| 19 এপ্রিল 2024
Categories
শিশু-কিশোর কলধ্বনি

হারিয়ে যাচ্ছে ছোটদের গান

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

হারিয়ে যাচ্ছে ছোটদের গান- ঠিক তাই। বিশ্বায়নের বিশ্ব-বাজার কী অদ্ভুতভাবে কেড়ে নিচ্ছে শৈশব! এ যেন এক কড়াল থাবা! চারপাশে শুধু ‘আইটেম’ ‘আইটেম’ আর ‘আইটেম’! সামগ্রিক সাংস্কৃতিক দুনিয়ায় সে-ছবি আমরা এত দেখি যে ফেলে আসা ছোটো বেলা আমরা প্রায় ভুলতেই বসেছি। খুব খারাপ লাগে, যখন দেখি বিভিন্ন রিয়েলিটি শো-গুলোতে ছোট-ছোট ছেলেমেয়েদের ‘বড়’-দের ল্যুক দেওয়া হচ্ছে; তাদের সার্বিক অর্থেই ঠিক বড়োদের মতো করে তোলা হচ্ছে। টি আর পি বাড়ছে চ্যানেলগুলোর! রমরমা বাজার। বাচ্চাদের আদব-কায়দা সব যেন বড়োদের মতো! টিভি শো গুলো দেখে-দেখে এটাই এখন সাংস্কৃতিক বাজারের ‘ট্রেন্ড’ হয়ে গেছে! বলতে খুব খারাপ লাগছে সংস্কৃতি এখন বাজারে নেমেছে!
খুব কষ্ট হয় হাতেগোনা কিছু ছোটো ছেলেমেয়ে ছোটদের গান গায়; এখন আর কেউ গায় না মানে গাইতে শুনি না শ্রদ্ধেয় সঙ্গীত শিল্পী সনৎকুমার সিংহের  সেই বিখ্যাত গান- “সরস্বতী বিদ্যবতী তোমায় দিলাম খোলা চিঠি…।” অথবা আমরা শুনি না রাণু মুখোপাধ্যাযের গাওয়া- “লাল ঝুঁটি কাকাতুয়া ধরেছে যে বায়না, চাই তার লাল ফিতে চিরুনি আর আয়না…” ‘বাদশা’ (১৯৬৩) চলচিত্রে মাস্টার শংকরের লিপে ছিল এই অত্যন্ত জনপ্রিয় গানটি। গানটির সঙ্গীত পরিচালক হলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। কথা-গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। ছোটদের কী অদ্ভুতভাবে ‘বড়’ বানিয়ে ফেলা হচ্ছে! শৈশব কী সূক্ষ্মভাবে মেরে ফেলছে তথাকথিত সংস্কৃতির দালালেরা! খুব কষ্ট হয়; দিন তো চলে যাচ্ছে না। প্রতিটি অধ্যায় তো বেশ কিছুদিন আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই রেখে যায় তার উপস্থিতির সুস্পষ্ট ছাপ। তবে কেন এভাবে আমাদের সামনে?

বিশেষ করে যদি লক্ষ করা যায় তবে দেখা যাবে যে ছোট-ছোট মেয়েদের কীভাবে আবেদনময়ী করে তোলা হচ্ছে! তাদের পোশাক থেকে জেশ্চার… সব দেখে মনে হয় যেন বড়দের মাথা আর পা এই দু-দিক থেকে বাড়ি মেরে চেপে দেওয়া হয়েছে! ওরা কখনও শোনেনি বা বলা ভালো ওদের বোধহয় এই সময় গাইতে বলা বা শেখানো তো দূর; কেউ শোনায় না রবি ঠাকুরের ছোটদের গান! হয়তো এই প্রজন্মের কোনও শিশুই হয়তো শোনেনি শ্রদ্ধেয় সঙ্গীত-ব্যক্তিত্ব সলিল চৌধুরীর সৃষ্টি করা গানগুলো; যে-গান শুনে,গেয়ে আমরা বড়ো হয়েছি ওরা শোনেনি হয়তো এমন অনেক কালজয়ী গানই শোনেনি। যেমন-
”টুংটাং পিয়ানোয় সারাটি দুপুর, কচি-কচি দুটো হাত তুলবে যে সুর, মাথা নেড়ে বুড়ো-বুড়ি শুনবে যে-গান থাপথুপ লাফাবে যে দেখে হনুমান….” (চলচ্চিত্র-হারায়ে খুঁজি-১৯৭৪, সঙ্গীত পরিচালক-অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, সঙ্গীত, কথা-পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, শিল্পী-আরতি মুখার্জি)

”ও আমার ছোট্ট পাখি চন্দনা, একটি শিসে জাগিয়ে গেল, লাগছে যে তাই মন্দ না…” (১৯৫৮ সালে আল্পনা বন্দ্যোপাধ্যায়-এর গাওয়া, সুর-নচিকেতা ঘোষ, কথা-পবিত্র মিত্র)

মনে পড়ে? সেই ঘুমপাড়ানিয়া গানের কথা? যে-গান শুনিয়ে মায়েরা তাদের সন্তানদের ঘুম পারতেন! অন্নদাশঙ্কর রায়ের লেখা সেই বিখ্যাত গান, যার সুর করেছিলেন নচিকেতা ঘোষ। সেই চিরকালীন গান- ”ময়নার মা ময়নামতী, ময়না তোমার কই? ময়না গেছে কুটুমবাড়ি গাছের ডালে ওই…” তারপর মনে পড়ে, ওই গানটির কথা-

”হাট্টিমাটিম টিম তারা মাঠে পাড়ে ডিম, তাদের খাড়া দুটো শিং, তারা হাট্টিমাটিম টিম’ অথবা ‘খোকন খোকন করে মায়/খোকন গেছে কাদের নায়/সাতটি কাকে দাঁড় বায়/খোকন রে তুই ঘরে আয়…’ এই গান-জন্মের একটা ছোট্ট গল্প বলি তবে। একবার এনা অর্থাৎ সকলের আল্পনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাক এলো এইচএমভি থেকে।

আচ্ছা, একটা কথা বলে রাখি যে আল্পনার আসল নাম ছিল এনা। যাইহোক, কর্তা-ব্যক্তি পিকে সেনের ডাকে তিনি গেলেন সেখানে দেখা করতে। পিকে সেন আল্পনাকে বলেন যে কী ধরনের গান আল্পনা গাইতে ইচ্ছুক। আর ঠিক এই সুযোগেরই যেন অপেক্ষায় ছিলেন আল্পনা। তিনি বললেন,’ এতদিন ধরে তো বড়দের জন্য গান গাইছিই; কিন্তু আমার তো অনেক ছোট-বন্ধু আছে, ওরা বলে আমি নাকি সব সময় বড়দের গান গাই। যদি অনুমতি দেন, তবে একটু ছোটদের গান গাই?’ অমনি পিকে সেন রাজি হয়ে গেলেন। এভাবেই আমরা এমন কালজয়ী কিছু চিরন্তন গান পেলাম। বেসিক রেকর্ড থেকে শুরু করে অনুরোধের আসর, সব্বার মুখে-মুখে খেলছে সেসব গান! দামাল-শিশুদের শান্ত করতে এই গানগুলোর জুড়ি মেলা ভার! ‘আল্পনা বন্দ্যোপাধ্যায়’-মানেই যেন ছোটোদের গান! তিনি এবং ছোটদের গান এমনভাবে জড়িয়ে আছেন তা বলে বোঝানো যাবে না। প্রসঙ্গত বলি, তাঁর বাবা কান্তিগোপাল ঘোষ ছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজের বোটানির অধ্যাপক। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তাঁর বিরাট দখল ছিল। তাঁর কাছে কলেজের ছাত্রছাত্রীরা গানের তালিম নিতে আসতেন। বিনা পারিশ্রমিকে তিনি তাদের শেখাতেন। নিজেও বাদল খানের সুযোগ্য শিষ্য ছিলেন। তিনি লক্ষ করতে লাগলেন যে তিনি ছাত্রছাত্রীদের যা- শেখাচ্ছেন, তাঁর কন্যা অর্থাৎ এনা (আল্পনা) তাই-ই গেয়ে দিচ্ছেন! এমনকি মাথার বালিশকে হারমোনিয়াম বানিয়ে মেয়েটি সেসব গাইতো! এরপর, বাবাই তাঁর প্রথম সঙ্গীত গুরু হন।
সময়টা ১৯৫০। ছবির নাম ‘বিদ্যাসাগর’। এই ছবির গান দিয়েই আল্পনার সরাসরি সঙ্গীত জীবনের সূচনা বলা যেতে পারে নিশ্চিত করেই। সঙ্গীত পরিচালক রবিন চট্টোপাধ্যায়ের সেদিনের রেকর্ডিং-এ অনেকেই এসেছেন। আল্পনা অনেকক্ষণ থেকে এসে বসে আছেন। ‘বিদ্যাসাগর’ ছবির প্রোডিউসার বিমল ঘোষ রবিন বাবুকে বললেন, ‘কী রবিন, তোমার আর্টিস্ট কোথায়?’-

রবিন বাবু বললেন যে, সে তো বহুক্ষণ থেকেই বসে অপেক্ষা করছে। বিমল বাবু বললেন, “আরে! এ তো বাচ্চা মেয়ে!’-
বিমল বাবুর চোখেমুখে এক অদ্ভুত সংশয়! অবশেষে, রেকর্ডিং শেষ হলে দারুণ খুশি হয়ে পিঠ-চাপড়ে আদর করলেন ছোট্ট আল্পনাকে। মিষ্টিও খাওয়ালেন। শৈলেন রায়ের কথায় এবং রবিন চট্টোপাধ্যায়-এর সুরে আল্পনা গাইলেন ‘বিদ্যাসাগর’-ছবির গান
“মাটির ঘরে আজ নেমেছে প্রাণ রে/
বলি ও জহুরী চোখ মেলে দেখ নিজ ভুবনের সাজ রে…”
এমন সব চমৎকার গল্প রয়েছে এইসব কালজয়ী কিছু গান-জন্মের নেপথ্যে! ছোটবেলা থেকেই সিনেমায় প্লে-ব্যাক, বেসিক রেকর্ড তাঁর ঝুলিতে। স্বয়ং উত্তম কুমার তাঁকে ‘আল্পস’ বলে ডাকতেন; এমনকি সিনেমায় তাঁর বিপরীতে অভিনয় করবার করার কথা বলেন। কিন্তু তিনি রাজি হননি। এরকম, অনেক গল্প। আক্ষেপটা এখানেই যে এমন গান শিশুদের জন্য আর তৈরি হচ্ছে কোথায়! এসব গানের আর ‘বাজার’ নেই! তাঁর আরও দু-একটি গানের কথা লিখছি। যেমন-

“আগডুম-বাগডুম-ঘোড়াডুম সাজে, ঢাক মৃদং, ঝাঁঝর বাজে
বাজতে বাজতে চলল টুলি, টুলি গেল সেই কমলাপুলি…’ ( ছোটোদের ছড়ার গান। সঙ্গীত শিল্পী-আল্পনা বন্দ্যোপাধ্যায়)

“শিব ঠাকুরের গলায় দোলে বৈচি ফলের মালিকা/ ওর গলায় দড়ি কে পরালো বল না গৌরীবালিকা…”(চলচ্চিত্র- বালক শরৎচন্দ্র, ১৯৭৪, সুর-অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, কথা- পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, সঙ্গীত শিল্পী-হৈমন্তী শুক্লা)

আমি আপনাদেরই প্রশ্ন করছি, সত্যিই বলুন তো আমরা কি সেই রেডিও-যুগের মতো আজ আর শুনি এইসব হৃদয়ছোঁয়া-গান? আমার মনে হয় যে সত্যি এর সংখ্যাটি নিতান্তই আণুবীক্ষণিক হবেই। বরং ‘আমি কলকাতার রসগোল্লা’ অথবা ‘শিলা কি জওয়ানি’, ‘তু চিজ বড়ি হ্যায় মস্ত-মস্ত’- এরকম গরম-গানের দাপটই এখন প্রায় সর্বত্র! কত নতুন-পুরোনো গান নিয়ে ‘মেশাপ’ হচ্ছে; রি-মিক্স হচ্ছে কিন্তু কখনও ভাবা হচ্ছে কিনা সংশয় আছে যে এইসব কালজয়ী ছড়ার গান নিয়ে এমন সংকলন হচ্ছে কি?! আমি অন্তত জানি না। তবে, হ্যাঁ ইউটিউব-এ এমনকিছু গান শুনতে পাই। এটুকুই যা ভালো! কিন্তু ভালো মানেই কি আশার? হয়তো তা নয়। তা যদি হতো তবে আমাদের প্রত্যেক ঘরের শিশুর মুখে-মুখেই গুনগুন করতো এইসব চিরকালীন গান। ‘ট্রেন্ড’ শব্দটির খুব ক্ষমতা এখন। সময়ের বাতাসও উড়ছে সে-দিকেই। আমরা ভুলতে-ভুলতে ভুলেই যাই!

হারিয়ে যাচ্ছে ছোটদের গান। চুরি যাচ্ছে ছোটবেলা। অথচ আমরা কেউ খুঁজবো না। কারণ, সময় তো আর সেসব গান চায় না। তাই যাক ভেসে জাহান্নামে! আমরা সেই তাগিদও অনুভব করছি না বা তার চেষ্টাও করছি না! আজও কানে বাজে সেসব হারানো গান! যখন স্কুল ছুটির পর অথবা শীতের ছুটির দুপুরে রেডিও মা চালিয়ে দিতেন আর অনুরোধের আসর অথবা অন্য কোনও অনুষ্ঠানে বেজে উঠতো-

”পুতুল নেবে গো পুতুল? আমার এই ছোট্ট ঝুড়ি, এতে রাম-রাবণ আছে, দেখে যা নিজের চোখে হনুমান কেমন নাচে…” (চলচ্চিত্র-ভানু পেলো লটারী, ১৯৫৮, সঙ্গীত পরিচালক- নচিকেতা ঘোষ,কথা- গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার)

”ও বাবু মশাই, এখন আমি কী শোনা/ শহরটার এই গোলক ধাঁধায় আঁধার হল মন/মন্দ-ভালো এই কী খেলা চলছে হেথা সর্বক্ষণ..’ (চলচ্চিত্র-হংসরাজ, ১৯৭৬, সঙ্গীত পরিচালক-সুধীন দাশগুপ্ত, কথা-পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, সঙ্গীত শিল্পী-আরতি মুখোপাধ্যায়)

”শোন-শোন শোন মজার কথা ভাই/আমায় বান্দর শুধায়, কুত্তা শুধায়,ছাগল শুধায় হায়/ সকলেরই মা আছে রে/আমার কেন নাই…” (চলচ্চিত্র-বাদশা,১৯৬৩, সঙ্গীত পরিচালক-হেমন্ত ‘মুখোপাধ্যায়, কথা-গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, শিল্পী-রাণু মুখোপাধ্যায়)

”টিয়া টিয়া টিয়া অজ পাড়া- গাঁয় থাকে/ ট্যারা চোখে তাকায় টিয়া নোলক পরা নাকে..” (চলচ্চিত্র-হংসরাজ, ১৯৭৬, সঙ্গীত পরিচালক- সুধীন দাশগুপ্ত, কথা-পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, সঙ্গীত শিল্পী-শ্যামশ্রী মজুমদার)

”এই ছোট্ট ছোট্ট পায়ে চলতে চলতে ঠিক পৌঁছে যাবো/সেই চাঁদের পাহাড় দেখতে পাবো…” (চলচ্চিত্র-হীরেমানিক, ১৯৭৯, সঙ্গীত পরিচালক-মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়,সুর- মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়, কথা- পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, সঙ্গীত শিল্পীরা হলেন-আরতি মুখোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়)

”লম্বা দাঁড়ির চৌকিদার বলছে এসে খবরদার/ পালিয়ে যাবার পথটি যেন নেই এখানে/সবাই মিলে থাকতে হবে এই এখানে…”
(আলবাম-দুষ্টু-মিষ্টি,১৯৭৫, সঙ্গীত পরিচালক-অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, কথা- পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, সঙ্গীত শিল্পী- হৈমন্তী শুক্লা)

”হো রে রে রে রে! সে এক রাজার ঘরে রাতদুপুরে ডাকাত এলো তেড়ে…” ( চলচ্চিত্র-প্রতিদান, ১৯৮৩, সঙ্গীত পরিচালক- বাপ্পি লাহিড়ী, কথা-গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, সঙ্গীত শিল্পী-কিশোর কুমার)

”বাবুরাম সাপুড়ে কোথা যাস বাপু রে…” (সুর-অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
কথা-অনল চট্টোপাধ্যায়, সঙ্গীত শিল্পী-সনৎ সিংহ)

এক এক্কে এক, দুই এক্কে দুই, নামতা পড়ে ছেলেরা সব পাঠশালার ওই ঘরে/ নন্দী বাড়ির আটচালাতে কুমোর ঠাকুর গড়ে/মন বসে কি আজ/ তা ধিনা তাক তা ধিনা তাক তা ধিনা কুড়ুর কুড়ুর তাক…’ (আলবাম-বাবুরাম সাপুড়ে সঙ্গীত পরিচালক- প্রবীর মজুমদার, কথা- রঞ্জিত দে, সঙ্গীত শিল্পী-সনৎ সিংহ)

”রথের মেলা রথের মেলা বসেছে রথ তলায়/আর ভরদুপুরে রথতলাতে ছেলেরা ভিড় জমায়…” (আলবাম-গান রেখেছি মনে, সঙ্গীত শিল্পী-সনৎ সিংহ, ষাটের দশকের এক অত্যন্ত জনপ্রিয় শিল্পী)

দার্জিলিং যাত্রা ছবিতে স্বপন চক্রবর্তীর কথায় আর ডি বর্মণের প্রায় সবক’টি গানই জনপ্রিয়! আশা’জির গাওয়া ‘উড়ে যাবো আমরা চাঁদ মামার বাড়িতে/ যেখানে শুধু মজা আর মজা/ চলেছি হাওয়া গাড়িতে..’ আর ডি বর্মণের সুরে। কথা স্বপন চক্রবর্তী-১৯৭৯, ‘চাঁদে যাত্রা’। আজও একইভাবে উপভোগ করি, ফিরে যাই ফেলে আসা শৈশবের দিনে! এছাড়াও প্রচুর ছড়ার গান আমাদের ভরিয়ে রাখতো। রেশটুকু আজও একইরকম! প্রচুর ভালো ছবি হয়েছে ছোটোদের জন্য। সেখানে তাদের উপযোগী গানও রয়েছে। তার কয়েকটির কথা আগে বলেছি। আরও কিছু তালিকা দিচ্ছি। যাঁরা এখনও শিশুদের বড়োটি করে রাখার মধ্যে গরিমা খুঁজে পান, তাঁদের আমার বিনীত অনুরোধ বাচ্চাদের সঙ্গে আপনারাও সময় বের করে দেখুন। দেখবেন, ভালো লাগবে!

কতগুলো ছবির তালিকা দিলাম এখানে:

১. চলচ্চিত্র-দামু
পরিচালক; রাজা সেন
কাহিনি-নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

২. টেনিদা
পরিচালক-চিন্ময় রায়
কাহিনি-নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

৩. অরুণ-বরুণ-কিরণমালা
পরিচালক-বরুণ কাবাসী
কাহিনি-ঠাকুমার ঝুলি অবলম্বনে
সঙ্গীত পরিচালক- অমল মুখোপাধ্যায়

৪. পাকা রাম (পুরস্কার প্রাপ্ত ছবি)
পরিচালক-শঙ্কর দেবনাথ

৫. নতুন পাতা (পুরস্কার প্রাপ্ত ছবি)
পরিচালক-দীনেন গুপ্ত
কাহিনি-প্রতিভা বসু
সঙ্গীত পরিচালক- উস্তাদ বাহাদুর খান

৬. রাণু
পরিচালক-শ্যামল কর্মকার

৭. গোয়েন্দা গোগোল
পরিচালক-অরিন্দম দে
কাহিনি- সমরেশ বসুর সোনালী পাড়ের রহস্য অবলম্বনে।

মোটামুটি, সীমিত একটা তালিকা দিলাম। যাইহোক, সব লেখা তো এখানে সম্ভব নয়। এমনিতেই এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি যে-বিষয়টি চোখে পড়ে, তা হল ভীষণরকমভাবে মানুষের ধৈর্য কমছে। আমিও বাদ নেই এর থেকে।

আসলে, আমি ইচ্ছে করেই শুরুর কথা শেষের আগে রাখছি। এবারে আমি একটু ফ্ল্যাশব্যাকে যাই। আসলে ইরাবতী থেকে যখন মানে যখনই বিশেষ করে গদ্য লেখার আদেশ আসে, আমাকে আমার মতো করে লিখবার সুযোগ দিয়ে থাকে বরাবর। তাই বিষয় যখন ‘হারিয়ে যাচ্ছে ছোটোবেলার গান’ তখন কি শুধু তথ্য দিয়েই ইতি টানতে পারি? একেবারেই নয়। আমার একটা স্মাইলি-ইমোটিকন দিতে ইচ্ছে করছে! ইসসস্ আবার যদি ফিরে যেতে পারতাম ফেলে আসা ছোটোবেলায়! গান শেখার শুরুই হয়েছিল সলিল চৌধুরীর সুরে অন্তরা চৌধুরীর গাওয়া ছড়ার গান দিয়ে…’ না না পুতুল সোনা কেঁদো না/তোমাকে ফেলে যাবো না…’! সেই বয়সে বছর সাড়ে তিন-চারে আমি যত না কিংবদন্তি শিল্পী সলিল চৌধুরীকে চিনি তারচেয়ে অনেক বেশি চিনি অন্তরা চৌধুরীকে! কারণ তখন খুব শুনতাম তাকে! বিশেষ করে সাদাকালো হিন্দি-ছবি ‘মিনু’-র দুটো গান তো খুব মনে পড়ে! খুব শুনতাম মায়ের মুখে! শুনে আমিও গুনগুন করতাম। ওই যে সেই গানটা- ”ও কালি রে/ও কালি রে/ তু তো কালি হ্যায়/ গোড়া সা এক ভাইয়া মা লানে ওয়ালি হ্যায়…”

গানটির সুর করেছিলেন সলিল চৌধুরী এবং কথা যোগেশ গৌড়। ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটি কালো একটি ছাগল-ছানা নিয়ে কী মিষ্টি করে গাইছিল! আর-একটি গান হল-

“তেরি গলিও মে হাম আয়ে/দিল। ইয়ে আরমান ভরা লায়ে/হামপে হো যায়ে করম হ্যায় জো তেরা/ আপনি কিসমত ভি সওয়র যায়ে জরা…” এই গানটিতেও সুর করেছিলেন সলিল চৌধুরী এবং কথা যোগেশ গৌড়। তবে,ছোট্ট অন্তরার সুযোগ হয়েছিল প্রবোধচন্দ্র দে-র সঙ্গে ডুয়েট গাইবার। কে বলুন তো প্রবোধচন্দ্র দে? জানি, অনেকেই জানেন; আর যারা জানেন না তাদের জন্য বলি, তিনি হলেন আমাদের সকলের প্রিয় মান্না দে। সত্যিই ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়! হারমোনিয়াম কাঁধে ঝুলিয়ে ছোট্ট মেয়েটির গান গেয়ে ভিক্ষে করার সেই করুণ দৃশ্য আজও কীভাবে ভিতরটা ঝাঁকিয়ে দেয়!
কী অদ্ভুত সঙ্গীত-আবহ! সলিল চৌধুরীর সঙ্গীতে সেই কালার ছিল। শেডস ছিল। অসামান্য এক অর্নামেন্টেশন ছিল। অবলিগাটোর চমৎকার ব্যবহার ছিল শুধু এই দুটো গানের কথাই বলছি না, কিন্তু! ডিমিউনেশন কর্ডের অসম্ভব সব ব্যবহার! এই ‘মিনু’ ছবিতে ছোট্ট অন্তরা চৌধুরীর গানের নেপথ্যে একটা মিষ্টি গল্প ছিল। গল্পটা হল এমন যে মেয়েটিকে তার বাবার কাছে রীতিমতো অডিশন দিতে হয়েছিল। ছোট্ট মেয়েটি পুতুল খেলতে-খেলতে আনমনে গেয়ে বেড়াতো। একদিন একটা হিন্দি ছবির কথা হচ্ছিল। তখন মা প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী সবিতা চৌধুরী অন্তরার বাবাকে বললেন যে এই ছবি তো বাচ্চাদের ছবি, ছোটোদের গান যখন আছেই, তাহলে মেয়েকে দিয়েই তো গাওয়ানোর একটা চেষ্টা যেতে পারে। এই কথা শুনে তিনি স্ত্রী সবিতা চৌধুরীকে বললেন,’ ও গান করে নাকি?’ সবিতা বললেন, ‘হ্যাঁ, ও তো পুতুল খেলতে-খেলতে গান গায় তো!” তখন বাবা সলিল চৌধুরী বললেন,’দেখি তো ও কেমন গান গায়? ওর একটা অডিশন নিয়ে দেখি…’ তখন সলিল চৌধুরী মেয়ের অডিশন নিলেন এবং মেয়ে যথারীতি পাশও করে গেল- ”ঝিলিক ঝিলিক ঝিনুক খুঁজে পেলাম/ তোমায় তা দিলাম/বললে তুমি মুক্তো কোথায় মুক্তো আমার চাই/ তাই ছুড়ে ছুড়ে তারে ফেলে দিলাম…” এই গানটি গেয়ে। তিনি তাঁর স্ত্রীকে বললেন, ‘ওর তো সুর-তাল সবই রয়েছে!’ এরপর মেয়ে অন্তরাকে বাবা শেখান- তেরি গলিও মে হাম আয়ে…” এই গানটি। এরকম কত গল্প লুকিয়ে আছে, প্রতিটি গানের ভিতর, সাসপেন্ডেড কর্ডের ওপর…অসম্ভব হারমোনাইজেশন থাকতো সেসব অবিস্মরণীয় সৃষ্টিতে! কিন্তু আজ?! ছোটোদের জন্য কোথায় এমনভাবে গান তৈরির তাগিদ? কোথাও নেই। তবু ইউটিউবের দৌলতে কিছু গান শোনার সুযোগ হচ্ছে! মন্দের ভালো! কিন্তু আমাদের মতো করে কেন পেতে পারে না এখনকার ছোটোরা তাদের জীবন? এভাবে লুটপাট কি হতে দেওয়া যায় সবুজ সব শৈশব? এত জখম শিশুমন নিতে পারে? আজ তাই তো এত-এত অবসাদের নজির এই বড়দের ও বড়দের মতো ছোটদের সমাজে!

একটু নিজের কথা বলি, সারাটা সময় (পড়া-স্কুল-রিওয়াজ এর বাইরে) আচ্ছন্ন থাকতাম অন্তরা চৌধুরীর গানে! আমার খুব মনে পড়ে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক মঞ্চে যখন নাম করা আমন্ত্রিত শিল্পীরা গাইছেন, তখন তাঁদের মধ্যে আমিই একমাত্র সবচাইতে ছোট্ট। আমাকে অন্তরা চৌধুরীর গান গাইবার জন্য গাড়ি করে বাড়ি থেকে নিয়ে যেতেন। সাথে অবশ্য আমার বাবা বা মা থাকতেন। সব্বার অনুরোধে আমি খুব আনন্দ করে গাইতাম- ‘বুলবুল পাখি ময়না টিয়ে..’, ‘না দির দা তুম না তুম তানা নানা নাচো তো দেখি আমার পুতুল সোনা…’ ”ও আয় রে ছুটে আয় পুজোর গন্ধ এসেছে…” বা ‘এক যে ছিল মাছি…’
‘ও সোনা ব্যাঙ ও কোলা ব্যাঙ…’, ‘‘ইস্কাবনের দেশে গিয়েছিলাম সেথায় গোলমেলে সব কাণ্ড দেখে এলাম…” আমার সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করতেন শ্রদ্ধেয় প্রতুল মজুমদার কাকু, তমাল পাট্টাদার কাকু, প্রশান্ত চক্রবর্তী কাকু। খুব উৎসাহ পেতাম ওঁদের থেকে! আজ ছোটদের মুখে-মুখে ঘোরে বড়দের গান! অসহায় লাগে বড়ো!

আমার সাথে এই গানগুলো কীভাবে আজও জড়িয়ে আছে ভাষায় বোঝাতে পারবো না! মায়ের জন্যই এসব সম্ভব হয়েছিল। মা-ই ছোটদের ছড়ার গানের ক্যাসেট আমায় মাঝেমাঝেই এনে দিতেন। আজ যতটুকু গান-বাজনার রুচিবোধ, বেশিটুকুই মায়ের জন্য! বাবা চাইতেন সবসময়ই মৌ সবেতেই সেরা হোক; কিন্তু পড়াটাই তাঁর কাছে আসল ছিল। চির-ফাঁকিবাজ তাঁর কন্যেটির কি আর সব ফেলে পড়ায় মন বসে! আমার বাবার মতো এখনও কোনও প্রিয়-পুরুষ, প্রখর-পুরুষ আর-একটিও দেখিনি! অবশ্য দুটো-তিনটে চরিত্রের ভিতর সামান্য কিছু আছে, এই যা। ছোটোদের গান নিয়ে যখন কথা হচ্ছে, তখন একটা ছোট্ট ঘটনা বলে লেখাটিকে শেষ করবো।

”বলো না গো কার মা তুমি, কোথায় তোমার ছেলে…” (চলচ্চিত্র-শত্রু, ১৯৮৪, সঙ্গীত পরিচালক- আর ডি বর্মণ, কথা-পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, সঙ্গীত। শিল্পী- পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়) এই গানটি আমার খুব ভালো লাগতো। একবার কী হল, আমায় পাপাই মানে বাবা এই ছবিটি চুপ করে দেখে আসে। কিন্তু আমার কাছে কেন জানি না কিছু সময়ের জন্য গোপন করে যান। কিছুক্ষণ পরে যখন তিনি আর সত্যি আর চেপে রাখতে পারলেন না, অবশেষে বলে দিলেন যে ওই ‘শত্রু’ ছবিটা তিনি দেখে এসেছেন! আমি কখনও আমার বাবাকে কোনও মিথ্যে বলতে দেখিনি। শুনিনি। কোনও সমঝোতা করতে দেখিনি কোনও অন্যায়ের সাথে। তাই বাবার মুখ থেকে শোনা এই মিথ্যেটায় আমার আকাশ ভেঙেছিল; ভ্যা-করে কেঁদে বলেছিলাম, ‘তুমিই আমার শত্রু, একা-একা ওই গানটা শুনে ফেললে আবার উলটে মেয়েকে বললে যে দেখোনি..!” বাবা-মায়ের মতো সত্যি কি আর বড়ো শত্রু হয়? শত্রুতা করেই তো তারা এই বিরাট পৃথিবীকে বন্ধু করতে শেখায়! আসলে, হয়তো ওই গানটা আমাকে মানে আমার শিশুমনকে ভয়ঙ্করভাবে ধাক্কা দিয়েছিল…আমি জানি না, সে-বোধ তখন কেন-কীভাবে বা কোন মনস্তত্ব …কিন্তু ধাক্কাটা সজোরে ছিল… 
“…ছেলের কথা বললে কেন, চোখ দুটো ভ’রে জলে/ বলো না গো কার মা তুমি, কোথায় তোমার ছেলে?”

তথ্যসূত্র-অন্তর্জাল
সারেগামা
এইচএমভি
উইকেন্ড ক্লাসিক শো

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত