| 3 অক্টোবর 2024
Categories
কবিতা সাহিত্য

চাষা হাবিবের একগুচ্ছ কবিতা

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

 

 

ভাষার পরকীয়া বাসর

কোথায় যেন সুরের পাখি গেয়ে ওঠে

জলের অক্ষর মুছে ক্ষতস্থান শুকায়

দূরের আকাশ

কাছে টেনে নেয় দারুণ ভালবেসে।

পরিষ্কার মানুষ পরিষ্কার শূন্যস্থান

ডানা ঝাপটায় ভাষা।

অর্ধেক খেয়ে ফেলা বর্ণমালা

মুঠোয় মুঠোয় হয়ে যায় সে

শব্দজট হিং-টিং ভালবাসা।

ক্ষুদে বার্তায় চাষে অপভাষা

গানের সুরে পোকা ধরে

আধেক কথায় মিশে যায় নগ্ন

বণিয়া সুড়সুড়ি কথা।

অক্ষরে অক্ষরে পাশা খেলায়

দুঃখিনী বর্ণমালা পরাজয় মেনে

দুষণে দুষণে নিঃস্ব হয়

মেনে নেয় সমকাম।

সীমানা প্রাচীর ভেঙ্গে শব্দ ছোটে

হু হু করে।

মাতাল স্রোত কে রোখে

ভাসে অক্ষর ছেয়ে যায় আকাশ

বেতাল নাভী চুম্বন ফাঁদে ফেলে

                          জারজ প্রেম।

চকচকে দুনিয়া অন্তর্জালে গেঁথে নেয়

চাষা বর্ণের বুকচাপা আর্তনাদ।

বিষাক্ত কলম এঁকে দেয়

সুরের পাখির ছটফট হাহাকার

রক্ত অক্ষর হয়ে যায় কদাকার।

জলের গানে ধুয়ে মুছে শুকায়

                  ক্ষতের দাগ।

লোভাতুর বিজ্ঞাপন সাজায় 

ধর্ষিত ভাষার পরকীয়া- 

বাসর রাত ।

 

 

কৃষ্ণকলি- এখনও ক্যামেলিয়া

পাড়াসুদ্ধ মজলিসে জেগে থাকে

জোৎস্না রাত কি দারুণ নাটক।

মাতুব্বরের জোয়ান পোলা রক্তে দানব

খেয়ে নেয় শীতের ভাপা পিঠা

একা চেটে কৃষ্ণকলির গায়ের ওম

আত্মচিৎকার

বাঁচাও

কেউ কপাট খোলেনি-শুধুই দুঃসাহস

রক্তাক্ত যোনি ছিড়ে উল্লাসে

পাশা খেলে

ক্ষমতা

রাজপাট।

উৎসব মজলিসে উত্তাপ খোঁজে

সব নেওটা পদলেহনের দল

মুচকি হাসে কি দারুণ নাটক।

কৃষ্ণকলির কালো প্রেম আজ ফর্সা

জোৎস্না মেখে-বিলাপ চিৎকার

আত্মচিৎকার

ওঁ হাঁমাক জল দিলু ক্যান।

হেঁসে ওঠে মজমা টিপ্পনী কাটে

উত্তর মেলেনি শিশির মেখে ঘাসফুল

দুমড়ে

মুচড়ে

পিষ্ট ক্ষমতার প্রসব ফেলে যায়

বেনামি জারজ       কি দারুণ নাটক।

প্রহসন শুধুই প্রহসন

জলের গানে স্বাধীনতার অশ্রুবিসর্জন।

বিলাপ বিষ বাষ্পে

ওঁ হাঁমাক গাওত জল দিলু ক্যান।।

(সাঁওতালি মেয়ের ধর্ষণ এবং বিচারের নামে তামাসাকে কেন্দ্র করে লেখা)

 

নোনা জলের সাতকাহন

সমুদ্রের পানিতে বুক,ঠোঁট ভিজিয়ে

তুমি বললে সব জলেই কি তাই

আমি বলেছিলাম চোখের জলেও

 যে নোনা।

এরপর কত প্রশ্ন তোমার-

সাগরের জল না হয় কিন্তু

চোখের কেন!

যে জল গহন ধূ ধূ প্রান্তরের

নুড়ি আর বেদনার শিখায় জমে অতলে

সে জল যে প্রবাহিত হয় মহাকালের বাঁকে

তারপর-তারপরই না মেশে অশ্রুরাশিতে।

সাতসমুদ্র আর কতশত নদীর মোহনায়

দূর্গম চর, পেত্রা আর কিরিতিয়ার হৃদয় চিরে

তাই না নোনা-যে নুন জমে হৃদয়ে।

তোমার আঁচল ভিজেছিল যে লোনা খুনে

তারপর এ জল কতশত ক্রোশ পেরিয়েছে

অমরা, ডিম্বকের আর বেহুলার তৃপ্ত রস মেখে

দেহের ভাঁজে আর প্রেমহীন বালুচরে।

শুষে নেয় মাটির ঘ্রাণ মজলুম চাষার ঘাম

তারপর শ্রমের শাসে নুনের বাসর গলে যায়

সমুদ্রের হৃদপিণ্ডের।

সেই থেকে চোখ অভিমানে অশ্রু দেয়

নুনে ভরা গোলা আর হাহাকারে।

এ জলে বুক, ঠোঁট আর সারা অঙ্গ

তুমি ভিজিয়েছ বারবার আর আমায় করেছ সিক্ত।

 

সেবার কেঁদে কেঁদে তুমি বলেছিলে

আমি না হয় নুনখুণে গলছি

কিন্তু তুমি অশ্রুর শোণিতে কেন!!

যে নুন বুকে নিয়ে বেঁধেছি ঘর

সে যদি জ্বলে আমি তো গলবই

সেই থেকে নোনাজল আর চোখের জল

মিশে একাকার ভালোবেসে সমুদ্রের লোনা বাতাস।

 

জলের কাজল

জল ভেঙ্গে সেই তুমি

                 চলে গেলে

নিঃশব্দে

তোমার গন্ধে কতবার

কতবার আমি পুড়িয়েছি

              আমার অন্ত্র।

কতবার আমি খোপায় জড়িয়েছি

হিম শীতল সাপের খোলস,

মেপে মেপে আমার চুলে তুমি এঁকেছিলে

         গঙ্গারিডির কারুকাজ

অথচ সেই তুমি চলে গেলে

দুপুরের জল এখনও মুছে নি

                        চোখ।

জেগে থাকে রাত ঘুমহীন পাথর

আমি কতরাত ভেসেছি ভেলায়

কত দিন স্পর্শের শামুক পারদ

ছুয়ে গেছে তোমার নিঃশ্বাসে,

তুমিও সেদিন লোবানের জলে

ভিজিয়েছ তোমার চিবুক।

সেই থেকে আমি মুছিনি চোখ

সেই নিরবতা

            সেই প্রস্থান

বাকরুদ্ধ দীর্ঘপথ

বাড়িয়েছে জলহীন বালুচর।

আমিও ধুপে পুড়িয়েছি খড়ের গাদা

কেটেছি মাচানের কুমড়ো ডাটা

লাউয়ের ডগায় কত ছাই ছিটিয়ে

করেছি পাঠ চাষের যবনিকা।

সেই তুমি আর বলোনি কথা

আমি জলকাব্যে করেছি ছটফট

মুছেছি কাজল রেখা

আর তুমি,সেই তুমি হলে

ভালোবাসলে রোদ্দুর, নিখুঁত বিকেল

আর আমায় দিলে শুধুই

           জলের কাজল।

 

আঁধার পোড়ানো কোরাস

আঁধার পোড়ায় যে সকাল

সমবেত কোরাসে জেগে তোলে যে

শব্দের ভেলা

বিষমাখা খাবার যে আঁধারে

হয়ে যায় বিষহীন স্বাস্থ্যকর

সে রুপের কসম

আমি আবার মরতে চাই

তোমার সে আঁধারে।

আমি আবার ডুবতে চাই তোমার

অন্ধকারে।

যেন সেই ঘামমাখা গন্ধে

তিমির সেই কালোয় কিংবা

নুন মাখা দুপুরের সুবাসে

আমি আবার গেয়ে উঠবো কোরাসে

আঁধার পোড়ানো গান।

যে সূর্য দেখায় আঁধারের যবনিকা

সকালের প্রেম

আমিও সে প্রেমে ভিজতে চাই

পুড়ে আমিকে হয়ে আমার নির্বাসন

আমি থেকে হয়ে আমার উদ্বোধন।

আমাকে নিয়ে যাও সেই আমিতে

যেখানে অন্ধকার বপন করে

আলো আঁধারের বীজ।

আর লিকলিকে বাড়ে আমি তরতর

খোঁজে না আমি রোদ্দুর জৌলুস।

আঁধার কোরাসে বাজে গীত সাঁনাই

সে সুরের কসম

আমি আবার মরতে চাই

আমাকে সে তোমার সুরাতে পুড়ে

কর শ্রাদ্ধ দিয়ে আঁধার সমার্পণ।

 

যাযাবর ক’ছত্র

কত রাত যেন হয়ে যায় উর্বর

বেদনার সুরে কত বিকেল যেন মেখে নেয়

                                 মেকি রঙ

খোলসের বিড়ালে আঁচড় কাটে

পুরানো খেলার দাগকাটা ময়দান

কি দারুণ রেসে কেঁপে ওঠে খেলার মাঠ

ওরা দল বেঁধে গেয়ে ওঠে শোষণের কোরাস

হাত মেলায় সব চোষমখোরের দল।

যে আঁচলে ফুটেছিল ভালোবাসার ফুল

যে ফুলে কত বিবর্ণ মধুকর লুটেছিল স্বাদ

আর বেদনার সব দিয়েছিল রক্তে মিশ

                     আমি কি কষ্টে সয়েছি সব

যেন একদিন আবারো হয়ে যায় রক্ত গোলাপ

সেই একাত্তর যেন আমার রক্তে ফেরে বারবার

কি দারুণ জোট সব চোরদের

যেন ভাগাড়ে মিশেছে সারমেয় শৃগাল

আর সব খোঁকোদের ভীড়

আমার পাঁজরে যেন ঘুণের কীট

খেয়ে নেয় আমার প্রেম।

দিগন্তের বিস্তৃত মাঠ চাষ করে

লোনা বাতাসে ভরে প্রেমের গান

আমি স্বপ্ন কুড়াতে পেরই মাঠ ঘাট জনপথ

সে স্বপ্নে ফেরে কার যেন ছেঁড়া শার্ট

ঘামে ভেজা

কার যেন শাড়ীর আঁচল

                     ছোপ ছোপ দাগ

আমি গন্ধ শুকি

                    চেনা বড্ড চেনা

যেন নিঃশ্বাসে লেপ্টে নেয় সে

                        গন্ধের স্বাদ।

আমি পেরোই সে ধুলিমাখা পথ

যে পথ আমার পূর্ব পুরুষের

যে পথ ঘামে আর রক্তে ভেজা

তেরশত নদীর আর হাজার তিমির

বুকের পাঁজর ভাঙ্গা প্রেমের

যে গান গেয়েছিল আমার পিতৃব্য

যে সুরে ছেঁড়া শার্ট আর আঁচল

হয়েছিল লাল জমিন

আমি যে সে রক্তভেজা কণ্ঠস্বর আগাম প্রেম

 

কালোর ফুল

যে ফুল বেড়ে ওঠে অন্ধকারে

যে গুল্ম জন্মে অলক্ষে

কি অন্ধকার অতল গহবর

কি অপার বিস্ময়-

দেখেনা এ চোখ-অন্ধকারে

বোকা বোকা সে চোখ।

গুল্মের ডগা কি অন্ধকারে বাড়ে

রঙিন চশমা খুঁজে নেয় সূর্য

শুষে বাষ্পের ঘ্রাণ করে চাষ অন্ধকার।

আমিও বেড়ে উঠি মেখে অন্ধকার

গেঁথে অমরার অন্ধ সে মালা।

খুলে ফেলে অন্ধকার আলোর ডালা

সাজায় বাঁসর ঘুটঘুটে অন্ধকার।

আঁতাতে আঁতাতে জ্বলে বারুদ সে আঁধার

পোড়ে কাল যৌবনবতীর মন

কানায় কানায় কলসি ভরে অন্ধকার

তবু কি তৃষ্ণা মেটে না নিয়মের বালুচর।

অন্ধকার জেগে তোলে অঙ্কুর

নগ্নতার আদিম সুর।

পাশা খেলায় প্রকৃতি নিশ্চুপ

অন্ধকারে বাড়ে হৃদস্পন্দন

নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে বড় হয় অন্ধকারের ডানা।

কোন সুদূর সে বয়ে চলা

আজও অজ্ঞাত নিকষ ঘুম।

আলোর মিছিলে ষোল আনা অন্ধকার

মিলিয়ে যায় মহাকাল-

মরিচীকা আলোর মিছিল জাগাতে পারেনি

সে অন্ধকারের ঘুম।

 

হে শ্বাস্বত অন্ধকার-

আমিও না হয় হলেম তোমার

অথই কালোর ফুল।

 

রেবাতি মাহালি

কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীরপ্রতীক স্যারকে উৎসর্গীকৃত-

 

মনে পড়ে সেই সব কথা

পড়ন্ত বিকেলে হাত ধরে হেটে চলা

সমুদ্র স্নানে বালিয়াড়ি ঝিনুক খোঁজা।

মনে পড়ে সেই সব দিন

নীল নীল মেঘে সাদা পাল তোলা

মনে পড়ে হাজার বছর হাজারতম পদরেখা।

সেই তো উত্তাল বনে বুনোফুল ফোটা

নোনা ঘাম নোনা জল কাঁদামাখা দুপুর

ঘোমটা ঢেকে কিষানীর পথ চলা

নাকের নথ বালা ঘুঙ্গুর আলতা পা।

দিন শেষে সুখটানে হুকো ভর্তি ধোঁয়া

আজও মনে পড়ে দুঃখের মাঝে সুখটা

যেন দুঃখের সংসারে বিজ্ঞাপন বিরতি

থেমে থেমে করে পানসে দুঃখটা।

মনে পড়ে সেদিন আমিও লেংটি মেরে

জোর দৌড়ে পেরিয়েছি সীমান্ত রেখা।

কত রাত কত প্রহর কি সাহসে-

থ্রিনট রাইফেলে করেছি ঝাঁঝরা শত্রু বুক।

মনে পড়ে রেবাতি মাহালি-বোনটি আমার

কি চিৎকার আমারে বাঁচাও-আমি কি

লুকোচুরি খেলায় করিনি মুক্ত তোমাদের প্রাণটা।

বাঁচাও-আমি যে আর পারছিনা

সেই গাছটা আজ কি সবুজে সবুজে সলাজ।

এখনও প্রতি অমবস্যায়-

রেবাতি মাহালি ফিরে আসে সে গাছটায়

যোনি ছিড়ে কি উল্লাস হায়েনার দল

মেতেছিল বীভৎস খেলায় আমি দূর হতে

অশ্রু মুছেছি-পারিনি বাঁচাতে বোনটি।

 

মনে পড়ে ৭ মার্চ ভেসে আসা মহাকাব্য

যেন রেবাতি এখনও বলে বাঁচাও বাঁচাও এ কাব্য।

 

সবুজ রক্ত সূর্য

জাঙ্গাল ব্রীজ এখনও দাঁড়িয়ে

স্বাক্ষী

দুপাশের খাড়ি-জলা নর্দমা

ঘাসফড়িং গুবরে পোকা জেলেদের মাচাঙ

শুনেছি সেদিনও ছিল।

পিতৃব্যের অগ্নিঝরা ভাসন

পেরিয়েছিল এ ব্রীজ রাজধানী হতে

বাঁশঝাড় শেওলা মাঠ।

অতপর পিতার কি নির্ঘুম রাত

জ্বালিয়ে ভিটে ঘুঘু ছাড়া

পোয়াতি মা গেরস্তের টুকিটাকি

বস্তাভরে পেরিয়েছে বায়ান্ন একাত্তর

কত কষ্টে বাঁশের সাঁকো-জলেশ্বরী

উত্তাল ঢেউয়ে নসিমন বিবির হাতের বালা

ভেসেছিল।নেংটি মেরে হারু কাকা উত্তাল স্রোতে

খুঁজতে খুঁজতে গিয়েছিল ভেসে।

জড়িয়ে আতুর গলাজুড়ে

শুধুই কান্না

পালাপালি কি ভীষন দুঃসময়

আবুলের বাপ এক বস্তা মাদুর নিয়ে হাজির

উদ্বাস্তু শিবির

পুইশাকের মুটুক পাতান পোড়া ভাত

কি তৃপ্তি-আহা স্বাধীনতা

নেংটি হাতে কাস্তে মারতে জোয়ান

বাবার কি উচ্ছ্বাস

খান মারো খান পাকবাহিনীর খান

ছিলনা ভয়-ডরেনি বীর

বাঁশের লাঠি হালের প্যান্টি হুঁকোর তামাক

কি প্রস্তুতি যুদ্ধ সাজ।

শুনেছি নানীর সব হারানোর গল্প

রউচ উদ্দীনের হাহাকার

দুখির মা রেঁধেছিল ঝোল-কি তৃপ্তি পাকসেনা

চাষাদের দুরন্ত সে সাহস

তেজে উদ্দীপ্ত সবুজ লাল সূর্য-তুমি মহান

খান বাঁধা আমগাছ স্বাক্ষী

আফসোস দেখিনি সেদিন

হতাম যদি আমার কোন পূর্ব পুরুষ।

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত