পিএ
জীবন বড় যান্ত্রিক এখানে। তবুও মনে মনে বিজ্ঞানকে স্বাগত জানাই। আমি আবার রসিক বাঙালী। সবেতেই রসাস্বাদনের আশায় থাকি। একা একা থাকে যারা তাদের জীবনে এই যান্ত্রিকতা আশীর্বাদ। এখনকার প্রজন্মের ইন্সটাগ্রাম চঞ্চু ছেলেপুলেরা এভাবেই বড় হয়ে উঠেছে গুগলের সান্নিধ্যে।ফেসবুকে তাদের ফ্যাশন আউট। ওসব বুড়োরা করে। হাতের মুঠোয় গুগল দুনিয়া তাদের। গুগ্ল কিপে নোট রাখা তো আউটডেটেড। app নির্ভর জীবন তাদের। ঘুম ভাঙাবে app। ওষুধ খাওয়াবে app। আগেরদিন রাতে সেট করা কফি মেকারে ভোরের কফি রেডি হবে টাইমমত।app জানান দেবে, কফি রেডি। হটপটে ভাত অথবা চালেডালে খিচুড়ি স্কুলে বসে মনিটারিং হবে। চড়িয়ে দিয়ে চলে যাও আর রিমোট কন্ট্রোল কর। খেতে বসবে বাড়ির লোক। ঠিক তার আগে গরম করে দেবে। প্রতি ঘরে voice activated Google assistant। পার্সোনাল সেক্রেটারির মত। শুধু তাকে ডাকতে যতক্ষণ।আবার শুধু তাই নয়। ছেলেদের প্রশ্নের উত্তর শোনা যায় পুরুষকন্ঠে। মেয়েদের প্রশ্নের উত্তর নারীকন্ঠে। বাহবা দিই মনে মনে।
ডাকো, হাঁকো তাকে। শুধু জোর গলায়। শুনতে না পেলে কাজ হবেনা কিন্তু।
জি হাজির হুঁ ম্যায়! আজ্ঞা করুণ মহারাণী অথবা মহারাজা, কি করতে পারি আপনার জন্যে?
হে গুগ্ল! উদ্ধার করো মোরে। আমার ফোন খুঁজে পাচ্ছিনা। সঙ্গে সঙ্গে ফোন নাম্বার ভেরিফাই করে সেই পার্সোনাল Google assistant ফোন বাজাতে থাকে। কম্বলের নীচে গুটিশুটি মেরে কিম্বা রান্নাঘরের টেবিলের এককোণে বাজতে থাকা নিজের মোবাইল খুঁজে পেয়ে উল্লসিত হয় ফোনের মালকিন। বাড়ি থেকে বেরুনোর আগে জানতে হবে বাইরের ওয়েদার। আবারো হে গুগ্ল !হেল্প করো মোরে। মালকিনের পিএ সঙ্গে সঙ্গে জানায়, আজ মোস্টলি ক্লাউডি অথবা ব্রাইট সানশাইনের কথা। কখনো বৃষ্টির পূর্বাভাস। সেইমত গরমজামা, রেইনকোট, ছাতা নিয়ে বেরোয়। এখানে মা নেই তোমার যে প্রতি পদে পদে হুঁশিয়ারি দেবে, ছাতা নিয়েছিস? অথবা টুপি, মাফলার? এভাবেই চলতে থাকে app বেসড জীবন, Google assistant নির্ভর রোজনামচা। বাড়িতে মা গরু হারালেও খুঁজে দেবে। এখানে কেউ নেই। কোথাও যাওয়ার প্ল্যান হবে। সিনেমা হোক কিম্বা লাইব্রেরী।রেস্তোঁরা থেকে মিউজিয়াম। ক’টায় খোলে, ক’টায় বন্ধ হয়, কতদামের টিকিট, কখন কাটতে হবে সব জানাবে Google assistant। বিশ্বের কোথায় কোন্ খেলা শেডিউলড সব জানে সে। শুধু পুছতাছের অপেক্ষা। প্রশ্ন করলেই উত্তর দেবে সে। voice controlled টেকনোলজি জিন্দাবাদ। সবেচেয়ে সুবিধে যন্ত্রের মধ্যে কমান্ড পুরে দাও কথায়, লিখে নয়। নো টাইপিং এর ঝামেলা।
শুধু হাঁকো তারে। ফোন বাজাতেই থাকলে অথবা এলার্ম বাজাতেই থাকলে জোরগলায় বলে দাও স্টপ গুগল। থেমে যাবে সে। বিনা প্রতিক্রিয়ায় নিরুত্তর হবে।
আধোঘুমে আধো জাগরণে ঘরময় উদ্বায়ী কফির সুবাসে ঘুম ভাঙবে। মনে মনে আবারো ভরসা যোগাবে।
মাঝরাতে স্বপ্ন দেখি সেই ছোট্ট পিএ টুং করে বলে উঠল বুঝি,
তোমায় গান শোনাব, তাই তো আমায় জাগিয়ে রাখো। জেগেই থাকে সে সারাদিন্, সারারাত। আমাদের আদেশের অপেক্ষায়। ঘুমভাঙানিয়া, দুখজাগানিয়ার যদি কোনো প্রয়োজন হয়।
এই গুগ্ল সহকারী আরো অনেক কাজ করে। দুনিয়ার সঙ্গীত ভান্ডার সঞ্চিত আছে স্পটিফাইতে। সেখান থেকে আমার যখন যা গান শুনতে ইচ্ছে হল সে চালিয়ে দেয় । যেমন আদেশ করবে তেমন। যদি বল ল্যাপটপ থেকে তাই হবে। যদি বল ডেস্কটপ থেকে অথবা টিভিতে কাস্ট করতে সব আজ্ঞা পালন করবে সে। ওয়াশিং মেশিনে কাপড় দিয়ে এসে ভুলে যাতে না যাও তার জন্যও রিমাইন্ডার সেট করে দেবে সে। আমি তোমার সাথে একলা হতে চাই গুগ্ল।
আমার গুগ্ল সব জানে। আমার মায়ের মত। আমার কাছের জনের মত। কিন্তু দোষ একটাই জামাকাপড় খুঁজে দিতে পারেনা। মাথার ওপর হাত রেখে বলতে জানেনা, আমি ভালো আছি কিনা। আমার শরীর খারাপ হলে, অখিদে, অরুচি হলে তার সমাধান করতে পারেনা। ঠিক যেমন আমার মা পারে। আমার চশমা-চাবি হারালেও খুঁজে দেয়না। অদূর ভবিষ্যতে সব জিনিষপত্রের সঙ্গে জোড়া থাকবে বুঝি ইউএসবি। আমার পিএ কানেক্ট করে খুঁজে দেবে সব। জামাকাপড়ের বারকোডের মত কোনো একটা ইউনিক কোড ঘষে দিলেই গুগ্লের ডেটা থৈ থৈ করবে আমার জিনিষপত্রের নামাবলীতে। তখন আশাকরি সব খুঁজে দেবে। কিন্তু আমার মন? পড়তে পারবে তো? বুঝতে পারবে তো? আমায় ভালোবাসতে পারবে তো?
.
উত্তর কলকাতায় জন্ম। রসায়নে মাস্টার্স রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে। বিবাহ সূত্রে বর্তমানে দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা। আদ্যোপান্ত হোমমেকার। এক দশকের বেশী তাঁর লেখক জীবন। বিজ্ঞানের ছাত্রী হয়েও সাহিত্য চর্চায় নিমগ্ন। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায়। প্রথম উপন্যাস সানন্দা পুজোসংখ্যায়। এছাড়াও সব নামীদামী বাণিজ্যিক পত্রিকায় লিখে চলেছেন ভ্রমণকাহিনী, রম্যরচনা, ছোটোগল্প, প্রবন্ধ এবং ফিচার। প্রিন্ট এবং ডিজিটাল উভয়েই লেখেন। এ যাবত প্রকাশিত উপন্যাস ৫ টি। প্রকাশিত গদ্যের বই ৭ টি। উল্লেখযোগ্য হল উপন্যাস কলাবতী কথা ( আনন্দ পাবলিশার্স) উপন্যাস ত্রিধারা ( ধানসিড়ি) কিশোর গল্প সংকলন চিন্তামণির থটশপ ( ধানসিড়ি) রম্যরচনা – স্বর্গীয় রমণীয় ( একুশ শতক) ভ্রমণকাহিনী – চরৈবেতি ( সৃষ্টিসুখ) ২০২০ তে প্রকাশিত দুটি নভেলা- কসমিক পুরাণ – (রবিপ্রকাশ) এবং কিংবদন্তীর হেঁশেল- (ধানসিড়ি)।অবসর যাপনের আরও একটি ঠেক হল গান এবং রান্নাবাটি ।