শিকাগো ডায়েরি (পর্ব-৯)
বাড়িওয়ালি
এদের বাড়ির মালকিন পোর্টোরিকান মহিলা স্বল্পভাষী আইরিন।বেশ কাজের মালকিন। কেজো কথা ছাড়া বেশী বকেন না। মধ্যবয়সীর আমরা আসাতে কোনো হেলদোল নেই। শুধু বলে রেখেছেন, কেউ এলে আগে থেকে বোলো। জলের যাতে টান না পড়ে। দেশী মকান মালকিন হলে এখুনি বেল বাজিয়ে ঘরে ঢুকে হয়ত হাঁড়ির খবর জানতে উত্সুক হত। দেশ থেকে কি আনল শাউড়ি কিম্বা শ্বশুর কে তো বেশ রাসভারী মনে হচ্ছে বলতেও পারতেন হয়ত। সে নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। একটু দূরে থাকে তবে নিজের ভাড়া দেওয়া বাড়ি গুলির তদারকি করতে আসে উইকএন্ডে। জমিতে মাল্চ ঢেলে দেয়। আগাছা সাফ করে। সিঁড়ি বেয়ে উঠে কাঁচের জানলা মোছে।
বিয়ের পরে যখন ওরা এই বাড়ি নিয়ে থাকতে শুরু করল তখনো নবদম্পতিকে নিয়ে আইরিনের কোনো আবাহন, বিসর্জন কিছুই ছিলনা। দেশী মাসীমা বাড়িউলি হলে সোজা ঘরে ঢুকেই বলে বসতেন,
বিয়ের পরপরই মাথায় এট্টু সিঁদুর না ছোঁযালে চলে? বলে নিজের সিঁদুর কৌটো খুলে এক ফোঁটা সিঁদুর সিঁথিতে আরেকটু লোহাতে ঠেকাতে গিয়েই বলে উঠতেন, তা বৌমা? তোমার দু’হাত খালি কেন বাপু?
শোয়ার ঘরে উঁকিঝুঁকি দিতেন কিম্বা আড়ি পাততেন রবিবারের দুপুরে। অথবা, তা বলি আজ কি রান্না হল বৌমা? কিম্বা ছুটির উইকএন্ডে কি প্ল্যান তোমাদের বলে আঁচলে হাত পুঁছতে পুঁছতে ঠকাস করে সেন্টারপিসের ওপর একটি মুড়িঘন্টের বাটি রেখে যেতেন। অথবা থ্যাংক্সগিভিংএর পার্টিতে নেমন্তন্ন করলেও করতে পারতেন। অথবা বলেই বসতেন হয়ত
“তা শাশুড়ি কেমন হল তোমার? ” কিম্বা বিস্ফারিত নেত্রে বলতেন কেমন গয়নাগাটি পেলে বৌমা?
বিয়ের পর যেমন হয় আর কি দেশী মেয়েদের জীবন। স্থান কাল পাত্র ভেদে আজো এমনি অব্যাহত। নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই জানি। নতুন জায়গায় সংসার পাতলেই অহেতুক কুতুহলী মহিলা মহল যেন একটু বেশীই সজাগ হয়ে পড়ে। আর সদ্য বিবাহিত মেয়েটি যদি পাঁচা করতে পছন্দ করে তাহলে আর কথাই নেই। শ্বশুরবাড়ির গল্পে মুখর হয় বিদেশী পাড়ার প্রতিবেশীনিও। বাড়িউলির জন্যে মেয়ের মা একটি নমস্কারি শাড়িও হয়ত দিয়ে দেন পরের বার।
তবে এর জন্য উভয়পক্ষের প্রচুর সময় থাকতে হবে হাতে। পানের খিলি ঠুসে, আঁচলে চুনের হাত মুছে গল্প করার সময় আইরিনের ও নেই আর আমার নী এর নিজের সংসার আর পড়াশুনো সামলিয়ে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের সময়টুকুনি কেবলি আইরিন মাসীমার সঙ্গে ওই হাই হ্যালো অবধিই, কখনোই গড়ায় নি বেশীদূর।
বাড়িউলির কাছ থেকে ভর্তি বাটি আসেও না আর ভাড়াটের দ্বারা সেই বাটি ভর্তির জন্য আদিখ্যেতাও অচল এদেশে। আমাদের বাড়ি তে ভাড়াটে ছিল একসময়। আমরা ছোটবেলায় এমন বাটি চালাচালি দেখবার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকতাম।
গিয়েই জেটল্যাগ সর্বস্ব আমি বাজার করে ফেরার দিন শুধু দূর থেকে হাই তুলে হ্যালো বলেছি আইরিন কে। স্বল্পভাষী হালকা হাসিতেই মন জয় না করেই বিদায় নিয়েছিল। শোনা যায় পূর্বতন ভাড়াটেদের সঙ্গে উনি নাকি একটু বেশী বকবক করতেন। সেই বাচালতার খবর ছড়িয়েছে আন্তর্জালেও। তারা তাই রেটিং কম দিয়েছে । বাড়ির বাকী সব ঠিকঠাক। তারপর থেকেই বুঝি আইরিনের মুখে কুলুপ আঁটা।
ফিরে আসার দিন মনে মনে আইরিন কে বলে আসি আমার ছেলে বউ রইল আইরিন। তুমি দেখো ওদের।
.
উত্তর কলকাতায় জন্ম। রসায়নে মাস্টার্স রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে। বিবাহ সূত্রে বর্তমানে দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা। আদ্যোপান্ত হোমমেকার। এক দশকের বেশী তাঁর লেখক জীবন। বিজ্ঞানের ছাত্রী হয়েও সাহিত্য চর্চায় নিমগ্ন। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায়। প্রথম উপন্যাস সানন্দা পুজোসংখ্যায়। এছাড়াও সব নামীদামী বাণিজ্যিক পত্রিকায় লিখে চলেছেন ভ্রমণকাহিনী, রম্যরচনা, ছোটোগল্প, প্রবন্ধ এবং ফিচার। প্রিন্ট এবং ডিজিটাল উভয়েই লেখেন। এ যাবত প্রকাশিত উপন্যাস ৫ টি। প্রকাশিত গদ্যের বই ৭ টি। উল্লেখযোগ্য হল উপন্যাস কলাবতী কথা ( আনন্দ পাবলিশার্স) উপন্যাস ত্রিধারা ( ধানসিড়ি) কিশোর গল্প সংকলন চিন্তামণির থটশপ ( ধানসিড়ি) রম্যরচনা – স্বর্গীয় রমণীয় ( একুশ শতক) ভ্রমণকাহিনী – চরৈবেতি ( সৃষ্টিসুখ) ২০২০ তে প্রকাশিত দুটি নভেলা- কসমিক পুরাণ – (রবিপ্রকাশ) এবং কিংবদন্তীর হেঁশেল- (ধানসিড়ি)।অবসর যাপনের আরও একটি ঠেক হল গান এবং রান্নাবাটি ।