| 20 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প ধারাবাহিক সাহিত্য

চোরাকাঁটা (পর্ব-২)

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

সত্যি সত্যিই অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকলো শান্তঘুম আসতে চাইছিল না। একথা থেকে সেকথা ভাবতে ভাবতে রাত বেড়েই চললো। ঘুম যেন পালিয়েছে তেপান্তরের মাঠে।

অনিকের কাছে শান্ত শুনেছিল, সুমনার বাবার বাসাতে কোনো কাজের মানুষ রাখা হতো না। বাসার সব কাজ প্রথম থেকেই সুমনা করতো। নিজের পড়াশুনা সামলে রান্নাবান্না, ছোটবোনকে দেখাশোনা করা…সব কাজই সুমনাকে একা হাতেই করতে হতো। মেধাবী ছিল বটে, কিন্তু এসব ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে গিয়ে নিজের পড়ালেখাটা মাঝপথেই ছেড়ে দিতে হয়েছে। বোনটা প্রতিবন্ধী বলে নিজের বাসাতেও এখন কাজের লোক রাখে না সুমনা। কাজের লোক রাখলে যদি বোনের এই অসুস্থতার কথা পাঁচকান হয়!

সুমনার বাবার আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো ছিল না। সাধারণ চাকরি করতেন। তৃতীয় শ্রেণীর সরকারী কর্মচারী। ঢাকাতে পরিবার নিয়ে থাকার মতো আর্থিক সামর্থ্য তার ছিল নাসুমনা ছোটবেলায় তার নানা বাড়িতে থাকতো। ওখানে থেকেই পড়াশুনা করেছে। ওর নানা অবশ্য আর্থিকভাবে বেশ সচ্ছলদেশে প্রচুর জমাজমি আছে। সুমনার বাবার সাথে তার নানা বাড়ির সম্পর্ক তেমন ভালো ছিল না। সুমনার মা নিজে পছন্দ করে বিয়ে করেছিল। তবু মেধাবী নাতনি ভালো যত্ন আত্তি পাচ্ছে না দেখে সুমনার নানা তাকে নিজের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। সুমনার ক্লাস নাইনে পড়ার সময়ে ওর ছোটবোন রুমানার জন্ম হয়। আর মাত্র এক বছরের মাথাতেই সবাই বুঝতে পারে রুমানা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। সচরাচর যাকে অটিস্টিক বলে 

রুমানার অবস্থা ছোটবেলাতে আরো অনেক বেশি খারাপ ছিল। ঘরের মধ্যে চেঁচামেচি করতো, জিনিসপত্র ছুঁড়তো। কেউ কিছু বলতে এলে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠতো। মারতে আসতো। সুমনার মা ছোটমেয়ের জন্মের পর থেকে অসুস্থই থাকতো বেশিরভাগ সময়। মেয়েকে প্রতিবন্ধী দেখে তার মানসিক অবস্থাও দিনকে দিন খারাপ হতে শুরু করে। মায়ের এই অবস্থায় সুমনার পক্ষে আর নানাবাড়িতে থেকে পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। ওকে ঢাকায় ফিরে আসতে হয়। শুরু হয় তাদের দুর্বিষহ দিন। রুমানাকে ছোটবেলা থেকেই সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যেতে হয়েছে। ঔষধপত্র আর নিবিড় পরিচর্যাতে ধীরে ধীরে পরিস্থিতি সহনীয় পর্যায়ে আসতে শুরু করে। কিন্তু ততদিন পর্যন্ত সুমনার মাকে আর বাঁচিয়ে রাখা যায়নি। তিনি যখন মারা যান, রুমানার বয়স যখন মাত্র পাঁচ বছর।

 সুমনা আর অনিকের বিয়েটা সুমনার নানার মাধ্যমেই হয়েছে। অনিকদের পরিবারের সাথে সুমনার নানার জানাশোনা ছিল। অনিকের কোনো এক পূর্বপুরুষ নাকি এককালে জমিদার ছিল। এখন সেই খানদানী চালচলনের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। কিন্তু সেই অতীত আভিজাত্যকে স্মরণ করে সুমনার নানা এখানেই নাতনীর ঘটকালী শুরু করে দেন। সুমনার বাবাকে তিনি প্রথম থেকেই গোনার মধ্যে ধরতেন না। নাতনীর বিয়েতে তাই তার মতামতেরও থোড়াই কেয়ার করেন। সুমনার বাবা তখন সাংসারিক ঝুট ঝামেলা আর প্রিয়তমা স্ত্রী বিয়োগে ক্লান্ত, বিষণ্ন। তিনিও এখানে শুধু শুধু বাগড়া দিতে যান না। কিন্তু সুমনার নানার জোর আপত্তি সত্ত্বেও একটা কাজ তিনি ঠিকই করে বসলেন। বিয়ের সময় অনিকের কাছে প্রতিবন্ধী মেয়ে রুমানার কথা কিছুই গোপন করলেন না তিনি। ছোটমেয়ের অসুস্থতার কথা সবিস্তারে খুলে বলেছিলেন অনিককে  

অবশ্য ততদিনে রুমানা অনেক সংযত হয়ে উঠেছে। একা একা নিজের হাতে খেতে পারে। একান্ত কিছু প্রয়োজনের কথাও টুকটাক বলতে পারে। আগের মতো ক্রুদ্ধতাটাও আর দেখাতো না। বাসায় কেউ বেড়াতে এলে দূর থেকে লক্ষ করতো সবাইকে। কিন্তু কাছে গিয়ে এলোমেলো কিছু বলা বা করা, এসব একেবারেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সুমনার সাহায্য ছাড়াই জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছিল রুমানা। আর এসব দেখেই সুমনার বাবা আশা করেছিলেন, হয়ত রুমানা এখন তার বড়বোনকে ছাড়াই থাকতে পারবে। রান্নাবান্নাটা তিনি নিজেই চালিয়ে নিতে পারবেন। আর ততদিনে বাসায় কাজের মেয়েও রাখতে শুরু করেছেন। কাজেই কোনোদিকে সমস্যা হবে বলে তার মনে কোনোরকম দুশ্চিন্তা ছিল না কিন্তু বিধিবাম! বড়বোনকে চলে যেতে দেখেই রুমানা দীর্ঘদিন পরে আবার সেই পুরনো রূপ বের করে বসেসেই একেবারে ছোটবেলার মতো। বোনকে এনে দেওয়ার জন্য চেঁচামেচি জুড়ে দেয় কিছুতেই বোনকে ছাড়া সে থাকতে রাজি হয় না। বাসা থেকে বের হয়ে বাইরে চলে যেতে চায়। সুমনার বাবা বিপদে পড়ে যান। বড় মেয়ে তখন সদ্য স্বামীর সংসারে গিয়ে উঠেছে। এই অবস্থায় তিনি ভেবে পান না, কী করবেন। 

এসব গল্প সবই অনিকের মুখ থেকে শোনা। অনিকই সেই সময় এই মহাবিপদ তাদেরকে থেকে উদ্ধার করে। হয়ত অন্য যেকোনো ছেলেই এমন পরিস্থিতিকে সহজভাবে মেনে নিতে পারতো না। ওপরে বড় বড় কথা বলা সহজ, কিন্তু বাস্তবে এসব করা কঠিন। অনিক সেই মহৎ কাজটা করে দেখিয়েছে। বড় বোনকে রুমানার প্রয়োজন, এটা অনুভব করেছে অনিক। 

আকাশপাতাল নানারকম চিন্তা রাতদুপুরে ভর করে শান্তর মাথায়।

রুমানার সাথে এরকম একটা ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর অনিকও নিশ্চয়ই এখন নিরাপদে নেই। ভবিষ্যতেও থাকবে না। আশেপাশের দু’দশ জন মানুষ তার দিকেও আঙুল তুলবে। বলবে, ছোটবোনের এই দুর্দশার জন্য বোনজামাই-ই দায়ী। আর কোথাও তো এই মেয়ে যায়নি। তাহলে আর কে এই অপকর্ম করবে?

রুমানাকে বাসার বাইরে কখনো পাঠানো হয় না। আশেপাশের বাসাতেও না। প্রতিবন্ধী বলে সুমনাও আড়ালে আড়ালেই রাখে তাকে। কিছু মানুষের তো আবার খেয়েদেয়ে তেমন কাজ থাকে না। কার বাসায় কী গল্প চলছে, কার বাসার কোন সদস্য এ্যাবনরমাল আচরণ করছে…এসব দিকে সবাই কান পেতে রাখে। সেজন্যই মেয়েটাকে একরকম ঘরবন্দি করেই রাখা হয় সব সময়। তাহলে এমন একটা ঘটনার পেছনে অন্য কাউকে কি দায়ী করা যায়? শুধু অনিকের বন্ধু বান্ধবদের সেই গ্যাদারিংটা বাদ দিলে? কিন্তু প্রশ্ন উঠতে পারে, এমন একটা গ্যাদারিংয়ের সময়ে কার এত দুঃসাহস জন্মাবে যে মেয়েটার ঘরে গিয়ে এমন একটা ঘটনা ঘটিয়ে আসবে? আর এলেও অন্যরাই বা কেন সেটা টের পাবে না?

সেদিন ওরা বন্ধুরা সবাই মিলে কিছুটা সময় ছাদেও কাটিয়েছিলতখন সুমনা আর তার সাথে রুমানাও ছাদে গিয়েছিলরুমানা এক কোনায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। সবাইকে তার স্বভাবমত দূর থেকে লক্ষ করে যাচ্ছিলো। সুমনা মাঝে মাঝে তাকাচ্ছিল বোনের দিকে। সবার উপস্থিতিতেও বোনের দিকে সে একটা চোখ দিয়েই রেখেছিল সবসময়। একসময় রুমানা কিছুটা একঘেয়েমিতে ভুগতে শুরু করেছিল হয়তোবা। সুমনা ‘ওকে নীচে রেখে আসি’ বলে নেমে গিয়েছিল। ফিরেও এসেছিল কিছুক্ষণ বাদেই। এরপরেও সবাই আরো অনেকক্ষণ ছাদে ছিল।

শান্ত দ্রুতবেগে ভাবতে থাকে। আর কী কী ঘটেছিল সেদিন? ছাদে ওরা সব মিলিয়ে প্রায় দেড়ঘন্টার মতো সময় কাটিয়েছিল। প্রত্যেকের হাতে ছিল সফট ড্রিংকসের গ্লাস। অনিক মজা করে বলেছিল,

‘বউ শ্যালিকা আছে। এখন আর হার্ড ড্রিংক্স অফার করতে পারলাম নাআপাতত সফট দিয়েই কাজ চালিয়ে নে!’

রিয়াজ যথারীতি তার নোংরা চাহনী দিয়ে আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো। অন্যরা চোখ ইশারায় থামিয়ে দিয়েছিল ওকে। 

হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়তেই এত রাতেও শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা কিছু নেমে যায় শান্তর। রিয়াজ মাঝখানে একবার নীচে গিয়েছিল না? রুমানার নীচে নামারও প্রায় পনেরো কুড়ি মিনিট পরে। অন্যদের দিকে তাকিয়ে কৈফিয়তের সুরে বলেছিল,

‘একটু ওয়াশরুম থেকে আসছি।’

সুমনা তখন কবির আর দিনারের সাথে কী নিয়ে যেন বেশ জমিয়ে গল্প করছিল। তিনজনেই হেসে কুটিপাটি হচ্ছিলো। চিলেকোঠার সিঁড়িটা থেকে পেছন ঘুরে দাঁড়িয়েছিল সুমনা। রিয়াজের নীচে নামা সে লক্ষ করেনি। আর অনিক তো বন্ধুদের সাথে তখন সিগারেটের রিং বানানোর কম্পিটিশন লাগিয়েছিল। রিয়াজ কোথায় গেল না গেল সেই ব্যাপারে কারোরই তখন মাথাব্যথা নেই। শুধু আলগোছে শান্তর কীভাবে যেন চোখ পড়ে গিয়েছিল রিয়াজের দিকে। তখন অবশ্য এসব কিছু ওর মাথাতেও ছিল না। রিয়াজ আউলফাউল মজা করে ঠিকই, কিন্তু বন্ধুত্ব আর সম্পর্কের সীমানাটুকু সে লঙ্ঘন করবে এমন দুরাশা কখনো করেনি কেউ।

ফিরে আসতে পনেরো কুড়ি মিনিটের ওপর লেগে গিয়েছিল রিয়াজের। এখন ভাবলে সেরকমই মনে হতে থাকে শান্তর। ভাবতে ভাবতে নিজের ভেতরে কেমন একটা অস্থিরতা বোধ করে সেএই ঘটনাটা কেন একটু আগে শোভনকে বললো না! নিজের মধ্যে তীব্র এক উত্তেজনা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকেরিয়াজটা তলে তলে এত খারাপ! বোধবুদ্ধিহীন একটা অবোধ মেয়ের সাথে এই দুষ্কর্ম করে বসলো বদমাশটা!  

যদিও একটা সম্ভাবনা বলছে যে কাজটা রিয়াজ নাও করতে পারে। কারণ, মেয়েটার সাথে তো আর এমন কাজ আগে হয়নি নিশ্চয়ই। কাজেই রিয়াজ যদি সেদিন এই জাতীয় কিছু করে থাকে, রুমানার চুপ করে বসে থাকার কথা নয়। সে চেঁচামেচি করতে পারতো। রেগে গিয়ে জিনিসপত্র ছুঁড়তে পারতো। আশেপাশের প্রতিবেশিরা জেনে গিয়ে থাকতে পারতো। অথবা এমন কিছু করতে পারতো যাতে সুমনা বিষয়টা বুঝে ফেলতে পারে। কিন্তু সেসব কিছুই হয়নি। সবকিছুই নির্বিঘ্নে শেষ হয়েছে। ছাদের আড্ডা শেষে ওরা আবার ঘরে গিয়ে কিছুক্ষণ বসেছেরুমানা তখন নিজের ঘরে ছিল। হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছিল। আর বের হয়ে আসতে দেখা যায়নি ওকে। রিয়াজ কি কিছু দিয়ে অজ্ঞান করে নিয়েছিল মেয়েটাকে? শয়তানটার হয়ত সবরকমের প্রস্তুতিই নেওয়া ছিল।

কেন যেন শান্তর তীব্র সন্দেহ হতে লাগলো এটা রিয়াজেরই কাজ। রিয়াজ ছাড়া ওদের বন্ধু মহলে এমন মিন লেভেলের কাজ আর কেউ করবে না। অন্ততঃ সেরকম কোনো ইঙ্গিত ওরা কেউ কখনো পায়নি।

মোবাইলটা টেনে নিয়ে সময় দেখলো শান্ত। রাত সাড়ে তিনটা বেজে গেছে। এত রাতে আর হুজ্জোত দাঁড় করিয়ে কাজ নেই। সকালের জন্য অপেক্ষা করা যাক।

মনে মনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয় শান্ত। রিয়াজকে তার অপরাধের জন্য উচিত শিক্ষা দিতেই হবে!

(ক্রমশ)

 

 

 

 

আগের পর্ব ও লেখকের অন্যসব লেখা পড়তে ক্লিক করুন।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত