Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

আগুন

Reading Time: 5 minutes
Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com
বাসের জানলা দিয়ে মাথাটা প্রায় পুরোটাই বের করে রেখেছিল অলোক। বাইরে বৃষ্টি হয়েছে কিছুক্ষণ আগেই, ঠান্ডা হাওয়া বইছে বটে! তাও পুড়ে যাচ্ছে সে। কন্ডাকটরের বকুনিতে মাথাটা ঢুকিয়ে নিল। শরীরে অস্বস্তিটা আরো বেড়ে গেল। আরো সাত আট মিনিট …
বাস থেকে নেমেই রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে বমি করে দিল। তারপর প্রায় টলতে টলতে বাড়িতে ঢুকল। দরজা খুলে দিল নন্দিনী।চোখ তাকিয়ে দেখল নন্দিনীর খোলা চুল, হাতকাটা নাইটি, কপালের টিপটা লেপে গেছে। 
জুতো খুলে হাত মুখ ধুয়ে ঘরে ঢুকতেই নন্দিনী চা নিয়ে এল। কথা বলে না নন্দিনী খুব দরকার ছাড়া বহুদিন। রোবটের মতো ঘুরে বেড়ায় অলোকের সামনে দিয়ে। চারপাশে একটা অগ্নি বলয় যেন! ছুঁতে গেলেই পুড়ে যাবে অলোক‍। অসহ্য লাগে ওর। আজ মাত্রা ছাড়িয়ে গেল তার – এত দম্ভ কেন নন্দিনীর। সে কি এতই ফেলনা! হাত ধরে টান দিল নন্দিনীর। চমকে উঠল নন্দিনী। উষ্ণতা তো নয়, এত শীতল কেন! অলোক!
আর বেশি ভাবার সময় পেল না সে। ততক্ষণে অলোকের হ্যাঁচকা টানে বিছানায়। বাধা দেওয়া, অনিচ্ছার সময়টুকুও নেই, শক্তিও। অলোক উদ্দাম। আঠাশ বছর আগেও অলোককে এমন কোনোদিন দেখেনি নন্দিনী। দীর্ঘ সাত আট বছর ওদের কাছে আসা হয়নি। নন্দিনী যত শান্ত হয়ে বুঝতে চেষ্টা করে অলোককে, অলোক তত দুর্নিবার হয়ে ওঠে। নন্দিনীর নীরবতা, আরো পাশবিক করে তোলে অলোককে।
রাত বারোটা। নিজের ঘরের জানলাটার পাশে দাঁড়ায়। কত সিগারেট জ্বললে অলোকের সমান ছাই জমবে অলোকের আজ জানা নেই। ঠোঁট ফাঁকা নেই। দরজা খুলে নন্দিনী ঘরে ঢোকে। খুব শান্ত স্বরে বলে,
– খেতে এসো। বুবাই ঘুমিয়ে গেছে। কাল ভোরে উঠতে হবে। ওর পরীক্ষা আছে।
উফফ্! এত শীতল কন্ঠ একজনের কী করে হতে পারে ! অবাক হয় অলোক। নন্দিনীর গলার কাছটায় নাইটির ফাঁক দিয়ে আঁচড়ের টাটকা ক্ষত দাগ উঁকি দিচ্ছে। অলোকের ভেতরের ক্ষত বেড়ে যায়। অস্ফুট স্বরে বলে ফেলে,
– সরি! নন্দিনী।
নন্দিনী বের হতে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়। কাছে আসে। ওমনই শীতল গলায় বলে,
– মিষ্টু নেই। অথচ এ তো যন্ত্রণা নয়, ক্ষোভ কেন অলোক? হেরে গেছ কি? 
চমকে ওঠে অলোক। নন্দিনী কী করে জানল?  কেউ কী তাহলে ওকে ফোন করেছিল? সবসময় ও কী করে সব জেনে যায় আজও বুঝতে পারে না সে। অথচ কখনো ওর ফোন, ওর ডায়েরি ওর ব্যাগ কোথাও নন্দিনীর সন্দেহের ঘেরাটোপে পড়ে না। কোনো প্রশ্ন করে না ভুল করেও। এই অবাধ স্বাধীনতাই অসহ্য লাগে অলোকের। নন্দিনী বোঝে নি কোনোদিন। কলেজ লাইফ থেকে একরকম রয়ে গেল ও। ওর ঔদাসীন্যই দিনের পর দিন বাড়িয়ে তুলেছে অলোকের অপরাধ, অথচ নন্দিনী নির্বিকার। কিছুতেই এ স্বাধীনতা অলোক ভোগ করতে পারে নি। কোথাও নন্দিনী বেঁধে রাখে। কী করে যেন জেনে ফেলে সব। বুবাইয়ের কথা ভেবে কি? নাহ্। এমনই সে বরাবর কলেজের সময় থেকেই …
– কি হল? উত্তর দেবে না জানি। নিজেকে দিও। খেতে এসো।
– মিষ্টু নেই আর তবুও তোমার রাগ? 
– থাকতেও রাগ করিনি। অবাক হচ্ছি আজ তোমায় দেখে। অচেনা লাগছে! খেতে এসো।
– আজ খাবো না। শরীর ভালো নেই।
– বেশ। জলের গ্লাস রেখে গেলাম।
নন্দিনী ঘুমাতে চলে গেল। দীর্ঘদিন ওদের দুই বিছানা। অলোক আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো। আয়নাতে কত দাগ! হাত দিয়ে ঘষে ঘষে মুছতে চেষ্টা করল অলোক।
– আসতে পারি স্যার? 
– আরে! তুমি! তোমায় ঢুকতে দিল? আমায় বল নি তো আসবে ? হঠাৎ কী ব্যাপার?
– স্ট্যাচু। 
– উফফ্!
– হুমম। আমায় ঢুকতে দিল কারণ আমি আপনার তিনদিন আগে করা ম্যাসেজ,  “চলে এসো অফিসে যে কোনো সময়” দেখিয়ে যুক্তি তক্কে সকলকে হারিয়ে দিলাম। বললে, সারপ্রাইজ হতো না। বাইরে মিট করতে হতো, তোমার এই ঘর দেখা হত না আর হঠাৎ নয়, কারণ আছে। স্ট্যাচু আউট।
মিস্টু, মাসখানেক হল পরিচয়, একটা কবিতা পাঠের আসরে। বয়স বড় জোর পঁচিশ ছাব্বিশ। অসম্ভব শক্তিশালী শব্দ ওর। অথচ অসম্ভব ক্যাজুয়াল। চোখে পড়ে সবার মাঝে ওকে – ওর চোখে বাঁচার তাগিদ পুঞ্জীভূত। আমার তিনটে বইয়ের কবিতা ওর ঠোঁটস্থ, সাথে যেখানে যা লেখা বেড়োয় সবের ঠিকুজি কুষ্ঠি জানা, এবং আগাম খবর গুলো অবধি। কী করে জানে কে জানে। এই কিছুদিনের মধ্যেই ও একটা দাবী তৈরী করে ফেলেছে আমার উপর। বছর বাহান্নর এই  আমারও প্রশ্রয় দিতে বেশ লাগে। তবে অফিসে চলে আসবে ভাবি নি। 
– বল কী চাই।
– তোমাকে। 
ঠোঁট দুটো আমার ঠোঁটের এক্কেবারে সামনে নিয়ে এসেই মুহূর্তে সরে গিয়েই হো হো করে হাসতে আরম্ভ করল। ওই এক মুহুর্তে ঘেমে উঠেছিলাম আমি। ও ততক্ষণে আমার সেক্রেটারীর টেবিলের উপর চড়ে বসে পা দোলাচ্ছে। 
– তোমার একটা উপন্যাস চাই। না শোনা আমার স্বভাবে নেই। সময়ও না।
– কী হবে!
– আমি পত্রিকা বের করছি। তোমার যা চ্যাম্পু বাজার। একাই সেঞ্চুরি।
– এই! ঠিক করে কথা বল।
– উফফ্! মাননীয় সাহিত্যিক অলোক চট্টোপাধ্যায় মহাশয়, আপনার একটি উপন্যাস আমাদের পত্রিকার জন্য পেলে আমরা ঋদ্ধ হব। এবার ঠিক আছে? বলে নিজেই হেসে গড়াগড়ি খেতে লাগল। একটি উপন্যাস, নতুন পত্রিকা! একটু খুঁত খুঁত করছিল তবে না বলার সাধ্য হল না ওর চোখে তাকিয়ে। ওর চোখে কী আছে জানি না। তবে ফিরিয়ে দেওয়া ওর চোখ সইবে না। আমিও ফেরাতে পারি নি। কখনোই পারি নি। বরং দাবীর আদান প্রদান বেড়ে গেছে। সাহিত্যিক মহলে যুগপৎ কে নিয়ে আলোচনা বেড়েছে। ও কখনোই পাত্তা দেওয়ার মেয়ে নয়। আমিও বেপরোয়া। আমার সব লেখার জগৎ ঘিরে নিয়েছে মিষ্টু একাই। আমাকেও শরীর থেকে মন-কলম থেকে কাব্য সবটুকু জুড়ে মিষ্টু। ও একটা স্কুলে পড়ায়, একাই থাকে। বাবা মা গ্রামে আর কিছু জানি না। প্রয়োজনও পড়ে নি। ওর ফ্ল্যাট ক্রমশ আমার আশ্রয় স্থল হয়ে উঠল। ও ও কেমন আঁকড়ে ধরল আমায়। বিয়ের নাম শুনলে চটে যেত। অথচ মাঝে মাঝে আমার নিজের তীব্র দহন হতো! আমার হাঁটুর বয়সী একটি মেয়ে! তার জীবনে এভাবে জড়িয়ে পড়ে নিজের দহন বেড়েই চলল কিন্তু পোড়া থামাতে পারলাম না। সব কিছু বুঝতে পারত নন্দিনী, ওর চিরকালীন শীতলতা আরো আমায় পতঙ্গের মতো টেনে নিত মিষ্টু নামে আগুনের দিকে।বছর তিন এ কোথাও ভাটা পড়েনি সম্পর্কে। কী অসম্ভব অলিখিত দাবীতে জড়িয়ে পড়েছি দু’জনে ক্রমশ‌।
হঠাৎ একদিন মিষ্টুর ফোন। বাড়ি যাচ্ছি। এমন মাঝে মাঝেই যেত। কিন্তু সেবার সাতদিনেও ফিরল না। চারদিন পর থেকে ফোন বন্ধ হয়ে গেল। ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ কোথাও নেই। ছুটে গেলাম ফ্ল্যাটে। ভাড়ার ফ্ল্যাটে ও সব টাকা মিটিয়ে দিয়ে গেছে। থমকে গেলাম। সহ্য হল না। দুদিন পর গাড়ি নিয়ে গেলাম ওর গ্রামে। ভুয়ো ঠিকানা।আগুন জ্বলতে লাগল মাথায়। এর মানে কি? ফ্রড! কী করে তাই বা বলি? তাও তো বলতে পারছি না। মেয়েটির শক্তিশালী কলম। আমাকে জড়িয়ে উঠতে পারতো অনেকদূর। কিছুতেই রাজী হয়নি। নিজের লেখা ডায়েরির বাইরে বের করতে। আমার কাছ থেকে কোনো টাকা নেয়নি, চায়নি। উপহারে বই ছাড়া কিছুই দিতে পারিনি আমি। তবে কি চাইতো ও? যা আমি দিতে পারিনি। স্কুলে গেলাম ওর- ওখানেও ও রেজিগনেশন দিয়ে দিয়েছে। না, দোষারোপ করতে পারছি, না ওকে খুঁজে পাচ্ছি। একটা জলজ্যান্ত মানুষ উধাও। অসহ্য যন্ত্রণায় থেমে গেল কলম। কিছুতেই আমি সামলাতে পারছিলাম না। দহন! আগুন উফফ্!
ফোনটা বাজছে, মিষ্টুর রিং টোন। “যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন…”। তিন মাস পর …
– হ্যালো মিস্টু। ব্যাপার কি তোমার?
– না! আমি মিষ্টুর বাবা। একবার শ্মশানে আসবেন। আমাদের গ্রামের শ্মশানে …
– মানে? কি হয়েছে মিষ্টুর?
– আপনি আসুন। ঠিকানাটা পাঠিয়ে দিয়েছি ম্যাসেজে। ফোনটা কেটে গেল।
শ্মশানে মিষ্টুর দেহ। সাথে আরো একজনের। বৃদ্ধ একজন কাঁপা হাতে একটা কাগজ আমায় ধরিয়ে ভেঙে পড়ল কান্নায়। কোঁচকানো কাগজ মেলে ধরলাম আগুনের আলোয় – 
‘ক্ষমা করো অলোক। আমি আমার পাশের শরীরটা ছাড়া আর কাউকেই ভালোবাসতে পারি না। পারিনি। তোমাকে ব্যবহার করেছি শুধু। তোমার লেখাকে আসলে।  তোমার লেখা আমার পত্রিকার বিক্রি বাড়িয়েছে ক’দিনের মধ্যেই। প্রচুর টাকা লাভ করেছি। এ লাভ এত দ্রুত তোমায় ছাড়া সম্ভব ছিল না। আমি নিরুপায় ছিলাম। আমার পাশে যে শুয়ে আছে- দেখতে পাচ্ছ? তার নামও অলোক। আমাদের বিয়ের একমাসের মাথায় ওর হার্টের দুরারোগ্য অসুখ ধরা পড়ল। চিকিৎসার টাকা লাগত। স্কুল, টিউশন সবে মিলেও কুলাচ্ছিল না। পত্রিকার কথা মাথায় এল আমার, সাথে তোমার কথা। জানতাম তুমি থাকলে লাভ হবেই! সব টাকাই আমার অলোকের জন্য খরচ করেছি। গত তিন মাস আগে ডাক্তার বলে দিল, সময় শেষ। তাই সব ছেড়ে পালিয়ে এলাম ওর কাছে। কিছুক্ষণ আগে ও চলে গেল। এবার আমার পালা, আমিও ঘুমোবো। অপরাধের ক্ষমাটুকু করে দিও। ঋণী রেখো না।’
পাশাপাশি তিনটে  চিতা জ্বলছে। তৃতীয়টি অদৃশ্য। কেউ দেখতে পাচ্ছে না। নন্দিনী পাচ্ছে। শুধুমাত্র নন্দিনী। আমার মিষ্টুর মৃত্যুতে যন্ত্রণা নেই। কষ্ট নেই, কান্না নেই, ঘৃণাও নেই। হেরে যাওয়া আছে। আমি হারতে শিখিনি।  বিখ্যাত সাহিত্যিক অলোক চট্টোপাধ্যায়!  যার জন্য মেয়েরা পাগল, যার জন্য প্রেমের শত শত প্রলোভন। সে হেরে যাচ্ছে আর এক অলোক নামে পুরুষের কাছে, মিষ্টুর কাছে, নন্দিনীর কাছে। আয়নার ওপারে আগুন জ্বলছে, নিভছে না … নিভভে না …।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>