নারীর উপর কর্তৃত্ব, নারীর উপর শ্রেষ্ঠত্ব কিংবা নারীকে অবমূল্যায়ন প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা, নৈতিকতার মানদণ্ড বা ধর্ম প্রাচীন কাল থেকেই করে আসছে। নারীকে নিজের বেঁধে দেওয়া অধিকারটুকুর জন্যও লড়তে হয়েছে, সংগ্রাম করতে হয়েছে। আর তার সুফল কিছুটা হলেও ভোগ করছে বর্তমান প্রজন্ম। কিন্তু তারপরও, কিছু কথায়, আচারে আমরা মেয়েরা নিজেরাই নিজেদের অবমূল্যায়ন করছি। হয়তো এর বহুবিধ যুক্তি দাঁর করানো যায়, কিন্তু একই কথা কি পুরুষদের মধ্যেও লক্ষ্য করি?
প্রচলিত ভাষা হয়ত বড় কিছু নয়, তারপরও অভিধান খুলে স্বামী শব্দের অর্থ পড়লে একটু কুণ্ঠা কি জাগে না? স্বামী বলতে এমনি আমরা বুঝি জীবন সঙ্গী, কিন্তু এর অর্থ যে আপনার মালিক। একই অর্থ নিশ্চয়ই স্ত্রী’র নয়? স্বামী শব্দটি এড়িয়ে অন্য শব্দ কি ব্যবহার করতে পারি না আমরা?
আমরা কি সেরকম ভাবে, রমণী (রমণ যোগ্য) বা মহিলা (মহলে থাকে যে) এসব অশালীন বা অপ্রযোজ্য শব্দ লেখায় কথায় ত্যাগ করতে পারি না? মেয়েরা রমণ (যৌন) কাজের জন্য নয়, তারা এখন মহলবাসীনিও নয়। তারা দশদিক সামলায়। মেয়েদের এখন ‘বিয়ে হয়’ কথাটার চেয়ে বলা ভাল তারা ‘বিয়ে করে’।
আর, বিয়ের অঙ্গীকারে যে অংকের অর্থ দাবী করছেন, নিজের সম্মান বাড়াতে অর্থমূল্য বাড়িয়ে নিজেকে সেই দাঁড়িপাল্লায় মাপতে কি একটুও লজ্জা লাগে না?
আপনার পরিবারের পুরুষ সদস্য অথবা ছেলে শিশুর প্রতি পক্ষপাতিত্ব করছেন না তো? তার পাতে ভাল খাবার দিয়ে, তার আনন্দের সময় বাড়তি রেখে, ঘরে ফেরার সময়সীমা শিথিল রেখে মেয়েটিকে পেষণ করছেন নাতো? ছেলে শিশুকে নগ্ন রাখছেন গরমের বাহানায়, মেয়ে শিশু কিন্তু কাপড় পরছে। নৈতিকতা, দায়িত্ববোধের শিক্ষা কি উভয়ের জন্য সমান হওয়া উচিৎ নয়?
মেয়েরা সৃজন করে, লালন করে, ঘরে হোক বাইরে হোক। তবু, তাদের শিক্ষা থেকে দূরে রাখতে ওয়াদা করিয়ে নেওয়া হয় এই বঙ্গের পুরুষদের কাছ থেকেই। বিয়ের পর বলা হয় চাকরী থেকে বিরত থাকতে। পোশাক, ইচ্ছে, সব কিছুতেই থাবা বসায় পুরুষতন্ত্র। ঐ ওতটুকু গণ্ডিতেই বা কি অধিকার পায় নারী!
বাংলাদেশ হয়ত জিপিএ ফাইভে অনেক এগিয়ে আছে, তবে শিক্ষায় এখনও অনেক পিছিয়ে। বাংলার মেয়েরা এখনও নিজেদের আত্মসম্মান খুঁজে পায় ধর্ষককে বিয়ের মাধ্যমে। নিজের সন্তানের পিতৃত্বের পরিচয় প্রতিষ্ঠা করতে অনশনে বসে পলাতক কাপুরুষ প্রেমিকের বাড়িতে। প্রতারিত হয়ে বিনা দোষে বেছে নেয় আত্মহননের পথ, নীল ছবিতে সে হয় ব্যবহৃত, আর পুরুষ চোরের মত মুখ লুকিয়ে থাকে। যে যৌনকর্মীকে বেশ্যা, খানকি বলে পুরুষ তার পুরুষ যন্ত্রের দণ্ডায়মান আক্রোশ প্রকাশ করে সুখ পায়, সে কিন্তু নিজের পয়সা নিজেই রোজগার করে খায়। বরং গালিগুলো পুরুষবাচক হলে সেখানে মুখ লুকীয়ে যাওয়া লোকগুলোকে দেওয়া যেত। আফসোস, মেয়েরা নিজেদের জন্য রচিত গালি গুলোই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ব্যবহার করে নিজেদেরকেই অপমানিত করে। আর কিই বা করবে! মেয়েদের হেয় করে বাংলা ভাষায় প্রচুর গালি পাওয়া যায়। পুরুষবাচক একটি গালি কিন্তু খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তাই এবার অন্তত একটু ভাবি। কি হচ্ছে আমাদের সাথে, আমাদের আত্মসম্মান কোথায় গিয়ে ঠেকেছে। আমরা তো এমন অবস্থানে নেই যেখানে আমরা আমাদের অধিকার আদায় করে নিতে পারব। কিন্তু নিজ নিজ আত্মমর্যাদার খাতিরে কিছু জিনিসে তো পরিবর্তন আনা সম্ভব। সেখান থেকেই নাহয় শুরু হোক। আমরা মেয়েরা নিজেদের নিজেরা একটু সম্মান করি। অন্তত কথায়?
সঙ্গীত আর লেখালেখি’র সাথে দীর্ঘদিন পথ চলা। বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত শিল্পী ও গীতিকবি। কাজ করছেন অডিও শিল্প, মঞ্চ ও ফিল্মেও। এ পর্যন্ত তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছে। জীবিকা নির্বাহে জ্বালানী ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত।