শিকাগো ডায়েরি (পর্ব-৩)

Reading Time: 2 minutes

প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

দ্বিতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

[গত পর্বের পরে…]

(৩) শিকাগোর ভূতের ভবিষ্যৎ

একটু ঠান্ডা, আধটু বরফ গলছে। মাটির মাঝে সবুজগুলোয় রোদের কণা লুটোপুটি । আপাত শান্ত, নিঝুম ছুটির দিন। ব্যস্ততা নেই। ছুটোছুটি নেই। অলস একটা দিন যাপন। কফির গন্ধে ঘুম ভাঙে শিকাগোর ঘরে। গতকাল রাতে কেমন সব আধিভৌতিক অনুভূতি হল। জেট ল্যাগের কারণে ঘুমের ব্যাঘাত। কতরকমের শব্দ কানে আসছিল। আলো জ্বালিয়ে রাখলাম। শব্দ থামলো। আলো নেভাতেই আবারো খুটখাট, ধুপধাপ। বোর্ডের দেওয়াল। ওপরে কেউ থাকে। তাদের চলন, গমন। নিশাচর পাখপাখালি বুঝি। আমিই কেন এত সজাগ? বাড়িতে আরো তিন জন আছে, তাদের কোনো হেলদোল নেই। আমি অন্ধকারের সঙ্গে একলা হতে চাই। বিরল অনুভূতির স্বীকার হতে চাই। ঘরে ঘরে হিটিং এর ভেন্টের মধ্যে কিছু আছে কি? হাওয়া বেরুতে গেলেই সেটি কাঁপে হয়ত। ব্যাক ইয়ারডে ঘুঘুর বাসা আছে। তারাও শব্দ করে। দিনেরবেলায় যে চিপমাংকগুলো ছুটে বেড়ায় রাতে তারা নিজের খোঁয়াড়ে বসে খুটুরখাটুর করে। কাল সারাদিনের যে বরফ পড়েছিল সেগুলো গলে গলে জল হয়ে টুপটাপ নিজের খেয়ালে পড়েছে বুঝি উল্লাসে। তাদের ঝরে পড়ার আনন্দ আমার অহেতুক অস্বস্তির কারণ?

গতকাল রাতেই আলোচনা হচ্ছিল শিকাগোর ভূতের ভবিষ্যৎ নিয়ে। খুব রগরগে সেই ভূতুড়ে ঐতিহ্য। কাল্টিভেট করতেই হচ্ছে তাকে। ভূত আমার পুত, পেত্নি আমার ঝি…. এসব সেকেলে বাংলা মন্ত্র এ শিকাগোর ভূত ন্যায়দম খাবেনা। অগত্যা সেই ভূতের অতীতে ডুব দিয়ে খোঁজার চেষ্টা করি।

১৮৭১ এ গ্রেট শিকাগো ফায়ারে অগ্নিদগ্ধ হয়ে শিকাগো লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। পুড়ে ছারখার হয় শহরের হৃদয়। আগুণ লাগার কারন হিসেবে এখনো দোষী সাব্যস্ত হয় একটি গরু।

মিসেস  অলিয়ারি নামে এক গোয়ালিনী  তার শস্যখেতের কাছে দাঁড়িয়ে গরুর  দুধ দুইতে ব্যস্ত ছিল।  ভেতরে কিছু লোক জুয়া খেলছিল। ইতিমধ্যে সেই গরুর  অসতর্কতায় লন্ঠন উল্টে গিয়ে আগুণ লেগে যায় শস্যখেতে আর তা থেকে সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ে ভয়ানক আগুণ।  আজো লোকমুখে প্রচলিত এই গল্প শুনে ভাবতে বসি,  সেই আগুণে অগ্নিদগ্ধদের অশরীরি আত্মারা তবে এখনো ঘুরে বেড়ায় শহরের আনাচেকানাচে? আর তারাই বুঝি শিকাগোর ভবিষ্যতের ভূত?

আরেকটা গল্প শুনে শিহরিত হলাম রীতিমত। মেয়েটির নাম মেরি। এখনো ঘুরে বেড়ায় সে শিকাগো রেসারেকশান সেমেটারির আশেপাশে। শিকাগোর সবচেয়ে আলোচিত ভূত থুড়ি পেত্নী এই মেয়েটি।  এখনো রাতেরবেলায় এই অঞ্চলে যারা গাড়ি চালিয়ে ঘুরে বেড়ায় মেরি তাদের গাড়িতে লিফট চেয়ে উঠতে চায়। উঠেও পড়ে কখনোসখনো। কবরখানা এসে গেলেই মেরি নেমে যায় গাড়ি থেকে। সুন্দরী মেয়ের পরণে পার্টি ওয়্যার, সাদা ডান্সিং গাউন। সোনালী তার রেশমী চুল। বাদামী চোখের মণি। মেরির গলায় জড়ানো পাতলা সিল্কের শাল, হাতে সুদৃশ্য ক্লাচ পার্স আর পায়ে ডান্সিং শ্যু।

শিকাগোর ইলিনয়ের উইলোব্রূক বলরুম ব্যাঙ্কোয়েটের ডান্স ফ্লোরে মেরি তার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মূহুর্তে  নাচে উন্মত্ত ছিল। হঠাত কোনো এক কারণে উত্তপ্ত বচসায় মেরি ডান্সফ্লোর ছেড়ে বলরুমের বাইরে আসে। ছুটে চলে যায় ব্যাস্ত রাস্তায়। আর চাপা পড়ে যায় অন্ধকারে। ভয়ানক দুর্ঘটনায় মেরির মৃত্যুর এই গল্প আজো লোকের মুখে মুখে ফেরে।

আবার কেউ কেউ বলে জুলিয়া নামে একটি মেয়ের প্রসবকালে মৃত্যু হয়। মৃতসন্তানকে হাতে নিয়ে বিয়ের পোষাকে  তাকে কবর দেওয়া হয়। জুলিয়ার মা এখনো স্বপ্নে দেখে তার মেয়ে উঠে আসছে কবরখানা থেকে।  সে নাকি বলে তাকে জ্যান্ত কবর দেওয়া হয়েছে। তার মৃত্যুতে ভুল ছিল। জীবনের কিছুই উপভোগ করা হল না জুলিয়ার। বিয়ে হল। সন্তান হল। সুখ পেল না সে। মা, আমাকে তুলে নাও তোমরা। আমি আর এখানে থাকতে পারছি না এমনি বলত সে তার মা কে। ছ’বছর ধরে সেমেটারি তে বন্দী থাকার পর যখন কবর খুঁড়ে তাকে বের করা হল দেখা গেল তার শরীর অক্ষত তখনো। ঠিক আগের মতন। দেখে মনেই হয়না  যে তাকে কোনোদিনো কবর দেওয়া হয়েছিল।

এক ঘর অন্ধকার আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে মেরির রেসারেকশান, জুলিয়ার  ফিরতে চাওয়া।

[ক্রমশ]

.

0 thoughts on “শিকাগো ডায়েরি (পর্ব-৩)

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>