অপারেশন উত্তরসুর

Reading Time: 4 minutes

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com১.

কমলপুর টু শ্রীমঙ্গল বর্ডার ক্রস করে শ্রীমঙ্গল এলাকায় ঢুকতেই একটা ভালো লাগা ছুয়ে যায় তপুর মনের ভেতর। কাঙ্খিত অপারেশনটা এবার হাতের নাগালে ওর। ঠিক ওর বলা যাবে না বলতে হবে ওদের। ওরা তিনজন শুরু থেকেই এক সাথে। বাড়ি থেকে পালানো থেকে অস্ত্র শিক্ষা সবশেষে এই অপারেশনের দায়িত্ব। স্কুল জীবনের শুরু থেকেই একটা অস্থিরতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল দেশের জন-জীবন। ঊনসত্তরের নির্বাচন পরবর্তী অসহযোগ আন্দোলনই ওদের মনে স্বাধীনতা বীজ বুনতে শুরু করে। শ্রীমঙ্গল কলেজের প্রথম বর্ষের টসবগে তরুণরা যেন জানতোই তাদের সামনে এক কঠিন সময় আসছে। সবশেষে বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ভাষণই তাদের গতিপথ স্থির করে দেয়। বাকি ছিলো যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া। সেটাও স্থির করে দেয় শ্রীমঙ্গলে বোমা বর্ষণ। তপু, মধু আর বিকাশ আর দেরি করেনি। শ্রীমঙ্গল থেকে পাহাড়ি পথে যাত্রা শুরু। একটানা হেঁটে একসময় পৌঁছে যায় কমলপুর। ধলাই নদীতে ইতিমধ্যে অনেক পানি গড়িয়েছে। শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ-কুলাউড়া এলাকার লক্ষ লক্ষ চা শ্রমিক সহ বাঙ্গালী জনগোষ্ঠি কমলপুরে রিফিউজি জীবন যাপন করছে। ওরা তিনবন্ধু জেনেছে তাদের পরিবার ও কমলপুরেই বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থান করছে। কিন্তু ওরা রিস্ক নেয়নি। পরিজনের কান্না হয়তো ওদের বাধ্য করতো যুদ্ধ থেকে ফিরে যেতে। কিন্তু ওদের ইচ্ছে সেটা নয়। জীবন তো একটাই। দেশের এই ক্রান্তিকালে যদি দেশের জন্য কিছু না করা যায় তবে কি হবে বেঁচে থেকে। সারাজীবন আফসোস করে কাটাতে ইচ্ছে নেই এই তিন তরুণের। তাদের ট্রেনারসহ সবার একটাই কথা ছিলো। অদম্য ইচ্ছা না থাকলে ফিরে যাও মা বাবার কাছে। মৃত্যুভয় যোদ্ধাদের মানায় না। ওরা পরস্পরের হাতে হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করেছে ওদের জীবন বাজি রাখবে দেশের জন্য। সেই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করার সময় সামনে।

গত তিন দিন বিকাশ রেকি করে ফিরে এসেছে শ্রীমঙ্গল থেকে। ওদের প্রথম অপারেশনটা ওরা ওদের গ্রাম উত্তরসুরেই করতে চায়। ওদের পুরো পাড়াটাই এখন রাজাকার বদর আর আলশামসদের দখলে। একটা হিন্দু বাড়িতেও কোন সম্পদ নেই, বাড়িঘর নেই এমনকি নেই বাঁশঝাড়, গাছপালাও। সব ওরা তুলে নিয়েছে। শুধু শুকনো মাটি পড়ে আছে। আছে শুকনো পুকুর। পুকুরের জল সেঁচে মাছ ও ধরে নিয়েছে ওরা।

তপুদের বড় পুকুরের তিন কোণায় তিনটে বাংকারে দিনরাত পাহারায় থাকছে পাকি সেনা বাহিনীর জওয়ান আর তাদের পাহারা দিচ্ছে রাজাকার বাহিনী। ঢাকা-সিলেট হাইওয়ের পাশে হওয়ায় হাইওয়ে, রেলপথ আর কাকিয়া ব্রিজ পাহারা দেয়া ওদের প্রধান কাজ। কাকিয়া রেল ব্রীজ,সড়ক ব্রীজ শ্রীমঙ্গল থানা আর মৌলভীবাজার মহকুমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এগুলো রক্ষা করতে না পারলে মৌলভীবাজার,সিলেট সদর আর সুনামগঞ্জে পাকিদের রসদ আসা বন্ধ হয়ে যাবে।

পুরো ছকটি মাথায় রাখছে তপু। ওদের রসদ বন্ধ করতে হলে ঢাকা সিলেট হাইওয়ে বন্ধ করতে হবে। সাতগাঁও এর পাহাড়ের ঐ পাশে শায়েস্তাগঞ্জ খোয়াই ব্রীজ, মীরপুর ব্রীজ আর নতুনবাজার ব্রীজও উড়িয়ে দেয়া যেতো কিন্তু ঐ ব্রিজগুলি সীমান্ত থেকে অনেক দূরে। জনপদ বেশী। রাজাকার, আলবদর বেশী। পাহারা বেশী। শ্রীমঙ্গলের এই দুটি ব্রিজেও কঠিন পাহারা আছে। কিন্তু সীমান্ত থেকে কাছে আর পাহাড় জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ব্রীজের কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব।

বিকাশের দেখানো পথ ধরে তিনজন এগোচ্ছে পাহাড় জঙ্গল ডিঙ্গিয়ে শ্রীমঙ্গল কমলপুর রোডএর পাশ ঘেষে এগোচ্ছে ওরা। পাহাড়ী এলাকা হওয়ায় এবং সীমান্তের একদম কাছে বলে পাক-মিলিটারী বা রাজাকাররা এদিকে আসার সাহস পায় না। স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে খাসিয়া আর চা শ্রমিকদের বাড়ীঘর থাকলেও এই গভীর রাতে ওরা কেউ জেগে নেই।

শেষরাতের দিকে রামনগর পৌছে যায় ওরা। ওদের বন্ধু কাজল এর বাড়িতে এসে থামে ওরা। কাজল এর পরিজন সবাই ভারতে শুধু ঠাকুমা বাড়ি আগলে আছেন। ঠাকুমার অনেক বয়স। শরীরের চামড়া প্রায় কুচকে গেছে। কিন্তু এখনও চলাফেরা করেন দিব্যি। পুরো রামনগর হিন্দুপাড়ায় এই এক বৃদ্ধা ছাড়া কেউ নেই। শুনশান নিরবতার মাঝে ঠাকুমার দরোজায় কড়া নাড়ে ওরা। বিকাশ ঠাকুমাকে বলে গিয়েছিলো ওরা আসবে। ঠাকুমা হয়তো তাদের অপেক্ষায়ই ছিলেন। ভেতর থেকে আওয়াজ এলো কে ?
-আমরা গো ঠাকুমা, বিকাশ।
-ও।
অন্ধকারেই দরোজা খুলে দিলেন ঠাকুমা। দরোজা বন্ধ করে কুপি জ্বালালেন। ঠাকুমার সাথে ফিসফিস করে আলোচনা সেরে ফেললো ওরা। ঠাকুমা মুড়ি কলা দিলেন। খেয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো তিনজন। গভীর রাতে অনেক দূর থেকে কুকুরের ডাক ভেসে আসছে। খুব ভয়ংকর লাগছে সেই ডাক। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঠাকুমাও শুয়ে পড়লেন।

অপারেশনর উত্তরসুর

ঠাকুমার কথা বলার শব্দে ঘুম ভাঙ্গলো তপুর। একা একাই কথা বলছেন ঠাকুমা। একা একাই দিন কাটে তার। বয়ষ্ক মানুষ। ক্ষেতের চাল, শাকসবজি এসব নিয়ে চারটে ফুটিয়ে নেন মাটির চুলোয়। সারা গ্রাম শুনশান। কোন লোকজন নেই। তারপরও ওরা কেউ বের হলো না। চুপ চাপ শুয়ে রইলো ঘরে। আজ রাতেই অপারেশন। ঠাকুমা চাল-ডাল-সবজি ফুটিয়ে খিচুড়ি বানিয়ে দিলেন। অমৃত মনে হলো ওদের। নিজেদের মধ্যে আলোচনায় আজ রাতের কাজটির বিষয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করলো তিনজন।

গভীর রাত। কাকিয়াছড়ার শুকনো খাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে তিনটি কালোমূুর্তি। দুপাশে ঝোঁপঝাড়ে অন্ধকার আরো গভীর। কোথাও কোন সাড়া শব্দ নেই। কাকিয়াছড়া রেল ব্রিজের দুই পাশে দুটি বাংকারের অষ্পষ্ট অবয়ব। ঘন কুয়াশায় জুবুথুবু চারপাশ। ব্রিজের কয়েকশত গজ দূরে এসে থামে তিনমূর্তি। নিজেদের মধ্যে ইঙ্গিতে কথা হয় তাদের। তারপর তিনজন তিনদিকে ক্রল করে এগিয়ে যেতে থাকে।

হেরিস কোম্পানী পেটা ঘড়িতে রাত তিনটের সংকেত। সংকেত এর রেশ ফুরিয়ে যেতে না যেতেই পরপর তিনটি ভয়ংকর বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে উত্তরসুর এলাকা। দূর থেকে দেখা যায় আগুনের ফুলকি মানুষের চিৎকার আর গোঙানীর আওয়াজ রাতে নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। বড়পুকুরের তিনটে বাংকার থেকে গুলির আওয়াজ আর আগুনের ফুলকি দেখা যায়। দূরে কুকুরের কান্নার শব্দ। তালতলা থেকে অনেকগুলো টর্চ জ্বলে ওঠে। কিন্তু কোন আলো এগিয়ে আসে না কাকিয়াছড়া রেল ব্রিজের দিকে।

সকাল হতেই হই চই পড়ে যায় শ্রীমঙ্গল এলাকায়। কাকিয়া ছড়া রেলব্রীজের দুপাশের দুটি স্প্যান অক্ষত থাকলেও মধ্যের স্প্যানটি ভেঙ্গে গুড়িয়ে মাটিতে পড়ে আছে। ব্রীজের দুপাশের দুটি বাংকারে একজন পাকসেনাও জীবিত নেই। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে আসা মিলিটারীরা হম্বি তম্বি করছে স্থানীয় রাজাকারদের ওপর। একদল পাকসেনা রাজাকারদের নিয়ে গ্রাম সার্চ করতে বেরিয়ে পড়ছে। আশপাশের গ্রাম তন্ন তন্ন করে খুজেঁও কোন মুক্তির সন্ধান পেলো না ওরা। রাস্তায় পাওয়া কটা গরু-ছাগলকে পিটিয়ে হাতের সুখ মেটাল ওরা।

অপারেশন শেষ করে তপুরা দেরি করেনি। ঠাকুমার কাছ থেকে আগেই বিদায় নিয়েছিলো। কাকিয়াছড়ার শুকনো খাত ধরে প্রথমে ক্রল করে দক্ষিণ দিকে এগিয়ে এসে দ্রুত পায়ে হাঁটতে শুরু করে পাহাড়ি পথে। অন্ধকার থাকতে থাকতেই পাহাড়ের ভেতর ঢুকে যায় ওরা। তারপর সেই পুরনো পথে এগোতে থাকে সীমান্তের দিকে। এক সময় সূর্য ওঠে তার রক্তিম রং ছড়িয়ে। পাখির কাকলীতে আর অচেনা নানা শব্দে ভরে ওঠে বনাঞ্চল। তপুর মাথায় পরবর্তী অপারেশনের চিন্তা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। আনন্দ আর ক্লান্তি দুটোকেই উপভোগ করতে করতে তিন বন্ধু এগোতে থাকে কমলপুরের দিকে। ধলাই নদী আর খুব দূরে নেই।

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>