Chitraniva Chowdhury, irabotee.com @Copyrighted by Irabotee

নারী চিত্রশিল্পী চিত্রনিভা চৌধুরী

Reading Time: 4 minutes

|| কামালুদ্দিন ||

কথায় আছে ‘আকাশে চাঁদ উঠলে ঢেকে রাখা যায় না’। দেশের আকাশে প্রথম চাঁদ উঁকি দেয় চাঁদপুরে। জায়গাটির নামেই রয়েছে এর স্বার্থকতা। যেমন জাপানে প্রথম সূর্যোদয় হয়। এ কারণে জাপানের আরেক নাম ‘নিপ্পন’। চিত্রনিভা চৌধুরী হলেন সেই চাঁদ। যার পূর্ণ আলোয় আলোকিত হয়েছে আমাদের শিল্পাঙ্গণ।

২৭ নভেম্বর, ১৯১৩ সালে চিত্রনিভা চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেন অধুনা বাংলাদেশের চাঁদপুরে। তিনি এই দেশের প্রথম মহিলা চিত্রশিল্পী। যদিও ঢাকার নবাব পরিবারের আরেকজন মহিলা চিত্রশিল্পী মেহেরবানু খানমের দুটি চিত্রকর্ম ১৯২০ সালে ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় ছাপা হয়। এছাড়া আর কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি, এমনকি অন্য কোনো মহিলা শিল্পীরও। সে হিসেবে উল্লেখযোগ্য চিত্রনিভা।

‘চিত্রনিভা’ নামটি শিল্পের আচ্ছাদনে জড়ানো। এই শিল্পীর চিত্রশৈলি দেখে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর (নিভাননী) নতুন নামকরণ করেন ‘চিত্রনিভা’। সেই থেকে রবীন্দ্রনাথ প্রায় রসিকতা করে বলতেন: ‘তোমার নামকরণ করলুম এখন বেশ ঘটা করে আমাদের খাইয়ে দাও’। নন্দলাল বসুর শুরুর দিকের প্রিয় ছাত্রী চিত্রনিভাকে শান্তিনিকেতনের শিক্ষার্থীরা আলপনায় বিশেষ খ্যাতি দেখে ‘আলপনাদি’ বলে সম্বোধন করতেন। চিত্রকলা ছাড়া তিনি দেওয়াল-চিত্র ও মাটির কাজেও সমান দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। কলাভবন প্রাঙ্গণে অবস্থিত ‘কালোবাড়ি’ তৈরির সময় রামকিংকরের সাথে তিনি ‘শিবের বিয়ে’ শীর্ষক ম্যুরালের কাজ করেছেন।

আজ ভেবে অবাক হতে হয়, সেই তমশাচ্ছন্ন সময়ে যখন বাড়ির মেয়েরা বাইরে পড়াশোনার সুযোগ পেতেন না, তখন চিত্রনিভা শান্তিনিকেতনে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, মানুষ গুহাতন্ত্র থেকে মুক্তির সনদ পেয়েছে, কিন্তু পরিবারতন্ত্র থেকে সবাইকে মুক্তির সনদ প্রদান করা হয় না।  পুত্রবধূদের জন্য এই সনদ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার বটে। সিগমুন্ড ফ্রয়েড বলেছেন, ‘মানুষ জন্মের পর থেকে স্বাধীন’। কিন্তু পুত্রবধূরা সম্ভবত পরাধীনতার শ্লেষ বহন করে চলেন। মেয়েরা বিয়ের পর ‘পরিবার’ নামক পিঞ্জরে প্রবেশ করে আর বের হবার ব্যর্থ চেষ্টা করেন না। কারণ তাঁরা জানেন এই পিঞ্জরে প্রবেশাধিকারের জন্য সরকারি রেজিস্ট্রেশন বা সামাজিক সনদ লাগে। উল্লেখ্য বিজয়ী পুরুষ ইতিহাস লেখে। সেই ইতিহাসের ভিড়ে যদি কতিপয় মহিয়সী নারীর সামান্য অবদান ফাঁকফোকর গলে জায়গা করে নিতে পারে সেটাই নারী মুক্তির পথ বলে আমরা মনে করি। যে কারণে সংসারে নারীমুক্তি আন্দোলনের পথিকৃৎদের তালিকা খুব বড় নয়। এই উপমহাদেশে আমাদের রয়েছেন বেগম রোকেয়া। তাঁর কথা নারী জাতির জন্য তো বটেই সমগ্র জাতির জন্য শিরোধার্য। তাদেরও জীবন পরিবারতন্ত্র, সংসারতন্ত্রের ভিতর দিয়ে অতিবাহিত হয়েছিল। তাঁরাও পরিবারের, সংসারের জানালা-দরজা খুলেছিল তবে অবলা নারীর মতো নয়। তাঁরা খুলে দিয়েছিল সূর্যবাতির আলো দেখতে এবং সমাজকে দেখাতে। স্রষ্টার আলোতে পক্ষপাতিত্ব নেই তবু পিছিয়ে পড়া নারীরা মনে করেন সব আলো পুরুষের জন্য বরাদ্দ। আমরা জানি বৈদিক যুগেও নারী-পুরুষের সমান অধিকার ছিল। উপরন্তু আজকের গল্প সেই আলোর স্ফুরণ চিত্রনিভা চৌধুরী।

তাঁর পিতা ডাক্তার ভগবানচন্দ্র বসুর অকাল প্রয়াণের পর সবাই মামার বাড়ি মুর্শিদাবাদ চলে যান। আমরা এখানে ইতিহাসের পাতায় দৃষ্টি ফেলে দেখতে পাই, তাঁর মামার বাড়িতে শিল্প ও সংগীতচর্চার ব্রত পালিত হতো প্রায় নিয়মিত। এখানেই চিত্রনিভার শিল্পবীজের অঙ্কুরোদম। তবে কিছুদিন পর তাঁর মা শরৎকুমারী দেবী নিজের পুত্রকন্যাদের নিয়ে আবার চাঁদপুর এসে বসবাস শুরু করেন। তখন লামচর নোয়াখালীর জমিদার ঈশ্বরচন্দ্র চৌধুরীর মধ্যমপুত্র নিরঞ্জনের জন্য তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা মনোরঞ্জন চৌধুরী পাত্রী দেখতে তাদের বাড়ি আসেন। তখন ছোট্ট নিভাননীর আঁকা ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে তার ভাইয়ের জন্য বিয়ের দিন ধার্য করে যান। সেই সূত্রে জমিদার পরিবারে বালিকা বধূ নিভাননীর আগমন। তিনি শ্বশুরবাড়ি এসে দেখেন বড় লাইব্রেরি। সেখানে প্রচুর বইপত্র, পত্রিকায় রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা এবং নন্দলাল বসুর আঁকা দেখে তিনি মুগ্ধ হন।

অর্থাৎ এখানে দেখা যাচ্ছে নিভাননী ভাগ্যবতী ছিলেন। তিনি এমন এক শ্বশুরবাড়ি পেয়েছিলেন যেখানে শিল্পচর্চা, পড়াশোনার অবারিত সুযোগ ছিল।  যদিও ‘শ্বশুরবাড়ি মধুর হাড়ি’ এই বাক্যটি এখনও পুরুষের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কিন্তু আমরা যখন নিভাননীর বিবাহিত জীবনে দৃকপাত করি তখন সেখানেও এরূপ দেখতে পাই।

উপরন্তু চিত্রনিভার ক্ষেত্রে আরেকটু ভিন্নমাত্রা যুক্ত হয়েছে। শ্বশুরবাড়ি থেকে তাঁকে শিল্পশিক্ষার জন্য শান্তিনিকেতনে কবিগুরুর আশ্রমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। শান্তিনিকেতন হচ্ছে এক প্রকাণ্ড শিল্পবৃক্ষ। এই বৃক্ষের ছায়াতে রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদ আছে। সেই ছায়াতলেই হয় চিত্রনিভার আশ্রয়স্থল। সেখানে গুরুদেব তাঁর থাকা-খাওয়া ও ছবি আঁকা, গান শেখার বন্দোবস্ত করে দেন। প্রতিদিন দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নন্দলাল বসুর কাছে পাঠিয়ে দিতেন। চিত্রনিভা চৌধুরীর ‘স্মৃতিকথা’ গ্রন্থের প্রথম পর্বের সূচনায় আমরা দেখি তিনি তাঁর প্রতিদান দিয়েছেন এভাবে: ‘আমার ধ্যানের ঋষি রবীন্দ্রনাথ, আমার ধ্যানের আশ্রম শান্তি নিকেতন’- এই শিরোনামে। 

গুরুদেবের কাছে ছাত্রছাত্রীদের ছিল অবারিত দ্বার। তিনি সব সময় বলতেন, ‘তোমাদের যখন যা বুঝতে ইচ্ছা হয় আমার কাছে এসে বুঝে নিও।’ চিত্রনিভার স্মৃতিকথায় মাস্টার মশাই নন্দলাল বসুর কথাও বিশেষভাবে উঠে এসেছে। তিনি নন্দলাল বসুর প্রয়াণে লিখেছেন: ‘তিনি ছাত্রছাত্রীদের নিজের সন্তানের মতো দেখতেন, তাই আজ তাঁর মৃত্যুতে আমরা পিতৃহীন হলাম। তাঁর শেখাবার পদ্ধতি ছিল একেবারে আলাদা। তিনি খুব অল্প কথায় সহজভাবে আমাদের বোঝাতেন।’

চিত্রনিভা চৌধুরী শান্তিনিকেতনের প্রথম মহিলা শিক্ষক। যদিও কিছুকাল পর তিনি নোয়াখালী শ্বশুরবাড়ি চলে আসেন এবং সংসার সামলানোর পাশাপাশি সেখানে চিত্রকলা ও সংগীতের স্কুল শুরু করেন। সেই সময় ঢাকায় তাঁর ভাশুর ডা. জে. কে. চৌধুরীর বসার ঘরে তিনি যে দেয়ালচিত্র আঁকেন সেটি ছিল তখন বাংলার সবচেয়ে বড় দেয়ালচিত্র । দেশ বিভাগের পরে, তিনি আবার তাঁর শিশু পুত্রকন্যাদের নিয়ে শান্তিনিকেতনে থাকতে শুরু করেন। তবে কলাভবনের সেই চাকরি আর ফিরে পাননি। ঐ সময়ে তাঁর অসংখ্য চিত্রসম্ভারে চিত্রশালা ভরে ওঠে। ১৯৫৭ সালে তাঁর ছেলেমেয়েদের উচ্চ শিক্ষার্থে কলকাতায় স্বামীর কর্মস্থলে চলে আসেন। এখানে এসে বিদ্যাসাগর বাণীভবনের শিল্প বিভাগের প্রধান হিসেবে যোগ দেন। সত্যিকার্থে চিত্রনিভার শিল্প সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকজন। এমন ঘটনা আমাদের সমাজে দুর্লভ বলতে হবে। সম্ভবত ইংরেজি সাহিত্যের জনক জিওফ্রে চসার-এর এই বাণীটি ফ্রেমবন্দি ছিল তাঁর শ্বশুরবাড়িতে: ‘What is better than wisdom? Woman. And what is better than a good woman? Nothing.’

৯ নভেম্বর, ১৯৯৯ সালে প্রচারবিমুখ নির্মোহ এই মহান শিল্পীর প্রয়াণ ঘটে। তাঁর সৃষ্টির প্রয়াণ নেই। যুগপৎ শিল্পেও তাঁর কাজ উল্লেখযোগ্য হয়ে থাকবে চিরকাল।

তথ্য সূত্র :
চারুকলা-৬, রাজ্য চারুকলা পর্ষদ
মাস্টার মশাই, নন্দলাল বসু, চিত্রনিভা চৌধুরী
স্মৃতিকথা, চিত্রনিভা চৌধুরী
কৃতজ্ঞতা: রাইজিংবিডি

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>