সুক্তোয় সুখ তো?
সেদিন অক্ষয় তৃতীয়া শিকাগোর শীত-বসন্তের সন্ধিক্ষণে। বোশেখের বাঙালীয়ানায় খামতি নেই । পুণ্য তিথিতে শাক-সুক্তোয় শুরুয়াত হলে মন্দ হবে না মধ্যাহ্নভোজন। অতএব সুক্তো রেঁধেও সুখ ঠান্ডায়। ওদিকে ভৈরবমূর্তি কলকাতার গরমের যজ্ঞের অনল দহনে দগ্ধ বাঙালী । এদিকে বসন্ত আগমনে ঠান্ডার বিরাম নেই। উনি বললেন এই ঠান্ডায় কেউ সুক্তো খায়? গরমে তেতো খেতে হয় জানি। বললাম সময় বিশেষে খেতে হয় বৈকি। তুমি দেখ শুধুই তেতো, আমি দেখি খাদ্যগুণ । এখানে আমার সাজতে গুজতে দোলখেলা ফুরোয়। রাত কমে আসে, মোচ্ছব জেগে ওঠে। মায়ের হাতে সুক্তো খেতে চেয়েছে জনতা। অতএব সুক্তো রেঁধেও সুখ তো, নাকি? শুধুই তেতো? একসঙ্গে কত সব্জী খাওয়া হয় বল তো? বাঙালীর বহুমাত্রিক রসনা সংস্কৃতির শুরুয়াত সুক্তো দিয়ে কেন হয় জানো ?
পদ্মপুরাণে বেহুলার বিয়ের নিরামিষ খাবার থেকে শুরু করে চৈতন্যচরিতামৃত, ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলেও বাইশ রকমের নিরামিষ পদের মধ্যে শুক্তুনিকে পাওয়া যায়।
পর্তুগীজরা আলু আমদানী করল আর বাঙালী সুক্তোর ঝোলে আলুর ব্যাবহার শিখল। সুক্তো রুচিকর, উপকারী, স্বাস্থ্যকর কারণ তিক্তরসে রুচি বাড়ে, অখিদে দূর করে। শিকাগোয় এদের বাড়ির কাছেই পোর্তোজ নামে পর্তুগীজ রেস্তোঁরা। নী আর শু কে বললাম, গিয়ে শিখিয়ে দিয়ে আয় তোরা। ভালো কাটতি হবে সুক্তোর ।
শিকাগোয় নিমপাতার সুখ নেই। নালতে, পলতা, হিঞ্চে, গুলঞ্চ নেই। উচ্ছে নেই, করলা আছে। সজনে ডাঁটার সবুজ নেই । অবিশ্যি নীরস , শুষ্কং কাষ্ঠবত্ বেরঙীন নাজনে আছে, বহুদিনের বরফের কবরে সমাধিস্থ। কলকাতার ডালের বড়ির সুখ আছে। তাতেই দৌড়বে সুক্তোর সুখ। ভাজা মশলাও এনেছেন মা জননী মনে করে। রাঁধুনি, পাঁচফোড়ন ভেজে গুঁড়ো করে। তেজীগন্ধের তেজপাতা আছে যদিও। আর এই সুখের সুক্তো মশলার সঙ্গে ঘিয়ের কেমিষ্ট্রি যেন জন্মজন্মান্তরের। সুক্তোর সঙ্গে এই ঘিয়েভাজা মশলার গাঁট ছড়া যবে থেকে বাঙালীর জন্ম হয়েছে তবেকার।
ভেজে রাখা মুচমুচে করলা, বড়ি শিকাগোর কিচেন হবের ওপরে পড়ে থাকে সুক্তোর সুখের ভাগ পাবে বলে। আলু, রাঙা আলু, ঝিরিঝিরি করে কাটা লালমূলো, শিম বা বরবটীর বদলে ফ্রেঞ্চ বিনস, কাঁচকলা, ডাঁটা, বেগুণ কড়াইয়ের মধ্যে স্টারফ্রায়েড হতে হতে করলার পানে ড্যাবড্যাবিয়ে চায় । ছ্যাঁক করে জল ঢেলে দেয় মা কড়াইতে। এবার নুন। সেদ্ধ হলে চিনি। রেডি হয় বাটির মধ্যে সর্ষের গুঁড়ো, পোস্তবাটা, আদার পেষ্ট । ঠিক কখন দিলে মশলাবাটাটা? নী জিগেস করে। সেদ্ধ হলেই দেব। সবুর কর। নামানোর আগে ঝোল ঘন করতে দুধে আটা গুলে, ঠিক হোয়াইট স্যসের মত। গা মাখা কনসিসটেন্সি হবে তবেই তো।
তাহলে ঘিয়ের ফোড়ন?
সবার শেষে। আদরে মাখোমাখো সুক্তোর সুখ তো উপচে উঠবে তখন শিকাগোর রান্নাঘরে। ম ম করবে রান্নাঘর। ঢাকা খুলে গন্ধ শুঁকবে জনগণ। ভাতের অঙ্গে আরো প্রগাঢ় হয় সেই প্রেম। বাসি হলে আরো মজে। স্টুডেন্ট নী পরম আদরে বাটি আজাড় করে ল্যাবে নিয়ে চলে যায় সেই সুক্তুনি। রান্নাঘর ঘিয়ের গন্ধে আমোদ করে। বাঙালীর বাসি সুক্তো তখন মজতে মজতে শিকাগোর গবেষণাগারে আরো মহার্ঘ হয়ে ওঠে। সুক্তোর সুখ সত্যিই উপচে ওঠে ।
.
উত্তর কলকাতায় জন্ম। রসায়নে মাস্টার্স রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে। বিবাহ সূত্রে বর্তমানে দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা। আদ্যোপান্ত হোমমেকার। এক দশকের বেশী তাঁর লেখক জীবন। বিজ্ঞানের ছাত্রী হয়েও সাহিত্য চর্চায় নিমগ্ন। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায়। প্রথম উপন্যাস সানন্দা পুজোসংখ্যায়। এছাড়াও সব নামীদামী বাণিজ্যিক পত্রিকায় লিখে চলেছেন ভ্রমণকাহিনী, রম্যরচনা, ছোটোগল্প, প্রবন্ধ এবং ফিচার। প্রিন্ট এবং ডিজিটাল উভয়েই লেখেন। এ যাবত প্রকাশিত উপন্যাস ৫ টি। প্রকাশিত গদ্যের বই ৭ টি। উল্লেখযোগ্য হল উপন্যাস কলাবতী কথা ( আনন্দ পাবলিশার্স) উপন্যাস ত্রিধারা ( ধানসিড়ি) কিশোর গল্প সংকলন চিন্তামণির থটশপ ( ধানসিড়ি) রম্যরচনা – স্বর্গীয় রমণীয় ( একুশ শতক) ভ্রমণকাহিনী – চরৈবেতি ( সৃষ্টিসুখ) ২০২০ তে প্রকাশিত দুটি নভেলা- কসমিক পুরাণ – (রবিপ্রকাশ) এবং কিংবদন্তীর হেঁশেল- (ধানসিড়ি)।অবসর যাপনের আরও একটি ঠেক হল গান এবং রান্নাবাটি ।