেষ্টা কম হয়নি, কিন্তু ফলাফল শূণ্য। সুতরাং ৪৩ তম মৃত্যু দিবসে মহান মার্কবাদী-লেনিনবাদী শিক্ষক মাও সে তুঙ এর শিক্ষাটাই আমাদের পাথেয় হয়ে উঠুক।

সহায়ক গ্রন্থসূচিঃ
১. ছোটদের মাও সে তুঙ – সুপ্রকাশ রায়। ১৯৫১, কলকাতা।
২. মাও সে তুঙ- শিব বর্মণ। প্রভাত প্রকাশন, লক্ষ্ণৌ, ১৯৫১।
৩. Strategic problems of Chinese Revolutionary War. P.P.H. 1951
৪. লেনিন রচনা সংকলন ৩৩-৪৭৪
৫. চারটি দার্শনিক প্রবন্ধ, ৯১, মা.স.র. ৩৮-৩৬
৬. মাও সে তুঙ নির্বাচিত রচনাবলী, ১-৩৪৪

 

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>